Popular Post

Posted by : Sayantari Ghosh Friday, March 01, 2013






দীপনের কথা

অফিস থেকে ফিরে নিয়মমত ব্রিফকেস’টা টেবিলে নামিয়ে সোফায় গা এলিয়ে দেয় দীপন। গত ছয়বছরে এটাই প্রতিদিন নিয়মিত দেখে আসছে তৃপ্তি। ও’ভাবে বসে পড়ার মানেই কাজের মেয়েটিকে ইশারা আসলে... আদা-দেওয়া বেশ কড়া একটা চায়ের না-বলা ফরমায়েস। চা শেষ করে একবার মিঠির ঘরে উঁকি দেবে দীপন... এটাও রোজ’ই। মিঠি তখন ঘুমায়; স্কুল থেকে ফিরে একটু ঘুমানোর অভ্যেস’টা তৃপ্তিই করিয়েছে ছোটো থেকে... তাহলে সন্ধ্যেটায় ফ্রেশ থাকে... হোমওয়ার্কগুলো করার সময় কম ঘ্যানঘ্যান করে। মিঠিকে ঘুমাতে দেখে স্নান সেরে এসে কম্পিউটারের সামনে বসে পড়বে দীপন... এই যে বসলো, সাড়ে ন’টায় তৃপ্তি খেতে ডাকার আগে সে উঠবে না... অফিসের কাজ, খানিক ফেসবুক, খানিক জি-টক... বন্ধুদের সাথে আড্ডা... কিছু পড়াশুনো, কিছু ফোটোব্লগ হাতড়ানো, কিছু নতুন বাজারে আসা ছবি-তোলার সরঞ্জাম নিয়ে জ্ঞানঅর্জন... শেষটায় স্রেফ গান শোনা... এই নিয়মের সাধারণভাবে কোন নড়চড় নেই।

দীপনের মাথায় এ সময়টায় হয়তঃ আরো কিছু ঘুরপাক খায় যে’সবের টের তৃপ্তি পায় না সেভাবে... অফিসের খিঁচড়ে যাওয়া মেজাজের টুকরোটাকরা বাড়ি বয়ে এসে মুখ দেখিয়ে যায় রোজই... তবুও... বিষয়গুলি গড়পরতা... অন্ততঃ দীপনের কাছে তাদের আদল খুব পরিচিত। অফ-টপিক কিছু বড় একটা ঘটে না, তাই রুটিনের অন্যথাও হয় না বড় একটা।

কিন্তু সেদিনটা অন্যরকম ছিল।

ঘরে ঢুকে ব্রিফকেসটা নামিয়েই বেসিনের সামনে গিয়ে মুখে জলের ঝাপটা দিল দীপন। তারপর তোয়ালে আর ইস্ত্রি করে রাখা ধবধবে পায়জামা পাঞ্জাবী নিয়ে সটান স্নানে ঢুকে গেল। কাজের মেয়েটির থেকেও অবাক চোখে সেদিকে তাকিয়ে রইলো আদা-দেওয়া চায়ের কাপখানা।

বাথরুমের দরজায় আলতো করে টোকা দিল তৃপ্তি, “শুনছো...? শরীর খারাপ লাগছে নাকি গো?”

দরজার ওপারে শাওয়ার চালিয়ে দেওয়ালে হেলান দিয়ে ঠায় ভিজছিল দীপন... তৃপ্তির কন্ঠস্বরের একটু সময় লাগলো চিন্তার জাল ছিঁড়ে ওর কাছ অব্দি পৌঁছতে, “কিছু হয় নি, ঠিক আছি,” উত্তর এল, “জাস্ট আ বিট টায়ার্ড...”

মোহরের মুখ’টা একটা ধোঁয়াটে সাইনবোর্ডের মত চোখের সামনে আটকে রয়েছে। সব দ্যাখা যাচ্ছে এ’পাশ থেকে ও’পাশ, কিন্তু সবের ভেতর সারমর্ম হয়ে বেরিয়ে আসছে ওই একটাই মুখ। কি ক্যাজুয়াল ছিল মোহর! কি আশ্চর্য্য! কলেজ স্ট্রিটের মোড়ে আজ ওকে দ্যাখা-মাত্র কেমন যেন বোকা হয়ে গেল দীপন... একটা মূহুর্তের জন্য লুকিয়ে পড়তে ইচ্ছে করলো ওর... ইচ্ছে হল এক্ষুণি ভিড়ের একটা যে কোন মুখ হয়ে যেতে... নিজেকে হারিয়ে ফেলে ভিড়ের ফাঁক থেকে উঁকি দিয়ে মোহরকে দেখতে ইচ্ছে হল... সত্যি, মোহর’ই...  শাড়ি, খোঁপা, চশমা, সিঁদূর... তবু, মোহর’ই।

তখুনি কি করে কে জানে মোহরের চোখ ঘুরলো এদিকে... আর এক সেকেন্ডের ভেতরে অজস্র ভয় এসে গলা টিপে ধরলো দীপনের... অগুনতি প্রশ্নের উত্তর হাতড়াতে লাগলো মাথার ভেতরে ও... “বম্বে পড়তে তুই একা যাস দীপ?”... “একটা চিঠি লিখতে ইচ্ছে হল না তোর?”... “আট’টা বছর... জাস্ট ভ্যানিশ হয়ে রইলি?” “আমি কি আদৌ ছিলামই না কখনো কোথাও?”... ... “কি করে পারলি রে?”...
চাপা পড়ে যাচ্ছিলো দীপন নিজের কল্পনাতেই... হাবুডুবু খাচ্ছিলো রীতিমত...

মোহর’টা অথচ...

কেমন পাগলিই রয়ে গেছে... চোখদুটোয় একটা অবাক-হাসি নিয়ে ছুটে এল... “দীপ...!! কেমন আছিস রে??” হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল কফি হাউসে, “আজ কোনো কথা শুনছি না... বউকে ফোন করে দে, বল আধ ঘন্টা দেরী হবে... আরে ধূর, জিগেসই করিনি... বিয়ে থা করেছিস তো?”

কত কথা বলল... জিগেস করলো আরো কত কি... কলেজের চাকরি, ছয় বছরের ছেলে, লেখালিখিতে ছেদ, নতুন করে রিসার্চের প্ল্যানিং... কত কত কথা।

শুধু বলল না কেন চিঠি লিখিস নি...

স্নান সেরে কম্পিউটারে বসলো দীপন... পনের মিনিট পরে উঠে পড়লো... শুলো খানিক... তাক থেকে একটা উপন্যাস নামিয়ে পড়তে নিয়ে দ্বিতীয় পাতায় আটকে গেল... একবার ভীষণ ইচ্ছে করলো একটা ফোন করতে; কিন্তু করা গেল না... তারপর ইচ্ছে করলো মিঠির ঘরে গিয়ে তৃপ্তিকে বলতে, যে আজ ওকে আর হোমওয়ার্ক করিও না, আজ ও একটু খেলুক আমার সাথে, আজ ওকে একটা গল্প শোনাই বরং... একটুবাদে সে ইচ্ছেটাও তেতো হয়ে গেল... তারপর আর কিছু ইচ্ছেই করল না।

বরের কথা জিজ্ঞাসাই করা হল না মেয়েটাকে... “হিংসে হল নাকি দীপন?” বুকের ভেতরের আয়নাটা বাঁকা হেসে বলল, “জেলাস! জেলাস! নাকি ইনসিকিউরিটি? না কি স্রেফ ভয়??”

জানি না জানি না... উফফফ...

কেন যে বলল না কেন চিঠি লিখিস নি...


মোহরের কথা


মোহর বাইরের গ্রিলের দরজাটা ঠেলতেই দোতলার জানলা থেকে বুয়ান উঁকি দিল, “এনেছো...? মা?”

একগাল হেসে হাতের আনন্দ পাবলিশার্সের প্যাকেটটা উঁচু করে দ্যাখালো মোহর। ঘরে ঢুকতেই ওই প্যাকেট আর তার ভেতরের টিনটিনের কমিকস খুলে মেঝেতেই বসে পড়লো বুয়ান; মোহর ওকে কোলের কাছে টেনে নিয়ে ওর পাশ’টাতেই বসলো শাড়িটা এলিয়ে, হাঁক পাড়লো ভেতর ঘরের দিকে, “কাজু...! আজ ফুলকপি কাটবি রাত্তিরের জন্য! বৃষ্টি হয়েছে এদিকে দুপুরে? জামাকাপড়গুলো তুলেছিস?

-“হ্যাঁ বৌদি,” ঘাড় হেলিয়ে সায় দেয় কাজু; হাঁক শোনামাত্র সে দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছিল, “কিন্তু বৌদি, মা-মনি আজ আমায় এমনি এম্নিই বকেছে... একটুখন কথা বলতে গেসলাম পাশের বাড়ির নমিতার সাথে, তাতে কি এমন মহাভারত’টা অসুদ্দ হয় বল ত?”

ছ’টা নাগাদ অনিন্দ্য ফিরল অফিস থেকে। তার আগের সময়টা কাজুর সাথে চেঁচামেচি করতে করতেই চলে গেল মোহরের। শাশুড়ি’মাকে বোঝালেও বুঝবেন না, তাই রোজদিন তাকে কাজুর সাথে চেঁচিয়েই গলা ফাটাতে হয় এ’সব সমস্যার সালিশি করতে এসে। অনিন্দ্য ঢুকেই হইচই শুরু করে দিল, “আজ বাইরে ডিনার!!!” কবে থেকে কি একটা এরিয়ার আটকে ছিল, সেটা নাকি আজ এসেছে।

-- “সাউথ সিটি যাই চলো...” মোহরের কোমর জড়িয়ে ধরে অনিন্দ্য বলল, “বুয়ান ওখানে বেশ এনজয় করে... আর ওদের ফুডকোর্ট’টা জাস্ট অস্যম!”
-- “চলো,” হাসিমুখে বলল মোহর, পরক্ষণেই চিন্তায় পড়ে গেল হঠাত, “এতগুলো আটা মাখালাম গো কাজুকে দিয়ে... আর গুচ্ছের ফুলকপি...”
-- “আরে দূর... ফ্রিজে রেখে দাও...”

সাউথসিটি থেকে ফিরতে রাত হল। ঘরে ঢুকেই আঁচল কোমরে গুঁজে বিছানা করতে লাগলো মোহর; বুয়ানটা তখন প্রায় ঘুমিয়েই গেছে।

পৌনে বারোটা বাজলো মোহরের বিছানায় আসতে। ছাড়া জামাকাপড়গুলো ভাঁজ করে, বুয়ানের স্কুলের ব্যাগ আর ইউনিফর্ম গুছিয়ে, কাল সকালের রান্নার সবজি, ভাতের চাল, চায়ের পাতা, চিনি-হলুদ-তেল-নুনের কৌটোর সরেজমিনে করে, জলের বোতলগুলো ভরে শুতে শুতে একটু তো দেরী হয়’ই। এ’সব সকালের জন্যে ফেলে রাখলে মুশকিল। সাড়ে ন’টার ট্রেন, বাড়ি থেকে বেরোনো সাড়ে আটটায়... তাতেই কলেজ ঢুকতে ঢুকতে পৌনে এগারোটা বেজে যায়... তার আগে রান্না, অনিন্দ্যর টিফিন, বুয়ানের স্কুলবাস...

-- “আহ্‌...” বিছানায় শুয়েই সারাদিনের ক্লান্তিতে শিরদাঁড়া’টা টনটন করে ওঠে মোহরের। পাশে অনিন্দ্য প্রায় ঘুমন্ত। একটু যেন ইতস্ততঃ করলো মোহর, তারপর হাত বাড়িয়ে অনিন্দ্যর হাত’টা ধরলো।

--“হুম...?” অনিন্দ্য ঘুমায়নি, “কি? কিছু বলবে?”
--“হু... আজ... আজ জানো... কলেজস্ট্রিট গেছিলাম বুয়ানের একটা বই কিনতে...” ক’টা মূহুর্ত থামলো মোহর, “হঠাৎ দীপনের সাথে দ্যাখা হয়ে গেল, জানো?”

একটু নড়ে ওঠে অনিন্দ্য, হাতে ধরা হাত একটু শক্ত হয়, তারপর আলতো হেসে বলে, “আরেব্বাবা... তা, কেমন আছে সে? বহুদিন পরে দেখা তো...”

--“... আট বছর... পুরো আট বছর... বম্বে থেকে ফিরেছে সেটাই জানতাম না...”
--“হুমম...” একটুখানি চুপ করে গেল অনিন্দ্য, তারপর গলা আরো নামিয়ে বলল “ঝগড়া করলে?”
--“নাহ্‌,” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল মোহর, “ইচ্ছেই করলো না... আর ও খুব আনকম্ফোর্টেবল ছিল...”

কিছুক্ষণ আবার নিস্তব্ধতা। বাইরের বারান্দায় ঘড়িটাই খালি একা-একা প্রলাপ বকছে টিক টিক করে। কম্পিউটারের স্ক্রিনসেভারে চাপা আলোয় ঘুরপাক খাচ্ছে একটা বেগুনি রঙের চতুর্ভূজ।

অনিন্দ্য মোহরের চুলগুলো আলতো হাতে সরিয়ে দেয় কপালের ওপর থেকে, “এই... মনখারাপ করে না, লক্ষ্মীটি...”

মোহর আস্তে আস্তে সেঁধিয়ে যায় অনিন্দ্যর বুকের ভেতরে, থেমে থেমে বলে, “না গো... মন খারাপ করলোই না একটুও... আশ্চর্য্য ব্যাপার...”

“আশ্চর্য্য কি আর?” বললো স্ক্রিনসেভারের বেগুনি আলোর ট্রাপিজিয়মটা... তার চারটে হাত নিজেদের দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে গড়ে তখনো চেষ্টা করে চলেছে আপ্রাণ... যদি ওপারের জন’কে একটু ছোঁয়া যায় কোনোভাবে...

{ 1 comments... read them below or add one }

- Copyright © পাঁচমিশেলি - - Powered by Blogger - Designed by সায়ংতরী -