Archive for April 2013
তিন ফোঁটা বৃষ্টি
By : Sayantari Ghoshএক/মেঘদূত
ন’তলা লাইব্রেরী বিল্ডিং টার দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে বললাম, “...আর এই হল জে.এন.ইউ. এর সেই বিখ্যাত লাইব্রেরী... হল দ্যাখা? তুই ফর্ম তুলতে এসেছিস না জে.এন.ইউ. ঘুরতে বল তো?”
ইন্দ্র অনেকক্ষন লাইব্রেরীটার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইল; তারপর বলল, “...আর এই পুরো ন’তলা খালি বইয়ে ঠাসা... ভাবতে কি ব্যাপক লাগে, তাই না?”
বই নিয়ে আদিখ্যেতা ব্যাপার'টা আমি কোনোদিনই বুঝি না, তাই তেমন ‘ব্যাপক’ কিছু অনুভব করতে পারলাম না বটে, কিন্তু নতুন আলাপী ছেলে, তদুপরি যদি সে এক ভালো বন্ধুর ভালো বন্ধু হয়, দুম করে তার কথায় বাধ সাধা যায় না... তাই আমার সেই ল্যান্ডমার্ক হাসিটা হেসে দিলাম যেটার কোনো মানে হয় না... তারপর বললাম, “বাঁদিকের রাস্তাটা ধরি...? তোকে বাসে তুলে দেব টি-পয়েন্ট থেকে... সোজা আই.আই.টির গেটে নামাবে তোকে...”
“ওকে! দ্যাটস গ্রেট...! একটা কথা বলি রিনি, তোর হাসিটা কিন্তু দারুন... আর... আই সোয়্যার, আমার মাথার যা অবস্থা, তুই এখানে আমায় ছেড়ে গেলে আমি বেমালুম হারিয়ে যাবো...”
কথাটার আদৌ কোন অন্তর্নিহিত অর্থ আছে কিনা ভাবতে যাবো, এ সময় আলতো করে যোগ করল ইন্দ্র, “সো কনফিউসিং... দীস জে.এন.ইউ. রোডস আর...”
দুজনে লাইব্রেরীর পিছনের আঁকাবাঁকা রাস্তাটা ধরলাম... এ সময়টায় গোটা ক্যাম্পাস জুড়ে হলুদ রঙের একটা ফুল ফোটে... বড় বড় গাছে থোকা থোকা ফুল... নাম জানিনা সেগুলোর... তবে ভারি ভাল লাগে... একটা আলাদা স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে যায় আমার জংলা ইউনিভার্সিটি জুড়ে...
“এ ফুলগুলো বেশ, তাই না?” ইন্দ্র বলল, “আমাদের ক্যাম্পাসে লাগায় না কেন.......”
ওর কথা শেষ হল না... একটা বাজ পড়ল... বোধহয় খুব কাছেই কোথাও... আকাশে ছায়া ছিল সকাল থেকেই আজ...
“সর্বনাশ! বৃষ্টি নামাবে নাকি?” একরাশ বিরক্তি নিয়ে আকাশের দিকে তাকাল ইন্দ্র...
“সর্বনাশের কি আছে রে? হোক, হোক... কতদিন ভিজিনি... বৃষ্টি হয় এ দেশে...? হচ্ছে, তো তাতে এত বিরক্তি কিসের শুনি?!” আমার তিনমাসের জমা অভিমান ওর ওপরেই গিয়ে পড়ল, তারপর সামলে নিয়ে বললাম, “ইয়ে... তুই ছাতা এনেছিস? না হলে আমারটা নে... আই.আই.টি গেট থেকে তোর হস্টেল তো অনেকটা...”
“না না, ঠিক আছে...” মাথা নেড়ে বলল ও।
“এনেছিস কি ছাতা?” জোরালো প্রশ্ন!
“নাহ্!” এবার স্বীকারোক্তি।
তেরছা জলের ফোঁটাগুলো একে একে ছুঁতে শুরু করেছে তখন... ব্যাগ থেকে ছাতাটা বের করে দিলাম ওকে, “নে ধর!”
হাত বাড়িয়ে ছাতাটা নিয়ে বলল, “পরশু দেবু যাবেই তো আমার ওখানে... ওকে দিয়ে দেব... আর ইয়ে, থ্যাঙ্কস!”
পায়ে পায়ে টি পয়েন্ট বাসস্টপে এসে পড়লাম... একে উইক ডে, দুপুর দুটো, তায় বৃষ্টি আসছে... বাসস্টপ একেবারে খালি...
“তুই যাবি কি করে?” হাওয়া আর জল দুয়ের তেজ বাড়ছে দেখে ধীরে ধীরে জিগেস করল ইন্দ্র, “হস্টেল ঢোকার আগেই নেমে যাবে মনে হচ্ছে তো... ভিজে যাবি যে...!”
আমি একগাল হেসে বললাম, “ভিজবোই তো! আমি তোকে বাসে তুলে, চটি খুলে হাতে নিয়ে, চন্দ্রভাগা হয়ে ঘুরে ঘুরে হস্টেলে ফিরবো... আজ নামুক বৃষ্টি... খুব ভিজবো...!!”
“ওফ্! আবার সেই সব্বোনেশে হাসি!”
“ধুর!” হেসে বললাম আমি।
“ওই তো আবার!”
“এ্যাই! চুপ কর তো...! যা, হাসবো না আর...”
কড়কড় করে আরেকটা বাজ পড়ল।
“এই রিনি, তুই চলে যা... আমি বাস এলে চলে যাবো...” আকাশের দিকে তাকিয়ে ভীষণ ভুরু কুঁচকে বল ইন্দ্র।
“মানে? এরপর যদি তুই হারিয়ে যাস, বা একা পেয়ে কেউ তোকে কিডন্এযাপ করে ফ্যালে, তখন দেবু বাবাজি যে এসে আমাকে চেপে ধরবে, তার বেলা? "
"যা না বাবা... চলে যা..."
একটু কড়া করেই বলল যেন। আচমকা এমন কথা শুনে একটু অবাকই হয়ে গেলাম, "এমন কি বললাম বাবা, যে তুই এত্ত রেগে গেলি... ওকে, চলে যাচ্ছি, টা টা...”
“রেগে? রাগতে যাবো কেন? রিকোয়েস্ট করছি... এমন কাজলা দিন, বৃষ্টি'টা জমিয়ে নেমেছে, রাস্তা'টা হলুদ ফুলের পাপড়ি মেখে একটা দারুণ রোম্যান্টিক ব্যাকগ্রাউন্ড রেডি করে বসে আছে... এর মাঝখান দিয়ে তুই ভিজতে ভিজতে যা না...! আমি একটু দেখি...”
“ধ্যাত্!!”
........................................................................................
সেদিন সত্যিই চূড়ান্ত ভিজে ফিরেছিলাম হস্টেল... অতসী ঘরের দরজা খুলে রেগে গিয়ে চিত্কার করে উঠেছিল, “আবার সখ করে ভিজেছিস?! হাজার বার বলেছি না অসুখ করলে আমি তোকে দেখতে পারব না... কথা কানে...”
ওর কথা কানে না নিয়েই ওর গলা জড়িয়ে ধরেছিলাম... খুব খুব হেসেছিলাম ওকে জড়িয়ে ধরে... ও প্রাণপণে চেঁচাচ্ছিল, মনে আছে, “ছাড় ছাড়! দিলো রে, আমাকেও ভিজিয়ে দিলো...!!”
আমিও মনে মনে বলেছিলাম... আমাকেও ভিজিয়ে দিলো... আমাকেও ভিজিয়ে দিলো...
দুই/বৃষ্টিনেশা
রাত হলে শ্রীরাম সেন্টর থেকে ফেরা এত মুশকিল হতে পারে, ভাবিনি...!
ফোক ডান্স-এর শো ছিল একটা, আমার থিয়েটার পেপারের প্রজেক্টের পার্ট ছিল এটার রিভিউ সাবমিশন... শো শেষ হয়েছে পৌনে এগারোটায়; বারোটা বাজতে চলল, একটা ফিরতি অটো নেই কোত্থাও...!! আর তার কারণ বোধহয় এই ছিপছিপ বৃষ্টিটা...! ধুর! আজকেই নামতে হল...!? দিল্লি শহরে অগুনতি দিন অসংখ্য বার আকুল প্রার্থনা করেছি এক পশলা বৃষ্টির... তখন কোথায় কি? আর আজ... এই অক্টোবরে, রাতদুপুরে... নাহ্! জ্বালালে...!
“ছটফট করছিস কেন?” দোকানটার বন্ধ শাটারে হেলান দিয়ে বলল ইন্দ্র, “আর একটু ওয়েট কর... বৃষ্টিটা থামলেই পেয়ে যাবো কিছু একটা...”
“আরো ওয়েট??!” আমার বিচ্ছিরি লাগছিল, শীতও লাগছিল খুব, “বারোটা বাজল... হস্টেলে ইনটাইম নেই মানে কি যা খুশি তাই...? রাত বারোটা, ইন্দ্র...! ধ্যাত্ ! আমার ভাবতেই কেমন লাগছে... অতসী খুব বকা লাগাবে আমায়... দেবু'টা যখন আসতে পারল না আজ, তখন থেকেই কেমন একটা যেন লাগছে আমার...”
“আররে! দেবু আসতে পারে নি সেটা খচখচ করছে এখনও... আর আমি যে এলাম? তার বেলা?”
গলার স্বরে ও কি? অভিমান মনে হল? একটু হাসি এম্নিই চলে এল ঠোঁটে, “তুই যে আসবি, আমি জানতাম...”, বললাম থেমে থেমে।
“তাই? সত্যি? আগে বলিস নি তো?”
এর কোন উত্তর হয় কি? ভাবছি... এমন সময় অটো-গোছের একটা কিছুকে দেখে সব ভাবনা গুলিয়ে গেল... দরদামের পথে না গিয়ে উঠে পড়লাম দুজনে। বৃষ্টিও ততক্ষনে জোর এসেছে... অটোর দু’পাশ দিয়ে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে আসছে অতি উত্সাহী হিম-ছোঁয়ানো জল... মাঝখানের একটু শুকনোতে ঠাঁই নিলাম দুজনে...
দুজনেই ভিজে যাচ্ছি, বেশ বুঝছিলাম, কিন্তু বাঁচার বা বাঁচানোর উপায় জানা নেই যে...!
কোন কথা হল না! একটা কথাও না! শুধু বৃষ্টির মাতাল-মল্লার আর অটোওয়ালার এফ.এম-এ খুব নিচু স্বরে রাতজাগা মিঠে গান... একটার পর একটা...
অটো জে.এন.ইউ. এলো প্রথমে। তাপ্তী হস্টেলের গেটে আমার পিছু পিছু ইন্দ্রও নেমে এল। বৃষ্টি একটু ধরেছে ততক্ষনে...
“এই দ্যাখ! এসে গেলাম তো তাহলে... তখনই বলছিলাম ছটফট করিস না... ক’টা বাজে দেখি?” মোবাইলে সময় দেখে একটু হাসল ইন্দ্র, “শোন, অতসী কে বলিস যে আমি এসেছিলাম তোকে ছাড়তে... আর বলিস একটু কম চেঁচাতে... বুঝলি?”
হাসলাম আমি। বললাম, “বেশ! তাই বলে দেবো ওকে...”
“চলি তাহলে? ঘুমিয়ে পড় গে যা... গুড নাইট...”
“সাবধানে যাস... গুড নাইট!”
অটোটা তাপ্তীর সামনে থেকে শার্প টার্ন নিয়ে রিং রোড ধরা অব্দি সিঁড়িতেই দাঁড়ালাম আমি। তারপর পা বাড়ালাম রুমের দিকে... তখুনি মোবাইলে ছোট্ট কাঁপুনি... মেসেজ... হ্যাঁ... তারই বটে...
........................................................................................................
“Not everything should be said clearly...Not everything could be touched distinctly...
Many of them are better felt than told...
Like Faith.
Like Love.
Like God.”
........................................................................................................
আচ্ছা, মাঝেমধ্যেই রাতবিরেতে এরকম বৃষ্টি হতে পারে তো...! দিব্বি হয় তাহলে...!
তিন/একদা নিদ্রাহীন রাতে
ন’টা বেজে যাওয়ার পরও আমি রাতের খাবার খেতে গেলাম না দেখে অতসী উঠে এসে কপালে হাত ছোঁয়াল, “কই রে? জ্বর-টর নেই তো দেখছি... খাবি না? একটু কিছু এনে দিই মেস থেকে...? খেয়ে নে...?”
আমি শুয়ে শুয়ে চোখ না খুলেই মাথা নাড়ালাম। খাবো না।
“কেন?”, কারন খুঁজে বেড়ানোটা ফিজিক্সের লোকেদের বদ অভ্যাস, “কি হয়েছেটা কি?”
“কিছু না” এবার মুখ খুলতেই হল, “মাঝে মাঝে উপোস দেওয়া ভাল... তুইই তো বলছিলি সেদিন...”
“হ্যাঁ, তা ভাল... কিন্তু এরকম পাংশুটে মুখ করে, উপুড় হয়ে খাটে শুয়ে উপোস দিতে বলেছি বলে তো মনে পড়ছে না...”
ওহ্! অতসীটা না... খুব তাড়াতাড়ি রেগে যায়...! আসলে ভালবাসে খুব... তাই... ওকে শান্ত করতে গেলে আবার উলটে রেগে গেলে চলে না...
“আচ্ছা বেশ, তাহলে উঠে বসে গল্পের বই পড়ি... তাহলে চলবে তো?” হেসে জিগেস করলাম।
“যা খুশি কর গে যা... আমি পেরিয়ার চললাম, কাল অ্যাসাইনমেন্ট সাবমিট করতে হবে আমায়... খিদে পেলে ফোন করিস, কিছু কিনে নিয়ে ফিরব তাহলে...”
ওর সেই ধুমসো নীল ব্যাগটা ঘাড়ে ফেলে দরজা টেনে বেরিয়ে গেল অতসী। পরক্ষনেই আবার দরজা ঠেলে ঢুকলো, বলল, “বাব্বা! কি গুমোট করেছে রে... খুব মেঘ করেছে... ছাতা নিয়ে বেরোই, বুঝলি?”
“হুঁ...” কতকটা না শুনেই সায় দিলাম আমি।
অতসী বেরিয়ে গেল সব গুছিয়ে নিয়ে। আমি শুয়েই রইলাম খানিকক্ষণ। একবার মনে হল আলোটা নিভিয়ে দিই উঠে... আর তারপরই সন্ধ্যেবেলার ফোনটার টুকরো-টুকরো ক’টা লাইন ঘুরপাক খেতে লাগল গোটা ঘরটা জুড়ে... আলো নেভানোর কথাটা ভুলেই গেলাম নিমেষে...
এরকম কেন হল? কেন হল এরকম?
ইন্দ্র আগেই বলে দিতে পারত পিয়ালীর কথা। প্রথমেই বলে দিতে পারত... এতদিন বাদে... এভাবে বলার কি মানে হয়?
আমি নাকি ওর কাছে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ...
আমি নাকি ওর সবচে' কাছের বন্ধু...
আমাকে নাকি ও ভরসা করে, অসুবিধায় পড়লে আমার কথাই নাকি মনে হয় ওর...
ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ আমি...!! ওর নভেলের ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ দ্বিতীয় অধ্যায়...!
নিজেকে ধুলোয় মিশিয়ে দিতে ইচ্ছে করল যেন... এত গুরুত্ব চাই না, ইন্দ্র... রেখে দে তোর বইয়ের তাকে সাজিয়ে, অন্য কাউকে দিস বরং, সে হয়তঃ মাথায় করে রাখবে... এ গুরুত্বের মানে বোঝার মতন অত বুদ্ধি আমি ধরি না রে... একটা তল-না-পাওয়া কুয়োর মধ্যে পড়ে যাচ্ছি মনে হল... দমবন্ধ করা অন্ধকার... শ্বাস নিতে চাইছি, আর কেউ যেন মুখ চেপে ধরছে প্রতিবার...
তখুনি জানলার পর্দাটা আলতো করে হাত বোলালো হাতে... একমুঠো স্বস্তির মতন একটা ঠান্ডা হাওয়া ছুট্টে বুকের ভিতর ঢুকে পড়ল ফাঁক পেয়ে... চন্দ্রভাগার ওপাশের জঙ্গল থেকে কি একটা নাম-নেই ফুল বেহিসেবী গন্ধ বিলিয়েছে আজ হাওয়াতে...
ঘড়ি দেখলাম। রাত সাড়ে এগারোটা... ঘর বন্ধ করে লনে চলে এলাম পায়ে পায়ে... দোতলার কার্ণিশে একটানা ‘কেয়া কেয়া’ বলে ডাকছে একটা ময়ুরী... অঝোরে বৃষ্টি নেমেছে... কারো ওপরে চরম অভিমানে মেঘের আদুরে মেয়ে রাত্রিবেলায় কাঁদতে বসেছে পা ছড়িয়ে... কি সুন্দর কাঁদতে পারে ও, তাই না? মনখারাপে, যন্ত্রণায় অবিশ্রান্ত কান্নায় সারা পৃথিবী ভাসাতে পারে ও...
আর আমি? আমি খালি হেসে উড়িয়ে দিতে পারি। আমার সব্বোনেশে হাসি ...!!
আমি খালি বলতে পারি, “ওভাবে বলিস না... নিজেকে কষ্ট দিস না...”
খালি বলতে পারি, “তোর কোনো ভুল হয় নি রে... দায় আমার... শুধু আমারই..”
ফাঁকা লনে একা দাঁড়িয়ে রইলাম... মনে হল হাতে-চোখে-বুকে যত কালি জমেছিল, সব ধুয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে... চোখের পাতায় আঙ্গুল ছুঁইয়ে, খোলা চুল ভিজিয়ে দিয়ে, ওড়না খসিয়ে দিয়ে আরো জোরে, ভীষণ জোরে বৃষ্টি নামল...
আমায় খেলা নে বৃষ্টি...! আজকে খেলা নে...! আজকে খেলা নে...!
Tag :
এমনি গল্প,
কবেকার গল্প,