Popular Post

Archive for April 2016

ফেরা / চার

By : Sayantari Ghosh


চার
হাসপাতালটা জুড়ে একটি মেয়ের মোলায়েম গলা মাঝেমধ্যেই ছড়িয়ে পড়ে... একতলার রিসেপসন থেকে সেই কন্ঠস্বর অনাগত অনাহুত ভবিতব্যের কথা ইঙ্গিতে বলে দেয় প্রায়শই...
—“রিলেটভ্‌স্‌ অফ দ্য পেশেন্ট ইন বেড নাম্বার ‘দিস’ অফ আই.সি.ইউ আর রিকোয়েস্টেড টু কাম অ্যাট দ্য রিসেপসন। দ্য ডক্টর নিড্‌স্‌ টু টক... ইট্‌স্‌ অ্যান এমারজেন্সি...”
তিনতলার লাউঞ্জে বসে কান পেতে থাকে দিনরাত-জাগা একদল মানুষ... বুকে শুধু প্রার্থনা... “কোনোভাবে ওই কন্ঠস্বরে যেন ওর নাম না থাকে!!” লাউঞ্জটা বদলায় না... পাঁচদিনে এ ব্যাপারটা খেয়াল করেছে টুপুর... মুখগুলো পালটে যায় খালি... চোখের ক্লান্তি দিনে দিনে বাড়ে... কথাকে সরিয়ে দিয়ে নীরবতা জিতে যায়... তারপর হুট করে একদল মানুষের কালিপড়া মুখ একদিন অদৃশ্য হয়ে যায় লাউঞ্জের ক’টা চেয়ার খালি করে দিয়ে... গল্পের বাকিটুকু বাকিরা বুঝে নেয় বিনা চেষ্টায়... দীর্ঘশ্বাস বলে দেয়, কোন একটি গল্প চিরতরে ফুরিয়ে গেছে...!
টুপুর আর শুভ হাসপাতালে পা রাখা মাত্র ভীষণ শব্দ করে একটা বাজ পড়ল কোথাও... একেবারে ভিতরে কোথাও একটা রিন্‌রিনে কাঁপুনি ধরিয়ে দিল যেন... আর সঙ্গে সঙ্গে হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি নেমে গেল... যেন ওদের জন্যই পুরো ব্যাপারটা থেমে ছিল এতক্ষণ।
এগিয়ে গিয়ে একটা খালি চেয়ারে বসল টুপুর। শুভকে হাতছানি দিয়ে ডেকে নিলেন প্রভাসকাকু; বোধহয় বিলিং সেকশনে যেতে হবে! এদিকে তিনটে থেকে ভিজিটিং আওয়ার। পুরো সময়টাতে জাস্ট একজনকে ঢুকতে দেয়... কথা নয়, ছোঁয়া নয়, শুধু এককোনে দাঁড়িয়ে দেখা আর ফিরে আসা... তবুও... দেখতে ইচ্ছে টুপুরেরও করেছে, বার বার। কিন্তু............ হয় নি!
মাথাটাকে দুহাত দিয়ে ধরে মেঝের টাইল্‌সে চোখ রাখল টুপুর। আজ আবার হয়তঃ বড়পিসি যেতে চাইবে। দেখে এসে আবার কান্নাকাটি করবে। কাউকে ওভাবে কাঁদতে দেখলে ভয়ানক অসহায় লাগে নিজেকে... খুব খুব রাগ হয়... অথচঃ কার ওপরে রাগ, সেটাই ঠিক বোঝা যায় না!
কাঁধে একটা ছোঁয়া পেয়ে চোখ খুলল টুপুর। বাপি।
—“কিছু বলবে বাপি?”
আস্তে আস্তে হাতটা ওর মাথায় দিল বাপি, “আজ যাবি তুই ভিতরে? দেখে আসবি একবার?”
চুপ করে বাপির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল টুপুর; তারপর হাত বাড়িয়ে বাপির হাতটা শক্ত করে ধরল...
মাঝেমাঝে কি করে কে জানে বাপি এত বোঝে ওকে? কি করে কে জানে এত হিসেবের মাঝেও ওর মনের এতটুকু ভালোলাগার কথা মনে রাখে...? এখনও মাঝে মাঝে তাই ছোট্টবেলার মত বলে উঠতে ইচ্ছে করে, “আমি আমার বাপির মতন হব!” মনে মনে নয়... জোরে বলে উঠতে ইচ্ছে করে...!
—“এখন তো সবে দেড়টা... একটু রেস্ট করে নে... চুপ করে চোখ বন্ধ করে থাক একটু... ঘুম এলে ঘুমিয়ে নে... আমি ডেকে দেব ঠিক সময়ে...”, বলে আলতো করে একটু হাসলো বাপি।
কোণের চেয়ারটায় বসে দেয়ালজোড়া কাঁচটার দিকে চোখ ফেরালো টুপুর... গোটা দেয়ালটা জুড়ে আল্পনার খেলায় মেতেছে বৃষ্টি... বাকি সব ভুলে গিয়ে, স্মৃতি হাতড়িয়ে, কারো খুব চেনা মুখ আঁকতে চাইছে যেন জলছবি করে... এরকম বৃষ্টি দেখলেই ছুটে গিয়ে ভিজতে ইচ্ছে করে... মনে হয় সবটুকু কালি মুছে যাবে তাহলেই... অপেক্ষা, দুশ্চিন্তা, হিসেব, প্রমাণ— এসব কালো শব্দগুলো সব ধুয়ে যাবে... কাঁচের ওপার থেকেই চোখের ওপর দিয়ে ভেজা হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলো বৃষ্টির ফোঁটাগুলো... একটা শান্তি আস্তে আস্তে পেয়ে বসছিল যেন... শান্তি না কি ক্লান্তি কে জানে... কিন্তু বেশ লাগছিল ডুবে যেতে...
চোখ বন্ধ করল টুপুর... দাদুমনি ঠিক আছে আজ... আজই ও দেখে আসবে একবার... কে জানে দাদুমনি জেগে থাকবে কি না... ওকে দেখলে নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে... যদি কিছু বলা যায়, কি বলবে টুপুর...? কি বললে দাদুমনি আরও জোর পাবে মনে...? নাঃ থাক... কিছু বলবে না... শুধু থাম্বস্‌ আপ... একবার...
ভেবেই ঠোঁটের কোনে এক চিলতে হাসি খেলে গেল... একটা অকারণ ভালোলাগা মনের দখল নিয়ে নিল আস্তে আস্তে... আর বহুযুগ ধরে নির্বাসনে থাকার পর একটুকরো ঘুম কোত্থেকে এসে জড়িয়ে ধরল চোখদুটোকে...
......................................................................................................................
—“দিদিভাই!”, কে যেন ঝাঁকুনি দিল টুপুরের ডানহাতটা ধরে, “সি.সি.ইউ, বারো নম্বরের বাড়ির লোককে ডাকছে নিচে রিসেপশনে... বাপি একা চলে গেল... তুই যা দিদিভাই...”
নূপুরের চোখ জুড়ে খালি উদ্বেগ আর উদ্বেগ... যন্ত্রচালিতের মত উঠে দাঁড়াল টুপুর... নূপুরকে দেখে মনে হল ভরসা, শুধু একটু ভরসা ও খুঁজছে বেপরোয়া হয়ে... কি বলা যায়? কিছু কি বলা যায়? গলা কেঁপে গেলে.........?
হাত বাড়িয়ে ওর হাতটা ধরল টুপুর...
—“ভয় পাস না... কিচ্ছু হবে না... যাচ্ছি আমি...”
ছুট! ছুট! ছুট!
লিফটটা ছয় আর সাততলার মাঝামাঝি কোথাও ঘুরপাক খাচ্ছে...
সিঁড়ি...??? সিঁড়িটা যেন কোনদিকে...?!
রিসেপসনের সামনে বাপিকে দেখা গেল বটে... সামনে থমথমে মুখে ডক্টর পারেখ্‌... তিনতলা থেকে নেমে আসতে তিন মিনিটও লাগেনি টুপুরের... অথচঃ এই কুড়ি পা দূর,বহু বহু দূর মনে হচ্ছিল যেন...
দু-চার পা দূর থেকেই টুকরো কিছু কথা উড়ে আসতে লাগল কানে, “... আণ্ড দেন সাড্‌নলি হি ওয়াস স্ট্রাগলিং...... উই ট্রায়েড আওয়ার লেভেল বেস্ট... বাট উনি পারছিলেন না... তাই ফাইনালি আমরা বাধ্য হয়েই... উই নেভার প্রেফার দিস ওভার এনি আদার অপ্‌শন... বাট...”
আর পারা গেল না...
—“কি হয়েছে বাপি? কি...?”
কয়েক মূহুর্ত চুপ করে থেকে একটা মাত্র শব্দ বলল বাপি,
—“ভেন্টিলেশন!”
...........................................................................................
ভীষণ শব্দ করে একটা বাজ পড়ল কোথাও... একেবারে ভিতরে কোথাও একটা রিন্‌রিনে কাঁপুনি ধরিয়ে দিল যেন... !!

আবার যদি ইচ্ছে কর / চার

By : Sayantari Ghosh
dsw.jpg

চার
“পারো’টা বেশ বদলে গেছে, বল?”
প্রশ্ন’টা হেম করল আমাকে।
ডিপার্টমেন্ট অফ স্টুডেন্ট ওয়েলফেয়ারের পাশ দিয়ে যে রাস্তা’টা জঙ্গলের দিকে নেমে গেছে, তার মুখেই একটা বাঁধানো বেঞ্চে বসে আছি আমরা দু’জন। পাশটাতেই সেই কবেকার শিশুগাছ’টা… রাস্তায় মেঘ ফেটে ফালি ফালি রোদ এসে পড়েছে এখন। আমরা ছায়াতে, পায়ের কাছে গোল গোল রোদের মোজাইক করা ধূলোমাটি…
সামনে, একটু দূরে, রাস্তায় ঘুরে ঘুরে পারো ফোনে কথা বলছে আলোকের সাথে। আগের সাথে অনেক তফাত্ এখন… এস.টি.ডি.ও সস্তা হয়ে গেছে আগের চেয়ে আর ব্যালান্সও অনেক বেড়ে গেছে মোবাইলে…
পারোর কাছে তার বিবাহ অভিযানের লাইল-বাই-লাইন বর্ণনা শুনছিলাম গত ঘন্টাখানেক ধরে; গল্প শেষ হয়েছে এইমাত্র। বুঝতে পারলাম হেমের প্রশ্ন’টা সেই সূত্র ধরেই। সত্যি সত্যি গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল আমারো।
ভাবতেই পারছিলাম না…!
যে মেয়েটাকে কোনোদিন তার বাবার কাছে ফোনে 'আচ্ছা' আর 'হ্যাঁ' ছাড়া কিছু বলতে শুনিনি, যে মেয়েটা চুপ করে বসে থাকতে থাকতে কি জানি কিসের ভয়ে হঠাত্‌ কেঁদে ফেলত মাঝেমাঝে, বাড়িতে আলোকের কথা জানলে কি হবে, একথা যেদিন ভাবতে বসতো, সেদিন মাঝরাত পেরিয়ে যাওয়ার পর টের পেতাম চুপিচুপি নিজের বিছানা ছেড়ে আমার পাশে এসে শুয়ে ঘুমিয়েছে কোনোমতে… ভাবতেই পারছিলাম না যে এ গল্প’টার মুখ্য চরিত্র’টি সে! ইউনিভার্সিটির পর গুরগাঁও’এ চাকরি, সেই চাকরির ভরসায় বাড়িতে সবাইকে বিয়েতে রাজি করানো, তারপর কতদূরে বীরভূমের কোন গ্রামে এসে আলোকের বাড়িতে সবার সাথে আলাপ করা, আর আজ সগর্বে বলা যে ‘কার্ড এখন প্রেসে…’… টুকরো টুকরো এ গল্প আমরা জানতাম বটে, কিন্তু, এইভাবে, এক তোড়ে, একটানা শুনে মনেই হচ্ছিল না যে এই পারো নিজেকেই সামলাতে পারত না একসময়ে… আর এখন…
“বদলে গেছে বলিস না…” হেম’কে বললাম হেসে, “বল, বড় হয়ে গেছে মেয়ে’টা…”
তা নয়তঃ কি? নিজেই বলে চললাম মনে মনে... বড় হওয়া মানে নিজেকেই চেনা বেশী করে...
আর নিজেকে শুধরে নেওয়া পদে পদে শুধু... খুব প্রিয় ভুল’দের মুছে দেওয়া ইরেজার ঘষে... কত দাবী জন্মায়, আর কত অজস্র মরে যায় এই পথে... বড় হতে গিয়ে...
হেম'ও হাসল আমার কথা’টা শুনে। আসলে আমরা দুজনেই জানি যে পারো আর আলোকের গল্প’টাতে যে এরকম একটা দিন আসতে পারে, আমরা ভাবিনি। ভেবেছিলাম, এভাবেই দশ মিনিটের ফোন, গোটা রাতজাগা, কান্নাকাটি, ভয়, অভিমান আর না-বলে ওঠা গুচ্ছের এক্সপেকটেশন নিয়েই গল্প’টা ফুরিয়ে যাবে একদিন। পরিনতি’টা আমাদের চোখে স্পষ্ট ছিল জলের মত। খারাপ লাগত খুব পারো’টার জন্যে। কিন্তু ওকে দোষ দিতে পারতাম না একটুও। আলোক’কে তো কখনও দেখিনি আমরা। তারই একরকম সুযোগ নিয়ে এই খারাপ লাগার সমস্ত দায়, নিজেদের এই হাত-পা-বাঁধা অবস্থার সবটুকু ফ্রাস্ট্রেশন সোজা ওর ঘাড়ে চাপিয়ে দিতাম।কখনও আমি বলিনি হেম’কে, হেমও বলেনি কখনও… কিন্তু দুজনে’ই বুঝতে পারতাম যে এ কাহিনীর শেষ নিয়ে আমরা মনে মনে মোটামুটি একমত। আমাদের ভোলামন বান্ধবী’টি যে এইভাবে আমাদের ভুল প্রমাণ করে দেবে কক্ষনো ভাবিনি।
ফোন শেষ। পারো ফিরছে। রাস্তার সোনা-সোনা রোদে ওকে আলোর পুতুল মনে হচ্ছে একটা। আলোয় আলো পারো… চোখে আলো, কপালে আলো, বুকে আলো, পায়ের তলাতে আলো… প্রতিটি চলাতে আলো…
“তোর কথাই হচ্ছিল মিস”, হেম বলল পারো’কে, “ঠিক কি বললে যে তোকে একটা যুত্সই ‘ব্রাভো’ বলা হবে ভেবে পাচ্ছি না আমরা…”
“কিছু বলতে হবে না”, হাসিতে আরেকচোট রোদ ছড়িয়ে পারো বলল, “একটা কাজ করে দ্যাখা দেখিনি… মেক আ লাভ স্টোরি অফ ইয়োর ওন টু কমপিট উইথ মি…”
হো হো করে হেসে উঠলাম তিনজনেই, হেম বলে উঠল, “আরে আমি আট লিস্ট ট্রাই তো করেছি… রিনিটা কে দ্যাখ… কাম অন সুইটি, গেট ইন্সপাইয়ার্ড…”
“শোন শোন”, পারো বলে উঠল আমাকে কিছু বলতে না দিয়ে, “দ্যাখ এই মেয়ে আমায় কি মেসেজ করেছিল হোয়েন আই টোল্ড হার দ্য সেম থিং… হিয়ার ইট ইস… লিস্‌ন্‌…”, খচখচ করে মোবাইলের ইনবক্স খুলে একটা মেসেজ পড়তে লাগল পারো, বাধা দিলাম, বারণ করলাম, শুনলোই না…
….. মেসেজটায় লিখেছিলাম কোনো এক অস্থির বিকেলে,
“জানিনা রে! আসলে খুব অনেস্টলি বলতে গেলে, যখন ভাবা যেত, যখন সুযোগ ছিল, তখন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলা’টা কেন জরুরি, বুঝিনি আমি। ভেবেছিলাম, যে পাশে আছে, আর থাকবে জীবনভর এমন দাবীও করে, কেন সে সম্পর্কের নাম এক্ষুনি ভেবে ফেলতে হবে? কি দরকার? সারা’টা জীবন তো রয়েছে পড়ে… পরে দেখলাম, সে যখন উত্তর চেয়েছিল, নিজের জীবনের ভাগ বাঁটোয়ারা করছিল তখন আসলে। আমিও ঘাড় নেড়ে দিয়েছি আর সেও আমার ভাগের তার জীবনটাকে কেটেছেঁটে এত্তটুকু করে দিয়েছে…”
“উফফফ… আ লঅঅঅং বাউন্সার…” মেসেজ পড়া শেষ করে ফোন’টা ব্যাগে পুরলো পারো।
বুকের ভেতর একটা অস্বস্তি। চোখদুটো বন্ধ করে ফেললাম। কানদুটোতে হাত চাপা দিতে ইচ্ছে করল খুব! মনে হল মাথার ভেতরের ঘরটার সমস্ত জানলার শাটারগুলো ভীষণ শব্দ করে কেউ বন্ধ করে দিচ্ছে একে একে, অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে চারদিক… আর আমি একটা দেওয়ালজোড়া ফ্রেমে-বাঁধা ছবির সামনে একা দাঁড়িয়ে আছি… নর্মদা আর সাবরমতির মাঝের সেই ঝুপসি অন্ধকার, আকাশে মৃতপ্রায় চাঁদ মেঘঢাকা দিয়ে শুয়ে, জংলা ফুলের গন্ধে মাতাল রাস্তা… হাতের কব্জি’তে মোচড়… ‘লাগছে রুদ্র, লাগছে!’… … ‘ভালবাসিস না রিনি? বল??’… … ‘বলেছি তো না... না, না, না’ … … জোরালো প্রশ্ন আর গোয়ার্তুমির উত্তর… …
মাথা নিচু করে বসে রইলাম চুপ করে। পরিষ্কার বুঝতে পারছিলাম, একজোড়া চোখ আমার পাশ থেকে আমার দিকে তাকিয়ে… সোজা, একদৃষ্টে… সে দৃষ্টি’তে আবিষ্কারের বিহ্বলতা… আমার বুকের ভেতর এতদিন ধরে লুকিয়ে রাখা ঘরটার খোলনলচে নেড়েচেড়ে দেখছে যেন সে তার সব কৌতূহল দিয়ে…
তোকে যা নির্দ্বিধায় বলা যায়, শুধু একটু শ্বাস নিতে গিয়ে, তুই বুঝবি না, কষ্ট পাবি না এই ভরসায়, হেম’কে কি সে সঅঅব বলতে আছে, পারো? সে যে অভিমানে মরে যাবে তাকে জানাইনি বলে?
জঙ্গলের কোন এক না-দেখা পাখিরও বুঝি মন-আনচান করে উঠল খুব… আকাশ ভাসিয়ে বলে উঠল, ‘পিউ কাঁহা… পিউ কাঁহা… পিউ কাঁহা…’
[ক্রমশঃ]

আবার যদি ইচ্ছে কর / তিন

By : Sayantari Ghosh
tapti.jpg

তিন
“এই যে পোস্টম্যানের বউ, তুই কি খাবি লাঞ্চে?” খোঁচা মারলাম হেম’কে, “তোর’ও ওই মিক্সড চাউমিন’ই তো?”
“অঙ্কুর শাহ, হি হ্যাস আ নেম… ও.কে.?” আচমকা বলল হেম, মুখে আলতো হাসি! পারো লাফিয়ে উঠলো কথাটা শুনেই, “উফফফ… জিও! শিগগির লাঞ্চ অর্ডার’টা দিয়ে ছুট্টে আয় রিনি, সামওয়ান ওয়ান্টস টু শেয়ার সাম সিক্রেটস্‌ আট লাস্ট!!!”
এক্কেবারে চমকে গেছিলাম আমিও; চিরকাল জানতাম, হেম যে ছেলেটির সাথে চ্যাট করত ক্লাস ফাঁকি দিয়ে, আসাইনমেন্ট ডুব মেরে, তার নাম-ধাম-কাজকাম কিছুই সে জানেনা। আরও অবাক হতাম এটা দেখে যে ও জানতেও চায় না! ছেলেটির চ্যাট আই.ডি. ছিল ‘দ্য পোস্টম্যান’… ব্যাস! আর কোন পরিচয় ছিল না তার আমাদের কাছে।
কিন্তু কি নিয়ে না কথা হত ওদের? সকালের চায়ে চিনি কম থেকে বিকেলে লোহিতের ছাদ থেকে সূর্যাস্ত, পরীক্ষায় দ্যাখাদেখি করে লেখা থেকে ভি.সি. কে ঘেরাও করতে গিয়ে হেম আর রুদ্র’র সাসপেন্ড হওয়া… যাবতীয় গল্প হেম করতো তার সাথে। মনখারাপ, মনভালো, অভিমান, স্বপ্ন কিচ্ছু বাদ যেত না।বাদ যেত খালি স্থান-কাল-পাত্রের পরিচয়গুলো। সে ছেলেও নাকি বহু কিছু বলত খোলামনে আর হেমের কাছে এই ‘খোলামন’ শব্দ’টা বরাবর খুব গুরুত্ব রাখত; ও বলত, দুটো মানুষের ‘স্ফিয়ার অফ ইনফ্লুয়েন্স’-এ থাকা চরিত্রগুলো যদি একটুও না মেলে, তাহলে সেই দুটি মানুষের বন্ধুত্বে কোন রাখঢাক থাকে না… আর সেই বিশ্বাস থেকে একটা অদ্ভূত ভরসা পাওয়া যায়… পরস্পরের প্রতিটি মতামত’কে গুরুত্ব না দিয়ে, না ভেবে বাতিল করা যায় না কিছুতেই।
ইউনিভার্সিটি’তে, ক্লাসে বা রাজনীতির সূত্রে অনেকের সাথে হেম’কে মিশতে দেখেছি; কিন্তু ‘পোস্টম্যান’ ছাড়া কাউকে নিয়ে ওকে এত’টা গভীরভাবে ভাবতে দেখিনি, সেটা সত্যি। ওর কথা শুনে মনে হত, যে ওর মত একটি মেয়ের উচ্ছ্বলতা বা স্পর্ধা’টাকে খোলাখুলি প্রশ্র্য় দিত ছেলেটি; সে সাহস সবার থাকেনা। কিন্তু ওদের এই আড়াল রাখা, পর্দানশীন ফিলোসফিকাল বন্ধুত্ব’টা একই জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে আছে কেন, তার কোন ব্যাখ্যা পেতাম না কিছুতেই। ফলে এতদিন পর পোস্টম্যানের অঙ্কুর শাহ পদে উত্তরণের খবর শুনে ঠিক কত’টা খুশি হলাম আর কতটা অবাক, নিজেই মেপে উঠতে পারলাম না ঠিকমত।
ঝপ করে লাঞ্চ’টা অর্ডার করে এসে, বেশ জমিয়ে বসে পড়ে বললাম, “ফাটাফাটি একটা গল্প শোনা হবে মনে হচ্ছে!”
“শুরু কর, মিস ছুপা রূস্তম”, পারো বলল খুনসুটি করে।
এক গাল হেসে হেম শুরু করল, “গল্প’টা কিন্তু একেবারেই তেমন কিছু না…”
“আর ভূমিকা করতে হবে না, বলে ফ্যাল তাড়াতাড়ি” সমস্বরে বললাম আমরা।
“ওহহো”, হাসতে হাসতে বলল হেম, “শোন, এখান থেকে বেরিয়ে যখন মুম্বাই গেলাম প্রথম চাকরি’টা নিয়ে এই নামধাম জানা’টা মোটামুটি সেই সময়ের কথা…”
“ঝুঠি, ঝুঠি”, পারো বলে উঠল মাঝপথে, “এত্তদিন ধরে মিথ্যে বলে যাচ্ছে…”
“আরে শেষ তো করতে দে”, বলল হেম, “তা… যখন জানলাম যে অঙ্কুরের বাড়িও মুম্বাইয়ে, তখন ভাবলাম ইট ইস আ নাইস কোইন্সিডেন্স। দ্যাখা করার দিন’টা ঠিকই করে ফেললাম অনেক ভেবেচিন্তে…”
“উফফফফ… কি রোম্যান্টিক…!” পারো টিপ্পনি কাটল।
একটুও পাত্তা না দিয়ে হেম বলে চলল, “একটা গোটা দিন একসাথে স্পেন্ড করার প্ল্যান করা হল। ফাইনালি দ্য ডে কেম আর যখন দশ’টা নাগাদ গেটওয়ে অব ইন্ডিয়াতে আই ফার্স্ট স হিম… আমার একদম ইনিশিয়াল রিয়াকশন কি ছিল বল ত?”
“কি?”
“কি??”
“……… যে হি ইস নট দ্য গাই…”
“হোয়াআ…?!”
“মানে??!!”
আমরা দুজনেই হাঁ করে তাকিয়ে ছিলাম হেমের দিকে!! বলে কি মেয়ে’টা? এতদিন এত কথা, এও গল্প… আর শেষকালে ‘দেখে’ মনে হল যে এ সে নয়…?! হেম অন্ততঃ ঠিক এরকম না… হেম’কে যা চিনি…
“মানে আমায় মিস আন্ডারস্ট্যান্ড করিস না প্লিস…” আমাদের অবস্থাটা বুঝে সামাল দিতে চাইল হেম, “মানে দ্যাখ আমি বোঝাবার চেষ্টা করছি… আমি ওর আপিয়ারেন্সের কথা এক্কেবারে বলছি না… ওর আপ্রোচ… খুব খুব অন্যরকম… মানে আমি এরকম ভাবিনি… সারা’টা দিন কাটালাম আর বারবার আমার এটাই মনে হল যে হয়তঃ আমার সাথে মিশতে গিয়ে আমার যে অংশ’টাকে ও মেনে নিয়েছে, সেটাকে ও নিজের মলাট হিসেবে সাজিয়ে নিয়েছে… আমায় ও পছন্দ করত বলে সেটাকে গায়ে তুলতে ওর সমস্যা হয়নি… ওকে দোষ দিচ্ছিনা আমি; কিন্তু গোলমাল হল যে আমি তো ভুল বুঝেছি পুরোপুরি… আমি তো সেই মলাট’টাকেই পুরো বই’টা ভেবে ফেলেছি… মানে… বুঝতে পারছিস আমি কি বলছি?” সরাসরি আমার দিকে তাকিয়ে হেম বলল; কেমন যেন অসহায় দ্যাখাচ্ছিল ওকে… আর ভীষণ ডেস্পারেট!
“হু, হু, বুঝতে পারছি তো…” খুব পরিষ্কার বুঝলেও সায় দিলাম আমি, “নিজেকে চাপে ফেলিস না হেম, ভালো লাগেনি নিশ্চয়ই কিছু… কি হয়েছে তাতে? হতেই তো পারে…”
পারো’ও মাথা নাড়িয়ে বলল, “বুঝতে পারছি আমরা…”
“থ্যাঙ্কস”, একটু যেন ঠান্ডা হল হেম, “মানে খুউউব ছোট ছোট ব্যাপার থেকে অনেক বড় বড় ব্যাপার অব্দি… ধর, এই যে আমার ফিল্ম ক্রিটিকের ট্রেনির চাকরিটা, এটা যে এম্নিই, আমি যে এরপর সিরিয়াসলি লেখালিখি’টা করতে চাই… মানুষের কথা লিখতে চাই, সারা দেশ বেড়াতে চাই, মানুষের সাথে মিশতে চাই… বা ধর আমাদের ইউনিভার্সিটির মশাল র্যা লি বা হাঙ্গার স্ট্রাইক, তার দাবীগুলো, যা ন্যায্য, যা প্রাপ্য, তার কথা জোর গলায় বলা, যেমন আমি বলতাম, রুদ্র বলত… অঙ্কুর এ’সব খুব মন দিয়ে শোনে, কিন্তু সেগুলো ভুলতে ওর কয়েক’টা সেকেন্ড লাগে মাত্র… চ্যাটে, ও যে শুনছে সেটা বুঝতে পারতাম ভীষণভাবে, মন’টা ভরে যেত ভালোলাগায়, জানিস? কিন্তু সামনে থেকে ওর ভুলে যাওয়া’টাই যেন খালি খালি চোখে পড়তে লাগল…”
পারো আস্তে করে হাত’টা রাখল হেমের মাথায়, বলল, “আমরা বুঝতে পারছি সোনা…”
একমিনিট চুপ করে চোখ বন্ধ করে রইল হেম; তারপর হঠাত্ ঝিলিক দেওয়া হাসি হেসে চোখদুটো মুছে নিল একবার, বলল, “সো… দ্যাটস দ্য স্টোরি… আর দেয়ার ইস নাথিং স্যাডি স্যাডি ইন ইট রাইট নাও…”
“গ্রেট!”, পারো বলল, “আরে কিঁউ সোচে ইয়ে দিল কে আগে কয়া হোগা, ’গর কুছ নহি হোগা তো তজর্বা হোগা…”
সব্বাই হেসে ফেললাম। হেম’কে হাসতে দেখে ভাল্লাগছিল। ওকে যেটুকু চিনি, হাসিটা দেখে এটুকু বুঝছিলাম যে, কান্না-চাপা-হাসি এটা নয় অন্ততঃ, বললাম, “হ্যাঁ রে, অঙ্কুর জিগেস করেনি পরে কিছু?”
হেম চোখদুটোয় একটা দুস্টুমি খেলিয়ে বলল, “আই টোল্ড হিম দ্যাট আই লাভ সাম ওয়ান এলস…”
“যা তা…” হাসতে হাসতে বললাম আমি।
“উফফফ, আই আম রিয়েলি মিসিং রুদ্র নাও”, হাসতে হাসতে চোখে জল এনে ফেলে বলল পারো, “হেমের পিছনে লাগার ব্যাপারটাতে কিন্তু ও বরাবরের চ্যাম্পিয়ন… হি মিস্ড্ আ ফ্যাবিউলাস চান্স টুডে…”
দু’হাতে মুখ ঢাকল হেম।
“মিক্সড চাউমিন, চিক্কেন মাঞ্চুরিয়ন, গুলাব জামুন… টেবিল নাম্বার বাইইইস…” হাঁক পাড়লো ক্যান্টিনের ছোটু।
[ক্রমশঃ]

ফেরা / তিন

By : Sayantari Ghosh


তিন

থালার ভাতগুলো কে নিয়ে খালি নাড়াচাড়া করছিল টুপুর; আজ যে কেন খেতে ইচ্ছে করছে না কে জানে... হঠাত্ টেবিলের ওপাশে চোখ পড়তেই দেখল শুভ একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। ও তাকাতেই থেমে থেমে বলল, “একদানা খেলি না কিন্তু! কি হয়েছে বলতো? দাদুমনি তো অনেক ঠিক আছে আজ... মুড ঠিক কর, টুপুর... খা!”
এক গ্রাস ভাত তুলে মুখে দিল টুপুর; গোটা গা-টা গুলিয়ে উঠল যেন... নাঃ! পারা যাচ্ছে না! জলের গ্লাসটা তুলে দু-ঢোঁক জল খেল ও...
—“কি রে? শরীর খারাপ লাগছে নাকি?”, এবার শাসনের জায়গায় উদ্বেগ শুভর গলায়, “থাক, জোর করিস না!অন্য কিছু খাবি? কোল্ডড্রিঙ্কস? বা আখের রস...? আনব?”
—“না রে... জাস্ট খিদেটা নেই এখন... খিদে পেলে পরে খেয়ে নেব আমি...”
শুভ আবার কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল ওর দিকে; তারপর বলল, “বেশ... চল, উঠি তাহলে... তুই বেরিয়ে দাঁড়া, আমি দামটা মিটিয়ে আসছি...”
দোকানটার থেকে বেরিয়ে এল টুপুর। হাসপাতাল থেকে এটা ওই মিনিট কুড়ির হাঁটা পথ।
পিছন ফিরে দেখল, ক্যাশ কাউন্টারের সামনের ভিড়টায় শুভকে দেখা যাচ্ছে। ও এসেছে আজ ভোরে। ভোর না বলে অবশ্য ভোররাত বলা উচিত... পৌনে চারটে-টাকে বোধহয় তাই-ই বলে। কাল রাত সাড়ে বারোটায় শহরে ফিরেছে ও... দিল্লি গেছিল... ইন্টারভিউ ছিল একটা...।
দাদুমনির খবরটা একরকম ইচ্ছে করেই শুভকে জানাতে দেয় নি টুপুর। প্রভাসকাকুকে নিজে গিয়ে বলেছিল, “কাকু, শুভকে জানিও না, প্লিজ... একেবারে ডিস্টার্বড হয়ে যাবে...”
টুপুর জানত, শুভ ফিরে এসে বাইরে বাইরে রাগ করবে, মেজাজ দেখাবে আর ভিতরে গুমরে মরবে... ভীষণ ভীষণ মনখারাপ করবে... কিন্তু ওকে তো আর এই আজ হঠাত্ করে দেখছে না টুপুর! সেই যখন ও ক্লাস ফাইভে, তখন প্রভাসকাকু ঝাঁঝা থেকে বদলি হয়ে এখানে এলেন বাপির অফিসে। সেই থেকে একসাথে ওরা... ক্লাসগুলো বদলে গেছে... ফাইভ, সেভেন, নাইন, ইলেভন... তারপর স্কুল বদলে গেছে কলেজে... কমেডি-ট্র্যাজেডি সবের আদল বদলে গেছে ধীরে ধীরে... মুখ আর নাম বার বার বদলেছে... সব পেরিয়ে একসাথে ওরা...
টুপুর জানে, শুভ পারত না, সব ফেলে ছুটে চলে আসত...! যেমন আজ ভোরে এল!
আজ সারা সকালটা শুভ ছিল এখানেই। বাপিরা আসার পর ডাক্তারের সাথে যা কথা হল তাতে ওদের হিসেবে দাদুমনি ইমপ্রুভ করছে...
—“চ!” পার্সটা পকেটে ঢোকাতে ঢোকাতে ওর পাশে এসে বলল শুভ, “আরেব্বাবা!! যা সেজেছে আকাশটা... আবার নামাবে মনে হচ্ছে...! চ জলদি! ভিজবো না আমি...”
দুজনে হাঁটা লাগালো। চুপচাপ। আজ সকাল থেকেই কে জানে কেন সেরকম কথাই হয় নি! টুপুর কত ভেবেছিল যে একবার শুভ আসুক... ব্যাস,তাহলে অন্ততঃ আর এই কথা জমিয়ে, দম বন্ধ করে থাকতে হবে না... কিন্তু কোথায়? কথাগুলোর কথা জড়িয়ে গেছে!
আকাশের একটা কোনা বেয়ে ধাপে ধাপে গাঢ় কালচে নীল মেঘ বড় হচ্ছে আস্তে আস্তে... রাস্তার ধুলোয় ছোট্ট ছোট্ট ঘূর্নি... একখানা খবরের কাগজ মাতাল হাওয়ার বেতালা ঘুড়ি হয়ে গেছে যেন... ঝড় উঠবে মনে হচ্ছে... কে জানে তাহলে আর বৃষ্টি হবে কি না...
—“সেই মাছধরা গুলো মনে পড়ছে বল!”, বলল শুভ, “আমি, তুই আর দাদুমনি...উফফফ! কি মজাটাই না হত!”
মনে পড়ছিল টুপুরেরও! তালপুকুরিয়ার ধারে ছিপ হাতে নিয়ে দুখানা কালো ছাতা খুলে উন্মুখ মেঘের দিকে পিছন ফিরে কাটানো সেই লম্বাআআ দুপুরগুলো... গোটা গরমের ছুটিটার প্রায় প্রতিটি দুপুর এভাবেই কেটে যেত সেসময়... তখন শুভরা প্রথম প্রথম এসছে এখানে...
—“হ্যাঁ... আমিও ভাবছিলাম”, হেসে বলল টুপুর, “তবে মাছ ধরা তো নামেই... সব মিলিয়ে কটা মাছ ধরতাম আমরা?”
—“ আররে!? থাকলে তো ধরবি? তালপুকুরিয়ায় মাছ ছিল? থাকার মধ্যে খালি পুঁটি ছিল... সে ত ধরতাম!”
—“যাঃ... রুই-এর পোনা ছিল... আমরা ধরেছি... আর তুই কিছু বলিস না... তুই কোনোকালেই কিছু ধরিসনি... ওই পুঁটি ছাড়া...” বলতে বলতেই হেসে ফেলল টুপুর
—“আমরা মানে কি? অমনি দাদুমনি কে নিজের দলে...না?” ঝুটমুট চোখ পাকিয়ে বলল শুভ।
—“সে তো দাদুমনি আমার দলেই... আর তাছাড়াও আমি ধরেছি... চারাপোনা ধরিনি আমি?”
কথার হারিয়ে যাওয়া খেই আবার ফিরে এল যেন... একযুগ আগের সেইসব দুপুরের বোকাবোকা স্মৃতি মেঘের সাথে মিশে আকাশ ভরাতে লাগল... কেঁচো দিয়ে তৈরি চার... তিন নম্বর বঁড়শি... ফাত্‌নার আলতো নাচন... আর ঘন্টার পর ঘন্টা সেই নিষ্পলক প্রতীক্ষা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা অজস্র গল্প... এদেশের বর্ষা আর ওদেশের বর্ষার গল্প... রাতদুপুরে পাগার উপছে আসা জলের তোড়ে কইজালা ফেলে রাশি রাশি কইমাছ ধরার গল্প... সিঙ্গি মাছের কাঁটায় জাল ছেঁড়া আর বোয়াল মাছের গায়ের জোরে হাতে বাঁধা ক্যাঁটার দড়ি সমেত জেলে কে টেনে নিয়ে যাবার গল্প... আর বর্ষা শেষ হলে পর ধানখেত ভর্তি হয়ে ছড়িয়ে থাকা মাছের কাঁটায় পা কেটে যাবার গল্প...
আকাশে মেঘের ওপর মেঘ জমছিল... গল্পের ওপর গল্পও জমে উঠছিল খুব...
ওরা খেলছিল, তর্ক করছিল নাকি ভুলে থাকার চেষ্টা... কে জানে! তবু বুকের ভিতর অব্দি ঢুকে যাওয়া হাসপাতালের ফিনাইলের আর ওষুধের গন্ধটাকে ছাপিয়ে উঠছিল ভেজা হাওয়া আর সোঁদা মাটির একটা সুবাস... সে সুগন্ধ খানিক আজকের... খানিক কে জানে কবেকার... দীর্ঘশ্বাসের গরম হলকা দূর হয়ে যেতে লাগল অজান্তেই...!

- Copyright © পাঁচমিশেলি - - Powered by Blogger - Designed by সায়ংতরী -