Archive for March 2015
হাওয়াঘন্টি
By : Sayantari Ghosh“মেজর চার্লস ক্রস্বি...? তাই তো...?” আরেকবার জিগেস করলাম আমি।
“ইয়াপ্, তাই...” বলে কবরগুলো থেকে চোখ তুলে আমার দিকে তাকালো
রিদ্ম্, “ফিলিং টায়ার্ড,
না?”
আসলে তাই! সকাল
সাতটায় ঢুকেছি সঞ্জৌলি গোরস্থানে; এখন মাথায় ওপর চনচন করছে রোদ... ঘড়ির কাঁটা
বারোটা পেরিয়ে গেছে...
কাল এসেছি
সিমলায়। চন্ডীগড়-সিমলা যাতায়াত'টা আমি আর রিদ্ম্
ইচ্ছে হলেই করে থাকি... উইকএন্ড, অফিসে ছুটি,
সেলিব্রেশন বা মনখারাপ...
গাড়ি বের করে সোজা সিমলা! তবে হুজুগটা বেড়েছে রিসেন্টলি... যবে থেকে এই জিনিওলজির
ভূত'টি এসে রিদ্মের মাথায়
চেপেছে! বোধহয় একটা পুরোনো ডায়েরি থেকে শুরু হয়েছিল ব্যাপারটা... তারপর এখন নিজের
পরিবারের ইতিহাস ঘেঁটে দ্যাখাটা শখ হয়ে গেছে রিদ্মের; আর পুরোনো জায়গায় ঘুরঘুর করতে চাইলে আমার ঝুলে
পড়তে আপত্তি থাকেনা কখনই.....
তিনদিন আগে থেকে
এই চার্লস ক্রস্বির নামটি মাথায় ঢুকেছে ওর। বুধবার রিসেস আওয়ারে দুম করে আমার
ক্যাবিনে ঢুকে এক গাল হেসে বলল, “তোর বর পাওয়া
গেছে রে...!” সত্যি বলতে কি, শোনামাত্র আমার বুকের ভেতর ধুকপুকুনি বেড়ে গেছিল! বলে কি ছেলেটা? প্রপোস'টা এভাবে করবে বুঝি? মাথা'টা কি খারাপ হয়ে গেল একেবারেই ওর? এক মিনিট পরে থতমত ভাবটা কাটিয়ে উঠলাম যখন রিদ্ম্ খোলসা করে বলল গল্প'টা। পুরো'টা শুনে মজা পেলাম ঠিক'ই, কিন্তু ভেতর ভেতর নিজেকে বড্ড বোকা মনে হচ্ছিল। হপ্তাখানেক আগে ভ্যালেন্টাইনস ডে'র দিনও এই একই রকম পাগলামি করছিল মন'টা! নিজেকে একটা আস্ত হাঁদাগঙ্গারাম মনে হল। প্রপোস-টোপোস কত কি ভেবে ফেলেছিলাম, ধূর!
রিদমের গল্পের মুখ্য ভূমিকায় আছেন এই চার্লস ক্রস্বি বলে ভদ্রলোক'টি। সম্পর্কে ওর ঠাকুর্দার মাসতুতো ভাই... প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় সিমলায় পোস্টিং ছিল তাঁর... সারা
সিমলায় ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীর হত্তাকত্তাদের মধ্যে মেজর ক্রস্বির নামযশ ছিল নাকি
খুব... বাড়ির বাতিল কাগজের স্তূপের কোত্থেকে জানি রিদ্ম্ একখানা ঘষে যাওয়া হলদেটে ছবি পেয়েছে... চাড়া-দেওয়া
গোঁফের ক্রস্বি সাহেব আর তাঁর সদ্যবিবাহিতা স্ত্রী'র... রিদ্মের চাপাচাপি’তে মানতে বাধ্য হলাম মেজর সাহেব যতই জাঁদরেল চেহারার হোন না কেন, ভদ্রমহিলাকে সত্যি সত্যি অনেকটাই আমার মতন দেখতে... ব্যাস, ছেলে খেপে উঠলো একেবারে, “চল না এই উইকএন্ডে ঘুরে আসি একবার, জাস্ট দ্য সেমেটারিস্... উই উইল লুক ফর এ
হোয়াইল অ্যান্ড কাম ব্যাক...”
ঘ্যানঘ্যান করলে
ওকে 'না' বলতে পারিনা কখনও... কে জানে কেন... মোক্ষম
ব্যাপারটা হল, রিদ্ম্ ডাকলে
আপত্তি করার ক্ষমতাই থাকেনা আমার... মনে হয় সারাটা জীবন যদি এভাবে হুঠহাঠ ওর সাথে
বেরিয়ে পড়া যেত...... ধুর! সেসব কথা ওকে বলাই হয়না আমার... ডিয়ারেস্ট কলিগ,
বেস্ট ফ্রেন্ড এই বেশ
ভালো আছি... কি দরকার ঝামেলা বাড়িয়ে...
যাগগে সেসব
কথা... উইকএন্ড এসে পড়তেই তাই কাল বেরিয়ে পড়েছিলাম... আর আজ অভিযান সঞ্জৌলি...
“লেট্স্ গো
ব্যাক দেন ফর নাও,” আমার মুখের দিকে
তাকিয়ে রিদ্ম্ বলল, “তোকে খুব ক্লান্ত
দ্যাখাচ্ছে...”
“ওক্কে...” আমি হেসে বললাম, “একটু বসে নিই? এক্কেবারে হাঁফিয়ে গেছি...”
একটা বিশাল
রডোডেন্ড্রনের নিচে বসলাম পা ছড়িয়ে। জায়গাটা এম্নিতে বেশ চুপচাপ, তারসাথে গলাজড়াজড়ি করে রয়েছে একটা পুরোনো
গন্ধ... সারসার পুরোনো পাথর আর আদ্যিকালের পাহাড়ি গাছেদের ভিড়... মানুষগুলো
ঘুমোচ্ছে কে জানে কবে থেকে... ডরোথি ড্যালি, ১৯২৯... ব্যারনাবি মারফি, ১৯৩৪... উইলিয়ম ক্যাহিল, ১৯৩৮... সবাই অঘোর ঘুমে... আগে হয়তঃ প্রতি
সপ্তাহে কেউ দেখা করতে আসত... একটা গোলাপ ফুল রেখে যেত ঘুমিয়ে পড়া বুকের ওপর...
ছুঁয়ে বসে থাকত... কেঁদে যেত অঝোরে... তারপর কতযুগ, কতযুগ পেরিয়ে গেছে... আর কেউ আসেনা... কেউ আসে
না...
ঝুপ করে আচমকা একটা
শব্দ হল আমার ঠিক পিছনে! খেয়ালে এমন ডুবেছিলাম যে ভেতর অব্দি কেঁপে গেল আওয়াজ'টায়... উঠে
দাঁড়িয়ে পড়লাম হুট করে...
“হেই... হোয়াট
হ্যাপেন্ড্?” রিদ্ম অবাক হয়ে
বলল, “এনিথিং রং?”
জানিনা...!
পিছনের ঝোপটার দিকে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ... অন্ধকার করে রয়েছে সাদা ফুল ফোটানো
একটা বুনো লতা... আর... আর যেন তার ওপাশ থেকে কেউ দেখছে আমাকে... মনে হল ঝুপসি হয়ে
নেমে আসা পাতাগুলো সরানোর অপেক্ষা... কেউ আছে ওখানে...
“মিলি...? কি হয়েছে...? বলবি তো...?”
“নাথিং!” একটা ঢোঁক গিলে বললাম, “বেরিয়ে পড়ি, চ... দেরি হচ্ছে...”
সিমলা এলে আমাদের
ঠিকানা হয় জেনের বাড়ি। তার দুটি পরিচয়... রিদ্মের খুড়তুতো দিদি; আর সোনায় বাঁধানো মনের একজন মানুষ। সারাটাদিন
মনিপাল ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসে পড়ে থাকে; আর সন্ধ্যেয় ফিরে দারুণ দারুণ সব গল্প আর
তারচেয়েও ভাল ভাল রান্না দিয়ে আড্ডা জমিয়ে দিতে পারে...
বাড়ির সামনে
পৌঁছাতেই পাশের দোকানের মেয়েটা দৌড়ে এসে চাবি ধরিয়ে দিল রিদ্মের হাতে; সঙ্গে একটা ছোট্ট চিঠি...
“খিদে-টিদে পেয়ে
গেছে নিশ্চয়ই... রান্নাঘর এবং ফ্রিজ তোমাদেরই... আগুন-টাগুন ধরিয়ে দমকল ডাকা ছাড়া
যা খুশি করতে পারো... :)”
এই হল জেন... মন'টা ভালো হয়ে গেল এক মিনিটেই...
“ঘরে ঢুকে সোফায়
এলিয়ে বোস...” তালা-চাবি আমার হাতে ধরিয়ে রিদ্ম বলল, “আমি একটা দারুণ করে কফি করছি...”
সদর দরজায় ছিটকিনি
দিয়ে বাগান পেরিয়ে ঘরে ঢুকলাম; বাগান’টা মরসুমি ফুলের ভিড়ে
রংরঙিন। বিশাল ওকে গাছটায় ঝিকিয়ে উঠেছে রোদ। বারান্দায় সেই চেনা উইন্ডচিমার'টা হাওয়ায় দুলছে। মন'টা জুড়িয়ে আসছিল। বসার ঘরের সোফায় এলিয়ে থাকবো এখন খানিক, তাহলেই ফ্রেশ হয়ে যাবো। হয়তঃ সত্যিই খুব ধকল হয়ে গেছে, তাই অস্বস্তি হচ্ছিল তখন।
টেবিলে তালাটা রাখতে গিয়েই জানলার বাইরে চোখ চলে গেল...
টেবিলে তালাটা রাখতে গিয়েই জানলার বাইরে চোখ চলে গেল...
একি! সদর'টা হাট করে খোলা...! সঞ্জৌলির
ধুকপুকুনিটা হুড়মুড়িয়ে ফিরে এল বুকের মধ্যে... আমি যে... আমি যে এখুনি লাগিয়ে এলাম
দরজাটা...!! কে খুলে দিল তাহলে?
হুশ করে জানলার
পর্দাটা উড়ে চোখ ঢেকে দিল আমার... আর সঙ্গে সঙ্গে কিরকম একটা অস্বস্তি পাক দিয়ে
উঠল সারা শরীরে... মনে হল যেন ঠিক আমার পিছনে দাঁড়িয়ে কেউ দেখছে আমায়...!!
[পরের কিস্তি'তে শেষ]
Tag :
গা-ছমছম-গল্প,