Archive for January 2016
পথচলতি / এক
By : Sayantari Ghoshতখন দিল্লীতে থাকি। চাকরির খোঁজে এদিকওদিক উঁকিঝুঁকি মারছি। এমন সময় একদিন চিঠি এসে পৌঁছালো যে গুজরাতের এক শিল্পশহরে চাকরির খোঁজ পাওয়া গেছে, ডাক পড়েছে ইন্টারভিউয়ের। তখন ক্যাম্পাসে থাকতাম; এসব জায়গায় দরখাস্ত পাঠানো হত সব বন্ধু’রা মিলে দল বেঁধে। খোঁজ নিয়ে জানলাম, চিঠি এসেছে তিনজনের নামে। সবচে’ মজা হল এইটে দেখে যে আসা-যাওয়ার খরচখরচাও সব নাকি তাঁদের। থাকার ব্যবস্থাটুকু খালি নিজেদের করতে হবে! আনন্দে উত্ফুল্ল হয়ে উঠলাম। চাকরি যে সক্কলে পাবো না তা দিব্বি বোঝা গেলেও অন্যের খরচায় সদলবলে দেশভ্রমণের সুযোগ কি আর সবসময় মেলে? সাত্তাড়াতাড়ি ট্রেনে টিকিট বুক করে ফেললাম।
দিল্লী সরাই থেকে ট্রেন ছাড়ার দিন ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। সবাই বলে দিল্লী নাকি এম্নিতে বৃষ্টির দেশ নয়, কিন্তু এখন কলকাতায় যা বৃষ্টি হয়, তারচে’ ঢের বেশী বৃষ্টি হত দিল্লীতে তখন, এখনও হয় নিশ্চয়ই। ভূগোলের মানুষেরা তার কি কারণ দেখাবেন জানিনা, তবে ঘটনাটি শতকরা একশভাগ সত্যি। সে যা হোক গে, কোনরকমে ইন্টারভিউয়ের চিঠি আর সার্টিফিকেটের গোছাটিকে ছাতায় আড়াল করে আপাদমস্তক ভিজে ট্রেনে উঠলাম। বৃষ্টির চোটে যাত্রীদের সাথে সাথে তাদের সঙ্গে আসা যাত্রীপিছু চারজন করে আত্মীয়স্বজনও ট্রেনে উঠে পড়ায় পোরবন্দর এক্সপ্রেস পৃথিবীর সর্বাধিক ঘন জনবসতিপূর্ণ অঞ্চলে পরিনত হয়েছে ততক্ষণে! মানুষজনের হাতের নিচ দিয়ে, ঘাড়ের ওপর দিয়ে একহাত গলা বাড়িয়ে দিয়ে আমরা থ্রি মাস্কেটিয়ার্স নিজেদের বার্থ খোঁজার চেষ্টা করছি প্রাণপণে... তখনই... পাশের লোয়ার বার্থটি থেকে এক অতি মোলায়েম আদুরে গলায় কে যেন বলে উঠল, “হুইচ্ বার্থ...?”
আমি কন্ঠস্বরের উত্সটিকে ঠিকমত খুঁজে ওঠার আগেই সিধু মরিয়ার মত চেঁচাল পিছন থেকে, “থার্টি টু টু থার্টি ফোর...!!”
“দিস ওয়ে দেন... নেক্সট টু মি...”
আমি কন্ঠস্বরের উত্সটিকে ঠিকমত খুঁজে ওঠার আগেই সিধু মরিয়ার মত চেঁচাল পিছন থেকে, “থার্টি টু টু থার্টি ফোর...!!”
“দিস ওয়ে দেন... নেক্সট টু মি...”
ফাইলপত্রদের বুকে আগলে আদুরে গলার ভদ্রলোকের পাশের বার্থে গুছিয়ে বসতে আরো মিনিট দশেক লাগল।
“থ্যাঙ্কস...” রুমাল দিয়ে চুলের জল মোছার বৃথা চেষ্টা করতে করতে মিত বলল।
“বাঙালি...?” একগাল হেসে ভদ্রলোক বললেন!
আমরা তো অবাক! সমস্ত বাঙালিই বাঙলার বাইরে জাতভাই দেখলে যারপরনাই খুশি হয়ে ওঠে। ট্রেন ছাড়ার আগেই দিল্লীর বৃষ্টি, আত্মীয়দের ভালোবাসা আর সুটকেসে চেন লাগিয়ে রাখা নিয়ে আড্ডা শুরু হয়ে গেল।
“থ্যাঙ্কস...” রুমাল দিয়ে চুলের জল মোছার বৃথা চেষ্টা করতে করতে মিত বলল।
“বাঙালি...?” একগাল হেসে ভদ্রলোক বললেন!
আমরা তো অবাক! সমস্ত বাঙালিই বাঙলার বাইরে জাতভাই দেখলে যারপরনাই খুশি হয়ে ওঠে। ট্রেন ছাড়ার আগেই দিল্লীর বৃষ্টি, আত্মীয়দের ভালোবাসা আর সুটকেসে চেন লাগিয়ে রাখা নিয়ে আড্ডা শুরু হয়ে গেল।
কিন্তু ট্রেন ছাড়ার পর, ব্যাপারটা ঠিক অত সহজ রইল না আর। একঘন্টার মধ্যে আমরা বেশ বুঝতে পারলাম যে এই ভদ্রলোকের সাথে তাল মিলিয়ে কথা বলার মত ক্ষমতায় পৌঁছাতে আমাদের অন্ততঃ সাড়ে পাঁচবছর একনিষ্ঠভাবে চেষ্টা করতে হবে!! ভদ্রলোকের নাম গোপাল বাগচি, থাকেন বেরসরাইয়ের কাছে, বইয়ের দোকান আছে, তাঁর দুই মেয়ে, মেয়ের শ্বশুরবাড়ি গোয়ালিয়রে, কিন্তু তিনি যাচ্ছেন আমেদাবাদে... কেন? কারণ আহমেদাবাদে তাঁর দিদির বাড়ি, দিদির মেয়ের এইবারে বিয়ে দেওয়া উচিত, সেজন্যে সে স্পোকেন ইংলিশের কোর্স করছে, ইংরেজি ভাষাটাকে আমাদের দেশে অতিরিক্ত পাত্তা দেওয়া হয়, দেশের ভবিষ্যত্ একেবারেই সুবিধের নয় ইত্যাদি এবং প্রভৃতি এবং ইত্যাদি... ভয় পাওয়ার মত কথা হল যে এই প্রতিটি ব্যাপার নিয়ে বেশ বিস্তারিতভাবেই বলতে উনি ঘন্টাখানেকের কিছু বেশি সময় নিয়েছিলেন! ভদ্রলোক অন্ততঃ জাপানিজ বুলেট ট্রেনের গতিবেগে কথা বলতে পারেন, শব্দের তীব্রতা ১০০ ডেসিবেলের কাছাকাছি। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হল যে এত শক্তিব্যয়েও উনি মোট্টেই ক্লান্ত হন না, বরং এই কাজটিকে দিব্বি উপভোগ করেন!
ফলতঃ দুপুরনাগাদ আমরা যখন যে যার বার্থে কোনোরকমে একটু ঘুমিয়ে কানদুটিকে রেহাই দেওয়ার কথা ভাবছি তখন “রাত্তিরে নামা কিন্তু... রাত’টা বরং আজ আমরা আড্ডা মেরেই পার করে দেবো, কি বল?” এই প্রস্তাব শুনে আমার অন্ততঃ বুকের ভেতর অব্দি কেঁপে গেছিল স্বীকার করতে আপত্তি নেই! ততক্ষণে আমার দৃঢ় বিশ্বাস হয়ে গেছে যে ইন্টারভিউয়ের একটি প্রশ্নও আমি আর শুনতে পাবোনা আর শুনতে পেলেও তার উত্তর দিতে গিয়ে হয়তঃ গোপালবাবুর কাজের লোক বা পড়শির নিন্দে করে ফেলব!
টাইমটেবিল বলছে আমাদের স্টেশন আসবে সাড়ে বারোটায়, আর রাত দুটোয় ট্রেন আহমেদাবাদ পৌঁছানোর কথা। কিন্তু ইতিমধ্যে ট্রেন প্রায় ঘন্টাদেড়েক লেট করে গেছে। ঘুমানো একটু যেত, কিন্তু গোপালবাবু দায়িত্ব নিয়ে আমাদের পৌনে বারোটায় উঠিয়ে দিলেন। আমরা থম মেরে বসে আছি পাশাপাশি, ঘুম ভালো কাটেনি, তখন হঠাত বলে উঠলেন, “আহমেদাবাদে তো আমি মাঝেমধ্যেই যাতায়াত করি, আমার এক-দুটো চেনা হোটেল আছে, তোমরা বরং আহমেদাবাদ'ই চল, এই তো সোয়া ঘন্টার রাস্তা... ওখানে তোমাদের থাকার ব্যবস্থা করে দেবো বরং... আমার দিদির বাড়ির কাছাকাছিই কত হোটেল...! তোমরা তো দু’দিন থাকবে বলছ... এইটুকুনি রাস্তা এসে ইন্টারভিউ দিয়ে যাবে না হয়... আহমেদাবাদে থাকলে দেখাসাক্ষাত্ হবে আবার... দিদির বাড়িতে বসে জমিয়ে আড্ডা মারা যাবে...”
‘আড্ডা’ শব্দ’টা শুনলেই তখন মাথা ঘুরে যাচ্ছে, মনে হচ্ছে যেন সাঙ্ঘাতিক লো-প্রেসার হয়ে গেছে! ইনারশিয়ার বশে মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, “না না...”
মিত আমার দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বলল, “না... মানে আমাদের বুকিং হয়ে গেছে... আমরা... মানে...”
“বুকিং করেই এসেছি আমরা... হ্যাঁ...” মিথ্যে কথাটায় বেমালুম সায় দিল সিধু। এই ব্যাপারটায় আমরা এককাট্টা দেখে মন’টা ভালো হয়ে গেল। আসলে সবাই নিজের কানদুটিকে ভালোবাসে...
মিত আমার দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বলল, “না... মানে আমাদের বুকিং হয়ে গেছে... আমরা... মানে...”
“বুকিং করেই এসেছি আমরা... হ্যাঁ...” মিথ্যে কথাটায় বেমালুম সায় দিল সিধু। এই ব্যাপারটায় আমরা এককাট্টা দেখে মন’টা ভালো হয়ে গেল। আসলে সবাই নিজের কানদুটিকে ভালোবাসে...
গোপালবাবু আড্ডার সম্ভাবনা ভেস্তে যাওয়ায় দুঃখ পেলেন ঠিকই, কিন্তু আমাদের তো হাত পা (কান?) বাঁধা... তাই স্টেশনে নেমে গোপালবাবুকে ‘বাই বাই’ করে আমরা নিঝ্ঝুম স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম ধরে পা বাড়ালাম। তখন ভোররাত, মিটমিটে আলো দপদপ করছে প্ল্যাটফর্মে, দোকানগুলোর সব ঝাঁপ বন্ধ, হালকা শীতের আমেজে জড়সড় হয়ে কুন্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে কয়েকটা কুকুর, কোনো মানুষের হদিস কোথাও নেই।
স্টেশনচত্বরেই আমাদের তিনজনের ব্যাগগুলোকে জড়ো করা হল এক জায়গায়... আমাদের ইন্টারভিউ দুপুর একটায়, ইচ্ছে ছিল হোটেলে উঠে একরাউন্ড ঘুম দিয়ে বেরিয়ে পড়ব... ঠিক হল সিধু মালপত্র পাহারা দেবে, আর আমি মিতের সাথে যাবো হোটেলের খোঁজে। সিধুর টাকাপয়সার ব্যাপারে খুঁতখুঁতুনিটা পুরোনো। সে পইপই করে বলে দিল যে দালালের খপ্পরে পড়া চলবে না কোনোমতে, তাতে হোটেলে ডবল ভাড়া লেগে যাবে!!
আমার এসব ব্যাপারে অনেক অভিজ্ঞতা... প্রচুর বেড়িয়েছি বাড়ির সবাইকে নিয়ে... চারটে বেজে গেছে দেখে আমরা দুইমূর্তি আত্মবিশ্বাসী পা রাখলাম স্টেশনের বাইরে। হোটেল ঠিক করে আধঘন্টার ভেতর ফিরব, সিধুকে এই আশ্বাস দিয়ে গেলাম যাবার আগে।
আমার এসব ব্যাপারে অনেক অভিজ্ঞতা... প্রচুর বেড়িয়েছি বাড়ির সবাইকে নিয়ে... চারটে বেজে গেছে দেখে আমরা দুইমূর্তি আত্মবিশ্বাসী পা রাখলাম স্টেশনের বাইরে। হোটেল ঠিক করে আধঘন্টার ভেতর ফিরব, সিধুকে এই আশ্বাস দিয়ে গেলাম যাবার আগে।
আমি ভুল ভাবিনি। হোটেল ঠিক করার অভিজ্ঞতা আমার কম না। কিন্তু এবারটায় কে জানে কেমন সব গোলমাল হয়ে গেল! যে হোটেলেই গিয়ে আমি আর মিত জিগেস করতে যাই, “রুম আছে নাকি দাদা...?” দেখি যে তারা ভয়ানক সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকায়... আমাদের আপাদমস্তক দেখে এবং গম্ভীরভাবে মাথা নিচু করে ঘাড় নেড়ে দেয়... এক জায়গায় এক বয়স্ক হোটেলমালিক তো আরেককাঠি ওপরে উঠে প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে গুজরাটিতে চেঁচামেচি (গালাগালিও হতে পারে) করতে লাগলেন... মনে হল হাতের কাছে সের’ম কিছু পেলে ছুঁড়ে মারতেও বাধতো না ওনার...
মুশকিল’টা হয়েছিল অন্য জায়গায়। আমি হোটেল ঠিক করেছি দিনের বেলায়, ভদ্রস্থ সময়ে, বোন কিম্বা বাবার সাথে গিয়ে... বর্তমান পরিস্থিতি যে তারচে’ কত আলাদা সে আর ভাবিনি... ভোর চারটে বাজে... কিন্তু জায়গাটা তো গুজরাত...! আলো ফোটেইনি প্রায়... স্টেশনের বাইরেটা এম্নিতেই যথেষ্ট ঘিঞ্জি... খুপরি খুপরি ছোট ছোট দোকান... ফুটপাথে ছড়ানো গৃহস্থালি... আমাদের শিয়ালদার আশপাশের মত কতক’টা... তখনও রাতের স্ট্রিটলাইট জ্বলছে... রাস্তায় এখানে সেখানে সারাদিন সারারাতের ধকলে ক্লান্ত মাতাল রিক্সাওয়ালা আর কুলিরা মনমৌজি হয়ে গান ধরেছে... হোটেলওয়ালারাও ব্যাতিক্রম না... তারা হয় ঘুমন্ত, না হয় রাতজাগা... পরে সিধু বলেছিল, যে এই রকম পরিস্থিতিতে মালপত্রহীন দুটি ছেলেমেয়ে'কে হোটেলের খোঁজ করতে দেখে অজস্র গোলমেলে কথা ভাবার অগাধ সুযোগ ছিল (ও আসলে যে শব্দ’টা বলেছিল সেটা হল ‘রসালো’, আরো অনেককিছুই বলেছিল সে’সব আমি আর লিখলুম না)...
হোটেল পেতে পেতে সেদিন ঘন্টাদুয়েক লেগেছিল প্রায়। শেষ অব্দি আমাদের জে.এন.ইউএর আই-কার্ড আর ইণ্টারভিউএর চিঠি নিয়ে হোটেলের দরজায় দরজায় ঘুরতে হয়েছিল, মনে আছে। আর ততক্ষণে সিধুর ‘প্রাণের ধন’ দালালের দল ওর কানের কাছে শ'খানেক হোটেলের খবর আর ভাড়ার ফিরিস্তি শুনিয়ে গেছে। দালালবিদ্বেষের চূড়ান্ত প্রমাণ রেখে সে হতচ্ছাড়া একবারও আমাদের ফোন করে ডাকেনি... আর আমরা পাগলের মত হোটেলমালিকদের বোঝানোর চেষ্টা করছিলাম যে আমরা ‘খালি’ ইন্টারভিউ দিতেই এসেছি...
সত্যি বলতে কি, সেইসময়টাতে গোপালবাবুকে খুব মিস করছিলাম... মনে হচ্ছিল, ভদ্রলোকের চেনা হোটেলে গেলে মন্দ হত না, তাই না...? এতক্ষণে বেশ আরাম করে ঘুমিয়ে পড়তাম... আর বিকেলে, ইন্টারভিউ থেকে ফিরে... আড্ডা...?
Tag :
পথচলতি গল্প,