- Back to Home »
- একটু বড় গল্প »
- ফেরা / দুই
Posted by : Sayantari Ghosh
Wednesday, March 16, 2016
দুই
“ শিল-শিলাটন শিলাবাটন শিলা আছেন ঘরে
স্বর্গ থেকে মহাদেব বলেন হরগৌরী কি ব্রত করে?"
স্বর্গ থেকে মহাদেব বলেন হরগৌরী কি ব্রত করে?"
দখিনদুয়োরী বড় ঘরটার মেঝের ঠিক মাঝখানে বড় করে আলপনা দিচ্ছে টুপুর—চারদিক কেমন ধোঁয়াটে—আর একটানা কেউ যেন পাঁচালি পড়ছে—
"....আকন্দ, বিল্বপত্র, তোলা-গঙ্গার জল
এই পেয়ে তুষ্ট হন ভোলা মহেশ্বর......”
এই পেয়ে তুষ্ট হন ভোলা মহেশ্বর......”
কোথায় যেন শোনা এই ছড়াটা? খুব,খুউব চেনা...তবু যেন ঠিক ঠিক চিনে নিতে অসুবিধে হচ্ছে—ওই তো দিদুন...খাটের ওপর বসে...এক্ষুনি স্নান সেরে এসেছে...এই অ্যাত্তো লম্বা ভেজা চুল গোটা পিঠে এলো হয়ে আছে...ছোট্টো কপালে ছোট্টো সিদুঁরের টিপ...
-“ম্যাডাম...!”
আচমকা তন্দ্রাটা কেটে গেল ডাকটায়—চোখ খুলতে হাসপাতালের রিসেপশনের মেয়েটির ব্যাতিব্যস্ত মুখটা পরিষ্কার হয়ে এল আস্তে আস্তে—বুকের ধুকপুকুনিটা অজান্তেই বেশ খানিকটা বেড়ে গেছে ততক্ষণে...
-“আপনি কি ICU-এর ছয় নম্বর পেশেন্টের বাড়ির লোক?”
মাথার বাঁ-দিকটা দপদপ করছে ক্রমাগত—কথাটা শোনার পর বুঝতে একটু সময় লাগল টুপুরের—তারপর ধীরে ধীরে উত্তর দিল ও—
-“না...না,আমার পেশেন্ট CCU-তে আছেন...বারো নম্বর...”
-“ওহ...সরি!” আর কথা না বাড়িয়ে মেয়েটি চলে গেল।
-“ওহ...সরি!” আর কথা না বাড়িয়ে মেয়েটি চলে গেল।
ঘুম এসে গেছিল একটুখানি—মাথাটা ভীষণ ব্যাথা করছে—একটু চা খেতে হবে—হাসপাতালের ক্যান্টিন এই রাত আড়াইটের সময় খোলা থাকবে না—রাস্তার মোড়ের দোকানটা ছাড়া গতি নেই...
পায়ে পায়ে লাউঞ্জটা থেকে বেরিয়ে এল টুপুর—ভীষণ গুমোট করেছে আজ—আকাশে একটাও তারা নেই—খুউব হালকা হাওয়া দিচ্ছে একটা—আলগোছে ছুঁয়ে যাচ্ছে—জোর করে বুঝতে চাইলে তবে বোঝা যায়—!
দাদুমনি নাকি এখন একটু ভাল—সাড়ে ন’টায় ডাক্তারের সাথে শেষ কথা হয়েছে—ব্লাড প্রেশার অনেকটা স্টেবল—কিন্তু হার্টবিট নাকি খুব উইক—কে জানে...? এদের কথায় আজকাল আর ভরসা করতেও সাহস হয় না—
আকাশে মেঘের ফাঁক দিয়ে এক চিলতে আগুন ছুটে গেল—বৃষ্টি হবে কি...?
চা-টা হাতে নিয়ে হাসপাতালের সিঁড়িতে বসল টুপুর—কি যেন একটা স্বপ্ন দেখছিল ও এখুনি? কি যেন...? যত ধরার চেষ্টা করছে,তত যেন পিছলে পালিয়ে যাচ্ছে স্বপ্নে-দেখা দৃশ্যগুলো...দিদুন ছিল এটুকু মনে আসছে...আর......
‘ শিল-শিলাটন শিলাবাটন শিলা আছেন ঘরে
স্বর্গ থেকে মহাদেব বলেন হরগৌরী কি ব্রত করে?’
স্বর্গ থেকে মহাদেব বলেন হরগৌরী কি ব্রত করে?’
-“না না...শ্রবণকুমারেরটা নয়...ওটা বিচ্ছিরি...আজ পুণ্যিপুকুরের গল্পটা বল না,দিদুন...!”
-“আআ মল যা...পুণ্যিপুকুরেরটা আবার গল্প নাকি? কতবার শুনিচিস ওটা...সেই যে চারকোনা পুকুর কেটে...”
-“না না...অম্নি করে না...ভালো করে বলো না...!”
-“আআ মল যা...পুণ্যিপুকুরেরটা আবার গল্প নাকি? কতবার শুনিচিস ওটা...সেই যে চারকোনা পুকুর কেটে...”
-“না না...অম্নি করে না...ভালো করে বলো না...!”
প্রতিদিন প্রাইমারি স্কুল থেকে ফিরে খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকে যাবার পর দিদুনের খাটটায় পাশাপাশি শুয়ে পড়তো ওরা দুইবোন...টানটান উত্তেজনায়...নতুন গল্পের দুরন্ত আকর্ষনে...বা সাতপুরোনো গল্পের কানাঘুঁজিতে একটু নতুন আবিষ্কারের আশায়...
-“ভালো করে আবার কি? সব মনে আছে তোদের...এই ত সেদিন শুনলি...”
-“না,না...বলো না দিদুন... ‘ভাটি-খালকুলায় বোশেখ মাসটা জুড়ে...’...বলো না...!”
-“বেশ,বেশ..শোন তবে....তা আমাদের গ্রাম ভাটি-খালকুলায় গোটা বোশেখ মাসটা জুড়ে নানাআআন রকম উত্সব-মচ্ছব লেগেই থাকত...গ্রামটার পাশ দিয়ে গোল করে বাঁক নেওয়া চন্দনা তখন এই প্যাকাটির মতন শুকিয়ে যেত...অথচ বর্ষায় তার সে কি আস্ফালন...! জলে আর মাছে থৈ থৈ করত তখন!
যা হোক বোশেখের কথা বলছিলাম...পয়লায় দয়ালের আসন থেকে একখানা নগরকীত্তন বার হত...সারা গ্রাম ঘুরে তারা সংক্রান্তির মেলার জন্য দান-দক্ষিণে নিত...সে কীত্তন ভাটি-খালকুলা আর মাদুলি-খালকুলার সব দরজায় ঘুরতো...
তারপর বোশেখের পত্থম ব্রত করতাম আমরা...পুণ্যিপুকুরের ব্রত...ঘর-লাগোয়া বিশাল দীঘি ছিল আমাদের...তার পাড়েই চারকোণা পুকুর গড়তাম...”
-“কত বড় পুকুর দিদুন...?”
-“ছোট্ট...! এই ধর এইটুকুনি...”, খাটের ওপর আঙ্গুল দিয়ে দাগ টেনে পুকুরের আয়তনটা বুঝিয়ে দিত দিদুন, “সেই পুকুরভর্তি করে জল দিতাম আর পুকুরের মাঝখানে একখানা বেলের ডাল লাগিয়ে দিতাম...”
-“বেলের ডাল কোত্থেকে নিতে...? দয়াল আসনের পাশের বোধন-বেলগাছটা থেকে বুঝি...?”
-“সে অত মনে নেই...বেলের কি আর অভাব ছিল নাকি...?”
-“তারপর...?”
-“তারপর পুজো করতাম...! হাত জোড় করে, কোষাকুষিতে সব সাজিয়ে নিয়ে...”
-“মন্ত্র বলতে না...?”
-“হ্যাঁ...বলতাম বই কি...সব্বাই মিলে বলতাম,
-“না,না...বলো না দিদুন... ‘ভাটি-খালকুলায় বোশেখ মাসটা জুড়ে...’...বলো না...!”
-“বেশ,বেশ..শোন তবে....তা আমাদের গ্রাম ভাটি-খালকুলায় গোটা বোশেখ মাসটা জুড়ে নানাআআন রকম উত্সব-মচ্ছব লেগেই থাকত...গ্রামটার পাশ দিয়ে গোল করে বাঁক নেওয়া চন্দনা তখন এই প্যাকাটির মতন শুকিয়ে যেত...অথচ বর্ষায় তার সে কি আস্ফালন...! জলে আর মাছে থৈ থৈ করত তখন!
যা হোক বোশেখের কথা বলছিলাম...পয়লায় দয়ালের আসন থেকে একখানা নগরকীত্তন বার হত...সারা গ্রাম ঘুরে তারা সংক্রান্তির মেলার জন্য দান-দক্ষিণে নিত...সে কীত্তন ভাটি-খালকুলা আর মাদুলি-খালকুলার সব দরজায় ঘুরতো...
তারপর বোশেখের পত্থম ব্রত করতাম আমরা...পুণ্যিপুকুরের ব্রত...ঘর-লাগোয়া বিশাল দীঘি ছিল আমাদের...তার পাড়েই চারকোণা পুকুর গড়তাম...”
-“কত বড় পুকুর দিদুন...?”
-“ছোট্ট...! এই ধর এইটুকুনি...”, খাটের ওপর আঙ্গুল দিয়ে দাগ টেনে পুকুরের আয়তনটা বুঝিয়ে দিত দিদুন, “সেই পুকুরভর্তি করে জল দিতাম আর পুকুরের মাঝখানে একখানা বেলের ডাল লাগিয়ে দিতাম...”
-“বেলের ডাল কোত্থেকে নিতে...? দয়াল আসনের পাশের বোধন-বেলগাছটা থেকে বুঝি...?”
-“সে অত মনে নেই...বেলের কি আর অভাব ছিল নাকি...?”
-“তারপর...?”
-“তারপর পুজো করতাম...! হাত জোড় করে, কোষাকুষিতে সব সাজিয়ে নিয়ে...”
-“মন্ত্র বলতে না...?”
-“হ্যাঁ...বলতাম বই কি...সব্বাই মিলে বলতাম,
‘পুণ্যিপুকুর ব্রতমালা/কে করে গো সকালবেলা
আমি সতী,লীলাবতী/সাতভায়ের বোন,ভাগ্যবতী
হবে পুত্র,মরবে না/ধান সে গোলায় ধরবে না
পুত্র তুলে স্বামীর কোলে/আমার মরণ হয় যেন এক গলা গঙ্গাজলে...’...”
আমি সতী,লীলাবতী/সাতভায়ের বোন,ভাগ্যবতী
হবে পুত্র,মরবে না/ধান সে গোলায় ধরবে না
পুত্র তুলে স্বামীর কোলে/আমার মরণ হয় যেন এক গলা গঙ্গাজলে...’...”
ছড়াটা শেষ হতেই হাততালি দিয়ে উঠত নুপূর...দিদুনের কোল ঘেঁষে বসে বলত, “আর শিবরাত্রির মন্ত্রটা......?”
-“ শিল-শিলাটন শিলাবাটন শিলা আছেন ঘরে
স্বর্গ থেকে মহাদেব বলেন হরগৌরী কি ব্রত করে?
আকন্দ, বিল্বপত্র, তোলা-গঙ্গার জল
এই পেয়ে তুষ্ট হন ভোলা মহেশ্বর।
আসনং পাশনং পাত সিংহাসন
হরগৌরী ব্রত করে শিব হরধন
কালো ফুল তুলতে গেলাম শুধু লতাপাতা
শিব-চরনে দেখা হল, শিবের মাথায় জটা...”
স্বর্গ থেকে মহাদেব বলেন হরগৌরী কি ব্রত করে?
আকন্দ, বিল্বপত্র, তোলা-গঙ্গার জল
এই পেয়ে তুষ্ট হন ভোলা মহেশ্বর।
আসনং পাশনং পাত সিংহাসন
হরগৌরী ব্রত করে শিব হরধন
কালো ফুল তুলতে গেলাম শুধু লতাপাতা
শিব-চরনে দেখা হল, শিবের মাথায় জটা...”
-“তারপর...?”
-“তারপর আর কি? চেয়ে নিবি...”
-“কি চেয়ে নেব...?”
-“বর...! এই টকটকে ফরসা রং, টানাটানা চোখ, টলটলে হাসি...রাজপুত্তুরের মতন বর চেয়ে নিবি...”
-“চাইলেই পাওয়া যাবে।তাই না দিদুন...?”, নুপূর জিগেস করত অনেক আগ্রহ নিয়ে...
-“কিন্তু এতো একেবারে দাদুমণির মতন...”, বলত টুপুর, “আমার তো দাদুমনি আছে...আমি আর চাইবো কি করতে...?”
-“তারপর আর কি? চেয়ে নিবি...”
-“কি চেয়ে নেব...?”
-“বর...! এই টকটকে ফরসা রং, টানাটানা চোখ, টলটলে হাসি...রাজপুত্তুরের মতন বর চেয়ে নিবি...”
-“চাইলেই পাওয়া যাবে।তাই না দিদুন...?”, নুপূর জিগেস করত অনেক আগ্রহ নিয়ে...
-“কিন্তু এতো একেবারে দাদুমণির মতন...”, বলত টুপুর, “আমার তো দাদুমনি আছে...আমি আর চাইবো কি করতে...?”
আকাশে আরেকখানা বিদ্যুতের ঝলক...শুধু আলো...কোনো শব্দ হলনা...দিদুন বুঝি মুচকি হাসল ওই ওপরে বসে বসে...আর তক্ষুনি টুপুর হঠাত্ খেয়াল করলো দু-গাল ভিজিয়ে দিয়েছে বাধ-না-মানা চোখের জল...দুহাতে মুখ ঢাকলো ও...সেইদিন থেকে সব্বাই কেঁদেছে...সব্বাই...শুধু ও ছাড়া...সুযোগ পেয়ে সবটুকু কান্না উছলে পড়তে চাইছে এখন...অঝোরে...
এই একা-রাত গুলো এরকমই অবাধ্য হয়...একগুঁয়ে...জেদি...কাঁদিয়ে তবে ছাড়ে...!