Popular Post

Posted by : Sayantari Ghosh Sunday, May 22, 2016


-“আর কতক্ষণ?”

গাড়ির জানলা দিয়ে মাথা বের করে অধৈর্য্য গলায় মাধবী বলল। সঙ্গে সঙ্গে ওর মুখে পিন বিঁধিয়ে দিয়ে গেল এক ঝলক ভীষণ ঠান্ডা হাওয়া! ডিসেম্বরের উত্তুরে বাতাস আস্তে আস্তে কৌসানি শহরের দখল নিচ্ছে। রাত বাড়ছে।

ওর দিয়ে তাকিয়ে ঠোঁট ওল্টালো সোহম। কত আর মিথ্যে বলা যায়, ও তো সত্যিই বুঝতে পারছে না যে আর কত দেরি হবে!

মাধবীর ক্লান্ত, বিরক্ত হয়ে ওঠা মুখটায় এবার আস্তে আস্তে দুশ্চিন্তার ছায়া পড়ছে। সোহম এসে জানলার কাছে দাঁড়ালো, “জানলার কাঁচ তুলে বস রে, বাইরে প্রবল ঠান্ডা”, বলল সোহম, “এই গুগল ম্যাপের যুগে রাস্তা চিনতে গিয়ে এরকম নাকানি-চোবানি খাচ্ছি... বল দেখি? এরকম জানলে একটা ভাড়া গাড়ি করে নিতাম, অনেক বেটার হত। লোকাল ড্রাইভার হলে ঠিক রাস্তা চিনতো।“

তাই বা হত কি করে? নতুন গাড়ি কিনে কিছুটা সেলেব্রেসনের আনন্দেই তো এবার ট্যুর’টা প্ল্যান করেছিল মানিক। পাঁচবন্ধু মিলে লং ড্রাইভ! আর দিল্লী থেকে কি ভালো এসেওছে গাড়ি’টা! হাত বদলিয়ে সকলেই স্টিয়ারিং ধরেছে অদল-বদল করে। নৈনিতালে দু’দিন, তারপর আলমোরা, সেখান থেকে রানিখেত হয়ে আজ কৌসানি পৌঁছানোর কথা। কৌসানি’টাই এবারের ট্রিপের বেস্ট স্পট। কৌসানি বাজারের ভিড় ছাড়িয়ে একটু এগিয়ে পাহাড়ের গায়ে দেওদারে ঘেরা একটা বাংলো বুক করেছে মিতালী। হোটেলের নাম গ্রিন প্যারাডাইস! ইন্টারনেটে দেখেছিল কটেজের ত্রিসীমানায় আর কোনো জনবসতি নেই বহুদূর অবদি, শুধু সবুজ আর সবুজ। বন্ধু’রা মিলে এলে এরকম একটা জায়গাই তো চাই, দু’টো দিন জাস্ট রিল্যাক্স করে কাটাতেই তো আসা!

রানীখেত থেকে বেরোনোর পর সময় হাতে যথেষ্টই ছিল। দাঁড়াতে দাঁড়াতে, ছবি তুলতে তুলতে, এগোচ্ছিল ওরা। সোমেশ্বর বলে একটা জায়গা পেরোলো সাড়ে পাঁচটায়, কৌসানির আগে এটাই শেষ জনপদ। সোমেশ্বরের বাজারে দাঁড়িয়ে চা আর তেলেভাজা খাওয়া হল যখন, তখনও তাড়াহুড়োর কথা কারো মাথায় আসেনি। ওখান থেকে আধঘণ্টার বেশি লাগার কথাই নয়। কিন্তু কপালে দূর্ভোগ লেখা থাকলে আর কি করা যাবে! এক চিলতে শহরটা পেরিয়ে যেই না পাইনবনের রাস্তা’টা এসে পড়ল, অম্নি তিন বার ঝাঁকুনি দিয়ে দাঁড়িয়ে গেল গাড়িটা। সন্ধ্যে’টাও ঝুপ করে নেমে এল তক্ষুনি।

-“কার্বুরেটরে কচ্‌রা..” বলল সোহম; মানিক আর নিসার’ও তখুনি নামল গাড়ি থেকে। বনেট খুলে নানারকম যুদ্ধ চলল ক্রমাগত। আনাড়ি হাতের অত্যাচারে মাঝেমাঝে ভয়ানক গর্জন করে উঠছিল গাড়ি’টা, কিন্তু তবুও নড়বে না শপথ করে সে দাঁড়িয়ে রইল পুরো পৌনে ঘন্টা। অগুনতি বার সেলফ মারতে মারতে শেষে ঘশঘশ করে একটা হোঁচট খেয়ে যখন স্টার্ট নিল গাড়ি’টা, ঘড়ির কাঁটা তখন সাত’টা ছুঁইছুঁই। আর কৌসানি তখনও বারো কিলোমিটার।

খুব সাবধানে চালাচ্ছিল মানিক, ফলে গাড়ি কৌসানি বাজার পৌঁছালো পৌনে আটটা নাগাদ। ম্যাপ দেখে বড় রাস্তা ছেড়ে জংলা রাস্তা ধরার দশ মিনিটের মধ্যেই বোঝা গেল পথ ভুল হয়ে গেছে। এ দিকে শুধুই পাইনের জঙ্গল, কোনো হোটেল রিসর্টের চিহ্নমাত্র নেই। তখুনি গাড়ি ঘুরিয়ে আবার খানিক রাস্তা হাতড়িয়ে বাজার ফিরে আসা ছাড়া আর কোনো উপায়ই দেখা গেল না।

বাজার এলাকার এক পাশ করে গাড়িটা লাগিয়েছে নিসার। গত কুড়ি মিনিট এখানেই দাঁড়িয়ে আছে ওরা। আশ্চর্যের ব্যাপার হল, এই এতক্ষণে অন্য একটা গাড়িও পেরোয় নি এখান দিয়ে! শীতকাল, অফ সিজন বলেই বোধহয় ট্যুরিস্ট’দের ভিড় কম! কে জানে!  একটু আগে মিতালীও নেমে গেছে গাড়ি থেকে, মাধবী একাই বসেছিল। ভীষণ টায়ার্ড লাগছে, ঘরে ঢুকতে ঢুকতে কত রাত হবে কে জানে! ব্যাগ ঘাড়ে করে পায়ে হেঁটে চলে যেতে ইচ্ছে করছে এবার! লোকজনের ঘরের দরজায় টোকা মেরে জিগেস করতে ইচ্ছে করছে, “আজ রাত্তির’টা একটু থাকতে দেবেন প্লিজ...”... ইস! যদি আরেকটু সকাল সকাল বেরোতো!

- “ধূর! আজকের দিনটাই খারাপ! মনে মনে গজগজ করে উঠলো মাধবী।

সন্ধ্যে সাড়ে আট’টার কৌসানি বাজার মধ্যরাতের কলকাতার মত শুনশান। ডিসেম্বরের শীতে শহরটা যেন অন্ধকারের সাথে লেপ্টে শুয়ে আছে একটু উত্তাপ খুঁজে। দোকানগুলোয় ঝাঁপ পড়ে গেছে, রাস্তার পাশে ঠেলাগাড়িগুলো অথর্ব হুইলচেয়ারের মত পড়ে আছে। আলো বলতে একখানা স্ট্রিটলাইটের দপদপানি খালি। আগেরবার বাজার পেরোনোর সময় দেখেছিল, দূরে একটা গলির মুখে চার-পাঁচটা লোক কম্বল মুড়ি দিয়ে সন্ধ্যের মৌতাতে বসে আগুন জ্বালিয়ে শরীর সেঁকে নিচ্ছে, এখন তারাও নেই, মরা আগুন’টা থেকে আলগা একটু ধোঁয়া উঠছে খালি। কি ভীষন নিঝঝুম চারদিক। শব্দ বলতে মাঝেমাঝে কোনো একটা অজানা পাখির আর্তনাদ, ব্যাস!

রাস্তার ওপাশে একটা পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরিয়েছে নিসার আর মানিক। সোহম আর মিতালী এখনো লড়ে চলেছে ফোন নিয়ে। টাওয়ার প্রায় অদৃশ্য। বাংলোর কেয়ারটেকার’কে তবু যদি পাওয়া যায়! গাড়ির হেডলাইট’টায় আলো হয়ে আছে জংলা পথের বাঁক’টা, মাধবী সেদিকেই তাকিয়ে ছিল। আস্তে আস্তে উল্টোদিকের জানলার কাঁচ’টা নামালো ও। গাড়ির বাইরে সত্যিই ভীষণ ঠান্ডা! দূরে অন্ধকার পাহাড়ের গায়ে ফোঁটা ফোঁটা আলো, মনে হচ্ছে কোল ভরে আলো জ্বালিয়ে পাহাড়টা যেন আকাশের তারাদের চ্যালেঞ্জ করছে বিউটি কনটেস্টে! ... ওটা কি জায়গা? ওরা কি পেরিয়ে এসেছে ওদিক’টা, না পৌঁছায়নি ওখানে এখনও?  ওই আলোগুলোর দিকে একটুক্ষন তাকিয়ে থাকলে বোঝা যায় যে কি ভীষন অন্ধকার ওই জঙ্গলের দিক’টা! ঘড়ির কাঁটা যত রাত্তিরের দিকে এগোচ্ছে, পাইনাসের দল যেন সারি বেঁধে আস্তে আস্তে রাস্তায় নেমে আসছে। গাড়ির হেডলাইট’টা যেন তরোয়ালের ফলার মত সেই আলখাল্লা পরা ভিড় সরাচ্ছে আর এই পাঁচটা মানুষের অস্তিত্বের জন্য আপ্রাণ লড়াই করছে।
সোহম’রা ফিরছে গাড়ির দিকে; নিসার’রাও। যা বোঝা যাচ্ছে আজ গাড়িতেই রাত্রিযাপন। বাইরে রাতের হাওয়া তান্ডব শুরু করছে এবারে। ইস! আজকের সব আড্ডার প্ল্যান একেবারে ভেস্তে গেল!

-“কুছ পরেশানি হ্যায় ক্যা মেডাম জি?”

ঘাড়ের কাছে হঠাত্‌ গলা’টা শুনে আঁতকে উঠল মাধবী! বুকের ভেতর’টা ধড়াস করে উঠলো যেন। এই শুনশান পাহাড়ী রাস্তার অন্ধকার বাঁকে রাতপাখির চিত্‌কারের মাঝে বসে থাকতে থাকতে বোধহয় পৃথিবীতে আর কোনো মানুষ থাকতে পারে এই ধারণাটাই লোপ পেতে বসেছিল।

একটা লোক। আপাদমস্তক গরম কাপড়ে মোড়া। মুখের মধ্যে খালি দেখা যাচ্ছে চোখদুটো, বাকিটা মাফলারে ঢাকা। উঁকি দিচ্ছে খোলা জানলার কাঁচের ফাঁক দিয়ে।

[পরের কিস্তি'তে শেষ]

Leave a Reply

Subscribe to Posts | Subscribe to Comments

- Copyright © পাঁচমিশেলি - - Powered by Blogger - Designed by সায়ংতরী -