Popular Post

Archive for February 2013

সেই তখন...

By : Sayantari Ghosh


তখন আমরা ক্লাস ইলেভন! আমার পালকের মতন হাল্কা নীল রঙের সাইকেলটা তখন ঝাঁ-চকচকে। আমার সবুজ রঙের প্রাণটাও! আজকাল দুটোতেই ভারী ঝুল পড়েছে... কতবার মুছে দিয়ে আসি... দু’দিনে আবার ধুলোয় ঢেকে যায়! নিজেকে বড় অসহায় লাগে তখন!

কিন্তু আজকালের কথা বাদ দাও... সেই তখনকার কথা বলছিলাম... তখন আমরা খালি ভিজতাম আর ভিজিয়ে দিতাম... ভাসতাম আর ভাসিয়ে নিতাম... আমরা পাঁচজন... খালি হাসতাম আর হাসিয়ে দিতাম!

বহু কথা, বহু সুর অগোছালো, এলোমেলো করে স্কুলচত্বর জুড়ে ফেলে রেখে এসেছি তখন... একশ রঙের রঙিন সুতো একসাথে খুলে ফেলে জট পাকিয়ে ফেলেছি... মাজিয়ারার মাঠে সাইকেল কাত করে শুইয়ে বুকের হাপরটাকে শান্ত করেছি গোলাপি রঙের মেঘজড়ানো স্বপ্ন দিয়ে... পাশাপাশি গোল হয়ে বসে হাঁ করে আকাশ দেখেছি... আর হিসেব করেছি, যেদিন আকাশ আমাদের হবে, কোনখানটার ভাগ কে নেবে?

আর তবুও কারা যেন বলে যে আমরা নাকি হিসেব-টিসেব বুঝতাম না তখন? তাদের কথা বিশ্বাস কোরো না গো...! ভুলভাল বকার আর জায়গা পায় না তারা! সবটুকুই তো হিসেববাঁধা ছিল... নেওয়া আর দেওয়ার রুটিনকরা গল্প... তবে যে বস্তুটির লেনদেন চলত, তার হিসেবী বোধবুদ্ধি বড়ই কম... সেটা বলতে পারো... বন্ধুত্ব ভালোবাসা যা খুশি নামে ডাকতে পারো সেটাকে...

সেদিক থেকে দেখলে অবিশ্যি তখন আমরা ভারি বোকা ছিলাম...!!

তখন প্রায় প্রতিদিন বিকেলে, পাহাড়ের যে দিকটায় ঝুপ করে খাদ নেমে গেছে, সেইদিকে পা ঝুলিয়ে সার বেঁধে বসে থাকতাম আমরা! সুয্যিটা কেন জানিনা আমাদের দেখে ভীষণ লজ্জা পেত; চুপটি করে মুখ লুকিয়ে আকাশ জুড়ে প্যাস্টেল নিয়ে হিজিবিজি কাটত... দক্ষিনের গাঢ় নীল শালবনটা থেকে একটা হাওয়া দিত তখন... কিরকম যেন একটা মিষ্টি গন্ধ ছিল তাতে... তখন আধচেনা লাগত... এখন সেটা একেবারে অচেনা হয়ে গেছে...!

হাওয়ার আর দোষ কি...? এখন তো অনেক অনেক কিছুই বদলে গেছে! ভোরের শিশির বদলায় নি, বলো? সাঁঝবেলার হিম বদলায় নি? কথা, সুর, সুতো, মাঠ, আকাশ... এমনকি আমরা অব্দি এত্ত বদলে গেছি, আর হাওয়া বদলালেই বুঝি দোষ??

ঠিক কবে থেকে এই বদলাবদলি খেয়াল করিনি, জানো! হঠাত্ একদিন দেখলাম, খাদের ধারে আমি একাই বসে আছি!! আমার সোনালি পঞ্চভূজ ভেঙে খানখান... একখানা আধমরা সরলরেখাও খুঁজে পেলাম না কোত্থাও!! সত্যি মানতে সাহস হল না... তাই একটা মিঠে ভ্রমকে মনের ঘরে আশ্রয় দিলাম...
সে ভাঙা ভাঙা ভীতু ভীতু গলায় বলতে থাকল, “ভরসা রাখ! সবকিছু তেমনিই আছে... খালি একটিবার দেখা হবার অপেক্ষা... ঠিক সেরকমই হাসি-গান-মজা-খুনসুটি করে কেটে যাবে বিকেলের পর বিকেল... দিনেরা ছুটি চাইবে... তোরাই দিতে পারবি না!!”

...আর ভ্রমের বউ চোরাপ্রার্থনা দমবন্ধ করে বিড়বিড় করত তখন, “ভগবান! সেভাবে যেন দেখাই না হয় এদের কোনদিন!!”

এভাবে চলল কিছুদিন! তারপর হাঁটা লাগালাম! হাঁটতে হাঁটতে আমার রাস্তা শুকিয়ে, পাকিয়ে, রোগা হয়ে, আস্তে আস্তে হারিয়েই গেল...

তারই মাঝে নুইয়ে পড়া তালগাছ আর ধুইয়ে দেওয়া বৃষ্টি জিগেস করে গেল হঠাত্ একদিন...
“...স্কুলচত্বরে আগে সুর খেলা করত বুঝি? কই? দেখলাম না ত...”

থেমে থেমে বললাম, “নিশ্চয়ই কেউ গুছিয়ে রাখে নি...আমরা ফেলে এসেছিলাম...”

এই-নিকানো উঠোন আর ঝিকঝিকানো দিঘিরা জানিয়ে গেল...
“...আজকে আমরা অনেকখানি জটপড়া রঙচঙে সুতো দেখলাম, জানো...?”
মাথা নিচু করে জবাব দিলাম, “ভুল হয়েছিল, ভাই... সেসব জট খোলাই হয়নি...”

এসব শুনে একদিন কেমন জানি লাগল... আবার খুঁজতে গেলাম চিলেকোঠার ঘরটা অনেক ঝক্কি করে... গিয়ে দেখি যা যেটুকু ছিল তাও মিলিয়ে যাচ্ছে যেন... সেই যে আমাদের এককথায় সব কথা উড়িয়ে দেবার ক্ষমতাটা, সেটা মরে গেছে... হলদে ঘাসফুল গুলো যে বইটার পাতার ভাঁজে শুকাতে দিয়েছিলাম, এত্ত ভার চাপানো ছিল তার ওপরে যে কিচ্ছুটি বাকি নেই ফুলের...

চোখে জল আসতে যাবে... ঠিক তখুনি সেই যে সেই বদলে-যাওয়া-হাওয়া খবর নিয়ে এল...

দেবী কোন এক উঁচু পাহাড়ের শুনশান পাকদন্ডিতে একা বসে কাঁদে আজকাল...
সাগর রঙিন কাঁচ নিয়ে খুব খেলেছিল ক’দিন... এখন তার হাতে দারুন চোট লেগেছে...
রূপসা নদী হয়ে গেছে... ভুলে যাওয়াটা ওর কাছে শিখে নিতে পারিনি কোনোদিনও...
আর
সই একগলা বাড়বাড়ন্ত বানের জলে দাঁড়িয়ে বাঁকা হেসে বলেছে যে সে ভাল আছে... আমি ত জানি যে সই সাঁতার জানেনা!

সব শুনে চুপ করে বসে আছি, তখন হাওয়া বলল, “আর তুমি? তুমি কেমন আছ?”
কি আর বলবো? সত্যিটাই বলে দিলাম...

বললাম, “আমি এখানেই আছি! চারদিকে তো দেখছই খালি বালি আর বালি... ঠিক জানিনা এটা মরুভূমি নাকি কোথাও বিশাল সমুদ্র আছে ওপারে...! আমি প্রতিদিন হাঁটি... প্রতিদিন এমন রোদের ঘা পড়ে যে আর বলার নয়... এই রোদই নাকি লাজুক হয়ে মুখ লুকাতো আমাদের দেখে... বিশ্বাস হয় না...!! যা হোক, আমায় পার হতে হবে...ব্যাস! এইটুকু জানি... আপাততঃ হাতে আর কিছু নেই...
শুধু একখানা বালি-ঘড়ি... মাঝেমাঝে তার বালি কম-বেশি করে সময়ের হিসেবটা ইচ্ছে করে গোলমাল করে দিই...”

আমার কথা শুনে হো হো করে খানিক হেসে নিল হাওয়া... তারপর বলল, “ওদেরকে বলে দেবো এসব?”

ভাবলাম খানিক... তারপর বললাম, “ হ্যাঁ... বলে দিও... সব বলে দিও... বোলো যে আমি ভালো নেই... আর বোলো যে আমি জিগেস করেছি যে ... সেই আগের মতন বোকা হয়ে যাওয়া যায় না??”

কথাক’টা বলতেই হাওয়া মুখ ঘুরিয়ে চলে গেল... আর আমার বালিছোঁয়া আকাশটাকে ভিজিয়ে দিয়ে গেল পাহাড়-সাগর-নদী-বানের পাঁচমেশালি গন্ধে...

আপাততঃ একা আমিই রইলাম... সেইটুকু আঁকড়ে ধরে...!!

- Copyright © পাঁচমিশেলি - - Powered by Blogger - Designed by সায়ংতরী -