Popular Post

Posted by : Sayantari Ghosh Tuesday, May 31, 2016


 

কাল রাতে একটা জম্পেশ স্বপ্ন দেখলাম।

দেখলাম, আমি ট্রেনে করে যাচ্ছি, সাইড লোয়ার বার্থে ঘুমাচ্ছিলাম, হঠাত ঘুম ভেঙে গেল। দেখি, একটা সবুজ পাইনে ঘেরা দিগন্তজোড়া চা-বাগানের পাশে ট্রেন দাঁড়িয়ে গেছে... রেললাইনটাকে প্রায় জড়িয়ে ধরে ফুটে আছে ঝাঁক ঝাঁক গোলাপী আর হলুদ ঘাসফুল। খানিকটা দূরে বেঁকে চলে গেছে একটা হাতছানি দেওয়া সর্পিল রাস্তা, রাস্তার ধার বরাবর পতপত করে উড়ছে তিব্বতী ভূততাড়ানি পতাকার সারি... ডানদিকে অনেকটা দূরে একটা সবুজ পাহাড়, পাহাড়ের কোল আলো করে কমলালেবুর বাগানে ঘেরা একটা ছোট্ট রংচঙে মনাস্ট্রি। আর সবার পিছনে টারকুইজ নীল ব্যাকগ্রাউন্ডে ঝলমল করছে কাঞ্চনজঙ্ঘা!

স্বপ্নটা আজ সকালে উঠেও আলো করে ছিল মনটা। দাঁত মাজতে মাজতে ভাবছিলাম, কোথায় যেন দেখা ছবিগুলো... ফুলের দল, চা-বাগান, মনাস্ট্রি, গাছ উপচানো কমলালেবু, পাইনের সারি, টিবেটান প্রেয়ার ফ্ল্যাগ, কাঞ্চনজঙ্ঘা... টুকরো টুকরো ছবির একখানা কোলাজ যেন দেখলাম!

চায়ের জল’টা যেই সোনালী হয়ে ফুটে উঠলো, অম্নি মনে পড়ে গেল... তিঞ্চুলে...!

বছর তিনেক হয়ে গেল তিঞ্চুলে ঘুরে এসেছি, জানেন, কিন্তু যখনই ট্যুর’টা মনে পড়ে কি যে ভালো লাগে কি বলব! আজ ছবিগুলো উল্টেপাল্টে দেখতে দেখতে ভাবলাম যেটুকু যা মনে আছে এখানে তুলে রাখি। আপনি হয়তঃ কাজের চাপে দম ফেলতে পারছেন না, বা কোনো কিছু নিয়ে খুব টেনশনে আছেনহয়তঃ আপনার খুব মনখারাপ যাচ্ছে, কিম্বা প্রাণ’টা ছটফট করছে ব্যস্ত শহরের হুড়োহুড়ি’তে। সেক্ষেত্রে এ লেখা’টা আপনার কাজে লেগেও যেতে পারে। উইকএন্ডের আশেপাশে আর একটা কি দুটো দিন ছুটি ম্যানেজ করতে পারবেন? তাহলে তিঞ্চুলে’টা ঘুরে আসুন। নিজের সাথে সময় কাটাতে হলে এ জায়গার কোনো জুড়ি নেই। এখানে পাইনবনের আলোছায়ার ঘুরতে ঘুরতে আপনার নিজের সাথে নতুন করে দেখা হয়ে যাবে, কথা দিতে পারি।

এবার আপনি বলবেন, “তিঞ্চুলে... হেঃ হেঃ, অদ্ভূত নাম... কোথায় জায়গাটা?”

আমিঃ “কাছেই... উত্তর বাংলা... নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে নেমে ঠিক পঁচাত্তর কিলোমিটার... শুক্কুরবার রাত্তিরে অফিস করে ট্রেন ধরে নিন... সকাল সকাল নামবেন... তারপর গাড়ি... দুপুরের লাঞ্চ তিঞ্চুলে’তে... আবার সোমবার’টা ছুটি নিলে মঙ্গলবার ভোরে আপনি আবার আপনার ব্যস্ত শহরের রাস্তায়... উইকএন্ডে ঘুরে আসার মত এরকম রোম্যান্টিক জায়গা খুব কম হয়, বুঝলেন...! নিচু হয়ে থাকা পাইনবনের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা রাস্তা... গেলে মনে হবে গ্রাম’টা যেন চা’য়ের বাগানে গা এলিয়ে আলসেমি করছে... বেড়ানোর প্ন্যানও একেবারে তৈরী... কোথায় যাবেন কি বেড়াবেন সে নিয়ে বেশী ভাবনারও দরকার নেই... তিঞ্চুলের গুরুং গেস্ট হাউস বুক করে রাখলে সব ব্যবস্থা ওরাই করে দেবে...”

  



আপনি(খানিক ডিপ্রেসড মুখ করে), “অ... গেস্ট হাউস... ভালো হোটেল কিছু নেই? রিসর্টগোছের আর কি...”

আমি (রে রে করে উঠে), “আরে বলেন কি? ভুলেও এ’কথা আর মুখে আনবেন না... অনেকরকম হোটেল রিসর্টের থেকেছি মশাই, কিন্তু গুরুং গেস্ট হাউসের মত ভালো ব্যবস্থা আর আদরযত্ন খুব কম জায়গায় পেয়েছি... যে’কদিন থাকবেন, মনে হবে আপনাকে পেয়ে বোধহয় ওদের আনন্দ আর ধরছে না... ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠিয়ে অসাধারণ চা খাইয়ে আপনাকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখাতে নিয়ে যাবে, বাড়ির ছেলেরা সঙ্গে করে ট্রেকিং’এ নিয়ে যাবে... আর খেতে বসে আপনি বলবেন যে ‘আর পারবো না’, তবু আপনার পাতে জোর করে দু’টো লুচি গুঁজে দেওয়া হবে... একেবারে জামাই-আদর যাকে বলে...”

আপনি, “তাই নাকি? বাব্বাহ্‌, দারুন ব্যাপার তো হে... তা প্ন্যানটা একটু গুছিয়ে বল দিকিনি...”

আমি, “ওই তো... ধরে নিচ্ছি আপনি সোমবার’টা ছুটি ম্যানেজ করেছেন... তাহলে শুক্রবার রাতে ট্রেন, শনিবার সকালে নিউ জলপাইগুড়ি, দুপুরে তিঞ্চুলে... বিকেল’টা জাস্ট পাইনবনে ঘুরে, পাখির ডাক শুনে, ঝোলা বারান্দায় বসে দার্জিলিং টি খেয়ে রিল্যাস্ক করুন... রোববার ভোরবেলা উঠে পড়ে গেস্ট হাউসের টাওয়ার থেকে দেখে নিন সানরাইস... যারা আগে দেখেছেন তাদের আর নতুন করে বলার কিছু নেই যে কি অভাবনীয় রকমের সুন্দর কাঞ্চনজঙ্ঘায় সূর্যোদয়... আমার দেখা সেরা কাঞ্চনজঙ্ঘা কিন্তু আমি তিঞ্চুলে থেকেই দেখেছি, নভেম্বর মাসের ধারালো ঠান্ডায় ভোর পৌনে পাঁচটায়। আমার নিজের কথা বলতে পারি, স্পেলবাউন্ড বলতে যা বোঝায় আমার সেই দশা হয়েছিল! যখন কমলালেবুর মত সূর্য’টা আস্তে আস্তে উঁকি দেবে আর গলানো সোনা ঢেলে বাঁধিয়ে দেবে কাঞ্চনজঙ্ঘা’কে, তখন আপনি পৃথিবীর আর সব কিছু পুরোপুরি ভুলে যাবেন কয়েকমিনিটের জন্য! মনে হবে সময় থমকে গেছে আর আপনি দাঁড়িয়ে আছেন স্বর্গের দরজায়। চোখ ফেরানো যায় না এত সুন্দর, অথচ সে সৌন্দর্য জমকালো না কি স্নিগ্ধ সেটা আমি এখনও ঠিক করে উঠতে পারিনি... অসাধারণ অভিজ্ঞতা... ভাষায় বোঝাতে পারবো না আর কি...”



আপনি, “আহা... মন ভরে যাচ্ছে গো... সত্যি এত সুন্দর?”

আমি, “সে তো হবেই, কাঞ্চনজঙ্ঘা বলে কথা, এ বাংলায় ও’রকম ডাকসাইটে সুন্দরী আর ক'জন আছে বলুন! হেঃ হেঃ হেঃ... সানরাইস হয়ে গেল তাহলে... সূর্য ওঠার পর কাঞ্চনজঙ্ঘা যখন আপনার মন ভরিয়ে দিয়েছে, তখন বাগানে চেয়ার পেতে বসে ব্রেকফাস্ট সেরে নিন... এরপর কিন্তু সারাদিন বেড়ানো... শুরু করুন হাতের কাছের গ্রাম লামাহাট্টা দিয়ে (এখানেও অনেক নতুন হোটেল হয়েছে, অনেকে তিঞ্চুলে’তে না থেকে এখানেও থাকেন)... এখানে আছে পাহাড়ের ধাপ বেয়ে মরসুমী ফুলের বাগান, আর পাখির ডাকে কুয়াশার ওড়নায় ঢাকা একটা ছোট্ট লেক... ঘন্টাখানেক এখানে কাটান আর অফিসের যাবতীয় দুশ্চিন্তাকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দিন... তারপর চলে আসুন তিঞ্চুলে মনাস্ট্রি... পাহাড়ের চূড়োয় ছোট্ট এই মনাস্ট্রি’টিও শান্তি-দিয়ে-মোড়া... এরপর দুপুরের খাওয়া সেরে বড়া-মাঙ্গওয়া গ্রামের কমলালেবুর বাগান... যাওয়ার রাস্তা একটু ভাঙাচোরা, কিন্তু বাগান’টি দেখে মন ভরে যাবে... আর সব শেষে তিস্তা-রঙ্গিতের সঙ্গম, ত্রিবেণী’ও বলে জায়গাটা’কে অনেকে... দেখবেন চঞ্চল, উদ্ধত, সবুজ রঙ্গিত নদী হঠাত এক পাহাড়ের বাঁকে এসে শান্ত তিস্তার ধূসর রহস্যের মধ্যে হারিয়ে ফেলেছে নিজেকে... প্রতি’টা জায়গা চোখজুড়ানো, মনভরানো... ঘন্টার পর ঘন্টা শুধু নিস্তব্ধতা’টাকে উপভোগ করে কাটিয়ে দিতে পারবেন... মনে হবে, এ’সব জায়গায় কথা বলার প্রয়োজনই নেই কোনো... সব কথা এম্নিই বলা হয়ে যায়... সব চিন্তা আপনিই দূর হয়ে যায়... যখন সন্ধ্যেবেলা গেস্ট হাউস ফিরবেন, ততক্ষনে রবিবার দিনটা শেষ হয়ে গেছে... আর আপনার ছুটিও প্রায় শেষ...”
  



আপনি, “ইস...”

আমি, (বলেই চলেছি), “পরেরদিন সকাল’টা তাই নিজের মতন করে কাটান... গেস্ট হাউসের একজন কাউকে সাথে নিয়ে বেড়িয়ে পড়ুন ট্রেকিং’এ... অথবা পায়ে হেঁটে উঁচুনিচু পথে নিটোল ছোট্ট এই গ্রাম’টা ঘুরে নিন... পাইনে ঘেরা এক চিলতে মাঠে ক্রিকেট খেলে নিন গ্রামের ছোটদের সাথে... কিম্বা প্রিয়জনের হাত ধরে এক্সপ্লোর করে আসুন পাইনবনের আলোআঁধারির ভেতর দিয়ে হারিয়ে যাওয়া কোনো একটি আঁকাবাঁকা শুঁড়িপথ... দশ’টা নাগাদ ফিরে এসে দেখবেন গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে... ব্রেকফাস্ট রেডি... মনে হবে শুধু আপনিই তৈরী নন তিঞ্চুলে’কে ছেড়ে আসতে... বিকেলে যখন এন.জে.পি. থেকে ট্রেনে উঠবেন দেখবেন তখনও আপনার মন মনাস্ট্রির প্রেয়ার ফ্ল্যাগের পাশে, চা’বাগানের কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলে কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকে তাকিয়ে আছে...”














আপনি, “উফফ, যা বলেছ... খরচ-খরচার একটা এস্টিমেট দাও দেখি এখুনি... এত কিছু শুনে যে যাওয়ার ইচ্ছে প্রবল হয়ে উঠছে ভাই...”

আমি, “যান না, আমিও তো যেতেই বলছি... গুরুং গেস্ট হাউসের ওয়েবসাইট দিয়ে দিচ্ছি... যোগাযোগ করুন... ইচ্ছে হলে লামাহাট্টা বা বড়ামাঙ্গওয়া’তেও থাকতে পারেন... থাকার খরচা সব জায়গায় কম-বেশি একই... ১২০০-১৭০০ ঘরভাড়া, সঙ্গে সারাদিনে চারবেলার খাওয়া-দাওয়া ৫০০-৬০০ মত। বাড়তি খরচা হল গাড়ি... মনে রাখবেন জলপাইগুড়ি থেকে পিক আপ আর ড্রপের গাড়ি বুকিং’এর কথাটা হোটেল’কে বলতে ভুলবেন না... তিঞ্চুলে’তে কিন্তু ট্যুরিস্ট’এর ভিড় নেই, ফলে শেয়ারে গাড়িও নেই... স্টেশনে নেমে গাড়ি করতে গেলে ড্রাইভার’রা যা খুশি দর হাঁকতে পারে... হোটেল থেকেই গাড়ি’টার ব্যবস্থা হলে ভালো... সে খরচা’টা আমাদের পড়েছিল ১৮০০টাকা... আমি কিন্তু তিন বছর আগের কথা বলছি...

আপনি, “ওক্কে, বুঝলাম, সব মিলে মন্দ নয়, বুঝলে... দেখি কবে যাওয়া যায়... আর দরকারী কিছু বাদ পড়ছে? ভেবে বল দেখি...”

আমি, “ও হ্যাঁ, ভুলেই গেছিলাম বলতে... আপনাদের বেড়ানোর দল যদি অ্যাডভেঞ্চারাস হয়, তাহলে রাফটিং করতে পারেন তিস্তায়... ত্রিবেনী’তেই রাফটিং হয়, ভীষণ এনজয় করবেন... আর হ্যাঁ, এন.জে.পি.’র ট্রেনের টিকিট কিন্তু সময় থাকতে কেটে ফেলুন, টিকিট পাওয়া যায় না দেরী হয়ে গেল আর... ঘুরে আসুন, ভালো লাগবে... দুটো দিনের জন্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলুন না তিঞ্চুলের পাইনবনে... দেখবেন, নিজেকে খুঁজে পাবেন নতুন করে... ফিরে এসে আমাকে জানাবেন কিন্তু কেমন ঘুরলেন...


{ 4 comments... read them below or Comment }

  1. খুব সঙ্গত কারণেই সায়ংতরী বার বার জলপাইগুড়ি তে ট্রেনে করে যেতে বলেছে। যে ভ্রমণ এর এত সুন্দর বিবরণ লিখেছে সেটাতে ওর সফরসঙ্গী হিসেবে আমিও ছিলাম আর গোটা ভ্রমণ এ যেটা সবথেকে জ্বালিয়েছিল তার নাম বাস। যেটা আমাদের এতটাই এতটাই বাঁশ দিয়েছিল যে ফেরার বাস থেকে নেমে আমি ওটার নাম দিয়েছিলাম রয়্যাল স্ক্রু!তাই গেলেও ভুলেও বাস এর কথা ভাববেন না!

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাঃ হাঃ... এক্কেবারে ঠিক বলেছিস গাবলু...

      Delete
  2. Asadharan ekta trip chhilo..jamon prokriti tamon sangee chhilo amader group ta te.. chhoi joner team er amio ekjon chhilam..jaoa theke fera puro tai mone rakhar moto ekta trip chhilo( Sayantari thik bollam to)..smritir monikothai chirokal sukher hoe thakbe..Tobe oi "royal screw" ta jachhetai jaghanya chhilo..r Sreemanta er "Aaa Khusi Se......" Khub thandar jekono din e mone pore..tai aaj o tour organizer der oi tour ta korar jonyo asankho dhonyobaad..

    ReplyDelete

- Copyright © পাঁচমিশেলি - - Powered by Blogger - Designed by সায়ংতরী -