Popular Post

কালমৃগয়া (শেষ পর্ব)

By : Sayantari Ghosh

[প্রথম পর্বের পর...]

তার থেকে চারপাঁচ পা দূরে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। মানুষ! তার বছর বারো বয়েস। পরণে কালো প্যান্ট-জামা। তাই একবার দেখে কিশোরী বলে বুঝতে পারেনি সে খুব একটা। তার চুল এখনও কাঁধ ছোঁয় নি। বাদামী চোখে সামান্য সবুজের আভাস।
সে চুপটি করে দাঁড়িয়ে রইলো মেয়েটির সামনে। মেয়েটিও তার ভ্রূ কুঁচকে খুব মনোযোগ দিয়ে তাকে দেখছে। প্রায় তিনগুণ চেহারার যন্ত্রমানুষ। তার সমস্ত শরীর আগুনের মত উত্তপ্ত। কাঁচের চোখে আকাশের ছায়া, বিচলিত দৃষ্টি। বাঁ হাত অদ্ভূত ভাবে মুচড়ে আছে, যেন পক্ষাঘাতের ফল। সারা শরীর জুড়ে আজকের দৌড়ের সাক্ষ্য--- কাদা, ধুলো, মাটি, ঘাস, গাছের বাকল, জামের রসের লাল, ইলেকট্রিক শকের নীল তার লোহার হাত-পা গুলিকে অসম্ভব রকমের রঙিন করে তুলেছে। এক্ষুনি পার করে আসা গুহাপথের কোনো ক্ষীণ জলধারা তাকে এমন ভিজিয়েছে, যে মনে হচ্ছে যেন সে ঘেমে নেয়ে গেছে। পাইনের একখানা ছোট ডাল আটকে আছে তার ঘাড়ের কাছে।
মেয়েটি খানিকক্ষণ এক দৃষ্টে তার এই বিচিত্র রূপ দেখলো। তারপর সরাসরি তার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোমার নাম কি?”
সে কোনো উত্তর দিল না।
মেয়েটি আবার বলল, “ভয় পাচ্ছো নাকি? ভয় পেয়ো না। আমাকে বিশ্বাস করতে পারো তুমি।”
“চলে যাও”, এতক্ষণে তার যান্ত্রিক কন্ঠে স্বর ফুটলো, “পালাও এখান থেকে...”
“তুমি তো ভীষণ বোকা”, বলল মেয়েটা, “তোমার তো আমার সঙ্গে আসার কথা, তা জানো না? আমি তো তোমাকে সাহায্য করবো। চলো...”
বলেই মেয়েটা পিছন ফিরে হাঁটতে লাগলো, যেন ওর পিছনে যাওয়া ছাড়া তার আর কোনো উপায় নেই। অগত্যা সেও মেয়েটির পিছন পিছন চলল।
চুনাপাথরের উঁচুনিচু পথ।
“এদিকে”, মেয়েটি বলল।
এখানে বর্ষার জল চুনাপাথরে অনেক হিজিবিজি নক্সা কেটে গেছে। পিছল মাটি, এগোনো সহজ নয়। তবু মেয়েটি সাবলীল ভাবে বেশ দ্রুত এগিয়ে চলেছে। হাঁপাচ্ছে একটু একটু। তার গোলাপি ঠোঁট তিরতির করে কাঁপছে। তার কচি কানের লতিতে একটা মুক্তোর দুল প্রতিটি পদক্ষেপের সাথে দুলে দুলে উঠছে। কিন্তু তাও দাঁড়িয়ে পড়ছে না।
জঙ্গল আবার বাড়তে লাগলো। জায়গাটা ধীরে ধীরে একটা গোলকধাঁধার চেহারা নিচ্ছে। আদিগন্ত যত গাছ দেখা যাচ্ছে, সকলের দূর্বল কান্ডগুলো পশ্চিমদিকে হেলে রয়েছে। গাছের পাতাগুলো মাটি ছুঁয়েছে প্রায়। ওইটুকুনি মেয়েটিকেও চলতে হচ্ছিল প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে। এদিকে কোনো পথই নেই। অক্ষত রয়েছে জঙ্গলের গন্ধ। সে অবাক হয়ে ভাবছিল মেয়েটি এই গভীর জঙ্গল এত ভালো চেনে কেমন করে? কিন্তু সেসব ভাবনাকে প্রশ্রয় দিল না সে। মেয়েটির আসার পুরো ঘটনাটাই তার ভাবনার অতীত। কেন যে তার পিছুপিছু সে চলেছে, তা নিয়েও তাই কোনো ভাবনা আসছিল না তার মনে। হামাগুড়ি দিয়ে মেয়েটির পাশে পাশে চলতে চলতে একটা অপূর্ব মিষ্টি গন্ধ তাকে বুঁদ করে রেখেছিল। দুধ, ফুল আর চকোলেটের পাঁচমিশালি একটা সুবাস!
হঠাৎ পিছন থেকে কুকুরের ডাক ভেসে এল। ধীরে, কিন্তু পরিষ্কার শব্দ। খুব একটা দূরে নয়।
“এসে গেছি”, বলল মেয়েটা।
ঘন অন্ধকার গাছের ভিড় থেকে বেড়িয়ে ওরা এসে দাঁড়ালো একখানা ছোটখাটো চুনাপাথরের টিলার সামনে। খেয়াল করলে বোঝা যায়, আসলে একটাই বিশাল পাথর খাঁড়া দাঁড়িয়ে আছে কোনো দৈত্যের দূর্গের মত। বৃষ্টির জল লেপ্টে রয়েছে পাহাড়টার গায়ে। এখান-ওখান থেকে উঁকি মারছে অন্ধকার কিছু গুহামুখ।
“এখান দিয়ে সোজা উপরে উঠে যাও” দু’হাতে পকেট হাতড়াতে হাতড়াতে বলল মেয়েটা, “গিয়ে লুকিয়ে পড়ো, বুঝলে?” বলল সে। ইতিমধ্যে পকেট থেকে একখানা বড়সড় লাল রুমাল বের করে এনে ওর পায়ের কাছে বসে লোহার জুতোয় বেশ করে খানিক বুলিয়ে নিল মেয়েটা। যেন পরিষ্কার করছে।
“কুকুর...”, ধীর কন্ঠে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল সে।
“তুমি না ভীষণ বোকা। আমি কি করছি বুঝতে পারছো না? এই রুমালটা দিয়ে আমি ওদের কে অন্যদিকে সরিয়ে নিয়ে যাবো। ওরা তোমার পিছু করছে ভেবে আমার পিছু নেবে। বুঝলে? ওঠো। দেরী কোরো না...”
সে তাও ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। কুকুরের ডাকের সাথে এবার অস্পষ্ট কিছু মানুষের গলার স্বর কানে আসছে। তবু সে দাঁড়িয়ে রইলো। একটা প্রশ্ন তার মুখে এসেও আটকে রয়েছে।
“তুমি যাচ্ছো না কেন?” এবার মেয়েটির গলার স্বরে রাগ সুস্পষ্ট, “যাও! যাও!” প্রায় আদেশের ভঙ্গীতে বলল মেয়েটি।
কথা না বাড়িয়ে সে আস্তে আস্তে টিলার দিকে এগোলো। একটা দুটো করে চুনাপাথরের স্তূপ পেরোতে পেরোতে যখন প্রথম গুহামুখটায় পৌঁছালো, তখন নিচের দিকে তাকিয়ে মেয়েটাকে আর কোত্থাও দেখতে পেল না সে। মেয়েটা যেন হাওয়ায় উবে গেছে।
পাথরের গায়ে একটা ফাটল হাঁ করে আছে। এক লাফে সেটা পার হয়ে গেল সে। কুকুরগুলো এত দূর অব্দি নিশ্চিত পৌঁছোবে, কিন্তু তারপর হয়তো মেয়েটির পিছু পিছু যাবে। সে খেয়াল করে দেখেছে কুকুরগুলো সাধারণত সমতলের রাস্তা পছন্দ করে, পাথুরে রাস্তায় থমকে যায়। ওরা কি পাথর ভয় পায়?
বৃষ্টিভেজা চুনাপাথর বেয়ে সে আস্তে আস্তে পাহাড়ে চড়তে লাগলো। মাঝেমধ্যে পা পিছলে যাচ্ছে, হাত ফসকে যাচ্ছে, আবার সামলে নিচ্ছে সে। আরেকটু সামনে একটা সরু গুহামুখ চোখে পড়ল। বরফের মতো ঠান্ডা হাওয়া হু-হু করে বইছে খোলা মুখটা থেকে। চট করে গুহার মধ্যে সেঁধিয়ে গেলো সে। ভেতরটা ধীরে ধীরে আরো সরু হয়ে গেছে। কোনোক্রমে নিজেকে দুমড়ে-মুচড়ে সে নিজের বিশাল শরীরটাকে গুহার ভেতর গুঁজে দিল, ডানপাশে ভর করে আস্তে আস্তে শুয়ে পড়ল সে, মাথা রাখল গুহামুখের বৃষ্টিধোয়া ফার্ণের ওপর। যদিও সে মাটি থেকে এখন প্রায় দোতলা উপরে, তবুও শিকারিদের গতিবিধি নজরে রাখা দরকার।
আবার কুকুরের ডাক… এবার ভীষণ স্পষ্ট আর ভীষণ কাছে। গুহার অন্ধকারে নিজেকে মিশিয়ে দিয়ে মৃতদেহের মতো স্থির হয়ে পড়ে রইল। নিচের খোলা জায়গাটা, যেখানে খানিক আগে মেয়েটা দাঁড়িয়ে ছিল, সেখানে জঙ্গল থেকে ছিটকে এসে বেরোলো একটা মানুষ। তারপর আরেকজন, সঙ্গে দু তিনটে কুকুর। দিব্বি বোঝা যাচ্ছে প্রত্যেকেই ভীষণ ক্লান্ত, প্রায় বিধ্বস্ত।
“ছুটিয়ে মারছে কিন্তু!” বলল প্রথম জন। তার গলার শব্দ এত পরিষ্কার ভাবে ওর কানে এলো মনে হল যেন এক ফুট দূরে দাঁড়িয়ে আছে লোকটা।
“গত বছর কিন্তু আরো জমে গিয়েছিল”, এবার দ্বিতীয় লোকটার গলা শোনা গেল, “দু-দুবার মনে হচ্ছিল, বুঝলে, যে প্রায় বাগে এনে ফেলেছি ব্যাটাকে, আর সে ব্যাটা কিন্তু ফাঁক বুঝে ঠিক পালাচ্ছিল বারবার।”
“তারপর?” প্রথম লোকটা জিজ্ঞেস করল; ওরা থেমে থেমে কথা বলছে আর কুকুরগুলো ততক্ষনে তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখছে পাহাড়ের গোড়ার কাছটা।
“আমরা তো ছুটে ছুটে হা-হদ্দ ক্লান্ত হয়ে গেলাম। শেষে, মানে ধরো সে প্রায় সূর্যাস্তের সময়…” লোকটার গলা ধীরে ধীর ক্ষীণ হয়ে গেল। ওরা বোধহয় টিলার নিচটা থেকে সরে যাচ্ছে। কুকুরের ডাকও সঙ্গে সঙ্গে সরে যাচ্ছে দূরে। ওরা বোধহয় মেয়েটার পিছু নিয়েছে। মেয়েটা এই অল্প সময়ের মধ্যে গেল কোথায়? কুকুরগুলোর থেকেও জোরে ছুটল কিভাবে? না, হয়তো ছোটেনি। হয়তো বুদ্ধি করে কোন ভীষন সংকীর্ণ পাথরের গহবরে গুঁজে দিয়েছে রুমালটা। মানুষগুলো হয়তো এখন হতভম্ব হয়ে বা ভাবছে যে সেই জায়গা দিয়ে ওর এই বিশাল শরীর পেরোলো কিভাবে? মেয়েটা তো জঙ্গল দারুণ চেনে। নিজে হয়তো জঙ্গলের কোথাও লুকিয়ে পড়েছে এতক্ষণে।
কিন্তু, কেন?
এই একটা প্রশ্নই তার মনে ধাক্কা খাচ্ছে অনেকক্ষণ ধরে। কেন মেয়েটা ওকে সাহায্য করতে গেল? এসব আসলে খুব জটিল ব্যাপার। স্যাঁতস্যাঁতে গুহার শিরশিরে হাওয়ায় শুয়ে তার শরীর যত জুড়াচ্ছিল, তত যেন আবোলতাবোল ভাবনা এসে ভীড় করছিল মাথার ভেতর। সত্যিই কি কারণ খোঁজার কোন মানে হয়? অন্যরা তাকে বলেছে, যারা প্রাণ হাতে করে একটা দিন কাটিয়ে কোনক্রমে ক্লান্ত, ক্ষতবিক্ষত দেহে ঘরে ফিরে আসতো, তারা। যারা শ্বাস নিতে প্রবল কষ্ট হলেও কোনোক্রমে খাবি খেতে খেতে উত্তরসূরিদের বলে যেত তার দৌড়ের গল্প, তারা। আর তারপর দিন দুপুরের রোদে ছোট্ট একখানা গাছের অপরিসর ছায়ায় কোনক্রমে গুলি খেয়ে মরে বাঁচতে চাইতো, তারাই বলেছে।
সত্যি বলতে কি ভয় পাওয়াটাই ওদের ধর্ম। যদি ওরা ভয় না পায়, তাহলে ওরা ছুটবে না। আর যদি ওরা না ছোটে, তাহলে যেন বাঁচার কোন চেষ্টাই করবে না। আর তাহলে তো পুরো আনন্দটাই মাঠে মারা যাবে! এ যেন ফায়ারিং স্কোয়াডে সরাসরি দাঁড় করিয়ে কাউকে গুলি মারা। যেন মাটির পায়রা সাজিয়ে, গুলি মেরে তাক প্র্যাকটিস করা। এ যেন খুব বেশী সোজা। বিরক্তিকর রকমের সোজা। তাতে নেই এমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, নেই পাহাড় উপত্যকা-ব্যাপী এই দৌড়, নেই কোন পরিকল্পনা, নেই কোন চমক। না আছে কলাকৌশল, না আছে লুকোচুরি আর না আছে কোনো চালাকির সুযোগ। শিকারের মধ্যে একটা উত্তেজনা থাকা উচিত। শিকার হওয়া উচিত একটা যুদ্ধের মতো। একটা যুদ্ধ যার নৃশংস, বীভৎস ফলাফল আগে থেকেই নির্ধারিত আছে। না হবে খুব সোজা, না হবে খুব কঠিন -- তবেই না মজা। এই যে লুকিয়ে থাকা, তাও তো সেই খেলারই অংশ। শিকারীর দলকে এটা ভাবার সুযোগ দেওয়া যে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী খুব একটা খেলো নয়।

এতক্ষণে ওর গা জুড়িয়ে এসেছে। সামনের গুহামুখ দিয়ে চৌকোণো আকাশ দেখা যাচ্ছে । তার হঠাৎ যেন মনে হচ্ছিল সে ভেসে উঠছে, হাওয়ায় গা ভাসিয়ে মেঘের মতো। সন্ধ্যার আকাশে আস্তে-আস্তে মেঘ জমেছিল। হয়তো রাতে বৃষ্টি হবে। তার অনেক কথা মনে পড়ছিল। সেই যে একজন, যে প্রবীণ, বয়সের ভারে ন্যুব্জ, ক্লান্তিতে মুখ রক্তাভ, ক্ষতবিক্ষত লোহার বর্ম, তার কথা। সে ওদের শেখাতো কিভাবে দৌড়তে হয়, কিভাবে ধাতব জিনিসের আড়ালে নিজেকে লুকাতে হয়, কিভাবে গাছে চড়ে পড়তে হয় নিজেকে বাঁচাতে। এভাবে খোলা গুহামুখে এসে একা শুয়ে আছে দেখলে সে কি বলতো? খুব করে বকুনি দিত নিশ্চয়ই! সেই পুরোনো দিনের কথা মনে পড়ছিল তার। তাদের এসব শেখানো হতো অন্য একটা জঙ্গলে, তার সাথে এ জঙ্গলের কোন মিল নেই। ওদিকটায় কোন পাহাড় নেই। বন্ধু কারণ’টা বুঝতে পেরেছিল। বন্ধু বলেছিল, যেখানে শিকার হবে সে জায়গাটার সাথে খুব বেশি পরিচিতি যেন আগে থেকে না থাকে, তাই এই ব্যবস্থা।
কিন্তু আজ এখানে শুয়ে ওর শিকারের কথা ভাবতে ইচ্ছে করছিল না। ঘষা কাঁচের চোখ দুটিতে ঝকঝক করে উঠছিল নরম, গোলাপি কিছু স্বপ্ন। আজ দৌড়ে আসার পথে সেই যে স্বচ্ছ্ব জলে টলটলে সরোবরখানা পেরিয়েছিল সে--- সেই জায়গাটার কথা খুব মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল সন্ধ্যে হয়ে আসছে, সরোবরের জল আস্তে আস্তে ঘন কালো হয়ে উঠছে। আঁধার হয়ে উঠছে গাছের তলাগুলো। তার সামনে বেগুনি আর হলুদ রঙের ছোট ছোট তাঁবু । আর সেই তাঁবুর পাশে ঝিলের ধারে দাঁড়িয়ে একখানি ছোট্ট ছেলে। সেই ছেলেটি আর কেউ নয়, সে যেন ও নিজেই! টলমল পায়ে তাঁবুর বাইরে দাঁড়িয়ে সে ভাবছে যে সে কবে এত বড় হবে যে একটা মাত্র ডুবসাঁতারে পার হয়ে যাবে এই পুরো সরোবর। দু’চোখ ভরা জল, বুকভরা হাসি নিয়ে সে নাচবে আর গাইবে। প্রথমে সে ছোট্টটি থাকবে, তারপর যখন সে একটু বড়, ওই মেয়েটির মতো, তখন সে স্কুলে যাবে।
পুরো ব্যাপারটা যে কত অর্থহীন, তা সে জানে। এসব কথা সে কাউকে বলেনি, এমনকি বন্ধুকেও না। তবু তার জানতে ইচ্ছে করতো যে এসব অদ্ভুত খেয়াল কি শুধু তারই মনে আসে? নাকি বাকিদেরও? বন্ধু তাকে নানান কথা বলতো, যা সে আর কোত্থাও কখনও শোনেনি। অন্ধকার, গুমোট নিচু ছাদের গুদামঘরের মত যে জায়গাটায় তাদের থাকার ব্যবস্থা ছিল, সেখানে বন্ধু থাকত ঠিক ওর পাশে। মাঝে মাঝে দুজনে কপালে কপাল ঠেকালে, ওরা দেখতো, কোন কথা বলার প্রয়োজন হয় না। এমনিই পরস্পরের চিন্তাভাবনাগুলো পরিষ্কার বুঝতে পারা যাচ্ছে দিব্বি। সে জানতো না এ ব্যাপারটা শুধু বন্ধু আর তার মধ্যেই হয়, নাকি বাকিদের মধ্যেও। ভেবেছিল, অন্যদেরকে জিজ্ঞেস করে দেখবে, কিন্তু কখন যেন ভুলেই গেছে একবারে! আর এখন দেরী হয়ে গেছে খুব। এই যে শুয়ে শুয়ে সে আকাশপাতাল ভাবছে, এটাও তো শুধু একটু দেরীর ফাঁকেই । দেরীতে হলেও মানুষরা তাকে খুঁজে বের করবেই। মানুষরা আসলে হার ব্যাপারটা কে এক্কেবারে বরদাস্ত করতে পারে না। মানতেই চায় না যে তারা হারতে পারে। বিশ্বাসই করে না। আজ না হলে কাল তারা হিড়হিড় করে তাকে এখান থেকে টেনে বের করবেই।
তবু আজ এখানে শুয়ে শুয়ে বন্ধুর কথা ভাবতে ভালো লাগছিল। বন্ধু কিন্তু বরাবরই অন্যরকম ছিল। মানুষদের ব্যাপারে তার জানার উৎসাহ ছিল খুব। অথচ, এই যে তার আকাশ দেখতে এত ভালো লাগে, বন্ধুর সেসব মোটেও ভালো লাগতো না। বন্ধু বলতো, একটা সময় ছিল, যখন মানুষরা নাকি মানুষই শিকার করত স্রেফ আনন্দের জন্যে। কে জানে! সেসব নিশ্চয়ই বহু আগের কথা। কিম্বা হয়তঃ একেবারে আজগুবি কল্পনা! বন্ধুর সব কথা সে বিশ্বাস করতে পারত না। কারণ কিছু কথা সত্যিই বড় অদ্ভুত, অসম্ভব শোনাতো। যেমন, একবার বন্ধু বলেছিল যে ওদের মধ্যে কেউ একজন পালিয়ে নাকি চাঁদে পৌঁছে গেছে। চাঁদে! তাও আবার সম্ভব! কি করে গেছে? না জাহাজে করে! রাতের অন্ধকারে যখন সব মানুষ ঘুমোচ্ছিল তখন একখানা জাহাজ চুরি করে ওদের মধ্যে একজন পালাতে পালাতে পৌঁছে গেছে চাঁদে! চাঁদে তো হাওয়া নেই, তাই শিকারের ভয় নেই। ওদের তো আর হাওয়া লাগে না বাঁচতে, কিন্তু মানুষের লাগে। তাই চাঁদ থেকে তাকে ধরে আনার ব্যবস্থা করতে মানুষের অনেক সময় লাগবে। ততদিন সেই পলাতক নিশ্চিন্ত। সে নাকি তার জাহাজ নিয়ে যে কোনোদিন ফিরে আসতেও পারে। এসব অবিশ্বাস্য গল্পের শেষ কিভাবে হত, তা এখন আর সে মনে করতে পারল না। বজ্রপাত না কি যেন একটা হয়েছিল গল্পের শেষ দিকে। বন্ধু বলতো, বজ্রপাত নাকি মানুষের তৈরী নয়! উফফ! কত কি যে সে বলতো। ভাবতে গিয়ে একটা হাসির আলতো রেখা ফুটে উঠল তার মুখে।
কতক্ষন হলো? একঘন্টা? দুঘন্টা? কোন হিসেব নেই তার। সূর্যের দিকে তাকিয়ে মনে হলো দুপুর গড়াচ্ছে বিকেলের দিকে। তাও এখনো ঘন্টা তিনেক অন্ততঃ আলো থাকবে। তার এবার হয়তঃ এখান থেকে বেরোনো উচিত। এতক্ষণ এক জায়গায় বসে থাকা একেবারেই উচিত না। কিন্তু কোথা থেকে একরাশ আলস্য এসে যেন তাকে চেপে ধরেছে! তার কোনো পরিকল্পনা নেই আর, পালিয়ে বেড়ানোর আর কোন ইচ্ছা নেই। কিছু করার কোন চেষ্টাও নেই, আর কোথাও যাবার কোনো উদ্দেশ্যও নেই।
বন্ধু কিন্তু তার চাঁদের গল্প, বজ্রপাতের গল্প, মানুষের গল্প নিয়ে মাসখানেক হলো চলে গেছে একদিন। আর ফেরেনি। কার যে কবে দিন ঘনিয়ে আসে আগে থেকে তো আর জানতে পারেনা তারা। সেই দিনটা তার স্পষ্ট মনে আছে। একদল মানুষ পৌঁছালো সকালের দিকে অট্টহাসিতে জঙ্গল কাঁপিয়ে। কুকুরের দল ঘেউ ঘেউ করছিল ক্রমাগত। বন্ধুকে সে বলেছিল তার ভয়ের কথা। আজ কি তবে ওদের পালা? বন্ধু হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল। অথচ তারপর যখন পাহারাদারগুলো বন্ধুকে ডাকতে এল, কেমন যন্ত্রের মতো ওদের পিছু পিছু চলে গেল সে। একবারও ওর দিকে না তাকিয়ে। কুকুরের দল তখন বাইরে পাগলের মতো চেঁচাচ্ছে। পরক্ষনেই ধুপধাপ পায়ের শব্দ কানে এসেছিল তার। এ শব্দ তার খুব চেনা, কারণ তার নিজের পায়ের শব্দের সাথে এর কোন তফাৎই নেই। দশ মিনিট। ঘড়ি ধরে ঠিক দশ মিনিট কুকুরগুলো উন্মত্তের মত চেঁচালো। ওদেরকে এই সময়টুকুই দেওয়া হয় খানিকটা এগিয়ে যাওয়ার জন্য। তারপর কুকুরের দলকে লেলিয়ে দেওয়া হয়।
সেদিনের পর থেকে বন্ধুর কথা সে খুব একটা আর ভাবেনি। শান্ত ঝিলের জলে পাথর ছুঁড়লে যেমন একটা বিন্দু থেকে অনেক ঢেউ ধীরে ধীরে সমস্ত জলটাকে অশান্ত করে তোলে, তেমনই এসব ভাবতে গেলেই বন্ধুর মুখ থেকে শুরু হয়ে ক্রমাগত বড় হতে থাকা সার বেঁধে এগিয়ে আসা ভয়ের ঢেউ তাকে ধীরে ধীরে আচ্ছন্ন করত। শুধু মনে হত, একদিন তাকেও এভাবেই ছুটতে হবে। পিছনে ছুটবে ক্রুদ্ধ কুকুরের দল আর নেশায় মশগুল শিকারীরা। ভাবতে গেলেই তার বুকের মাঝের অনেকটা জায়গা যেন খালি হয়ে যেত। কোনভাবে কিছু দিয়ে সেই শূণ্যতা, সেই অন্ধকারকে থামানো যেত না। তাই সে নিজের মন সরিয়ে দিত অন্যদিকে।
ভাবতো, মানুষের সাথে তাদের মিলই কি কম কিছু? বন্ধুকেও তো সে খুব কাছ থেকে দেখেছে। সে নিশ্চিত, তারই মত বন্ধুও ভাবতে পারতো, স্বপ্ন দেখতে পারতো, অনুভব করতে পারতো। বন্ধুরও কোনো দিন মন’টা ভালো থাকত, কোনদিন একেবারে মনখারাপ। তারও চোখে রং, ঠোঁটে হাসি ছিল। এক্কেবারে তার নিজের মতন। তাহলে তার মত বাকিদেরও কমবেশী এরকমই হয় নিশ্চয়ই। মানুষের সাথে এ সবই তো মিলে যায়। এই কষ্ট, এই ক্লান্তি, সর্বাঙ্গে শিরশিরিয়ে ওঠা এই ভয়--- এসব কি মানুষদের নেই? মাঝে মাঝে মনে হয় তার শরীরের এই ভীষণ ভার, চলাফেরার যান্ত্রিক শব্দ, তার ভাষাহীন দুটি ঠোঁট যেন আসলে একটা দুঃস্বপ্ন, কোনো অসুস্থতা অথবা কোনো দুর্ঘটনা হয়তঃ।
তার তো কখনো একটুও ভাবতে অসুবিধা হয় না যে জঙ্গলের পাতাঝরা রঙিন রাস্তায়, ছোট্ট ঝিলের ধারে অনেক মানুষের সাথে সে নাচছে আর গাইছে। বন্ধুকে সে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করতো বটে, কিন্তু এ কথা কখনো মুখ ফুটে বলতে পারেনি । এই যন্ত্রশরীরের বাইরে নিজেকে রক্তমাংসের শরীরে ভাবতে কেন তার এতোটুকু অসুবিধে হয় না? হ্যাঁ, খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারটা তার অদ্ভুত লাগে বৈকি! খানিক লতাপাতা, ফল-সবজি, নানা রঙের তরল গলায় ঢেলে দিয়ে কি আনন্দ পায় মানুষেরা, তা সে বুঝে উঠতে পারেনা। বন্ধু বলতো, হাওয়ার মত মানুষদের এসবও দরকার লাগে। হয়তো হবে বা!
কিন্তু... না। মানুষের সাথে তার সবচেয়ে বড় তফাৎ এটা মোটেও নয়। তফাতটা অন্য জায়গায়। তফাত হল যে মানুষ যদি তার মতন হত, এক্কেবারে হুবহু তার মতন, তাহলে তারা শিকারই করত না। সে বোঝে যে জগতে শিকার খুব অস্বাভাবিক কিছু নয়। যার দল ভারি, যার সাথে কুকুরের পাল, যার হাতে শক্তিশালী অস্ত্র, সে এই জঙ্গলে-ঘেরা, চুনাপাথরে বৃষ্টিজলের আঁকিবুকি’তে সাজানো, পাতার ঝালরে মোড়া, পাহাড়ি রঙ্গমঞ্চে অন্য কাউকে নাটকীয়ভাবে ছুটিয়ে মারছে, এ ব্যাপারটা বুঝতে, ব্যাখ্যা করতে তার মোটেই অসুবিধে হয়না। এ তো চাইলেই করে ফেলা যায়! কিন্তু যা করে ফেলা যায়, তা যে সব সময় করে ফেলতেই হবে, তা কেন? তাহলে তো পৃথিবী রসাতলে যাবে। টুকরো টুকরো হয়ে ধুলোয় মিলিয়ে যাবে একদিন। এই যে পাইনের বন, পাথুরে পাহাড়, কুলুকুলু নদী, নরম সবুজ ঘাস, বৃষ্টিধোয়া নীল আকাশ--- এরা সক্কলে একসাথে না হলে কি তৈরী হবে এই সুন্দর ছবিখানা? এক এক করে সকলকে সরিয়ে দিলে কি পড়ে থাকবে শেষে? সকলকে নিয়েই তো পৃথিবী। তাই যদি সে মানুষ হতো, সে কক্ষনো শিকার করত না।
সূর্য এবার অস্তাচলের পথে হেলে পড়ছে। কমলালেবুর মত একমুঠো সোনালী রোদ কোন ফাঁক গলে তার অন্ধকার গুহার দেওয়ালে এসে পড়েছে। ঠিক তখনই সে যেন গলার শব্দ শুনতে পেল। মিষ্টি, কচি গলার শব্দ। সেই মেয়েটার গলা। হঠাৎ তার মনে হল সে যেন এতক্ষন শুধু মেয়েটার ফেরারই অপেক্ষা করছিল। খুব ভেবেচিন্তে নয়, কিন্তু তবু যেন এই যে তার বসে থাকা, সাতপাঁচ ভেবে সময় কাটানো, তা শুধুমাত্র মেয়েটির ফেরার অপেক্ষাই। হয়তো মনের কোণে আশার আগুন ধিকিধিকি জ্বলছিল। যে মানুষটা এত কিছু করলো তার জন্য... সে লুকোতে পারলো পাহাড়ের গুহায়, পথ হারিয়ে বিভ্রান্ত হল শিকারীর দল, এমনকি কুকুরগুলোকে পর্যন্ত নাজেহাল হল খুব... সে তো সব মেয়েটির জন্যেই; আশা ছিল হয়তো সে ফিরবে, যাতে সুন্দর করে এই ছোট্ট আলাপের শেষ হয়। একটা বিদায়ী সাক্ষাত। এটুকুই। এ যে অসম্ভব দূরাশা, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু সারাটা দিন ধরে সেই মেয়ে যা যা করলো, তাই বা কি কম অসম্ভব? ভাবতে গিয়ে আবার ভীষণ আশ্চর্য লাগল তার। মেয়েটার এলেম আছে বটে।
মেয়েটি কিছু বলছে। কিন্তু কি, তা সে খুব পরিষ্কার বুঝতে পারল না। শুধু এটুকু বুঝতে পারল যে মেয়েটি একা নয়। শিকারি দুজনের মধ্যে যার বয়স কম, সেও মনে হচ্ছে যেন এসে দাঁড়িয়েছে নিচে। তার সাথে মেয়েটির কথা কাটাকাটি হচ্ছে যেন। ছেলেটা বোধ হয় কিছু বোঝাবার চেষ্টা করছে মেয়েটিকে। বিকেলের দখিনা হাওয়া তাদের কথাগুলোকে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিল দূরে। তবু যেন মনে হল ছেলেটি যেন বলছে, “এ কি ছেলেখেলা নাকি?” আর মেয়েটি বলছে, “আমি বড় হয়ে গেছি তো...”
অস্পষ্ট কথাগুলোর কোনো মানে সে করতে পারলো না। কারণ, কথা হচ্ছে চাপা গলায়। কিন্তু তাদের পায়ের শব্দ ধীরগতিতে এগিয়ে আসছে এদিকেই। শুকনো পাতার খসখসানি তার জানান দিচ্ছে।
“বাবা শুনলে কিন্তু ভীষণ রাগ করবে...”, ছেলেটির গলায় রাগের ছাপ।
“সে আমি বাবাকে সামলে নেব, আমাকে ওটা দাও...”, মেয়েটি বলল।
“এটা খেলনা নয়... কি ছেলেমানুষী হচ্ছে?” আবার বলল ছেলেটি।
“আমি ছেলেমানুষ নই”, গলার জোর বাড়ালো মেয়েটি, “তোমরা সারাদিন ধরে পেরেছো? বলো? পারোনি তো? আরো এক সপ্তাহ ধরে ঘুরলেও তোমরা পারবে না...আমি তো পেরেছি... কি কথা হয়েছিল বলো?”
“কিন্তু সোনা, তুমি যে অনেক ছোট... নিয়মের ভীষণ কড়াকড়ি এখানে...” এবার একটু নরম স্বরে বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করল ছেলেটি।
“কিন্তু তুমি বলেছিলে কি না যে যদি আমি পারি, তাহলে আমায় দেবে...” মেয়েটি নাছোড়বান্দা।
তাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে ছেলেটি বলল, “কিন্তু একটু বোঝার চেষ্টা কর, বাবা যে খুব রাগ করবে...”
“তুমি বলেছিলে কি না...? বলো? তুমি কিন্তু বলেছিলে...”, কাটা কাটা ভাবে বলল মেয়েটি দৃঢ়স্বরে।
ছেলেটি আর কোন উত্তর দিল না। যেন মেয়েটির সাথে আর তর্ক করার কোন মানে হয় না বলে হাল ছেড়ে দিল সে। খুব হালকা একটা শব্দ হলো খুট করে। যেন একটা কোন ধাতব জিনিস হাতবদল হল। “এসো, এসো, বেরিয়ে এসো”, এবার সেই পুরোনো আদেশের ভঙ্গিতে চিৎকার করে বলে উঠলো মেয়েটি।
এই ডাক তার উদ্দেশ্যে। শোনামাত্র মনটা কেমন উদাস হয়ে গেল তার। আরেকবার সন্ধ্যার রঙে রঙিন আকাশটাকে দেখে নিল সে। তারপর ধীরে ধীরে গুহার মুখের কাছে এগিয়ে এসে দাঁড়াল। ওদের দেখা যাচ্ছে দশ হাত দূরেই।
আকাশে অস্তগামী সূর্য জ্বলজ্বল করছে। সেই আলোয় দীর্ঘ ছায়া ফেলে ছেলেটি দাঁড়িয়ে আছে এক পাশে, তার হাতদু’টো বুকের কাছে ভাঁজ করা । এমনভাবে, যেন যা হচ্ছে, তাতে তার আর কোন দায় নেই। তার ডানপাশে, পাথুরে পথের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা। খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে বলে তাকে যেন আরো ছোট্টটি দেখাচ্ছে। দুটো কুকুর দাঁড়িয়ে আছে তার দু’পাশে। তাদের লম্বা জিভগুলো ক্লান্তিতে ঝুলে পড়েছে। কুকুরগুলোর দিকে তীক্ষ্ণ নজর রেখে আর মেয়েটির ফর্সা ছোট্ট মুখখানির দিকে তাকিয়ে সে আস্তে আস্তে সোজা হয়ে দাঁড়ালো।
মেয়েটি এক পা পিছিয়ে গেলো সাবধানে, আর সঙ্গে সঙ্গে তার হাতে উঠে এল লম্বা একটা বন্দুক। রক্তাভ সূর্যের আলোয় ঝলসে উঠল অস্ত্রটা।
সে এগোতে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো, আর মেয়েটি গুলি চালালো তক্ষুনি। বাড়িয়ে দেওয়া লম্বা লোহার হাত দুটো বুলেটের ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পিছনে সরে এলো। তার পা টলে গেল তখনই।
পড়ন্ত লোহার শরীরটার দিকে মেয়েটি আবার গুলি চালাল। তারপর আবার। আলোর ঝলক’টা নীল, ভীষণ নীল। সূর্যের থেকেও উজ্জ্বল যেন। আর সাথে সাথে একটা তীব্র জ্বালা তার শরীরটাকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিল। একটা পাক খেয়ে লোহার শরীর’টা যেন হাওয়ায় ভেসে রইলো খানিক্ষণ। তারপর ভীষণ শব্দ করে আছড়ে পড়ল চুনাপাথরের মেঝেতে ধূলো উড়িয়ে। ঘাড়টা বেঁকে রইল অস্বাভাবিক একটা কোণে। দুমড়ানো মুচড়ানো হাত-পা নিয়ে লোহার বিশাল পুতুলখানা পড়ে রইল। সামান্য একটু ধোঁয়া দখিনা হাওয়ায় মিশে গেল আগ্নেয়াস্ত্রের আক্রমণে উত্তপ্ত-হয়ে-ওঠা ক্ষতস্থানগুলো থেকে। শেষ গুলিটা মোক্ষম জায়গায় লেগেছে। আজকের মত ছুটি বুঝে ক্লান্ত কুকুরগুলো পিছিয়ে গেল আস্তে আস্তে।
***** শেষ *****

কালমৃগয়া (প্রথম পর্ব)

By : Sayantari Ghosh
[কল্পবিজ্ঞানকে যিনি সমাজের প্রতিবিম্ব করে গড়েছিলেন, সেই অসামান্য স্রষ্টা স্তানিসোয়াভ লেমের জন্মদিন আজ। শতবর্ষে পা দিলেন বিশ্বখ্যাত কল্পবিজ্ঞানের এই লেজেন্ড। তাঁরই ‘দ্য হান্ট’ কাহিনীর ভাবানুবাদের প্রচেষ্টা করলাম। এই গল্পটি দীর্ঘকাল অপ্রকাশিত ছিল। একই নামের লেখকের আরেকটি পরিচিত গল্প থাকার দরুণই বোধহয় এই লেখাটি এতদিন যাবৎ পাঠকের চোখ থেকে দূরে লুকিয়ে থাকতে পেরেছে। ২০১৮ সালে প্রথম প্রকাশিত এই কাহিনীর রচনাকাল খুব সম্ভবতঃ পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিক।]


প্রায় মাইলখানেক ধরে সে টানা ছুটছে, একটুও ক্লান্ত হয়নি। অবিন্যস্ত পাইন বন তার চারপাশে। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকা পাইনগাছের সুঠাম শরীরগুলো সটান উঠে গেছে উপরের দিকে, পাহাড়ের সাথে একটা কোণাকুণি ভঙ্গিমায়। গাছের সুউচ্চ চূড়াগুলো আজ কুয়াশায় মুখ লুকিয়েছে যেন ভীষণ বিষাদে। সেই কুয়াশাচ্ছন্ন জঙ্গলের পিছন থেকে আলতোভাবে ভেসে আসছে অজানা নদীর কুলুকুলু শব্দ।
এদিকটা সে খুব একটা চেনে না। ঠিক কোথায় যে যাচ্ছে তাও সে জানেনা। কতকটা দিশাহীন ভাবেই সে আজ ছুটছে। এ পথটুকু’তে এখনো পর্যন্ত অবশ্য কোন জনপ্রাণী তার চোখে পড়েনি। পুরনো কোনো চড়ুইভাতির আগুনের ধ্বংসস্তূপ বা কারো ফেলে যাওয়া আধময়লা ব্যবহারী জিনিস -- জঙ্গলের কোথাও সে সব কিছু নেই। এদিকটায় মনে হয় বড় একটা কেউ আসে না। আসলে এদিকটাতে রাস্তাঘাট নেই তো, সবাই বলে পাহাড়ের দৃশ্যও নাকি এখানে সাংঘাতিক আহামরি কিছু নয়। শুধু জঙ্গল আর জঙ্গল। ঘন হয়ে কাছিয়ে-আসা বিশাল উঁচু উঁচু সব গাছ। কোথাও আলো-আঁধারি, কোথাও বা অন্ধকার । কোথাও গাঢ় সবুজ, কোথাও গাঢ়তর।
সেই সবুজের সমারোহে যেটুকু সাদার ছাপ, সেদিকে এগোলে দেখা যাবে কিছু মরা গাছের দুধসাদা কান্ড দাঁত বের করে রয়েছে। হয় ঝড়ে ভেঙে পড়েছে, নয় বয়সজনিত কারনে। দূর থেকে মরা গাছ দেখলেই সে দৌড়াতে দৌড়াতে হিসেব করে নিচ্ছিল। টপকে যাওয়ার দরকার না পড়লে শুকনো ডালপালা ঠেলে নীচ দিয়েই পার হচ্ছিল সে। অকারণ শক্তি নষ্ট করে লাভ কি?
অনেক উঁচুতে আকাশ ঝলমল করছে। সে চট করে একবার পিছনে তাকালো। এ গাছ ও গাছ ধাক্কা খেতে খেতে তার দৃষ্টি চলে গেল যতদূর যাওয়া যায়। কান খাড়া করল সে। না, আপাতত শুধু নির্জনতা। নৈঃশব্দ। আছে শুধু সেই নদীটার শব্দ। আর পাতায় হাওয়ার সরসরানী। তার চোখ কিন্তু ভীষণ তীক্ষ্ণ। উজ্জ্বল আকাশের দৃশ্যপটে কোন গাছের ডাল সামান্য একটুখানি নড়লেও সে টের পাচ্ছিল পরিষ্কার। উল্টোদিকের পাহাড়েও বৃষ্টিধোয়া পাইনের ঘন গালিচার আস্তরণ। সবুজের ফাঁক দিয়ে, ঠেলে-বেড়িয়ে-আসা হাড়ের মতো উঁচু হয়ে আছে কতগুলো চুনাপাথরের পাহাড়। নিশ্চয়ই গুহা আছে ওর আড়ালে। নিশ্চয়ই বহু শিকারের দৌড় ওদিকে গিয়েই শেষ হয়েছে। ওদিকে যাওয়ার বিশেষ জায়গা নেই, ভাবারও বিশেষ সুযোগ নেই।
সুযোগ কি আদৌ কখনো থাকে? তারও কি আছে? তা হলে সে কেন ছুটছে? তার আগে বাকিরাও কেন ছুটেছে? পাহাড়-নদী ভেঙে, জলে-জঙ্গলে প্রাণপাত করে, নিজের শক্তির সীমার উপরে উঠে কেন ছুটেছে তারা? কেন অযথা এত কষ্ট না করে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে পিঠে গুলি খেয়ে মরেনি তারা? এর উত্তর সে জানেনা। এসব সে ভাবেও না, এত ভাবার সময়ও তার নেই।
পায়ে পায়ে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসে খাদের পাশটায় দাঁড়িয়ে সে নিচের দিকে তাকালো। অনেক নিচে রূপোলি ফিতের মত নদীটা দেখা যাচ্ছে এখন। আর দূরে জঙ্গলে কোথাও অজানা অচেনা একটা পাখি একঘেয়ে ডেকে চলেছে ঘুরে ঘুরে একটাই বিষন্ন সুরে। নদীর দিকটায় নেমে যাবে কি? না, না… তাহলে এতটা উপরে ওঠার কসরত তার একেবারে বিফলে যাবে। তার পিছু-ধাওয়া-করা দলটার সাথে কুকুর আছে। ওরা ঠিক গন্ধ পেয়ে খুঁজে বের করবে ওকে। তাহলে কি জঙ্গলে? জঙ্গল কিন্তু পাহাড়ের গা বেয়ে উঠে গেছে সোজা। অনেকটা চড়াই। ‘কষ্ট হবে’, ভাবলো সে, ‘তবু তাই ভালো।’ আরেকবার চট করে পিছন দিকটা দেখে নিল সে। আর ঠিক তখনই, অনেক দূরে, জঙ্গলের গভীরতম অন্ধকার কোণ’টা যেন একটু নড়ে উঠলো।
তক্ষুণি সে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে লাগল পাহাড় বেয়ে সোজা উপরের দিকে। লাফিয়ে লাফিয়ে বড় বড় পা ফেলে সে এগোতে লাগলো। এ কিন্তু ভয় নয়, এ যেন অভ্যেস। এমন নয় যে তার হৃদস্পন্দনের গতি বেড়েছে, এমন নয় যে সে প্রচণ্ড হাঁপাচ্ছিল, এমনও নয় যে তার কপালের শির ফুলে উঠেছে। শুধু বুকের মধ্যে কোথায় যেন একটা কোনো তারে প্রচন্ড টান লেগে গেছে। বুকের মাঝখানটাতে যেন একটা কান্না তিরতির করে উঠলো।
জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ছুটতে ছুটতে হঠাৎই সে বুঝতে পারলো যে আসলে এক শুকনো নদীখাত বরাবর সে ছুটছে। কোনো এক বর্ষাকালে হয়তো কোন ঝরনা এ পথে নেমেছিল কোনদিন। সামনে ছুটতে ছুটতে একবার আকাশের দিকে তাকালো সে। না, এই রোদ-ঝলমলে দিনে বৃষ্টির কোন সম্ভাবনা নেই । এখন তুমুল বৃষ্টি হলে, ঝড় হলে তার বেঁচে যাওয়ার হয়তো একটা সম্ভাবনা ছিল। গতকাল রাতেও খুব বৃষ্টি হয়েছে। টিনের ছাদে বৃষ্টির অবিরত আওয়াজ তাকে জাগিয়ে রেখেছিল অনেকক্ষণ। সারারাত জেগে সে আশায় বুক বাঁধছিলো। তার মনে হচ্ছিল এ বৃষ্টি যদি না থামে, তবে আজকের এই শিকার হয়তো পিছিয়ে যাবে। গতকালের বৃষ্টির দু-একফোঁটা জল গাছের পাতা থেকে টুপ টুপ করে ঝরে পড়ল তার ধাতব হাতের পাতায়, আর চকচক করতে লাগলো কতগুলো হীরের টুকরোর মতন। একমুহূর্ত সেদিকে মন যেতেই সে জোর হোঁচট খেলো। তার পায়ের লোহার জুতো ঢং করে ঠুকে গেলো মাটিতে পড়ে থাকা একখানা বিশাল পাথরে। শব্দটা শুনে আঁতকে উঠল সে। ওরা এমনও কিছু দূরে নেই যে এই আওয়াজ ওদের কানে যাবে না।
হোঁচট’টা খেয়ে এক মুহূর্তের জন্য সে থেমেছিল। আর তক্ষুনি কানে এলো পাহাড়ের নিচে থেকে, জঙ্গলের ভেতর থেকে তীব্র, হিংস্র হাউন্ডের চিৎকার। এই কুকুরগুলোকে সে ভয় পায় না, কিন্তু কুকুর মানেই সঙ্গে মানুষ আছে। এই প্রাণীগুলোকে কি সে একেবারে সহ্য করতে পারেনা? জীবনে এসব নিয়ে খানিকটা ভাবার সময় পেলে হয়তো এদের সে ঘৃণাই করত। তবে এখন তাতে কিছু আর এসে যায় না।
তার মাথার ভেতর কত ভাবনা যেন বয়ে গেল! সামনে দিগন্তবিস্তৃত পাহাড়ি জঙ্গল ধাপে ধাপে ঢেউ খেলিয়ে উঠে গেছে উপরদিকে। পাহাড়ের চূড়ায় থোকা থোকা মেঘ গায়ে গায়ে লেগে আছে বরফের সাথে। যতদূর চোখ যায় তন্বী নদীর বাঁকে বাঁকে সবুজ, গাঢ় সবুজ ধীরে ধীরে ঘন নীলে মিলেমিশে গেছে। কি সুন্দর এই পাহাড়! আগে কখনো কোনদিন এ জায়গাটার কথা সে ভাবেনি, কোনদিনও এখানে আসেনি। তবু যেন শরীর নিংড়ে রূপোলি তরলের একবিন্দু তার বুকের এপাশ থেকে ওপাশে গড়িয়ে পড়লো। আর কি কখনো দেখতে পাবে সে এই দৃশ্যগুলো? হাতে হয়তো আর ঘন্টা খানেক সময় মাত্র, অথবা হয়তো কয়েক মিনিট।
এবার কি একটু ভয় পেল সে? দৌড় শুরু করতেই আপনা-আপনিই যেন এবার গতিবেগ তার আরো বেড়ে গেল। জোরে। আরো জোরে। এভাবে যেন আগে কেউ কখনো ছোটেনি। এক-একটা পদক্ষেপে চার-পাঁচ মিটার করে লাফিয়ে পেরিয়ে যেতে লাগল সে। এবার যেন কপাল দপদপ করছে তার, এবার যেন চোখের সামনে আলো ঝলসে উঠছে মাঝে মাঝে। তার ভারি পদক্ষেপে উপড়ে যেতে লাগল ঘাস। তার হাত-পা যেন টনটন করে উঠল। সে বুঝতে পারল হয়তঃ তার একটু আস্তে ছোটা উচিত, কিন্তু নিজের উপর থেকে সমস্ত নিয়ন্ত্রণ তার যেন চলে গেছে। সে থামতে চাইল না, কিংবা হয়তঃ থামতে পারল না। এ দুটোর মধ্যে তফাৎ করার ক্ষমতা ঈশ্বর তাকে দেননি।
আয়নার মত স্বচ্ছ্ব একখানি সরোবর গাছের ফাঁক দিয়ে চিকচিক করে উঠলো। জলের ধারে হয়তো কিছু তাঁবু থাকতে পারে। সে সাবধান হলো। নিঃশব্দে, শান্ত ভাবে এগোতে লাগলো। ওই তো তাঁবুর গর্ত, ওই তো জলের ধারে নৌকো বাঁধার সুগভীর আঁচড়। তবে যাক, কোনো মানুষ নেই। সরোবরের ধার ঘেঁষে প্রায় কয়েকশো গাছ কে জানে কোন ঝড়ের তান্ডবে কবে থেকে উৎখাত হয়ে পড়ে আছে। যেন সারি সারি মৃতদেহ শোয়ানো। জায়গাটা পেরোনো সোজা নয়, কোনোক্রমে নিজের সুবিশাল দেহটাকে টেনে টেনে সে এগিয়ে চলল।
শেষ গাছটা পেরোতেই সামনের সবুজের মাথার উপর দিয়ে সে দেখতে পেল মাস্তুলের মত মাথা উচু করে আছে একখানা লোহার স্তম্ভ। ওটা কি? তখনই বিদ্যুৎ ঝলকের মতো মনে পড়ল, এখান দিয়েই তো হাইভোল্টেজ পাওয়ার লাইন গেছে। জঙ্গলের মাঝের এই টাওয়ারগুলোকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে চলে গেছে একেবারে নিচের সমতল পর্যন্ত। সে দৌড়ে গিয়ে স্তম্ভের গোড়ার কাছটাতে নিজেকে লুকিয়ে নিল। শিকারি দলের কাছে একরকম এক্স-রে মেটাল ডিটেক্টর আছে। গাছের কান্ডের ফাঁকে ফাঁকে লোহার চিহ্নমাত্র টের পেলে সে যন্ত্র চিৎকার করে তাদের জানিয়ে দেয় যে শিকার কাছেই আছে। কিন্তু এই স্তম্ভের কাছাকাছি দাঁড়ালে তাকে ও যন্ত্র আর খুঁজে পাবেনা। তবে ওদের কাছে কুকুর আছে, তারা গন্ধ পাবে ঠিক। ওরা গেল কোথায়? এতক্ষণে তো ওদের পায়ের শব্দ তার কানে আসা উচিত ছিল। কোন কিছুতে আটকে পড়েছে কি?
এতক্ষণে সে টের পেল যে দাঁড়ানোমাত্র তার সারা শরীরে যেন আগুন জ্বলে উঠেছে, কলকব্জাগুলো যেন ঢিলে হয়ে আসছে। সে হাত-পা ছড়িয়ে দিলো একটু। হু হু করে আগুনের স্রোত যেন বেরিয়ে যাচ্ছে শরীর থেকে। সে বুঝতে পারছিল এখানে দাঁড়িয়ে পড়লে তার সময় শেষ হয়ে যাবে খুব শিগগিরি। এসব তার বহুবার দেখা। এরকম শিকারের সে পাঁচ-পাঁচ বার এসেছে। তবে, সেবারগুলোতে সে শিকার ছিল না। সে এসেছিল শিখতে; সমগোত্রীয় আরেকজনের মৃত্যুউৎসবে শিক্ষানবীশ হয়ে। আর প্রত্যেক বার একটা জিনিস শিখেই সে ফিরে গিয়েছিল। যে এই দৌড় শিকারের অন্তিম দৌড়। শিকারীর জন্য অবশ্য এ হল সেই চিরকালের আদিম আনন্দ খুঁজে পাওয়ার একটা ব্যবস্থামাত্র। পশুহত্যা তো এখন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ, তাদের সংখ্যা এতটাই কমে গেছে যে পশুশিকার চলতে থাকলে ক’বছরেই মানুষ ছাড়া অন্য কোনো পশু আর থাকত না পৃথিবীতে। অথচ শিকারের আনন্দের কি কোনো তুলনা হয়? তাই এই ব্যবস্থা। তাই কুকুর থেকে শুরু করে আধুনিক সমস্ত যন্ত্রপাতি, অস্ত্রশস্ত্রের ব্যবস্থা রয়েছে ওদের ওই ছোট্ট স্কুল ব্যাগে। যাতে কোনভাবে কোন গোলমাল না হয়। হরিষে বিষাদ না হয় যেন!
না, দিগন্তে কোন ছায়ামূর্তির দল ভেসে উঠলো না। হয়তো ওরা জ্বালানি বাঁচাচ্ছে। এতে যে সে খুব নিশ্চিন্ত হল তা নয়, বরং ভেতরে ভেতরে ভীষণ এক নিরাপত্তাহীনতা তাকে পেয়ে বসলো। হয়তঃ শিকারীরা অন্য কোনো প্যাঁচ কষছে। তার চোখ নিজে থেকেই চলে গেল ডানদিকে ওই জাহাজের মাস্তুলের মত উঁচু লৌহস্তম্ভটার দিকে। তার থেকে সার বেঁধে ধাতব ইলেকট্রিক তার সোজা নেমে গেছে নিচের সমতলে। বিদ্যুৎ নিয়ে চলেছে বিশালাকৃতি লৌহমিনার! মানুষের নাগালের সম্পূর্ণ বাইরে!
এক পলকে সে লৌহস্তম্ভটা বেয়ে উঠতে শুরু করলো। দূর থেকে তাকে দেখলে মনে হবে যেন একটা শিম্পাঞ্জী তরতর করে চড়ছে গাছে। তামা আর অ্যালুমিনিয়ামের তারগুলো ঝকঝক করছে সূর্যের আলোয়। মাশরুমের মতো উঁচু হয়ে থাকা চিনামাটির ছোট ছোট বাটির মালার অন্তরকের সুরক্ষা সেই তারের গায়ে। চিনামাটি তার ভার নিতে পারবে না। সে আস্তে করে ঝুঁকে পড়ে তামার তারের উপরেই হাত রাখল সরাসরি। তারপর অন্য হাত। তারপর বাকি দুটো পাও। তারপর এক মূহুর্তে চার হাত-পায়ে ওই তার ধরে ঝুলে পড়ে সরসর করে নামতে থাকলো নিচে সমতলভূমির দিকে, ভীষণ দ্রুতগতি’তে।
অভিকর্ষের টানে দূর্বার গতিতে। হাইটেনশন তারের বিদ্যুৎ ওর হাতের ছোঁয়া পেয়ে যেন চমকে উঠলো। অথচ, তার চোখ নির্বিকার। সূর্যের ঝলমলে আলোতে সে যেন দেখতেই পেল না তার দুই হাতের তালু ঝলসে যাচ্ছে কয়েকশো ভোল্টের ইলেকট্রিক শকে। আগুনের ফুলকি উড়তে লেগেছে চতুর্দিকে। তার দৃষ্টি নিচের উপত্যকার দিকে স্থির হয়ে আছে। ঘাসের কাছাকাছি আসতেই সে লাফিয়ে নামল নিচে। আর তক্ষুনি নীল আলোয় চারদিক ঝলসে দিয়ে প্রচন্ড বিদ্যুৎ তার শরীর দিয়ে বয়ে গেল। সে মাটিতে পড়ে ছটফট করতে লাগলো। নিদারুণ যন্ত্রণায় ঘাস ছিঁড়তে লাগল মুঠো মুঠো। সমস্ত শরীর যেন নিস্তেজ হয়ে আসছে। তবু সে আড়চোখে তাকালো ফেলে আসা পাহাড়ের চূড়াটার দিকে। দেখতে দেখতে যেন ছোট ছোট কতগুলো ছায়ামূর্তি এসে দাঁড়ালো সেখানে। মানুষ, না কুকুর, বোঝা যায় না। সে মুচকি হাসল, এই দৌড় সে এত তাড়াতাড়ি শেষ হতে দেবে না।
এখনো তার শরীরে এখানে-ওখানে কালো আর নীলচে ক্ষত। বিদ্যুতের চাবুকের দাগ। সে কুঁকড়ে গেল মাটির উপর শুয়ে। একটা মিনিট কি অন্ততঃ থেমে থাকতে পারে সে? শিকারীদেরকে তো সে অনেক পিছনে ফেলে এসেছে। একটু কি বিশ্রাম নিতে পারে? মনে হচ্ছে যেন প্রবল জ্বর আসছে, শরীর পুড়ে যাচ্ছে যেন। সে মরার মত পড়ে রইল কিছুক্ষণ। বিহ্বলের মত তাকিয়ে রইলো নিজের বাঁ’হাতের অস্বাভাবিক রকম মুচড়ে-যাওয়া কনুই’টার দিকে। কনুই’এর কাছে, হাঁটুর কাছে এ সব কি লেগে আছে? এ তো রক্তের মত দেখাচ্ছে!
না। রক্ত নয়। ওর যান্ত্রিক শরীরে রক্ত কোথায়? যে নাম-না-জানা ফুলের ঝোপখানাকে তছনছ করে সে পড়েছে, তার থেৎলে-যাওয়া লালচে ফল থকথকে রক্তের মত লেগে আছে তার গায়ে। জামের মতন ছোট ছোট ফল। কি অদ্ভূত গাঢ় মেরুণ তার রঙ। শুয়ে শুয়ে ফলে-ছেয়ে-থাকা ঘাসজমি’টাকে দেখতে দেখতে তার মনে হল, ‘যদি কিচ্ছুটি না করতে হত… যদি এভাবেই চিরটাকাল কাটানো যেত…’

তবে তেমন ভাগ্য তার নয়। তাই নিজেকে হারিয়ে ফেলার আগের মূহুর্তে ব্যথায় কাতর শরীরটাকে টেনে তুললো সে। কুকুরগুলো খানিকক্ষণ দিশেহারা হয়ে পড়বে বটে, কিন্তু বুদ্ধিমান শিকারীর দলের ব্যাপারটা বুঝতে খুব বেশী সময় লাগবে না। ওরা আবার যেই গোড়ার থেকে শুরু করবে, তক্ষুণি ওর খোঁজ পেয়ে যাবে।
জঙ্গলের ধার বরাবর ও দৌড় শুরু করলো। ওদিকের পাহাড়ের তুলনায় এদিক’টা অনেক আলাদা। নদীটা অদূরে বইছে। সামনে তাকালে জঙ্গল বেশীদূর নেই আর। ওই যে দূরে আবছা ছবির মত বড় রাস্তাটা, নদীর ওপর দিয়ে এ চূড়া থেকে ও চূড়ায় রেলের ব্রিজ, পাহাড়ের গায়ে ইতস্ততঃ ছড়ানো লাল-সাদা চালের বাড়ি, ওই ততদূরই ওর সীমারেখা। তার ওপারে আর যেতে পারবে না সে।
হাওয়া’টা ধাক্কা দিচ্ছে তার পিঠে। এক দিক থেকে ভালো। কুকুরগুলো সহজে গন্ধ পাবে না। তবে সেই হাওয়াতেই ভেসে এল প্রাণীগুলোর গর্জন। খুব কাছে নয়। তবে তাদের বিরক্তি, ক্লান্তি, রাগ সব মিলেমিশে গেছে সেই ডাকে। ভয় কাঁপিয়ে দিল তাকে। নাকি প্রচন্ড পরিশ্রমে শরীর সঙ্গ দিচ্ছে না আর। সে বাঁ-দিকে বাঁক নিয়ে এবার জঙ্গলে ঢুকে পড়লো। আর ঢুকেই একটা গাছের উঁচু শিকড়ে হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়লো মাটি’তে। মিনিটখানেক চোখের সামনেটা অন্ধকার হয়ে গেল তার। তারপর ধীরে ধীরে চোখ খুললো সে।
জঙ্গলের ভেতরে গাছের ফাঁক দিয়ে এখানে ওখানে সূর্যের আলো স্পটলাইটের মতন এসে পড়েছে। মাটিয়ে ছিড়িয়েছিটিয়ে আছে সাদাটে কচ্ছপের খোলের মত পাথর। আর একটু দূরে একটা বড় পাথরের চাঁইয়ের ওপরে রাখা এক গুচ্ছ রূপোলী ফিতে হাওয়ার তালে তালে উড়ছে আস্তে আস্তে।
সে আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল ছেলেমানুষের মত অমোঘ কৌতূহলে। টিনের পাত পাতলা করে কেটে কেউ বানিয়েছে এগুলো। পাথরের ওপরে রাখা গোছা’টা থেকে কয়েকটা রূপোলি সুতো উড়ে বেড়াচ্ছে হাওয়ায়। আটকে যাচ্ছে গাছের ডালে। কে বানিয়েছে এগুলো? কেন? পরমূহুর্তেই সন্দেহ ফিরে আসে হুড়মুড় করে। ফাঁদ! নিশ্চয়ই কোনো ফাঁদ এটা! তার শিকারীরা যে বহুদূরে অন্যদিকে পাহাড়ী পথে তার পিছুধাওয়া করেছিল সে কথা মন থেকে মুছে ফেলে একটা সর্বগ্রাসী আশঙ্কা তাকে চেপে ধরে। চকিতে ফাঁকা জায়গাটা থেকে সরে এসে ছিটকে আরো গভীর জঙ্গলের দিকটাতে ঢুকে পড়লো সে। এতক্ষণে হয়তঃ কুকুরের দল আবার গন্ধে গন্ধে ওর পিছু ধরেছে। দূরত্ব কমতে দেওয়া চলবে না। ততক্ষণ, যতক্ষণ না ক্লান্ত কুকুরের দলের গর্জন ক্ষীণ ঘ্যানঘ্যানানিতে বদলে যায়। ততক্ষণ, যতক্ষণ না তারা দিশাহারা হয়ে শিকারীর দলে কাছে কাঁচুমাচু মুখে ফিরে যায়।
সামনের জায়গাটায় চুনাপাথরের কিছু টিলা সার বেঁধে উঠে গেছে একে একে। অতি সংকীর্ণ কিছু গিরিপথ তার ফাঁকে ফাঁকে। টুপটাপ জলের ফোঁটা ঝরে পড়ছে পাথরের গা বেয়ে, গতরাত্রের বৃষ্টির সাক্ষী হয়ে। গুহার মত অন্ধকার সে সব পথ সোজা নেমে গেছে আরো নিচের দিকে। বেছে বেছে একটা গিরিপথের সামনে এসে দাঁড়ালো সে। ফার্ণ আর মসের স্যাঁতস্যাতে গুহাটার শেষ প্রান্তে সামান্য একটু আলোর আভাস। এক মূহুর্ত সে এক কঠিন সম্ভব-অসম্ভবের হিসেব কষে নিল। তারপর বুকের কাছে দু’হাত জড়ো করে নিজেকে গড়িয়ে দিল সেই ঢালু অপ্রশস্ত পথ বরাবর।
যেন অনন্ত এক অন্ধকূপে তার পতন শুরু হল। মনে হল যেন এক যুগ পরে (আসলে কয়েক মিনিট) সে ছিটকে বেরোলো পথের অন্য প্রান্তে, সূর্যের আলোয়। বেরোতেই একখানা ফার ঘাছে প্রচন্ড ধাক্কা খেয়ে এক রাশ নুড়ি পাথরের ওপর পড়ল সে। কনকনে ব্যথায় মনে হল বাঁ পা’টা বোধহয় এক্কেবারে অকেজো হয়ে গেছে। সে চোখ খুলে দেখলো গুহার মুখটায় আরো কয়েকটা রূপোলি সুতো উড়ছে। আর তক্ষুণি খুব কাছে কারো পদক্ষেপের অস্পষ্ট শব্দ শুনে তার সমস্ত শরীর কাঠ হয়ে গেল।


[বাকিটা শেষ পর্বে...]

উইকএন্ডে চলুন, তিঞ্চুলে

By : Sayantari Ghosh

 

কাল রাতে একটা জম্পেশ স্বপ্ন দেখলাম।

দেখলাম, আমি ট্রেনে করে যাচ্ছি, সাইড লোয়ার বার্থে ঘুমাচ্ছিলাম, হঠাত ঘুম ভেঙে গেল। দেখি, একটা সবুজ পাইনে ঘেরা দিগন্তজোড়া চা-বাগানের পাশে ট্রেন দাঁড়িয়ে গেছে... রেললাইনটাকে প্রায় জড়িয়ে ধরে ফুটে আছে ঝাঁক ঝাঁক গোলাপী আর হলুদ ঘাসফুল। খানিকটা দূরে বেঁকে চলে গেছে একটা হাতছানি দেওয়া সর্পিল রাস্তা, রাস্তার ধার বরাবর পতপত করে উড়ছে তিব্বতী ভূততাড়ানি পতাকার সারি... ডানদিকে অনেকটা দূরে একটা সবুজ পাহাড়, পাহাড়ের কোল আলো করে কমলালেবুর বাগানে ঘেরা একটা ছোট্ট রংচঙে মনাস্ট্রি। আর সবার পিছনে টারকুইজ নীল ব্যাকগ্রাউন্ডে ঝলমল করছে কাঞ্চনজঙ্ঘা!

স্বপ্নটা আজ সকালে উঠেও আলো করে ছিল মনটা। দাঁত মাজতে মাজতে ভাবছিলাম, কোথায় যেন দেখা ছবিগুলো... ফুলের দল, চা-বাগান, মনাস্ট্রি, গাছ উপচানো কমলালেবু, পাইনের সারি, টিবেটান প্রেয়ার ফ্ল্যাগ, কাঞ্চনজঙ্ঘা... টুকরো টুকরো ছবির একখানা কোলাজ যেন দেখলাম!

চায়ের জল’টা যেই সোনালী হয়ে ফুটে উঠলো, অম্নি মনে পড়ে গেল... তিঞ্চুলে...!

বছর তিনেক হয়ে গেল তিঞ্চুলে ঘুরে এসেছি, জানেন, কিন্তু যখনই ট্যুর’টা মনে পড়ে কি যে ভালো লাগে কি বলব! আজ ছবিগুলো উল্টেপাল্টে দেখতে দেখতে ভাবলাম যেটুকু যা মনে আছে এখানে তুলে রাখি। আপনি হয়তঃ কাজের চাপে দম ফেলতে পারছেন না, বা কোনো কিছু নিয়ে খুব টেনশনে আছেনহয়তঃ আপনার খুব মনখারাপ যাচ্ছে, কিম্বা প্রাণ’টা ছটফট করছে ব্যস্ত শহরের হুড়োহুড়ি’তে। সেক্ষেত্রে এ লেখা’টা আপনার কাজে লেগেও যেতে পারে। উইকএন্ডের আশেপাশে আর একটা কি দুটো দিন ছুটি ম্যানেজ করতে পারবেন? তাহলে তিঞ্চুলে’টা ঘুরে আসুন। নিজের সাথে সময় কাটাতে হলে এ জায়গার কোনো জুড়ি নেই। এখানে পাইনবনের আলোছায়ার ঘুরতে ঘুরতে আপনার নিজের সাথে নতুন করে দেখা হয়ে যাবে, কথা দিতে পারি।

এবার আপনি বলবেন, “তিঞ্চুলে... হেঃ হেঃ, অদ্ভূত নাম... কোথায় জায়গাটা?”

আমিঃ “কাছেই... উত্তর বাংলা... নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে নেমে ঠিক পঁচাত্তর কিলোমিটার... শুক্কুরবার রাত্তিরে অফিস করে ট্রেন ধরে নিন... সকাল সকাল নামবেন... তারপর গাড়ি... দুপুরের লাঞ্চ তিঞ্চুলে’তে... আবার সোমবার’টা ছুটি নিলে মঙ্গলবার ভোরে আপনি আবার আপনার ব্যস্ত শহরের রাস্তায়... উইকএন্ডে ঘুরে আসার মত এরকম রোম্যান্টিক জায়গা খুব কম হয়, বুঝলেন...! নিচু হয়ে থাকা পাইনবনের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা রাস্তা... গেলে মনে হবে গ্রাম’টা যেন চা’য়ের বাগানে গা এলিয়ে আলসেমি করছে... বেড়ানোর প্ন্যানও একেবারে তৈরী... কোথায় যাবেন কি বেড়াবেন সে নিয়ে বেশী ভাবনারও দরকার নেই... তিঞ্চুলের গুরুং গেস্ট হাউস বুক করে রাখলে সব ব্যবস্থা ওরাই করে দেবে...”

  



আপনি(খানিক ডিপ্রেসড মুখ করে), “অ... গেস্ট হাউস... ভালো হোটেল কিছু নেই? রিসর্টগোছের আর কি...”

আমি (রে রে করে উঠে), “আরে বলেন কি? ভুলেও এ’কথা আর মুখে আনবেন না... অনেকরকম হোটেল রিসর্টের থেকেছি মশাই, কিন্তু গুরুং গেস্ট হাউসের মত ভালো ব্যবস্থা আর আদরযত্ন খুব কম জায়গায় পেয়েছি... যে’কদিন থাকবেন, মনে হবে আপনাকে পেয়ে বোধহয় ওদের আনন্দ আর ধরছে না... ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠিয়ে অসাধারণ চা খাইয়ে আপনাকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখাতে নিয়ে যাবে, বাড়ির ছেলেরা সঙ্গে করে ট্রেকিং’এ নিয়ে যাবে... আর খেতে বসে আপনি বলবেন যে ‘আর পারবো না’, তবু আপনার পাতে জোর করে দু’টো লুচি গুঁজে দেওয়া হবে... একেবারে জামাই-আদর যাকে বলে...”

আপনি, “তাই নাকি? বাব্বাহ্‌, দারুন ব্যাপার তো হে... তা প্ন্যানটা একটু গুছিয়ে বল দিকিনি...”

আমি, “ওই তো... ধরে নিচ্ছি আপনি সোমবার’টা ছুটি ম্যানেজ করেছেন... তাহলে শুক্রবার রাতে ট্রেন, শনিবার সকালে নিউ জলপাইগুড়ি, দুপুরে তিঞ্চুলে... বিকেল’টা জাস্ট পাইনবনে ঘুরে, পাখির ডাক শুনে, ঝোলা বারান্দায় বসে দার্জিলিং টি খেয়ে রিল্যাস্ক করুন... রোববার ভোরবেলা উঠে পড়ে গেস্ট হাউসের টাওয়ার থেকে দেখে নিন সানরাইস... যারা আগে দেখেছেন তাদের আর নতুন করে বলার কিছু নেই যে কি অভাবনীয় রকমের সুন্দর কাঞ্চনজঙ্ঘায় সূর্যোদয়... আমার দেখা সেরা কাঞ্চনজঙ্ঘা কিন্তু আমি তিঞ্চুলে থেকেই দেখেছি, নভেম্বর মাসের ধারালো ঠান্ডায় ভোর পৌনে পাঁচটায়। আমার নিজের কথা বলতে পারি, স্পেলবাউন্ড বলতে যা বোঝায় আমার সেই দশা হয়েছিল! যখন কমলালেবুর মত সূর্য’টা আস্তে আস্তে উঁকি দেবে আর গলানো সোনা ঢেলে বাঁধিয়ে দেবে কাঞ্চনজঙ্ঘা’কে, তখন আপনি পৃথিবীর আর সব কিছু পুরোপুরি ভুলে যাবেন কয়েকমিনিটের জন্য! মনে হবে সময় থমকে গেছে আর আপনি দাঁড়িয়ে আছেন স্বর্গের দরজায়। চোখ ফেরানো যায় না এত সুন্দর, অথচ সে সৌন্দর্য জমকালো না কি স্নিগ্ধ সেটা আমি এখনও ঠিক করে উঠতে পারিনি... অসাধারণ অভিজ্ঞতা... ভাষায় বোঝাতে পারবো না আর কি...”



আপনি, “আহা... মন ভরে যাচ্ছে গো... সত্যি এত সুন্দর?”

আমি, “সে তো হবেই, কাঞ্চনজঙ্ঘা বলে কথা, এ বাংলায় ও’রকম ডাকসাইটে সুন্দরী আর ক'জন আছে বলুন! হেঃ হেঃ হেঃ... সানরাইস হয়ে গেল তাহলে... সূর্য ওঠার পর কাঞ্চনজঙ্ঘা যখন আপনার মন ভরিয়ে দিয়েছে, তখন বাগানে চেয়ার পেতে বসে ব্রেকফাস্ট সেরে নিন... এরপর কিন্তু সারাদিন বেড়ানো... শুরু করুন হাতের কাছের গ্রাম লামাহাট্টা দিয়ে (এখানেও অনেক নতুন হোটেল হয়েছে, অনেকে তিঞ্চুলে’তে না থেকে এখানেও থাকেন)... এখানে আছে পাহাড়ের ধাপ বেয়ে মরসুমী ফুলের বাগান, আর পাখির ডাকে কুয়াশার ওড়নায় ঢাকা একটা ছোট্ট লেক... ঘন্টাখানেক এখানে কাটান আর অফিসের যাবতীয় দুশ্চিন্তাকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দিন... তারপর চলে আসুন তিঞ্চুলে মনাস্ট্রি... পাহাড়ের চূড়োয় ছোট্ট এই মনাস্ট্রি’টিও শান্তি-দিয়ে-মোড়া... এরপর দুপুরের খাওয়া সেরে বড়া-মাঙ্গওয়া গ্রামের কমলালেবুর বাগান... যাওয়ার রাস্তা একটু ভাঙাচোরা, কিন্তু বাগান’টি দেখে মন ভরে যাবে... আর সব শেষে তিস্তা-রঙ্গিতের সঙ্গম, ত্রিবেণী’ও বলে জায়গাটা’কে অনেকে... দেখবেন চঞ্চল, উদ্ধত, সবুজ রঙ্গিত নদী হঠাত এক পাহাড়ের বাঁকে এসে শান্ত তিস্তার ধূসর রহস্যের মধ্যে হারিয়ে ফেলেছে নিজেকে... প্রতি’টা জায়গা চোখজুড়ানো, মনভরানো... ঘন্টার পর ঘন্টা শুধু নিস্তব্ধতা’টাকে উপভোগ করে কাটিয়ে দিতে পারবেন... মনে হবে, এ’সব জায়গায় কথা বলার প্রয়োজনই নেই কোনো... সব কথা এম্নিই বলা হয়ে যায়... সব চিন্তা আপনিই দূর হয়ে যায়... যখন সন্ধ্যেবেলা গেস্ট হাউস ফিরবেন, ততক্ষনে রবিবার দিনটা শেষ হয়ে গেছে... আর আপনার ছুটিও প্রায় শেষ...”
  



আপনি, “ইস...”

আমি, (বলেই চলেছি), “পরেরদিন সকাল’টা তাই নিজের মতন করে কাটান... গেস্ট হাউসের একজন কাউকে সাথে নিয়ে বেড়িয়ে পড়ুন ট্রেকিং’এ... অথবা পায়ে হেঁটে উঁচুনিচু পথে নিটোল ছোট্ট এই গ্রাম’টা ঘুরে নিন... পাইনে ঘেরা এক চিলতে মাঠে ক্রিকেট খেলে নিন গ্রামের ছোটদের সাথে... কিম্বা প্রিয়জনের হাত ধরে এক্সপ্লোর করে আসুন পাইনবনের আলোআঁধারির ভেতর দিয়ে হারিয়ে যাওয়া কোনো একটি আঁকাবাঁকা শুঁড়িপথ... দশ’টা নাগাদ ফিরে এসে দেখবেন গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে... ব্রেকফাস্ট রেডি... মনে হবে শুধু আপনিই তৈরী নন তিঞ্চুলে’কে ছেড়ে আসতে... বিকেলে যখন এন.জে.পি. থেকে ট্রেনে উঠবেন দেখবেন তখনও আপনার মন মনাস্ট্রির প্রেয়ার ফ্ল্যাগের পাশে, চা’বাগানের কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলে কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকে তাকিয়ে আছে...”














আপনি, “উফফ, যা বলেছ... খরচ-খরচার একটা এস্টিমেট দাও দেখি এখুনি... এত কিছু শুনে যে যাওয়ার ইচ্ছে প্রবল হয়ে উঠছে ভাই...”

আমি, “যান না, আমিও তো যেতেই বলছি... গুরুং গেস্ট হাউসের ওয়েবসাইট দিয়ে দিচ্ছি... যোগাযোগ করুন... ইচ্ছে হলে লামাহাট্টা বা বড়ামাঙ্গওয়া’তেও থাকতে পারেন... থাকার খরচা সব জায়গায় কম-বেশি একই... ১২০০-১৭০০ ঘরভাড়া, সঙ্গে সারাদিনে চারবেলার খাওয়া-দাওয়া ৫০০-৬০০ মত। বাড়তি খরচা হল গাড়ি... মনে রাখবেন জলপাইগুড়ি থেকে পিক আপ আর ড্রপের গাড়ি বুকিং’এর কথাটা হোটেল’কে বলতে ভুলবেন না... তিঞ্চুলে’তে কিন্তু ট্যুরিস্ট’এর ভিড় নেই, ফলে শেয়ারে গাড়িও নেই... স্টেশনে নেমে গাড়ি করতে গেলে ড্রাইভার’রা যা খুশি দর হাঁকতে পারে... হোটেল থেকেই গাড়ি’টার ব্যবস্থা হলে ভালো... সে খরচা’টা আমাদের পড়েছিল ১৮০০টাকা... আমি কিন্তু তিন বছর আগের কথা বলছি...

আপনি, “ওক্কে, বুঝলাম, সব মিলে মন্দ নয়, বুঝলে... দেখি কবে যাওয়া যায়... আর দরকারী কিছু বাদ পড়ছে? ভেবে বল দেখি...”

আমি, “ও হ্যাঁ, ভুলেই গেছিলাম বলতে... আপনাদের বেড়ানোর দল যদি অ্যাডভেঞ্চারাস হয়, তাহলে রাফটিং করতে পারেন তিস্তায়... ত্রিবেনী’তেই রাফটিং হয়, ভীষণ এনজয় করবেন... আর হ্যাঁ, এন.জে.পি.’র ট্রেনের টিকিট কিন্তু সময় থাকতে কেটে ফেলুন, টিকিট পাওয়া যায় না দেরী হয়ে গেল আর... ঘুরে আসুন, ভালো লাগবে... দুটো দিনের জন্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলুন না তিঞ্চুলের পাইনবনে... দেখবেন, নিজেকে খুঁজে পাবেন নতুন করে... ফিরে এসে আমাকে জানাবেন কিন্তু কেমন ঘুরলেন...


উইকএন্ডে চলুন, বড়ন্তি

By : Sayantari Ghosh


মাঝেমাঝে উইকএন্ড’গুলো ঘরে বসে থাকতে হবে ভেবে আপনার গায়ে জ্বর আসে না? আমার তো প্রায়শঃই আসে! বিশেষতঃ যদি তার সাথে একটা সোমবার পনেরই অগাস্ট পড়ে যায়, বা শুক্কুরবার’টা হয় গুড ফ্রাইডে। আমার তো ভাই তেমন হলে মাথা দপদপ, কান কটকট, হাত নিশপিশ সব একসাথে হতে থাকে। পড়াশোনা করতে বসলেই ব্যাগ গোছাতে ইচ্ছে করে, পুরোনো বেড়াতে যাওয়ার ছবিগুলো দেখলেই কান্না পায়, ইন্টারনেট খুললেই হাত চলে যায় ইন্ডিয়ান রেলওয়েজের ওয়েবসাইটের দিকে। বুকের ভেতর নানারকম প্রশ্ন খচরমচর করে, “কোথায় টিকিট আছে দেখি? কবে যাওয়া যায়? কবে ফেরা যায়? থাকবো কোথায়?” আরো কত কি!

আমি তাই যখন-তখন বেরিয়ে পড়ি পিঠে ব্যাগ নিয়ে, সঙ্গে বন্ধুবান্ধব বা বাড়ির কাউকে জুটিয়ে নিই। তো এরকমই একটা উইকএন্ডে আমরা ঘুরে এলাম বড়ন্তি। নেক্সট ছুটি’তে যদি আপনার ইচ্ছে হয়, তাই ডিটেইলগুলো ব্লগে তুলে রাখছি। যদি আপনাদের কারো কাজে লেগে যায়...

এবার আপনি বলবেন, “কেন যাবো বড়ন্তি? সেখানে আছে’টা কি?”

আমি বলব, “আপনার গ্রাম ভালো লাগে? মেঠো আলপথ, লালমাটির ধূলোওড়া রাস্তা, পরিষ্কার আকাশ, খোলা হাওয়া, অন্ধকার রাতের আকাশে একটা-দুটো করে উল্কা? তার সাথে জুড়ে নিন ছড়ানো-ছেটানো পাহাড়, টিলা, শিমুল-পলাশের জঙ্গল আর একখানা বি-শা-ল লেক। নির্জন, ছিমছাম, নির্ঝঞ্ঝাট। কলকাতার হট্টগোল থেকে দুটো দিন নিজেকে ছুটি দিতে ইচ্ছে করলে আপনার এ জায়গা ভালো লাগবে আমার মনে হয়...”

এবার আপনি, “জায়গাটা কোথায় বল তো?”

আমি, “মুরাডি চেনেন? যেখানে খুব বড় একটা চোখের হাসপাতাল আছে? চেনেন না? আমি বলে দিচ্ছি। আসানসোল চেনেন তো? বড়ন্তি আসানসোল থেকে ৪০ কিলোমিটার মোটামুটি। একটা উইকএন্ড কাটিয়ে আসার পক্ষে কলকাতা থেকে বড়ন্তির দূরত্ব’টা কিন্তু এক্কেবারে আইডিয়াল।
ধরুন, যদি কলকাতা থেকে যান তাহলে দু’ভাবে যেতে পারেন। এক, আপনি চাপতে পারেন আসানসোল যাওয়ার যে কোন ট্রেনে। আসানসোলে নেমে চেপে পড়ুন আদ্রা লাইনের যে কোনো লোকালে, চতুর্থ স্টেশন মুরাডি, আধ-ঘন্টার রাস্তা। আবার অন্য আরেকটা উপায় হল শুক্কুরবার অফিস সেরে এসে আপনি রাত্তিরে ধরে নিতে পারেন হাওড়া-চক্রধরপুর প্যাসেঞ্জার। ভোর পাঁচটায় নামবেন আদ্রা। এক কাপ চা খেয়ে আসানসোল লাইনের লোকাল ট্রেন ধরুন, এদিন থেকেও চার নম্বর স্টেশন মুরাডি। আমার মতে দ্বিতীয়’টা আপনার পক্ষে বেটার অপশন। তাতে সময় বাঁচবে। তবে যদি আসানসোল বা আদ্রা থেকে দু’দিনের জন্য একটা গাড়ি ভাড়া করে বেরিয়ে পড়তে চান, তা হলে আপনার আসানসোল হয়ে যাওয়াই ভালো, আদ্রায় অত গাড়ি পাবেন না।

আপনি, “মুরাডি, আদ্রা, জায়গাগুলোর নাম শুনিইনি আগে কখনও...”

আমি, “হেঃ হেঃ হেঃ... জয়চন্ডী পাহাড়ের নাম নিশ্চয়ই শুনেছেন? হীরক রাজার দেশের অনেকখানি শুটিং হয়েছে কিন্তু এই এলাকায়, সেই পাহাড়ে মাস্টারমশাইএর লুকিয়ে থাকার জায়গাটা মনে আছে তো? দেখবেন, দেখলেই চিনে ফেলবেন। আদ্রার দিক থেকে এলে জয়চন্ডী পাহাড় স্টেশনটাও পেরোবে, অনেকে ট্রেকিং করতে আসে এই পাহাড়ে... ট্রেন থেকেই দেখতে পাবেন...

ট্রেন থেকে নেমে দেখবেন, মুরাডি স্টেশন’টা চুপটি করে ঘুমিয়ে আছে যেন। কোন ব্যস্ততা নেই কোথাও। নেমে পড়ে একটা রিক্সা করে নিন, ধিমে তালে রিক্সা চলবে গাংপুর গ্রামের অলিগলি ধরে। গ্রাম ছাড়িয়ে মেঠো পথ ধরে আরেকটু এগোতেই দেখতে পাবেন এলোমেলো পাহাড়ি দিগন্ত রেখার গায়ে রূপোলি একটা দাগ, স্টেশন থেকে আট কিলোমিটার রাস্তা পেরিয়ে এসে যখন রিসর্টের সামনে নামবেন, দেখবেন সেই দাগটাই পাহাড়ে ঘেরা এক বিশাল লেক হয়ে গেছে। কলকাতা থেকে রাত সাড়ে দশটায় শুরু করে সকাল সাত’টা সাড়ে সাত’টার ভেতর আপনি বড়ন্তি’তে। আর একেবারে হাওড়া থেকে এই রিসর্ট অবদি যাতায়াতে সাকুল্যে আপনার ২৫০ টাকাও খরচ হবে কিনা সন্দেহ...”

আপনিঃ “ওকে, ওকে, গুড... পৌঁছে গেলাম ধরো, এবার? কদিনে প্ল্যান, কি কি ঘোরার জায়গা?”

আমিঃ “দেখুন, এ জায়গাটার মেইন অ্যাট্রাকশন কিন্তু শান্তি আর নির্জনতা। নিজের সাথে, নিজের কাছের মানুষদের সাথে দু’দন্ড রিল্যাক্স করা। দেখার জায়গা যে কিছু নেই তা না, অজস্র আছে, বড়ন্তির একদিকে বিহারিনাথ পাহাড়, একদিকে পাঞ্চেত ড্যাম, আর খুব কাছেই গড়পঞ্চকোট। তারপর ধরুন, আসানসোলের পথে একটু এগোলেই মাইথন ড্যাম, কল্যানেশ্বরী মন্দির। গাড়ি নিয়ে আসেন যদি তাহলে এ’সব বেড়াতে বেড়াতে দিব্বি দু’টো দিন কেটে যাবে। কিন্তু এ’সবের আগে বিকেলে যখন লেকের জলে হাজার শেডের হলুদ, কমলা আর লাল গুলে দিয়ে সূর্যাস্ত হবে তখন জলে পা ডুবিয়ে বসে থাকুন খানিকখন... ভোরবেলা উঠে ছোট্ট একটা ট্রেক করে আসুন সামনের দন্ডাহিত পাহাড় থেকে একজন লোকাল গাইড নিয়ে... রাত হয়ে গেলে দু’চোখ ভরে দেখে নিন আদিবাসী গ্রামের রাত্তির কি অদ্ভূত অন্ধকারে মোড়া, কি অপূর্ব সব শব্দ দিয়ে সাজানো... রিসর্টের বাগানে বা ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দেখবেন আকাশের গায়ে আঁচড় কেটে উল্কা চলে গেল... ক্যাম্পফায়ারের আগুনের ধারে বসে জমজমাট ভূতের গল্প করবেন... এ’সব কলকাতায় কোথায় হয় বলুন তো মশাই?”

আপনিঃ “হুম, বুঝলাম... মন্দ লাগছে না শুনে, বুঝলে... তা রিসর্ট বলছো... কেমন রিসর্ট? কি নাম?”

আমিঃ “আমরা ছিলাম যেটায় সেটা সবচে’ পুরোনো আর লেকের সবচে’ কাছে। নাম আকাশমণি। মোটামুটি সব মিলিয়ে ভালোর দিকেই বলবো (লোকেশন, ৫/৫, রাঁধুনির রান্নার হাত, ৫/৫, ঘরের অবস্থা, ৪/৫, বাথরুমের অবস্থা, ৩/৫, বাগানের অবস্থা, ৩/৫, এসি ঘর, বোধহয় নেই, পার্কিং’এর জায়গা, যথেষ্ট আছে, ঘরভাড়া, ৮০০-১২০০ টাকার মধ্যে, সাথে সারাদিনের খাওয়াদাওয়ার জন্য একজনের ২৫০/৩০০ টাকা)। আমার এখানে থেকে ভালোই লেগেছে, তবে ৮০০টাকার ঘরগুলোর আরেকটু মেইন্টেনেন্সের দরকার বলে মনে হয়েছে। আকাশমনি’তে থাকতে হলে ফোন করুন এই নম্বরে +918017215958, বাকি ব্যবস্থা ফোনেই হয়ে যাবে, দেখবেন। ইন ফ্যাক্ট, চারবেলায় কি কি খাবেন সে’সব ফরমায়েসি মেনু’ও আপনার কাছে ফোন করে জেনে নেবেন কেয়ারটেকার নিজে।

তবে এই হোটেল’টি ছাড়াও আরো অনেক হোটেল রিসর্ট আছে। কয়েকটা নাম বলছি, আপনি গুগল করে দেখতে পারেন, পলাশবাড়ি, লেক হিল রিসর্ট, বড়ন্তি ভিলেজ রিসর্ট... এগুলো সবই বেশ ভালো জায়গায় আর ব্যবস্থাও সুন্দর... আপনি শুধু যাওয়া ঠিক করুন আর ফোন করুন, দেখবেন থাকার জায়গা নিয়ে আপনাকে সমস্যায় পড়তে হবে না... এ’সব জায়গায় তো আর ট্যুরিস্টের ভিড় নেই...”

আপনি, “বাঃ, বেশ বেশ... আর কিছু... ফাইনাল টিপস...”

আমি, “উমমম... ওখানে গেলে লেকের মাছ অবশ্যই খাবেন, শীতে গেলে ভোরবেলা তখুনি গাছ থেকে নামানো খেজুর রস খাবেন, মাছ ধরা দেখবেন, সূর্যাস্ত কোনো মূল্যে মিস করবেন না, লোকাল ক্র্যাফট (যেমন, ছৌ নাচের মুখোশ) কিনবেন। শুধু ভালো ভালো বলছি, নেগেটিভ দিকগুলোও বলে দি... রাস্তা কিছু জায়গায় কিন্তু বেশ খারাপ থাকতে পারে... আর আমি গিয়েছিলাম জানুয়ারি’তে... অন্যান্য সিজনে যেতে হলে কেয়ারটেকারের সাথে কথা বলে নেবেন... আফটার অল, পুরুলিয়া জেলা, গরমে কিন্তু কষ্ট হতে পারে, সেটা মাথায় রাখবেন... আর কি? এবার একটা প্ল্যান করুন দেখি... দু’দিন একটু ঘুরে আসুন... যখন ফিরে আসবেন, দেখবেন বুক ভরে গেছে তাজা অক্সিজেনে আর ছুটি কাটানোর আনন্দে... সেই রসদ দিয়ে আবার দু’টো মাস অফিসের ঘানি টানা যাবে... তারপর আবার অন্য কোথাও, অন্য কোনোখানে...


ঘুরে এসে আমায় জানাবেন কিন্তু যে কেমন লাগল...”

- Copyright © পাঁচমিশেলি - - Powered by Blogger - Designed by সায়ংতরী -