Popular Post

Archive for April 2015

হাওয়াঘন্টি / ২

By : Sayantari Ghosh




[শেষটুকু...]

ভয় করল ভীষণ! গলা শুকিয়ে গেল মূহুর্তে... এই ভরদুপুরে, দিনের আলোয় এ কিরকম পাগলামিতে পেয়ে বসল আমাকে...?

কি রে?” চমকে পিছনে ফিরলাম রিদ্‌মের ডাকে, “রেস্ট নিতে বললাম তোকে... আর তুই...... এইইই, এরকমভাবে ঘেমেছিস কেন রে...? কি হল'টা কি তোর...? শরীর খারাপ করছে না কি?”

না না, আয়াম ফাইন... আমি... আমি ঠিক আছি... জাস্ট টায়ার্ড...বললাম, কিন্তু নিজের গলাটাই চিনতে পারলাম না নিজের বলে... গলার কাছে কি যেন দলা পাকিয়ে আটকে গেছে...!!

সারা দুপুর চুপটি করে বসে রইলাম... জেনের জার্মান স্পিত্‌জ্‌ চেরি আমার কোলে উঠে বসেছিল... আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলাম ওর মাথায়... ঠুন্‌ন্‌-ঠুন্‌ন্‌‌ করে উইন্ডচিমার বাজছে বারান্দায়... ফালি ফালি পড়ন্ত রোদ ঢুকে পড়ছে বাগানের ওক গাছটার ফাঁক দিয়ে... ঘরের হাওয়াটা কেমন যেন ভারি ঠেকছে আমার... যেন পলিথিনের প্যাকেটে মোড়ানো হয়েছে হাওয়াটাকে... একটা ছায়া যেন ঘিরে ধরে আছে...

রিদ্‌ম বলল বিকেলে সেন্ট এডওয়ার্ড স্কুলের পাশের চার্চে যাবে। ওর লাগোয়া গোরস্থানটাও বেশ পুরোনো... এখন আর লোকজনের সেরকম যাতায়াতও নেই সেখানে...

তুই যাবি...? না কি...... আই থিঙ্ক ইউ শুড টেক রেস্ট... ঘোরাঘুরি করতে হবে না আর...বলল ও...
বুঝতে পারছিলাম না! বেরোতে ইচ্ছে করছে না, কিন্তু একা থাকার কথা ভাবতেই কেমন একটা বোকাবোকা ভয় চেপে ধরছে যেন। বললাম, “জেন কখন ফিরবে রে...?”

আজ তাড়াতাড়ি ট্রাই করবে... মে বি ফাইভ থার্টি অর সিক্স... কেন...?”

টেবিলের ওপর থেকে হাতঘড়িটা তুলে দেখলাম। চারটে। বললাম, “তাহলে... তাহলে আমি আর বেরোবো না...
ওকে দেন... আমি বেরোই, কেমন...? কিছু নিয়ে আসব? কিছু চাই...?”

বলতে ইচ্ছে করল, “রিদ্‌ম্‌... আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে... আমি চন্ডীগড় ফিরতে চাই...

বলা গেল না।

........................................................................................................

রিদ্‌ম্‌ বেরিয়ে যাবার পর সোফায় বসে বসে চেরিটাকে জড়িয়ে ধরে কখন জানি চোখ লেগে গেছিল। চোখ খুললাম যখন, আলো কমে এসেছে ঘরটায়। এত তাড়াতাড়ি সন্ধ্যে হয়ে গেল বুঝি? 'টা বাজছে...? চোখ রগড়ে টেবিলের উপরটা হাতড়ালাম অন্ধকারেই...

খুব ঠান্ডা কি একটা হাতে ঠেকলো... চমকে উঠে বসলাম... একটা জলের বোতল...! কেউ এক্ষুণি ফ্রিজ থেকে বের করে রেখেছে... এতটুকু জল গড়ায় নি সেটা থেকে এখনও... আর গোটা টেবিলে কোথাও রিস্টওয়াচ'টা নেই...!

ঝট করে উঠে দাঁড়াতেই মাথাটা ঝিমঝিম করতে লাগল... পা টলছে... চেরি কোথায় গেল...?
চেরি...!ডাকলাম...

সাড়া নেই...

সোফার নিচেটা দেখলাম উঁকি দিয়ে... ঘর'টা বেশ অগোছালো, টের পাচ্ছি রীতিমতো... ডায়নিং টেবিলের ওপর আমার শেষ-করা কফির কাপ'টা ধুয়ে উলটে রাখা, ওয়াশ বেসিনের পাশে জল ছড়িয়ে আছে, একটা চেয়ার টেনে একটু বেঁকিয়ে রাখা... যেন কেউ বসেছিল সোফাটার দিকে তাকিয়ে...

চেরি নেই কোত্থাও!

চেরি...?” ডাকলাম আরেকবার... পাত্তা নেই কারো...

আস্তে আস্তে বারান্দায় বেরিয়ে এলাম.....উইন্ডচিমারটা সেরকমই বাজছে এখনও... ওকগাছটাকে কেমন ডাইনিবুড়ির মতন দেখতে লাগল একবার তাকিয়ে...

ঘরে ফিরে এলাম; এক গ্লাস জল খাবো... টেবিলে রাখা বোতল'টা নিতে গেলাম আর রক্ত হিম হয়ে গেল মূহুর্তে...

সোফাটার কোল জুড়ে অন্ধকার বেশ গাঢ় হয়েছে ততক্ষনে... দেখলাম, চেরি সোফার কুশনে গা ঘষছে আনমনে... যেন খুব করে আদর খাচ্ছে কারো কাছে...

কে...???? কে ওখানে...?” চেঁচিয়ে উঠলাম খুব জোরে...

একঝাঁক হাওয়া ঢুকলো খালি জানলার পর্দাটা উড়িয়ে দিয়ে...

কে...??? কেন ভয় দ্যাখাচ্ছো...? জেন...? জেন ফিরে এসেছো বুঝি...? না কি... না কি তুই রিদ্‌ম্‌...? প্লিজ আমায় আর ভয় দেখাস না তোরা, ভাল্লাগছেনা আমার, প্লিজ...

গলা ভেঙে গেল আমার কথা'কটা বলতে গিয়ে... বুকের ভেতর কেউ যেন ভয়ে চোখ বন্ধ করে বলছিল যে ঘরে কেউ আছে... নিশ্চিত আছে... কিন্তু সে রিদ্‌ম্‌ নয়... জেনও নয়... তাকে আমি চিনি না...!!
আরেকবার পর্দাটা উড়ল... এবার খুব জোর হাওয়া... টেবিলের নিচের তাক থেকে খবরের কাগজগুলো উড়ে ঘরময় হয়ে গেল একেবারে... চেরি এবার আমার দিকে তাকাল অবাক হয়ে...

কেন...? কেন...? কি চাও...? কি.........বলতে বলতে চোখ জল এসে গেল আমার... নড়তে পারছি না এতটুকু... গলার স্বর তলিয়ে যাচ্ছে যেন চিরকালের জন্যে...

..........আরেকজনও কিছু বলতে চায়... ভীষণ ভাবে বলতে চায়... ঘরজোড়া টানটান অন্ধকার সেটা জানান দিইয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত...

আরেকবার হাওয়া দিল... আর পাক খেয়ে খবরের কাগজের একটা পাতা আমার পায়ে জড়িয়ে গেল...
আর সাথে সাথে হাওয়া থেমে গেল একেবারে...

সব চুপ... সব শান্ত... যেন ত্রিভুবনে শব্দ বলে কিছু হয়'ই না এ'রকম নীরবতা... উত্‌কন্ঠায় উপচে যাওয়া নীরবতা... সব্বাই যেন অপেক্ষা করছে আকুল হয়ে...

আঙুল হিম... হাত কাঁপছে... কোনোরকমে কাগজটা কুড়িয়ে নিলাম...

গত চোদ্দ'ই ফেব্রুয়ারির খবরের কাগজ...

পাতাজোড়া গোলাপি রঙের বিজ্ঞাপন কোনো এক গ্রিটিংস্‌ কার্ড কোম্পানির... বড় বড় অক্ষরে লেখা...

Some day, when I'm awfully low
When the world is cold
I will feel a glow just thinking of you
And the way you look tonight

পড়া শেষ... আস্তে আস্তে মাথা তুললাম... হাঁটুর আশেপাশে জোরালো কাঁপুনি... শিরদাঁড়ায় ঠান্ডা ঝিমুনি... ঘরের আলোআঁধারের মধ্যে কাউকে খুঁজে চলেছে আমার দু’চোখের মণি... স্ট্যাচু হয়ে তাকিয়ে রইলাম সামনের দিকে...

চেরি আবদারি জুলুজুলু চোখে তাকালো আমার দিকে...

নরম আকুতির মতন খুব আলতো একটা হাওয়া দিল ঘরটায়...

[শেষ]


- Copyright © পাঁচমিশেলি - - Powered by Blogger - Designed by সায়ংতরী -