Popular Post

Archive for July 2012

নীলচে সবুজ রহস্য

By : Sayantari Ghosh



বারোই জুলাই, ২০১২ নীল-রঙা নেপচুন এক বছরের হল। অবিশ্যি আমরা তাকে চেনার পর থেকে হিসেব করা হলে... এমনি করে আমরা মানুষের বয়েস হিসেব করি না যদিও, তবে গ্রহ নক্ষত্রদের ক্ষেত্রে এটাই নিয়ম। আর সত্যি বলতে কি এছাড়া আর উপায়ও নেই! তাদের বয়েসের মাপকাঠি আমাদের থেকে অনেএএক বড়সড় কিনা? এই নেপচুনের কথাই ধর,পৃথিবী’তে প্রায় এক’শ পঁয়ষট্টি বছর পার হলে নেপচুনের বয়েস বাড়ে মাত্র এক বছর! ঠিকমত দিন হিসেব করলে তারিখ’টা দাঁড়ায় তেইশে সেপ্টেম্বর,১৮৪৬,যেদিন আমাদের কাছে নেপচুন জন্মালো। আর বললে বিশ্বাস করবে কি না জানি না,এক ঘন্টাও লাগেনি সেদিন নেপচুন’কে খুঁজে বার করতে! অথচ তার পঁয়ষট্টি বছর আগে, ১৭৮১ থেকে গোল বেঁধেছে, নেপচুন লুকোচুরি খেলছে সেই তবে থেকে, কিন্তু আশ্চর্য! কেউ খুঁজেই পায় নি! আসলে একেই বলে কলমের খোঁচা! আবার অঙ্কের ভেল্কিও বলতে পারো! (যারা অঙ্ক’কে দু’চক্ষে দেখতে পারো না,এই বলে দিচ্ছি,শুনে নাও... অঙ্ক না থাকলে একটা আস্ত গ্রহ থেকেও না-থাকা হয়ে থাকতো চিরকাল... হু হু,বাবা,নিন্দে-মন্দ করলেই হবে?)।

নাহ, বড্ড ছড়িয়ে যাচ্ছে! বরং পেতে বলি গল্প’টা...
১৭৮১ সালে এক বসন্তের সন্ধ্যেয় নিজের টেলিস্কোপ বাগিয়ে আকাশ দেখতে দেখতে উইলিয়ম হারশেল যবে থেকে ইউরেনাস’কে দেখেছেন, তার কিছুদিন পর থেকেই গল্পের শুরু। সৌরজগতের সপ্তম গ্রহটি আবিষ্কৃত হতেই দ্যাখা গেল আরো কিছু রহস্য যেন তার সাথেই দানা বেঁধে আছে। ইউরেনাসের যে পথে সূর্যের চারপাশে ঘোরার কথা, যত সময় লাগার কথা তার কোন অঙ্ক’ই সে পুরোপুরি মানে না! কোথাও ছোটে তাড়াতাড়ি, কোথাও বা ভীষণ ধীরে ধীরে। যেন কেউ তাকে ঠেলছে কখনও, কখনও বা টানছে পিছনদিকে... কে সে? অদেখা শক্তির উত্স খুঁজে চিরুনীতল্লাসী চলল, কিন্তু ওভাবে কি খোঁজ মেলে? অগনতি নক্ষত্রের আলো ঝিকিয়ে উঠলেই সব হিসেব গুলিয়ে যায় বারবার!

১৮২১ সালে একটা মস্ত বড় অঙ্ক কষা হল;কাগজে হিসেব করে লিখে ফ্যালা হল আগামী বছরগুলোতে কখন কোথায় থাকা ‘উচিত’ ইউরেনাসের। শুরু হল মিলিয়ে দ্যাখা, খুঁটিয়ে দেখতে চোখ পেতে বসে রইলেন বিজ্ঞানীরা; দ্যাখা গেল,হিসেবে কোনো ভুল নেই,কিন্তু ইউরেনাস মোটেই উচিত অনুচিতের হিসেবের ধার ধারছে না।

আবিষ্কারের গল্প হবে,আর সেই গল্পের একজন বুদ্ধিমান অঙ্ক-কষতে-ভালোবাসা নায়ক থাকবে না, তা কি হয়?
সে ছেলের নাম জন আডামস। ইংলন্ডের কর্ণোয়ালের কাছে একটা খুব ছোট গ্রাম লানেইস্টের এক চাষীর ছেলে সে। জমি আছে বাবার সামান্য, তাতে চাষ-বাস হয় অল্প করে, বাপ মা সাত ভাইবোনের সংসার তাতে টেনেটুনে চলে যায় একরকম। জন বাবাকে চাষের কাজে সাহায্য করত বটে, কিন্তু পাহাড়ের গায়ে ক্ষেতের পাশে বসে খাতা ভরিয়ে অঙ্ক করতেই যেন বেশী ভালো লাগে তার। যেদিন মেঘ থাকে না, সেদিন রাতের আকাশে তারার মেলায় হারিয়ে যেতে যেতে বিভোর হয়ে ভাবে লন্ডন... অক্সফোর্ড... কেমব্রিজ...
একদিন হঠাৎ করে সত্যি হয়ে গেল স্বপ্ন’টা। কোথা থেকে কে জানে টাকাকড়ি জোগাড় করে মা তার কেমব্রিজে আসার ব্যবস্থা করে দিলেন! ১৮৩৯ এ কেমব্রিজে এসেই একটা নতুন দরজা যেন খুলে গেল জনের সামনে। আর তখুনি কানাঘুষোয় একটা না-মেলা অঙ্কের খবর এসে পৌঁছালো তার কানে... ইউরেনাসের কক্ষপথে কে জানে কি গোলমাল... সে নাকি কোনো নিয়মের কথা শোনে না!

কলেজের পড়া শেষ করতে না করতেই কাজটায় হাত দিলেন তিনি। তাঁর বিশ্বাস ছিল যে ইউরেনাসের চলার মোড় ঘুরিয়ে দিচ্ছে তার খুব কাছেই থাকা আরেকজন কেউ। অঙ্কের কক্ষপথ থেকে ইউরেনাসের যেটুকু সরে যাওয়া,সে সেই অদৃশ্য উপস্থিতির জন্যেই। শুধু সেটুকু খবর আর নিউটনের সূত্রগুলি ছাড়া আর কিছুই লাগবে না সমস্যাটাকে মিটিয়ে ফেলতে। অঙ্ক কষে পরিষ্কার বলে দেওয়া যাবে,যে যার জন্যে এত গোলমাল,সে কে? সে কি কোন নক্ষত্র? না কি সৌরজগতের আরেক সদস্য? ধূমকেতু না কি নতুন কোন গ্রহ? কোথায় তার অবস্থান? এ’ধরনের অঙ্কের একটা নাম দেওয়া হয়েছে এখন... ইনভার্স প্রবলেম,মানে যাকে বলে ‘কার্য দেখিয়া কারণ অনুসন্ধান’!

১৮৪৪ এর সেপ্টেমরের মাঝামাঝি ‘সৌরজগতের অষ্টম গ্রহ’টির খবর নিয়ে কেমব্রিজ অবসারভেটরির ডিরেক্টর জেমস চ্যালিসের কাছে জন আডামসের চিঠি পৌঁছায়। সমস্ত অঙ্কের খাতা তো আর পাঠানো যায় নি চিঠির সঙ্গে; তাই চ্যালিসের মনে হয় এ নেহাত্‌’ই ছেলেমানুষের মাতামাতি! বাকি অঙ্ক দেখতে না চেয়েই তিনি উত্তর লিখে দেন,“খাটনি প্রচুর হবে নিশ্চিত,আর সাফল্য নিশ্চিত নয় একেবারেই...”
বছরখানেক পেরিয়ে যাওয়ার পর আবার সুযোগ আসে। কর্ণওয়াল থেকে ছুটি কাটিয়ে ফেরার পথে একদিন গ্রিনিচ অবসারভেটরির প্রধান জর্জ এয়ারির বাড়িতে উপস্থিত হন আডামস। আপয়েন্টমেন্ট নেওয়া ছিল না;জর্জ বাড়িতেও ছিলেন না। বাধ্য হয়ে পুরোনো চিঠিটির’ই একটা কপি জর্জের টেবিলে রেখে যান আডামস। সে চিঠির উত্তরে সমস্ত অঙ্কের হিসেব মিলিয়ে দেখার জন্যে চেয়ে পাঠান জর্জ এয়ারি।

ইতিমধ্যে সুদূর ফ্রান্সে একই সমস্যা নিয়ে মাথা খাটাচ্ছিলেন আরেকজন গণিতবিদ। তাঁর নাম লা ভেরিয়র। ১৮৪৫ এর নভেম্বরে আর পরের বছর জুনে পরপরদুটি পত্রিকায় তাঁর গণনা প্রকাশিত হয় আর সে গণনা অনুসরণ করে প্রথম ২৩শে সেপ্টেম্বর রাতে নেপচুন’কে দ্যাখা যায় বার্লিন থেকে। যেখানে থাকার কথা লা ভেরিয়র বলেছিলেন তার এক ডিগ্রির ভেতরেই!! অবসারভেটরির একজন উচ্ছ্বসিত বিজ্ঞানী এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন,“খড়ের গাদায় সূঁচ খোঁজার কাজটিকে পড়া-পড়া-খেলার মত সোজা করে দেয়,গণিত এমনি সুন্দর!”

২৩শে সেপ্টেম্বর ১৮৪৬। নাইট্রোজেন আর মিথেনের বরফে মোড়া সৌরজগতের দ্বিতীয় নীলগ্রহ’টি প্রথম ধরা পড়ে টেলিস্কোপের লেন্সে।
কিন্তু এই দীর্ঘ এক বছর সময় জন আডামস কেন এয়ারির চিঠির উত্তর পাঠাননি তা এখনও রহস্য। যে গণনা তিনি কতদিন আগে মিলিয়ে ফেলেছেন,দোরে দোরে ফিরেছেন তার স্বীকৃতির খোঁজে,কেন তা পাঠালেন না এয়ারি’কে? এ প্রশ্নের কোন সদুত্তর তিনি দিতে পারেন নি। হয়তঃ হতাশ হয়ে পড়েছিলেন,হয়তঃ বা নিজেই সন্দিহান হয়ে পড়েছিলেন...

ফ্রান্স আর ব্রিটেনের মধ্যে “নেপচুন কার” এ জাতীয় একটা ঠান্ডা লড়াই বেঁধেছিল সে সময়। শেষ অবদি ভেরিয়র’ই নেপচুনের আবিষ্কর্তা হিসাবে স্বীকৃত হয়ে যান। সৌরজগতের একমাত্র গ্রহ যার অবস্থান টেলিস্কোপের আগে অঙ্কের খাতা জেনেছিল... ভেরিয়র’ই হলেন তার প্রথম দ্রষ্টা। আর জন আডামসের নাম একটা রহস্যের মত খালি জড়িয়ে রয়ে গেল নীলচে সবুজ নেপচুনের গায়ে।

- Copyright © পাঁচমিশেলি - - Powered by Blogger - Designed by সায়ংতরী -