Popular Post

Archive for March 2016

আবার যদি ইচ্ছে কর / দুই

By : Sayantari Ghosh
ps.jpg

দুই
লোহিতের সামনে বসেছিলাম। আকাশ ভর্তি মাখাসন্দেশের মত মেঘ, সূর্য আছে না নেই টের’ই পাওয়া যায় না। সামনের বাগানটায় ছবি তুলছে হেম আর পারো। প্রথম আলাপ’ও আমাদের এই বাগানের সামনেটাতেই, হস্টেলে ঘরের চাবি পাওয়ার দিন’টায়। পশ্চিম বাংলার বাইরে প্রথম পা রেখে এই দূরশহরে এসে দক্ষিণের মেয়ে হেমাক্সি আর অসম থেকে আসা পার্বতি যে আমার নিঃশ্বাস আর প্রশ্বাসের নামান্তর হয়ে যাবে এমন’টা ভাবার কথাও ভাবিনি কোনোদিন! অবশ্য রুদ্র’কে বাদ দেবো না আমি। প্রথমবার এখানে আসার ট্রেন যেইই ছাড়লো, প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো বাবার মুখ’টা আবছা হয়ে গেল কিছু কুয়াশায়, কিছু’টা চোখ উপচানো জলে, সেই থেকে ওই দু’বছর যার চোখদুটোতে রাজ্যের আশ্বাস দেখতে পেতাম সারাক্ষন, ভিড়ে, ভয়ে, নির্দ্বিধায় যার হাত ধরতে পারতাম সুরক্ষা চেয়ে... সে রুদ্র। ও ছিল তাই এই অবাক-দুনিয়া দ্যাখা হয়েছে আমার। ও ছিল তাই কত কি শেখা হয়েছে.........
হেম বলত, ‘আমাদের ভেতর গ্লুয়িং রিয়েজেন্ট হল পারো’... আপনভোলার চূড়ান্ত মেয়ে! ওকে সামলাতে সামলাতেই আমাদের তিনজনের বন্ধুত্ব’টা কখন যেন ‘কভি টুটেগা নেহি’ মার্কা হয়ে গেছিল। আদ্ধেকদিন ঘর তালা দিতে ভুলে যেত, সাইকেল বাজারে স্ট্যান্ড করে হস্টেল চলে আসত নিশ্চিন্তে, অন্ততঃ একহাজার বার দরজায় টোকা দিয়ে ভুলে গেছে যে ঠিক কি বলতে এসেছিল...
কিন্তু অবাক কান্ড হল, যে এমন ভুলোমন মেয়ে্টা আশ্চর্য রকম খেয়াল করে সামলে রাখত একখানি জিনিস। তার মোবাইল! সাদামাটা পুরোনো হ্যান্ডসেট’টাকে হেম মজা করে বলত ‘সতীন’! মোবাইল’টি ছিল পারোর প্রাণ! তার যত্নের, আদরের, পরিচর্যার শেষ ছিল না কোন! আর সেইসব কিছুর কারণ ছিল মাত্র একটি। সেই ফোনে ঠিক রাত সাড়ে দশটায় একজন ফোন করত সুদূর গুয়াহাটি থেকে... সে তার সারামাসের বরাদ্দ থেকে অতিকষ্টে বাঁচিয়ে রাখত এস.টি.ডি. ফোনের রিচার্জের দামটুকু। গুনে গুনে দশমিনিট কথা হত সাধারণতঃ... আর অসাধারণ কিছু হলে কথা ফুরাতো না, ব্যালান্স ফুরিয়ে যেত তার আগে... সেসব রাত্রিগুলোয় যতক্ষণ ঘুম আসত না আমার, একটা খুব আবছা কান্না ঘরজুড়ে ঘুরঘুর করছে টের পেতাম। অতি রক্ষণশীল অসমিয়া পুরোহিত-বাড়ির মেয়ে পার্বতি গোস্বামী তার চরম ভুলোমনের সবটুকু দিয়ে গুয়াহাটি ইউনিভার্সিটির পড়ুয়া আর আপাদমস্তক বাঙালি আলোক ঘোষ’কে ভালোবাসত!
ভালোবাসা-টাসা’কে আবার এক্কেবারে পাত্তা দিত না হেম। সাঙ্ঘাতিক ডাকাবুকো মেয়ে। অন্ধ্রপ্রদেশের এলুরু থেকে কলকাতা এসেছিল যাদবপুরে ফিল্ম স্টাডি নিয়ে পড়াশুনো করতে। তারপর এখানে। এমন ঝরঝরে বাঙলা বলতো যে ওকে বাঙালি বলে ভুল হবে। জমিয়ে রাজনীতি করত, সারারাত জেগে একতলা বাড়ির সমান উঁচু অসাধারণ সব পোস্টার আঁকতো, একখানা স্‌প্লেন্ডার বাইক নিয়ে রিং রোড চষে বেড়াত রাতে-দিনে। হস্টেল থেকে স্কুল, প্রফেসর থেকে দারোয়ান সব্বাই তার প্রতাপে তটস্থ ছিল! কারোর তোয়াক্কা করত না এক কথায়!
মনে আছে একবার রাত্রি বারোটার পর খালি একটা ঢাউস টর্চ হাতে নিয়ে আমাদের সঞ্জয়-বনের গহনে ঢুকিয়ে নিয়ে গেছিল। ভয়ে আমাদের প্রান প্রায় ওষ্ঠাগত, গলা শুকিয়ে গেছে, হারিয়ে যাবো, আর ফিরতে পারবো না, আরো যা যা কুডাক ডাকা সম্ভব, মন সব ডেকে ফেলেছে... জানিনা কতদূর হেঁটে শেষে একখানি উঁচু পাথরের ওপর এনে বসালো আমাদের... সামনে খাদ, ঝুপসি জঙ্গল সেদিকটায়... আকাশে কানাউঁচু থালার মত পূর্ণিমার চাঁদ, কিন্তু সে আলো ওই আঁধারে নামার চেষ্টাও করে না... পাথরে, পাহাড়ে পিছলানো জ্যোত্‌স্না... আর জঙ্গলের ওপাশে, অনেক দূরে জ্বলজ্বল করছে ঘুমন্ত লোহিত হস্টেলের দু’শো ঘরের ছড়ানোছিটানো রাত-আলো... আবছা দ্যাখা যাচ্ছে সামলের রাস্তার হলুদ হয়ে আসা স্ট্রিটলাইটগুলো... মনে হল যেন স্বর্গ থেকে কেউ আমাকে আমার বাড়ির উঠোন দেখিয়ে দিয়েছে! কথা সরেনি কোন, আমি আর পারো চুপ... হেম শুধু বলেছিল, “আমরা খালি ওই ছাদ থেকে এই পাহাড়, এই জঙ্গল দেখি, বল? এখান থেকে এই জঙ্গল পেরিয়ে ওওওওই অব্দি যাওয়ার রাস্তা বানানোর কথা ভাবি না কেন?”
উত্তরে কি বলতে হত আজো জানি না।
একটু থেমে হেম বলেছিল, “আমি বানাবো, দেখিস...”
[ক্রমশঃ]

ফেরা / দুই

By : Sayantari Ghosh



দুই
“ শিল-শিলাটন শিলাবাটন শিলা আছেন ঘরে
স্বর্গ থেকে মহাদেব বলেন হরগৌরী কি ব্রত করে?"
দখিনদুয়োরী বড় ঘরটার মেঝের ঠিক মাঝখানে বড় করে আলপনা দিচ্ছে টুপুর—চারদিক কেমন ধোঁয়াটে—আর একটানা কেউ যেন পাঁচালি পড়ছে—
"....আকন্দ, বিল্বপত্র, তোলা-গঙ্গার জল
এই পেয়ে তুষ্ট হন ভোলা মহেশ্বর......”
কোথায় যেন শোনা এই ছড়াটা? খুব,খুউব চেনা...তবু যেন ঠিক ঠিক চিনে নিতে অসুবিধে হচ্ছে—ওই তো দিদুন...খাটের ওপর বসে...এক্ষুনি স্নান সেরে এসেছে...এই অ্যাত্তো লম্বা ভেজা চুল গোটা পিঠে এলো হয়ে আছে...ছোট্টো কপালে ছোট্টো সিদুঁরের টিপ...
-“ম্যাডাম...!”
আচমকা তন্দ্রাটা কেটে গেল ডাকটায়—চোখ খুলতে হাসপাতালের রিসেপশনের মেয়েটির ব্যাতিব্যস্ত মুখটা পরিষ্কার হয়ে এল আস্তে আস্তে—বুকের ধুকপুকুনিটা অজান্তেই বেশ খানিকটা বেড়ে গেছে ততক্ষণে...
-“আপনি কি ICU-এর ছয় নম্বর পেশেন্টের বাড়ির লোক?”
মাথার বাঁ-দিকটা দপদপ করছে ক্রমাগত—কথাটা শোনার পর বুঝতে একটু সময় লাগল টুপুরের—তারপর ধীরে ধীরে উত্তর দিল ও—
-“না...না,আমার পেশেন্ট CCU-তে আছেন...বারো নম্বর...”
-“ওহ...সরি!” আর কথা না বাড়িয়ে মেয়েটি চলে গেল।
ঘুম এসে গেছিল একটুখানি—মাথাটা ভীষণ ব্যাথা করছে—একটু চা খেতে হবে—হাসপাতালের ক্যান্টিন এই রাত আড়াইটের সময় খোলা থাকবে না—রাস্তার মোড়ের দোকানটা ছাড়া গতি নেই...
পায়ে পায়ে লাউঞ্জটা থেকে বেরিয়ে এল টুপুর—ভীষণ গুমোট করেছে আজ—আকাশে একটাও তারা নেই—খুউব হালকা হাওয়া দিচ্ছে একটা—আলগোছে ছুঁয়ে যাচ্ছে—জোর করে বুঝতে চাইলে তবে বোঝা যায়—!
দাদুমনি নাকি এখন একটু ভাল—সাড়ে ন’টায় ডাক্তারের সাথে শেষ কথা হয়েছে—ব্লাড প্রেশার অনেকটা স্টেবল—কিন্তু হার্টবিট নাকি খুব উইক—কে জানে...? এদের কথায় আজকাল আর ভরসা করতেও সাহস হয় না—
আকাশে মেঘের ফাঁক দিয়ে এক চিলতে আগুন ছুটে গেল—বৃষ্টি হবে কি...?
চা-টা হাতে নিয়ে হাসপাতালের সিঁড়িতে বসল টুপুর—কি যেন একটা স্বপ্ন দেখছিল ও এখুনি? কি যেন...? যত ধরার চেষ্টা করছে,তত যেন পিছলে পালিয়ে যাচ্ছে স্বপ্নে-দেখা দৃশ্যগুলো...দিদুন ছিল এটুকু মনে আসছে...আর......
‘ শিল-শিলাটন শিলাবাটন শিলা আছেন ঘরে
স্বর্গ থেকে মহাদেব বলেন হরগৌরী কি ব্রত করে?’
-“না না...শ্রবণকুমারেরটা নয়...ওটা বিচ্ছিরি...আজ পুণ্যিপুকুরের গল্পটা বল না,দিদুন...!”
-“আআ মল যা...পুণ্যিপুকুরেরটা আবার গল্প নাকি? কতবার শুনিচিস ওটা...সেই যে চারকোনা পুকুর কেটে...”
-“না না...অম্নি করে না...ভালো করে বলো না...!”
প্রতিদিন প্রাইমারি স্কুল থেকে ফিরে খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকে যাবার পর দিদুনের খাটটায় পাশাপাশি শুয়ে পড়তো ওরা দুইবোন...টানটান উত্তেজনায়...নতুন গল্পের দুরন্ত আকর্ষনে...বা সাতপুরোনো গল্পের কানাঘুঁজিতে একটু নতুন আবিষ্কারের আশায়...
-“ভালো করে আবার কি? সব মনে আছে তোদের...এই ত সেদিন শুনলি...”
-“না,না...বলো না দিদুন... ‘ভাটি-খালকুলায় বোশেখ মাসটা জুড়ে...’...বলো না...!”
-“বেশ,বেশ..শোন তবে....তা আমাদের গ্রাম ভাটি-খালকুলায় গোটা বোশেখ মাসটা জুড়ে নানাআআন রকম উত্সব-মচ্ছব লেগেই থাকত...গ্রামটার পাশ দিয়ে গোল করে বাঁক নেওয়া চন্দনা তখন এই প্যাকাটির মতন শুকিয়ে যেত...অথচ বর্ষায় তার সে কি আস্ফালন...! জলে আর মাছে থৈ থৈ করত তখন!
যা হোক বোশেখের কথা বলছিলাম...পয়লায় দয়ালের আসন থেকে একখানা নগরকীত্তন বার হত...সারা গ্রাম ঘুরে তারা সংক্রান্তির মেলার জন্য দান-দক্ষিণে নিত...সে কীত্তন ভাটি-খালকুলা আর মাদুলি-খালকুলার সব দরজায় ঘুরতো...
তারপর বোশেখের পত্থম ব্রত করতাম আমরা...পুণ্যিপুকুরের ব্রত...ঘর-লাগোয়া বিশাল দীঘি ছিল আমাদের...তার পাড়েই চারকোণা পুকুর গড়তাম...”
-“কত বড় পুকুর দিদুন...?”
-“ছোট্ট...! এই ধর এইটুকুনি...”, খাটের ওপর আঙ্গুল দিয়ে দাগ টেনে পুকুরের আয়তনটা বুঝিয়ে দিত দিদুন, “সেই পুকুরভর্তি করে জল দিতাম আর পুকুরের মাঝখানে একখানা বেলের ডাল লাগিয়ে দিতাম...”
-“বেলের ডাল কোত্থেকে নিতে...? দয়াল আসনের পাশের বোধন-বেলগাছটা থেকে বুঝি...?”
-“সে অত মনে নেই...বেলের কি আর অভাব ছিল নাকি...?”
-“তারপর...?”
-“তারপর পুজো করতাম...! হাত জোড় করে, কোষাকুষিতে সব সাজিয়ে নিয়ে...”
-“মন্ত্র বলতে না...?”
-“হ্যাঁ...বলতাম বই কি...সব্বাই মিলে বলতাম,
‘পুণ্যিপুকুর ব্রতমালা/কে করে গো সকালবেলা
আমি সতী,লীলাবতী/সাতভায়ের বোন,ভাগ্যবতী
হবে পুত্র,মরবে না/ধান সে গোলায় ধরবে না
পুত্র তুলে স্বামীর কোলে/আমার মরণ হয় যেন এক গলা গঙ্গাজলে...’...”
ছড়াটা শেষ হতেই হাততালি দিয়ে উঠত নুপূর...দিদুনের কোল ঘেঁষে বসে বলত, “আর শিবরাত্রির মন্ত্রটা......?”
-“ শিল-শিলাটন শিলাবাটন শিলা আছেন ঘরে
স্বর্গ থেকে মহাদেব বলেন হরগৌরী কি ব্রত করে?
আকন্দ, বিল্বপত্র, তোলা-গঙ্গার জল
এই পেয়ে তুষ্ট হন ভোলা মহেশ্বর।
আসনং পাশনং পাত সিংহাসন
হরগৌরী ব্রত করে শিব হরধন
কালো ফুল তুলতে গেলাম শুধু লতাপাতা
শিব-চরনে দেখা হল, শিবের মাথায় জটা...”
-“তারপর...?”
-“তারপর আর কি? চেয়ে নিবি...”
-“কি চেয়ে নেব...?”
-“বর...! এই টকটকে ফরসা রং, টানাটানা চোখ, টলটলে হাসি...রাজপুত্তুরের মতন বর চেয়ে নিবি...”
-“চাইলেই পাওয়া যাবে।তাই না দিদুন...?”, নুপূর জিগেস করত অনেক আগ্রহ নিয়ে...
-“কিন্তু এতো একেবারে দাদুমণির মতন...”, বলত টুপুর, “আমার তো দাদুমনি আছে...আমি আর চাইবো কি করতে...?”
আকাশে আরেকখানা বিদ্যুতের ঝলক...শুধু আলো...কোনো শব্দ হলনা...দিদুন বুঝি মুচকি হাসল ওই ওপরে বসে বসে...আর তক্ষুনি টুপুর হঠাত্ খেয়াল করলো দু-গাল ভিজিয়ে দিয়েছে বাধ-না-মানা চোখের জল...দুহাতে মুখ ঢাকলো ও...সেইদিন থেকে সব্বাই কেঁদেছে...সব্বাই...শুধু ও ছাড়া...সুযোগ পেয়ে সবটুকু কান্না উছলে পড়তে চাইছে এখন...অঝোরে...
এই একা-রাত গুলো এরকমই অবাধ্য হয়...একগুঁয়ে...জেদি...কাঁদিয়ে তবে ছাড়ে...!

স্বীকারোক্তি, আমি আর একরাশ বাজে-বকা

By : Sayantari Ghosh


জানেন ত, আজকে স্বীকারোক্তি দিবস...? (কি যেন একটা ইংরিজি নামও ছিল...ভুলে গেছি!)
একখানা সিরিয়াস স্বীকারোক্তি করা নাকি আজকের দিনে যাকে বলে একেবারে মাস্ট! “সিরিয়াস স্বীকারোক্তি” বুঝলেন না? মানে ওই ধরুন “ছোটবেলায় আমি ধুলোবালি, মাটি, ছাই এসব হাতে পেলেই বেমালুম খেয়ে ফেলতাম” বা “গতকাল আমি ২১৫ নয়,৭১ নম্বর বাসে উঠেছিলাম আসলে” কিম্বা “ওই কাঁচের ফুলদানিটা... মানে আমারই হাত থেকে পড়ে...” এই জাতীয় অ-সিরিয়াস স্বীকারোক্তি সব বাতিলের খাতায়... বুঝলেন এইবারে?
এখন আপনারা ত জানেন (?) এসব দিনক্ষণ আমি কি নিষ্ঠার সাথে মেনে চলি! অনেক ভেবে দেখলাম, কাজটা যখন করতেই হবে তখন ব্লগটাই সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা... আমার ভ্যাজর-ভ্যাজরে চূড়ান্ত বিরক্ত হলেও কেউ আমায় চাঁদা তুলে গণপিটুনি অন্ততঃ দিতে পারবে না এখানে!
অতএব......শুরু করি তাহলে...!
শুরু'টা করবো একটা প্রশ্ন দিয়ে। আচ্ছা, মনে করুন, আপনাকে জিগেস করলুম যে একখানা এরকম টপিক বলুন দেখি, যেটা নিয়ে আপনার বেসিকালি কিচ্ছু এসে যায় না, কিন্তু তবু  কেউ সেই নিয়ে গল্প শোনাতে চাইলে আপনি নন্দলালের মালাই চমচম খাওয়ার অফার'ও হেলায় উপেক্ষা করে বসে পড়বেন? নিশ্চয়ই এরকম পছন্দের বিষয় কিছু আছে... যেমন ধরুন ভূত? বা ভিন গ্রহের প্রাণী...? বা ধরুন, দাম্পত্য-কলহ? আছে নিশ্চয়ই...? আমার তেমনই বহুদিনের আকর্ষণ একটি শব্দের প্রতি ... শব্দটি হল “ক্রাশ”! এই সব গল্পের চুম্বকে আমি এক্কেবারে বাঁধা, সে মায়া বোধহয় এ-জন্মে আর কাটিয়ে উঠতে পারব না!!! আমি ক্রাশের আড্ডা বড্ড ভালোবাসি, আর সে সব আড্ডা বসলেই আমার মনের অন্ধকার আউটহাউসের বাসিন্দা আমারই অংশবিশেষ কোনো এক দুরাত্মা (তার কদমছাঁট চুল, মারাত্মক লালচে চোখ আর মাথায় দুখানা ছোট্ট ছোট্ট শিং!! তাকে আমি মাঝেমধ্যেই মানসচক্ষে দেখতে পাই!) বসে বসে বিচ্ছিরিভাবে দাঁত বের করে হাসে আর বলে, “ভাবছিস কি?? সবাই এখানে ক্রাশের গল্প শোনাবে...?! খুব মজা, না? খ্যাঁক খ্যাঁক, খোঁক খোঁক...”
আজ বড় ভালো দিন— মিথ্যে বলব না— ওই শিংওয়ালা শয়তানটার কথার পুরোপরি সত্যি— ক্রাশ-টাশের গল্প আমার ভাই বেজায় ভাল লাগে— আপনারা হয়তঃ বিশ্বাস করবেন না, ভাববেন বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলছি, কিন্তু সেরকম গল্প বলার লোক পেলে আমি সারাজীবনটা খাটের ওপর এলিয়ে বসে, বাদামভাজা খেয়ে আর ক্রাশের গল্প শুনে মজাসে কাটিয়ে দিতে পারি— এসব রোমাঞ্চকর কাহিনীর আমি চিরন্তন একনিষ্ঠ শ্রোতা!
কিন্তু ভাল শ্রোতা হওয়ার একটা গুরুতর অসুবিধা আছে। তাতে আপনি চিরকাল শুনতেই থাকেন, কেউ আর আপনার কাছে কখনো কিচ্ছুটি শুনতে চায় না!
আমারও সেই একই ঝামেলা! রাজ্যের লোকজন এসে আমাকে রকমারি গল্প শুনিয়ে যায়, আমিও শোনার আনন্দে সেসব গোগ্রাসে গিলে ফেলি... কিন্তু তাই বলে বুঝি আমার বলার মত কিছু থাকেনা? আমার বুঝি এক-দুটো ক্রাশের গল্প থাকতে নেই? যাচ্ছেতাই একেবারে...!
সে যাই হোক, আজ তাই আমার সিরিয়াস স্বীকারোক্তিটি আমার প্রথম ক্রাশ বিষয়ক একখানি দূর্লভ কাহিনী। দীর্ঘকাল যাবত্ পুরনো গল্পের বস্তায় পড়ে থাকার দরুন পচে-টচে গেলে অবিশ্যি জানিনে...!(শুনেছি স্বীকারোক্তি ব্যাপারটা নাকি বেশ কষ্টকর; আমার এরকম ভয়ানক আনন্দ হচ্ছে কেন, কে জানে!)
প্রথম ক্রাশ জিনিসটা আমার বান্ধবীদের মধ্যে ঘটে গেছিল ওই ক্লাস সেভেন-টেভেন নাগাদ। আমি সেই সময় ঠিক কি করছিলাম অনেক চেষ্টা করেও কখনও সেটা মনে পড়েনা! ওই সবার গপ্পোগাছা শুনতে গিয়েই কাল হয়েছিল হয়তঃ...
আমার বাবার ইস্কুলের ছাত্র'রা সকাল-বিকেল দঙ্গল বেঁধে আমাদের বাড়ি আসত মাঝে মাঝেই। সেদিকেও আমার তেমন উত্সাহ ছিল না। কিন্তু...... ব্যাতিক্রমী ঘটনাটি ঘটল! তখন আমি ক্লাস নাইন। এক শনিবারে স্কুলের পর ঘন্টাদেড়েক গানের রিহার্সাল করে, খিঁচড়ানো মেজাজে, স্কুলড্রেসের হলুদ শাড়িতে হোঁচট খেতে খেতে বাড়ি ফিরছি। মাথায় তখন খালি ঘুরছে পরদিনের টিউশনের পরীক্ষাটার কথা...

হঠাত্ রাস্তার পাশ থেকে কে যেন বলে উঠল, “আচ্ছা, সুজনস্যারের বাড়িটা কোনদিকে?”
গলার স্বরের মালিকের দিকে চোখ পড়তেই আমি থ! বুকের মধ্যে একসাথে হাজারখানা কাঁসর-ঘন্টা বাজতে শুরু করল হঠাত্! একি দেবদূত নাকি রে বাবা? কিছুক্ষন হাঁ করে তাকিয়ে থাকার পর বুঝলাম যে, না, এ দেবদূত নয়; দেবদূতরা CBZ বাইক চালায় না!
সে আমার এই বিহ্বলতা লক্ষ্য করেছিল কিনা জানিনা। সে আবার বলল, “আমি সুজনস্যারের বাড়িটা খুঁজছিলাম; আপনি চেনেন?”
কোনোক্রমে হাত উঠিয়ে বাড়ির দরজাটা দেখিয়ে দিলাম। এটুকুও বলা গেল না যে সেতো আমাদেরই বাড়ি..! যাকে বলে একেবারে দর্শন এবং সম্মোহন... কয়েক ন্যানোসেকেন্ড সময় লেগেছিল হয়তঃ...
পরে জেনেছিলাম বাপির কোন এক চেনা ডাক্তারবাবু তাঁর তনয়রতনটির জয়েন্টের স্পেশাল কোচিং-এর জন্য বাপিকে রিকোয়েস্ট করেছেন। বাপিকে সাধারণতঃ এ ধরনের অনুরোধের ফাঁদে ফেলা যায় না; এবারেই কি করে না জানি অঘটনটা ঘটে গেছে। ব্যাপারটা শোনামাত্র আমার উত্তেজিত প্রাণের মধ্যে একটা দৈব-নির্দেশিত ঘটনার ইঙ্গিত আরো স্পষ্ট হয়ে গেল এক্কেবারে! আর তার ওপরে যখন শুনলাম যে প্রতি শনিবারই সাড়ে তিনটে নাগাদ তার আগমন ঘটবে, তখন এত আনন্দ রাখব কোথায়, এই নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেলাম!
এরপর থেকে শুরু হল এক অদ্ভুত রুটিন! বাড়ির সবাইকে দিবানিদ্রার সুযোগ দিয়ে স্বার্থত্যাগী (?) আমি শনিবারের ভর দুপুরগুলো অঙ্ক খাতা নিয়ে দিন-জাগা শুরু করলাম! মা তো মহাখুশি! মাধ্যমিকের বছর মেয়ে দুপুরে টানটান পাঁচঘন্টা না ঘুমিয়ে অঙ্ক খাতা নিয়ে বসলে মায়ের খুশি হওয়াটাই স্বাভাবিক। আর আমি? সেই “পাপা কেহতে হ্যায়...” গানের স্টাইলে সারা দুপুর “চমকিত মন, চকিত শ্রবণ, তৃষিত আকুল আঁখি” নিয়ে দুরুদুরু বক্ষে বসে থাকতাম— অপেক্ষা— কখন সে আসবে আর আমি দরজাটা খুলে দেব! সে রোমাঞ্চ ভাষায় বলার মতন অত বাংলা আমি শিখিনি এখনও...!
এতদূর শুনে যদি আপনি একটা দারুন প্রেমের গল্পের গন্ধ পাচ্ছেন, তাহলে মহাভুল করছেন মশাই! গল্পের মুখ্য পাত্রীটি যে আমি সেটা বুঝি নির্ঘাত ভুলে মেরে দিয়েছেন? মাসছয়েক ধরে আমি ওই দরজা খোলার কাজটি বড় দায়িত্ব নিয়ে, ভীষণ নিপুণতার সাথে করে গেলাম আর তারপর...? 
তারপর আর কি? জয়েন্ট পেয়ে গিয়ে সে যথারীতি বিদায় নিল!
সেই দুঃখে মাসখানেক মুহ্যমান হয়ে ছিলাম। আমার বন্ধুরা বলে সেসময় নাকি আমার মধ্যে বেশ একটা বৈরাগ্য-গোছের ভাব এসছিল; ওদের নাকি ভয় হয়েছিল যে তার নামের মালা জপ করেই বোধহয় আমার বাকি জীবনটা কেটে যাবে... যাই হোক, ঘাড়ের ওপর হুড়মুড়িয়ে মাধ্যমিক পরীক্ষাটা এসে গিয়ে আমার বৈরাগ্য-টৈরাগ্যের সব্বোনাশ করে দিলে... নইলে আমায় নিয়েও কত্তো কবিতা-উপন্যাস লেখা হত, দেখতেন!
শেষমেশ আর একটা কথা বলি। মাধ্যমিকে অঙ্কে সঅঅব ঠিক করে এসছিলাম; তবু একশ হয়নি। প্রথমে দুঃখ পেলেও পরে বুঝেছিলাম এ আমারই পাপের ফল বই আর কিছু নয়। শনিবারের ওই দুপুরগুলো অঙ্ক করার ব্যাপারটা যে শুধুই গল্প, সে ত আর মা-বাপি কোনোদিন জানতে পারেনি! রীতিমত ভয় করত মাঝেমাঝে, যে কোনদিন মা এসে ক্যাঁক করে চেপে ধরবে, “প্রতি শনিবার অত্তো অত্তো অঙ্ক করলে তো দশ-বিশ কিলো খাতা জমে যাবার কথা! কোথায় সে সব? দেখি...” ইত্যাদি! যা হোক, সে দুর্দিন আমার আসেনি কখনও।
তা এই হল গিয়ে আমার আজকের স্বীকারোক্তি! আপনার কিন্তু অসাধারণ ‘ইয়ে’.... এখনো পড়ে যাচ্ছেন!! তো এতটা যখন পড়লেনই, আর একটা কাজও করে ফেলুন না! আজ দিনটা সত্যিই খুব ভালো। আপনিও একটা এই জাতের স্বীকারোক্তি করেই ফেলুন না বুকের সমস্ত সাহস একজোট করে...! বলছি শুনুন, কিউপিডের নেকনজরে থাকবেন! বিশ্বাস করুন...

ফেরা / এক

By : Sayantari Ghosh


এক

হাসপাতালটার একটা দিকের দেওয়ালের জায়গায় সাততলা-জোড়া কাঁচ— তার মধ্যে দিয়ে দেখলে বাইরের উত্তপ্ত জ্যৈষ্ঠের দুপুরটাকেও সবজে ছায়ায় ঢাকা মনে হয়। তিনতলার সেইরকম একটা কাঁচের সামনে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল টুপুর। বাইরের গাছপালা,বাড়িঘর— নির্জন রাস্তায় মাঝেমাঝে হুশ করে ধুলো উড়িয়ে চলে যাওয়া এক-একটা গাড়ি— সবকিছুর মধ্যেই যেন একটা জড়তা— সময়টা খারাপ ক্যাসেটের রিলের মত জড়িয়ে গেছে যেন! এখান থেকে বোঝাই যায় না এটা ভোর, দুপুর নাকি বিকেল গড়িয়ে গেছে— ইচ্ছে করে এরকম কাঁচ লাগিয়েছে এরা— জোর করে সময়টাকে আটকে দিতে চায়। ভীষণ একটা ভাঁওতার মধ্যে রেখে দিতে চায়— একটা ধাঁধার মধ্যে।

এভাবেই তিনটে দিন কেটে গেল— দিনরাতের হিসেবটাও গোলমাল হয়ে যাচ্ছে এবারে—
একটু দূরে ওয়েটিং হলের বেঞ্চিতে মা-কে জড়িয়ে ধরে, চোখ বন্ধ করে নূপুরটা বসে আছে— মায়ের চোখ ফোলা, মুখ লাল— বাপি আর কাক্কা অনেকখন ধরে কথা বলছিল; এখন চুপ— বাপির চোখ বন্ধ; চোখের পাতাটা তিরতির করে কাঁপছে— কথা আর কান্না তে কিই বা আসে-যায়? হিসেব তো মনেমনে সব্বাই করছে!

টুপুর আবার রাস্তার দিকে তাকালো—গলার কাছটায় কেমন যেন একটা অস্বস্তি হচ্ছে—
দাদুমণির এই ভাবে অসুখে পড়াটা ঠিক মেনেই নেওয়া যাচ্ছে না। সেদিনও তো বিকেলে হাঁটতে বেরোলো— টুপুর স্কুল থেকে ফিরেছে তক্ষুনি— M.A.-এর রেসান্টটা বেরোয়নি—এই ফাঁকে একটু হাত পাকানো আর কি! 

সদরের কাছটাতে দাদুমণির সাথে দেখা, বলল, “কি বড়দি? মুখ গোমড়া কেন? ছাত্তররা কথা শুনছে না বুঝি?”
-“কি যে বল,দাদুমনি? আমার কথা শুনবে না?জানো, আমি সারাক্ষণ হাতে বেত রাখি!”,হেসে জবাব দিয়েছিল টুপুর, “দু-মিনিট দাঁড়াও না গো! এক কাপ চা খেয়ে নিই— দিয়ে আমিও তোমার সাথে ঘুরে আসি একটু...”
-“না ভাই, তুই বড় দেরি করে দিস!” মাথা নেড়ে বলেছিল দাদুমনি, “তোর সাথে আরেকদিন ঘুরতে যাব... যেদিন ব্যাগপত্তর কিনতে নিয়ে যাবি, সেইদিন... কবে যাবি বল তো?”
-“ইইইস!! ব্যাগপত্তর কেনার আর তর সইছে না,বলো?! রোববার যাব, দাদুমনি... পাক্কা...!”

আজ রোববার! ভাবতেই বুকের ভেতর'টা যেন দুলে উঠল একেবারে... বৃহস্পতিবার থেকে আজ রোববার— দাদুমনি কথাই বলছে না— সেইরাত থেকে আজ তিনদিন টানা এখানেই টুপুর— বাড়িমুখো হয়নি সে— মা আজ সকালে বলছিল,"বাড়ি গিয়ে একটু ঘুমিয়ে নে মামনি, এবার শরীর খারাপ করবে কিন্তু...”

ঘুমিয়ে?! এই তিনদিনে বসে বসে মাঝেমাঝে ঝিমুনি এলেও একটা দারুণ ঝটকা দিয়ে উঠেছে ভিতর থেকে— ঘুমের মধ্যে মারাত্মক দুঃস্বপ্ন দেখে যেমন ঘুম ভেঙে যায়, সেইরকম— চমকে সোজা হয়ে উঠে বসেছে টুপুর প্রতিবার!

-“না ভাই, তুই বড় দেরি করে দিস!” বলেছিল বটে দাদুমনি— খুব দেরি হয়ে গেল কি? কে জানে... বেশী কিছু তো নয়— শুধু একবার ঘরে ফিরতে চায় মানুষটা—তারও কি অনুমতি মিলবে না?? ভগবান...!

ঘরে ফেরা। এই একটা ইচ্ছে নিয়ে প্রতিটি রাত স্বপ্ন দেখত দাদুমনি; প্রতিটা দিন স্বপ্ন লিখত! দু'বছর আগে সেপ্টেম্বরে যখন হুঠ করে দিদুন চলে গেল, তার পর থেকেই আস্তে আস্তে এই ছেলেমানুষিটা পেয়ে বসেছে দাদুমনিকে... ঘরে ফিরবে! একবার! সেই গ্রাম, সেই মাটি, সেই ঘাস, সেই নদী, সেই সঅঅব কিছু একবার, শুধু একবার আলতো করে ছুঁয়ে আসবে! একটিবারের জন্য বাংলাদেশ ফিরবে! “ছানি পড়া চোখ, তবু দেখবো রে... কালা কান, তবু যেটুক শোনা যায়!” যেটা বলেনি সেটা হল,এখনও জীবন্ত প্রাণ... তাই বাঁচবো রে, যেটুক বাঁচা যায়!!

হুজুগ?! বলা যায়। অনেকে বলেও ছিল— তোতোনপিসি, দীপ্তিবউদি এমনকি মিতুলদা অবদি!দাদুমনির বাংলাদেশে যাওয়ার এই পাগলপারা ইচ্ছেটাকে আশকারা দিতে মানাও করেছিল বাপিকে। বাপি কোনোদিন কারো কথায় কান দেয় না; এবারও দেয় নি। বলেছিল, “যেতে ইচ্ছে তো যাক না!”

সেই দেশভাগের সময় থেকে মাটিছাড়া দাদুমনি। তারপর কোনোদিন, কখখনো ফিরে যায় নি। ফিরতে চায়ও নি। কিন্তু স্মৃতিজুড়ে ছিল সেই মাটির সোঁদা গন্ধ। এখনও মনে পড়ে— সে কবেকার কথা— টুপুর তখন স্কুলে পড়ে— শীতকালে ওপরের বারান্দার রোদে-ভেজা খাটটায় বসে বসে কত গল্প বলে যেত দাদুমনি আর দিদুন— টুপুরের আপাদমস্তক শহুরে মনটার কাছে রূপকথার থেকেও অবিশ্বাস্য লাগত সেসব কথা— দেখতে দেখতে ওর মনটাও ছুটতে শুরু করত সবুজ ধানের শিষে হাত ছুঁইয়ে— সরু আল বেয়ে— নীল আকাশটা নুইয়ে পড়ছে ওকে দেখতে— দূরে একদল সাদাকাশ একসাথে হৈ হৈ করছে— ছুট, ছুট, ছুট— “রুপুউউউ...!! ওওওওওই বুড়ো অর্জুনতলা অবদি কিন্তু— আজ আবাআআআর তুই হেরে যাবি...!!!” —আআআর এই যে গাছ ছুঁয়ে দিয়েছি— জিতে গিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠত টুপুর— শুনতে শুনতে ভুলেই যেত যে স্মৃতিটা আসলে কার...! মনে হত কবেকার সেই জোড়া-বাংলার অজপাড়াগাঁয়ের ছেলেমেয়ে রুপু, মদন, গীতা, নাজিম, সুজয়... এরা যেন ওরই ক্লাসে পড়ে, ওরই অভিন্নহৃদয় বন্ধু...

তাই যেচেই দায়িত্বটা নিয়েছিল ও। আর সবাই যখন সময়-সুযোগের অভাব-টভাব নিয়ে সাতপাঁচ ভাবছে, নিজেই বলেছিল, “আহা!কি দরকার ঝামেলা বাড়িয়ে? আমিই যাবো সাথে...!”

মনে মনে হেসেছিল তখন। দিদুন টুপুরকে “সতীন” বলতো আদিখ্যেতা করে... দিদুন নেই, দায়িত্বটা ওরই ওপর বর্তায় বইকি!!

সেই ঘরে ফেরা। তার কত আয়োজন! রীতিমত পাগল হয়ে উঠেছিল দাদুমনি। কত কিছু গোছগাছ, কেনাকাটা... আজ রোববার... আজ বড় দেখে একটা ব্যাগ কিনে দেবে বলেছিল টুপুর... আর আজ...
-“মামনি!”

চমকে উঠল টুপুর! মা কখন কে জানে পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে।

-“ চল, আজ বাড়ি ফিরে চল তুই! টানা তিনদিন হল। মিতুল বলছে, ও না'হয় থেকে যাবে আজ রাতটা...!”

-“কি দরকার মা? আমিই থাকছি— মিতুল'দার আর কষ্ট করার দরকার নেই... বাড়ি গিয়ে আমার লাভ কিছুই হবে না”, কবজি উলটে ঘড়িটা দেখল টুপুর, “সাড়ে সাতটা বাজল। তোমরা বরং বেরিয়ে পড়ো!”

[চলবে]

আবার যদি ইচ্ছে কর...

By : Sayantari Ghosh
morning-jnu-light-way-road.jpeg

এক
অনেকদিন বাদে ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে ফিরলাম। জীবনের হিসেবে ফেললে ‘অনেক’ শব্দ’টা ভুল হয়ে যাবে অবশ্যই... তবে দূরত্ব আর গুরুত্বের হিসেবে কিন্তু একশ’ভাগ ঠিক! সেই যে অঝোর বৃষ্টি’তে চোখভর্তি ছেলেমানুষী জল নিয়ে শহর ছেড়েছিলাম... সে পাক্কা আড়াই বছর হল!
এবারেও ট্রেন থেকে নেমেছি ঝমঝমে বৃষ্টি’তে। ভাবা যায়? এই ফেব্রুয়ারির শেষে... ওই শুকনো দেশে...!? আসলে এ শহর জানে আমি বৃষ্টি ভালোবাসি। কারণে অকারণে সেই দু’বছরে কত যে বৃষ্টি নামিয়েছে আমায় অবাক করে দিয়ে, সে হিসেব ডায়েরিতে রাখতাম তখন... প্রতিবার নিখুঁত টাইমিং, নির্ভুল নিশানা!
হাঁটতে ইচ্ছে করছে... নর্থ গেটের সামনেটাতেই ছ’শো পনেরো থেকে নেমে পড়লাম... এখানে এখন আগের চেয়েও অনেক বেশি গাছ... একেবারে সবুজে সবুজ... দিন’টা মঙ্গলবার, উইক’ডে... সব্বাই ক্লাসে, বা হস্টেলে এই অসময় বৃষ্টি’তে নির্ঘাত... রিংরোড প্রায় শুনশান...
গঙ্গা হস্টেলের সামনের বাস স্টপ’টা পেরোলো... সেই ধূ ধূ গরম’টা ছুঁয়ে গেল যেন হলকা দিয়ে... মনে পড়ে গেল বাহান্ন না তিপ্পান্ন’র তর্ক আর মনে এল অজ্ঞান হয়ে গেলে মানুষের শরীর’টা ঠিক কত’টা ভারি হয়ে যায়...
নর্মদার সামনের সেই পাথর’টার ফাঁকে উঁকি দিলাম পেরোতে পেরোতে... ‘ইয়ং গান্‌স্‌ অফ ইন্ডিয়া’ জ্বলজ্বল করে উঠল আমাকে চমকে দিয়ে... আধ সেকেন্ড বাদে টের পেলাম হেসে ফেলেছি অজান্তেই...
নর্মদা আর সাবরমতির মাঝের শুঁড়িপথ ধরলাম... এই আলো’টা বুঝি এখনও রাতে দপদপ করে? কাবেরির দিকে যাওয়ার চোরারাস্তা’টার সামনে কারা যেন পাঁচিল তুলে দিয়েছে... এখানে সেই ঝামরঝুলোর মত নিচু হয়ে ঝুঁকে আসা জঙলা লতাগুলো আরো গাঢ় করে দিয়েছে অন্ধকার... হঠাত্‌ হাতের খুব কাছে মনে হল আর কারো হাত... ছিটকে সরে এলাম... গলার কাছে ভয় না কান্না কি যেন একটা ধাক্কা দিচ্ছে ক্রমাগত...
তাপ্তীর সামনের ওপেন এয়ার ক্যান্টিন’টা দ্যাখা যাচ্ছে। সবক’টা চেয়ার নিশ্চয়ই ভিজে সপসপে, ভাবতে ভাবতে যেই না ঢোকা, দুটি খুব পরিচিত কন্ঠ সমস্বরে ঘোষণা করল, “লেট! অ্যাস ইউসুয়াল...!” ইউসুয়াল’ই বটে। আড্ডায়, ওয়ার্কশপে, ক্লাসে বা অ্যাসাইনমেন্ট করার তলবে দেরি করে পৌঁছানোর কত বিশ্বরেকর্ড আমি করেছি, সে খবর ওরা ছাড়া আর কে’ই বা রাখে...?
হেম আর পারো!
পরের পঁচিশ’টা মিনিট পাগলামি’তে ভেসে গেল একেবারে। যা বলছিলাম তার মধ্যে আদৌ কোন বক্তব্য ছিল না। ছিল খালি নিখাদ উচ্ছ্বাস... এতদিন বাদে এত কাছ থেকে এই চেনা মুখগুলো চোখের সামনে দ্যাখার উন্মাদ উচ্ছ্বাস! ছবি নয়, ওয়েবক্যাম নয়... একেবারে লাইভ আর এক্সক্লুসিভ!!
রাজুদা’র বহুচর্চিত ম্যাগি (বহু-আস্বাদিত’ও বটে) অর্ডার দেওয়া হল, যা কিনা জমাটি আড্ডার শাশ্বত সঙ্গী!
“মিসিং রুদ্র, না?” পারো বলল, “চারজনের গ্রুপ’টা ইস সামহাউ ইনকমপ্লিট উইদাউট দ্য ওনলি গাই...”
“ওকে ছাড়... ও চিরকালের ব্যস্ত মানুষ”, আমি বললাম।
“শোন শোন, তুই বল আগে...”, পারোর দিকে মিটমিটিয়ে তাকিয়ে হেম বলল, “দুম করে এমন সাঙ্ঘাতিক কাজ’টা এক্সিকিউট করে ফেলার ডিসিশন নিয়েই ফেললি তাহলে? বিয়ে, হ্যাঁ? কান্ড করলি বটে মিস্‌...”
“দুম করে?!”, রে রে করে উঠল পারো, “কাম অন মিস হেমাক্সি আইয়ার... যে গল্প’টা গত পাঁচ বছর ধরে দিল্লি, হরিয়ানা, অসম আর বেঙ্গল চারটে স্টেট জুড়ে ছুটে বেড়াচ্ছে, যে’টা সল্‌ভ্‌ করতে গিয়ে আই ইউস্‌ড্‌ দ্য লাস্ট ড্রপ অফ মাই ইন্টেলিজেন্স আর টলারেন্স, সেটা ‘দুম করে’?! ইট অলমোস্ট রিচ্‌ড্‌ মাই ইলাস্টিক লিমিট ইয়ার... অন্য কেউ না লিখে থাকলে আমি পাক্কা একটা বই লিখে ফেলতাম...”
আমি আর হেম হো হো করে হাসছিলাম ওর ছটফটানি দেখে।
“আচ্ছা, তোর ব্যাপার’টা কি বলত হেম?”, পারো রেগে গিয়ে কথা ঘোরাতে চাইল, “হোয়াট হ্যাপেন্ড উইথ ইয়োর ‘পোস্টম্যান’ গাই? জিগেস করলে বলিসও না ঠিক করে ফোনে... হোয়াট ইস দ্য প্রবলেম আকচুয়ালি, হাঁ? কি হয়েছে... এই রিনি, চেপে ধর তো ওকে...”
“কি হবে? নাথিং! উই আর ফ্রেন্ডস্‌...”, ব্যস্ত হয়ে উত্তর দিল হেম।
“স্টিল...” দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমি বললাম, “ওই শব্দটা’ও বল্‌ সাথে করে... নইলে হয়?”
(ক্রমশঃ)

- Copyright © পাঁচমিশেলি - - Powered by Blogger - Designed by সায়ংতরী -