Popular Post

Archive for March 2013

নষ্টনীড়

By : Sayantari Ghosh


রবীন্দ্রনাথ ‘নষ্টনীড়’ লিখেছিলেন ১৯০১ সালে। সত্যজিত রায়ের ‘চারুলতা’ রিলিজ করে ১৯৬৪’র এপ্রিলে। ‘চারুলতা ২০১১’ এল ২০১১’তে,‘আমি চারুলতা’ আসতে চলেছে ২০১৩ তে। অর্থাৎ হিসেব অনুযায়ী দেখতে গেলে আমরা এক শতাব্দীকাল ধরে বার বার চারুলতার কাছে ফিরেছি। বার বার নানাভাবে আমরা চিনতে চেয়েছি সেই চারু কে ‘কাগজের আবরণ ভেদ করিয়া স্বামীকে অধিকার করা’ যার পক্ষে ‘দুরূহ’ হয়েছিল। ভূপতি,অমল আর চারু,এই তিনটি চরিত্রের হাত ধরে মনের আলো-অন্ধকার হাতড়ে হাতড়ে বেড়ানোটাকে বোধহয় ভালোবেসে ফেলেছি আমরা সকলেই। আরেকবার সেই একই অভিজ্ঞতা’কে অন্যভাবে অনুভব করতে গিয়েছিলাম স্টার থিয়েটার;‘যোজক’ সপ্তাহশেষের এক জমজমাট আসর বসিয়েছিল রবীন্দ্রনাথের জন্মসার্ধশতবর্ষ উদ্‌যাপনে। আর সেই আসরের শেষ নাটক ছিল ‘নষ্টনীড়’। অবশ্য নাটক না বলে ‘যোজক’ তাদের পরিবেশনার নাম দিয়েছিল সিনে-প্লে,সিনেম্যাটিক থিয়েটার।



গৌতম হালদার নিজে সিনেমা ও নাট্যজগতের একজন সফল পরিচালক। এবং উনি ভীষণ ভার্সেটাইল। ওনার আরেকটি সাঙ্ঘাতিক গুণ হল,প্রিয় লেখকদের প্রিয়তম কাহিনীগুলি নিয়ে নাটকের ফাটাফাটি এক্সিকিউশনে উনি অনবদ্য। নান্দীকারের সফল নাটক ‘বড়দা’(মুন্সি প্রেমচন্দ),‘চোখ-গেল’ (তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়),‘বাপ্পাদিত্য’ (অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর),‘দুলিয়া’ (লীলা মজুমদার),‘সজন বাদিয়ার ঘাট’ (জসীমুদ্দিন) এবং আরো অনেক নাটক তাঁর এই দক্ষতার জলজ্যান্ত প্রমাণ। এবার ‘যোজক’এর সাথে উনি হাত দিয়েছেন শহর কোলকাতার প্রথম সিনে-প্লে নির্মানে;প্রথম পছন্দের কাহিনীকার অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ আর কাহিনী ‘নষ্টনীড়’। খবরটা কানে যেতেই প্রাথমিক প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছিলুম। অপেক্ষা ছিল সপ্তাহান্তের,প্রস্তুত ছিলাম চমকে যাওয়ার জন্য। একটা ভিন্ন জাতের আনন্দের জন্য যেটা মেলে পুরোনো চিঠির ভেতর বছর কুড়ি পরে নতুন কোন সংকেত আবিষ্কারে।

কিন্তু নাটকের দিন সকাল থেকে সব কেমন গোলমাল হয়ে গেল। কাজ মিলল না,তার ওপরে তুমুল বর্ষণ। বৃষ্টি মাথায় করে,কাদায় সালোয়ার লেপ্টে ফেলে,আধঘন্টা স্টার থিয়েটারের দরজার লাইন দিয়ে ঢুকতে পেলুম। চেনাশোনা নামের আনাগোনা চারদিকে,গৌতম হালদার,দুলাল লাহিরী,রীতাভরী,শুভ্রজিত... তবু কেন জানি না,কাজের চাপেই হয়তঃ,মনে মনে বেশ ভারাক্রান্ত লাগছিল। মনে হচ্ছিল,সারাদিনের মত নাটকটাও ঝুলিয়ে দেবে নিশ্চয়ই। মুঠোফোনগুলি’কে নীরবতায় স্থান দেওয়ার হাল্কা কিছু পরিচিত অনুরোধ যখন চলছে,তখনও আমি নিজের আসনে একটু যেন অস্বস্তিতে। কিন্তু তারপর... তারপর যেন ডুবে গেলাম একটা যাদুমন্তরের ভেতরে। হুঁশ ফিরলো সমবেত হাততালির শব্দে। দু’ঘন্টা কোথা দিয়ে যেন পেরিয়ে গেছে। মনের ভেতর তখন শুধুই উথাল-পাথাল করছে হাজার’টা সংলাপ,হাজার’টা অনুভব।

‘নষ্টনীড়’এর কাহিনী নিয়ে তো আর নতুন করে কিছু বলার নেই। কাহিনী আমাদের চারু’র,যার অযথা-কাজে-আটকে-থাকা স্বামীর সময় হয় না তার দিকে তাকানোর। কেউ সে কথা মনে করিয়ে দিলেও তিনি চারুর সঙ্গী হিসেবে এনে দেন ‘শ্যালকজায়া মন্দাকিনীকে’। এ এক এমন গৃহস্থালীর গল্প যেখানে বিবাহিত জীবনের প্রাথমিক উচ্ছ্বলতাটাই নেই,যেখানে চারুলতা আর ভূপতি ‘নূতনত্বের স্বাদ না পাইয়াই উভয়ে উভয়ের কাছে পুরাতন পরিচিত অভ্যস্ত হইয়া গেল’। নিতান্ত একাকীত্বে,ঔদাসীন্যে স্থির হয়ে থাকা চারুর জীবনে একমাত্র নতুনত্ব যদি কিছু থেকে থাকে,তবে তা হল  ভূপতির পিসতুতো ভাই অমলের দৌরাত্ম,তার আবদার,তার নিত্যনতুন চাই-চাই। চারু’র সমস্যা ছিল এই যে ‘তাহার কাছে কেহ কিছু চায় না,অমল চায়-- সংসারে সেই একমাত্র প্রার্থীর রক্ষা না করিয়া সে থাকিতে পারে না।... প্রত্যেক বারেই চারুলতা আপত্তি প্রকাশ করিয়া কলহ করে এবং প্রত্যেক বারেই বহু যত্নে ও স্নেহে শৌখিন অমলের শখ মিটাইয়া দেয়...’ শুধু তাই নয়,চারুর পড়াশোনার সখ,তার বাগান করার গল্প,অমলের কাব্য নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা,তার পান থেকে শুরু করে কার্পেটের জুতোর আবদার... সব মিলিয়ে এই সম্পর্কে লাগে এক খুব কাছের,বড় নিজের বন্ধুতার রঙ। কিন্তু অমল তো চারুর জীবনের চিরস্থায়ী সত্য নয়,সেই সত্যের নাম ভূপতি। সম্পর্কের এই দোলাচলের নাম’ই ‘নষ্টনীড়’।

কিন্তু এখানেই কি শেষ?তা নয়। সত্যজিত রায়ের চারুলতা আর রবীন্দ্রনাথের নষ্টনীড়ের একটা বড় তফাত শেষ দৃশ্যে। অমলের চলে যাওয়ায় চারুলতার ভেঙে পড়াতেই কিন্তু রবীন্দ্রনাথ গল্পটাকে শেষ করে দেন নি। শেষ পর্যায়ে ভূপতির স্বগতোক্তি’তে বুঝতে পারি,এ কাহিনীর সারমর্ম শুধু ত্রিকোণ-প্রেম আর একাকীত্বেই শেষ হয়ে যায় না। দেখতে পাই,চারু অমল কে ভালোবাসে বুঝতে পেরে ভূপতি খুব সহজে ভাবতে পারে,‘আমার কথা সে একবার ভাবিয়া দেখিল না?... নির্জন বন্ধুহীন প্রবাসে প্রত্যহ তাহাকে সঙ্গদান করিতে হইবে?সমস্ত দিন পরিশ্রম করিয়া সন্ধ্যায় যখন ঘরে ফিরিব তখন নিস্তব্ধ শোকপরায়ণা নারীকে লইয়া সেই সন্ধ্যা কী ভয়ানক হইয়া উঠিবে। ... যে আশ্রয় চূর্ণ হইয়া ভাঙিয়া গেছে তাহার ভাঙা ইঁটকাঠগুলা ফেলিয়া যাইতে পারিব না,কাঁধে করিয়া বহিয়া বেড়াইতে হইবে?’ চারু অমল কে ভালোবাসে বলে ভূপতি খুব সহজে বলতে পারে,তোমাকে সঙ্গে নিয়ে চলা?‘না,সে আমি পারিব না...’
এ তো খুব সহজ স্বাভাবিক বক্তব্য স্বামীর ক্ষেত্রে,তাই না?বিবাহিতা স্ত্রী পরপুরুষে সমর্পিত-প্রাণ বোঝার পরে এই মনোভাবই তো হওয়া উচিত পতিদেবের...! আজকের দিনেও অজস্র মানুষ ভূপতির সঙ্গে একমত হয়ে যাবেন। এর প্রতিবাদ করতে গেলে ফেমিনিস্ট আখ্যা জুটতে বাধ্য। কিন্তু একশ বছরেরও বেশি আগে রবীন্দ্রনাথের চারুলতা ভূপতির দয়াপরবশতা কে প্রত্যাখ্যান করেছে,দৃঢ়কন্ঠে বলেছে,‘না থাক্...!’ এই একবিংশ শতকেও ক’জন সহধর্মিনী চারুলতার মত বলতে পারে,‘না থাক্’...?

রবীন্দ্রনাথের চারুলতার এই কাহিনীকে জীবন্ত হতে দেখলাম সেদিন স্টারে। গৌতমবাবু গল্পের আধুনিকীকরনের বিন্দুমাত্র চেষ্টা করেন নি। নাটকের সময় তাই ১৮৭০-৮০ তেই বাঁধা। কিন্তু শতাব্দীপ্রাচীন গল্পে এই শতকের রঙ লাগিয়েছে টেকনোলজি। আগে শুটিং হয়ে যাওয়া প্রি-এডিটেড কিছু দৃশ্য অসাধারণ আলো-শব্দের কারসাজিতে একাত্ম হয়ে গেছে স্টেজের লাইভ পারফর্মান্সের সাথে। চারুর জানলার বাইরে উন্মত্ত ঝড়,ছাদ থেকে চারুর ছুটতে ছুটতে ঘরে ফিরে আসা,জানলা দিয়ে দ্যাখা বাগানের দৃশ্য আর আয়নায় টিপ পরতে পরতে ‘বৌঠান’ ডাকের সাড়া দেওয়ার দৃশ্যগুলি রোমাঞ্চকর লাগে রীতিমত। Computer-Generated Imagery,যেটা মূলতঃ ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির ব্যবহার্য,তার তুলনাহীন ব্যবহারে তাক লেগে যায়। একাঙ্ক থিয়েটারের সীমা’কে ছাড়িয়ে স্ক্রিন আর সিনক্রোনাইজেশনের দূর্দান্ত নমুনা রেখে ‘যোজক’এর শিল্পীরা কার্যতঃ অবাক করে দেন দর্শককে। আর উপরি-পাওনা হিসেবে জুটে যায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কন্ঠের ভাষ্যপাঠ!
আগেই বলছিলাম,আমি যখন স্টার থেকে বেরোলাম সে দিন,মনের ভেতর সংলাপের ভিড়,অনুভবের আনাগোনা। একশ রকম যেন একসাথে খেলা করছে বুকের ভেতরে,কিন্তু তবু তার মধ্যে হলে ঢোকার আগের সেই মন-ভার’টা যেন কোথায় হারিয়ে গেছে দেখলাম। তখন স্বপ্নের মত কতকিছু মনে হতে লাগল,মনে হল বাসা বাঁধতে গেলে যে খড়কুটোগুলো লাগে সেগুলোর নাম ভালোবাসা-ভালোবাসা... সেগুলোর রঙ নীল,সবুজ,গোলাপী,আকাশি,কমলা... এই যে ছুটছি,রোজ হাঁপাতে হাঁপাতে ডেলিরুটিনের কাজগুলো সামলে ফেলছি রোজ,যদি এক মূহুর্ত সময় দি নিজেকে ভাবার এ সবের মাঝে,‘আমি সেই রঙগুলো হারিয়ে ফেলিনি তো...?’ যদি ওটুকু সময় নষ্টই করি,খুব কি ক্ষতি হয়ে যাবে?

দেরি হয়ে গেছিল একটু। সাড়ে ন’টার সময় যখন হাতিবাগানের মোড়ে হাত দেখিয়ে বাস’টাকে দাঁড় করিয়ে উঠে পড়লাম,তখন একটা কথাই মনে হয়ে গায়ে কাঁটা দিল হঠাৎ,‘ভদ্রলোক আজও কি সাঙ্ঘাতিক ভাবে রেলেভেন্ট... উফফ...’

মুখোমুখি

By : Sayantari Ghosh





দীপনের কথা

অফিস থেকে ফিরে নিয়মমত ব্রিফকেস’টা টেবিলে নামিয়ে সোফায় গা এলিয়ে দেয় দীপন। গত ছয়বছরে এটাই প্রতিদিন নিয়মিত দেখে আসছে তৃপ্তি। ও’ভাবে বসে পড়ার মানেই কাজের মেয়েটিকে ইশারা আসলে... আদা-দেওয়া বেশ কড়া একটা চায়ের না-বলা ফরমায়েস। চা শেষ করে একবার মিঠির ঘরে উঁকি দেবে দীপন... এটাও রোজ’ই। মিঠি তখন ঘুমায়; স্কুল থেকে ফিরে একটু ঘুমানোর অভ্যেস’টা তৃপ্তিই করিয়েছে ছোটো থেকে... তাহলে সন্ধ্যেটায় ফ্রেশ থাকে... হোমওয়ার্কগুলো করার সময় কম ঘ্যানঘ্যান করে। মিঠিকে ঘুমাতে দেখে স্নান সেরে এসে কম্পিউটারের সামনে বসে পড়বে দীপন... এই যে বসলো, সাড়ে ন’টায় তৃপ্তি খেতে ডাকার আগে সে উঠবে না... অফিসের কাজ, খানিক ফেসবুক, খানিক জি-টক... বন্ধুদের সাথে আড্ডা... কিছু পড়াশুনো, কিছু ফোটোব্লগ হাতড়ানো, কিছু নতুন বাজারে আসা ছবি-তোলার সরঞ্জাম নিয়ে জ্ঞানঅর্জন... শেষটায় স্রেফ গান শোনা... এই নিয়মের সাধারণভাবে কোন নড়চড় নেই।

দীপনের মাথায় এ সময়টায় হয়তঃ আরো কিছু ঘুরপাক খায় যে’সবের টের তৃপ্তি পায় না সেভাবে... অফিসের খিঁচড়ে যাওয়া মেজাজের টুকরোটাকরা বাড়ি বয়ে এসে মুখ দেখিয়ে যায় রোজই... তবুও... বিষয়গুলি গড়পরতা... অন্ততঃ দীপনের কাছে তাদের আদল খুব পরিচিত। অফ-টপিক কিছু বড় একটা ঘটে না, তাই রুটিনের অন্যথাও হয় না বড় একটা।

কিন্তু সেদিনটা অন্যরকম ছিল।

ঘরে ঢুকে ব্রিফকেসটা নামিয়েই বেসিনের সামনে গিয়ে মুখে জলের ঝাপটা দিল দীপন। তারপর তোয়ালে আর ইস্ত্রি করে রাখা ধবধবে পায়জামা পাঞ্জাবী নিয়ে সটান স্নানে ঢুকে গেল। কাজের মেয়েটির থেকেও অবাক চোখে সেদিকে তাকিয়ে রইলো আদা-দেওয়া চায়ের কাপখানা।

বাথরুমের দরজায় আলতো করে টোকা দিল তৃপ্তি, “শুনছো...? শরীর খারাপ লাগছে নাকি গো?”

দরজার ওপারে শাওয়ার চালিয়ে দেওয়ালে হেলান দিয়ে ঠায় ভিজছিল দীপন... তৃপ্তির কন্ঠস্বরের একটু সময় লাগলো চিন্তার জাল ছিঁড়ে ওর কাছ অব্দি পৌঁছতে, “কিছু হয় নি, ঠিক আছি,” উত্তর এল, “জাস্ট আ বিট টায়ার্ড...”

মোহরের মুখ’টা একটা ধোঁয়াটে সাইনবোর্ডের মত চোখের সামনে আটকে রয়েছে। সব দ্যাখা যাচ্ছে এ’পাশ থেকে ও’পাশ, কিন্তু সবের ভেতর সারমর্ম হয়ে বেরিয়ে আসছে ওই একটাই মুখ। কি ক্যাজুয়াল ছিল মোহর! কি আশ্চর্য্য! কলেজ স্ট্রিটের মোড়ে আজ ওকে দ্যাখা-মাত্র কেমন যেন বোকা হয়ে গেল দীপন... একটা মূহুর্তের জন্য লুকিয়ে পড়তে ইচ্ছে করলো ওর... ইচ্ছে হল এক্ষুণি ভিড়ের একটা যে কোন মুখ হয়ে যেতে... নিজেকে হারিয়ে ফেলে ভিড়ের ফাঁক থেকে উঁকি দিয়ে মোহরকে দেখতে ইচ্ছে হল... সত্যি, মোহর’ই...  শাড়ি, খোঁপা, চশমা, সিঁদূর... তবু, মোহর’ই।

তখুনি কি করে কে জানে মোহরের চোখ ঘুরলো এদিকে... আর এক সেকেন্ডের ভেতরে অজস্র ভয় এসে গলা টিপে ধরলো দীপনের... অগুনতি প্রশ্নের উত্তর হাতড়াতে লাগলো মাথার ভেতরে ও... “বম্বে পড়তে তুই একা যাস দীপ?”... “একটা চিঠি লিখতে ইচ্ছে হল না তোর?”... “আট’টা বছর... জাস্ট ভ্যানিশ হয়ে রইলি?” “আমি কি আদৌ ছিলামই না কখনো কোথাও?”... ... “কি করে পারলি রে?”...
চাপা পড়ে যাচ্ছিলো দীপন নিজের কল্পনাতেই... হাবুডুবু খাচ্ছিলো রীতিমত...

মোহর’টা অথচ...

কেমন পাগলিই রয়ে গেছে... চোখদুটোয় একটা অবাক-হাসি নিয়ে ছুটে এল... “দীপ...!! কেমন আছিস রে??” হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল কফি হাউসে, “আজ কোনো কথা শুনছি না... বউকে ফোন করে দে, বল আধ ঘন্টা দেরী হবে... আরে ধূর, জিগেসই করিনি... বিয়ে থা করেছিস তো?”

কত কথা বলল... জিগেস করলো আরো কত কি... কলেজের চাকরি, ছয় বছরের ছেলে, লেখালিখিতে ছেদ, নতুন করে রিসার্চের প্ল্যানিং... কত কত কথা।

শুধু বলল না কেন চিঠি লিখিস নি...

স্নান সেরে কম্পিউটারে বসলো দীপন... পনের মিনিট পরে উঠে পড়লো... শুলো খানিক... তাক থেকে একটা উপন্যাস নামিয়ে পড়তে নিয়ে দ্বিতীয় পাতায় আটকে গেল... একবার ভীষণ ইচ্ছে করলো একটা ফোন করতে; কিন্তু করা গেল না... তারপর ইচ্ছে করলো মিঠির ঘরে গিয়ে তৃপ্তিকে বলতে, যে আজ ওকে আর হোমওয়ার্ক করিও না, আজ ও একটু খেলুক আমার সাথে, আজ ওকে একটা গল্প শোনাই বরং... একটুবাদে সে ইচ্ছেটাও তেতো হয়ে গেল... তারপর আর কিছু ইচ্ছেই করল না।

বরের কথা জিজ্ঞাসাই করা হল না মেয়েটাকে... “হিংসে হল নাকি দীপন?” বুকের ভেতরের আয়নাটা বাঁকা হেসে বলল, “জেলাস! জেলাস! নাকি ইনসিকিউরিটি? না কি স্রেফ ভয়??”

জানি না জানি না... উফফফ...

কেন যে বলল না কেন চিঠি লিখিস নি...


মোহরের কথা


মোহর বাইরের গ্রিলের দরজাটা ঠেলতেই দোতলার জানলা থেকে বুয়ান উঁকি দিল, “এনেছো...? মা?”

একগাল হেসে হাতের আনন্দ পাবলিশার্সের প্যাকেটটা উঁচু করে দ্যাখালো মোহর। ঘরে ঢুকতেই ওই প্যাকেট আর তার ভেতরের টিনটিনের কমিকস খুলে মেঝেতেই বসে পড়লো বুয়ান; মোহর ওকে কোলের কাছে টেনে নিয়ে ওর পাশ’টাতেই বসলো শাড়িটা এলিয়ে, হাঁক পাড়লো ভেতর ঘরের দিকে, “কাজু...! আজ ফুলকপি কাটবি রাত্তিরের জন্য! বৃষ্টি হয়েছে এদিকে দুপুরে? জামাকাপড়গুলো তুলেছিস?

-“হ্যাঁ বৌদি,” ঘাড় হেলিয়ে সায় দেয় কাজু; হাঁক শোনামাত্র সে দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছিল, “কিন্তু বৌদি, মা-মনি আজ আমায় এমনি এম্নিই বকেছে... একটুখন কথা বলতে গেসলাম পাশের বাড়ির নমিতার সাথে, তাতে কি এমন মহাভারত’টা অসুদ্দ হয় বল ত?”

ছ’টা নাগাদ অনিন্দ্য ফিরল অফিস থেকে। তার আগের সময়টা কাজুর সাথে চেঁচামেচি করতে করতেই চলে গেল মোহরের। শাশুড়ি’মাকে বোঝালেও বুঝবেন না, তাই রোজদিন তাকে কাজুর সাথে চেঁচিয়েই গলা ফাটাতে হয় এ’সব সমস্যার সালিশি করতে এসে। অনিন্দ্য ঢুকেই হইচই শুরু করে দিল, “আজ বাইরে ডিনার!!!” কবে থেকে কি একটা এরিয়ার আটকে ছিল, সেটা নাকি আজ এসেছে।

-- “সাউথ সিটি যাই চলো...” মোহরের কোমর জড়িয়ে ধরে অনিন্দ্য বলল, “বুয়ান ওখানে বেশ এনজয় করে... আর ওদের ফুডকোর্ট’টা জাস্ট অস্যম!”
-- “চলো,” হাসিমুখে বলল মোহর, পরক্ষণেই চিন্তায় পড়ে গেল হঠাত, “এতগুলো আটা মাখালাম গো কাজুকে দিয়ে... আর গুচ্ছের ফুলকপি...”
-- “আরে দূর... ফ্রিজে রেখে দাও...”

সাউথসিটি থেকে ফিরতে রাত হল। ঘরে ঢুকেই আঁচল কোমরে গুঁজে বিছানা করতে লাগলো মোহর; বুয়ানটা তখন প্রায় ঘুমিয়েই গেছে।

পৌনে বারোটা বাজলো মোহরের বিছানায় আসতে। ছাড়া জামাকাপড়গুলো ভাঁজ করে, বুয়ানের স্কুলের ব্যাগ আর ইউনিফর্ম গুছিয়ে, কাল সকালের রান্নার সবজি, ভাতের চাল, চায়ের পাতা, চিনি-হলুদ-তেল-নুনের কৌটোর সরেজমিনে করে, জলের বোতলগুলো ভরে শুতে শুতে একটু তো দেরী হয়’ই। এ’সব সকালের জন্যে ফেলে রাখলে মুশকিল। সাড়ে ন’টার ট্রেন, বাড়ি থেকে বেরোনো সাড়ে আটটায়... তাতেই কলেজ ঢুকতে ঢুকতে পৌনে এগারোটা বেজে যায়... তার আগে রান্না, অনিন্দ্যর টিফিন, বুয়ানের স্কুলবাস...

-- “আহ্‌...” বিছানায় শুয়েই সারাদিনের ক্লান্তিতে শিরদাঁড়া’টা টনটন করে ওঠে মোহরের। পাশে অনিন্দ্য প্রায় ঘুমন্ত। একটু যেন ইতস্ততঃ করলো মোহর, তারপর হাত বাড়িয়ে অনিন্দ্যর হাত’টা ধরলো।

--“হুম...?” অনিন্দ্য ঘুমায়নি, “কি? কিছু বলবে?”
--“হু... আজ... আজ জানো... কলেজস্ট্রিট গেছিলাম বুয়ানের একটা বই কিনতে...” ক’টা মূহুর্ত থামলো মোহর, “হঠাৎ দীপনের সাথে দ্যাখা হয়ে গেল, জানো?”

একটু নড়ে ওঠে অনিন্দ্য, হাতে ধরা হাত একটু শক্ত হয়, তারপর আলতো হেসে বলে, “আরেব্বাবা... তা, কেমন আছে সে? বহুদিন পরে দেখা তো...”

--“... আট বছর... পুরো আট বছর... বম্বে থেকে ফিরেছে সেটাই জানতাম না...”
--“হুমম...” একটুখানি চুপ করে গেল অনিন্দ্য, তারপর গলা আরো নামিয়ে বলল “ঝগড়া করলে?”
--“নাহ্‌,” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল মোহর, “ইচ্ছেই করলো না... আর ও খুব আনকম্ফোর্টেবল ছিল...”

কিছুক্ষণ আবার নিস্তব্ধতা। বাইরের বারান্দায় ঘড়িটাই খালি একা-একা প্রলাপ বকছে টিক টিক করে। কম্পিউটারের স্ক্রিনসেভারে চাপা আলোয় ঘুরপাক খাচ্ছে একটা বেগুনি রঙের চতুর্ভূজ।

অনিন্দ্য মোহরের চুলগুলো আলতো হাতে সরিয়ে দেয় কপালের ওপর থেকে, “এই... মনখারাপ করে না, লক্ষ্মীটি...”

মোহর আস্তে আস্তে সেঁধিয়ে যায় অনিন্দ্যর বুকের ভেতরে, থেমে থেমে বলে, “না গো... মন খারাপ করলোই না একটুও... আশ্চর্য্য ব্যাপার...”

“আশ্চর্য্য কি আর?” বললো স্ক্রিনসেভারের বেগুনি আলোর ট্রাপিজিয়মটা... তার চারটে হাত নিজেদের দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে গড়ে তখনো চেষ্টা করে চলেছে আপ্রাণ... যদি ওপারের জন’কে একটু ছোঁয়া যায় কোনোভাবে...

- Copyright © পাঁচমিশেলি - - Powered by Blogger - Designed by সায়ংতরী -