Popular Post

Archive for June 2013

দ্য আনসিঙ্কেবল / দুই

By : Sayantari Ghosh


টাইটানিকের গল্পটা তো সক্কলের জানা। অনেকে হয়ত এটাও জানেন যে টাইটানিক'রা আসলে তিন বোন। অলিম্পিক,টাইটানিক আর ব্রিটানিক ছিল হোয়াইট ষ্টার লাইনের গর্বের তিন কন্যা;সিস্টার শিপ'স। সে সময়কার প্রযুক্তি, বিজ্ঞান আর শিল্পের সেরাটুকু দিয়ে জাহাজ তিনটিকে বানিয়েছিল হোয়াইট ষ্টার লাইন। ঘটনাচক্রে এমনি দাঁড়ায় যে দূর্ঘটনা প্রথম থেকে শেষ অব্দি পিছু ছাড়েনি এই তিন বোনের।

১৯১১'র জুন মাসে প্রথম জলে নামে অলিম্পিক। ৮০০ ফিটের চেয়েও বেশি দৈর্ঘ্যের প্রথম জাহাজ।সে বছরের'ই সেপ্টেম্বর মাসে সাউদাম্পটনে ধাক্কা খায় এইচ.এম.এস. হক জাহাজের সাথে। সাঙ্ঘাতিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দুটি জাহাজই,তবে প্রাণে বেঁচে যান দুই জাহাজের সকল যাত্রীই;খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ক্ষতবিক্ষত দেহে বন্দরে নোঙর করে বিশালবপু অলিম্পিক।

পাক্কা দু'মাস লেগেছিল অলিম্পিকের সেরে উঠে আবার জলে নামতে। সেই ধাক্কা সামলে নিতে টাইটানিকের প্রথম যাত্রা এক মাস পিছিয়ে দেয় হোয়াইট ষ্টার লাইন। মার্চ ২০'র বদলে টাইটানিক সাউদাম্পটন বন্দর ছাড়লো এপ্রিল ১০,১৯১২;কে বলতে পারে, এক মাস আগে হলে হয়তঃ নিউ ইয়র্কে নোঙর'ও করত টাইটানিক? পাঁচ দিন পর এপ্রিল ১৫'তে আইসবার্গের ধাক্কায় ১৫০০ টি প্রাণ সঙ্গে করে আতলান্তিকের তলিয়ে যায় টাইটানিক।

আসলে ব্রিটানিকের নাম হওয়ার কথা ছিল জাইগান্টিক। আকারে,আয়তনে সে ছিল বড় দুই বোনের বাড়া।কিন্তু টাইটানিকের মর্মান্তিক দূর্ঘটনায় হোয়াইট ষ্টার লাইন আর ওই দূর্ধর্ষ নামের দুঃসাহস দ্যাখাতে পারেনি। এম্নিতেও ততদিনে আকাশে উঁকি দিয়েছে বিশ্বযুদ্ধের মেঘ,অনেক স্লথ হয়ে গেছে জাইগান্টিকের জলে নামার প্রস্তুতি। সেপ্টেম্বর ১৯১৪'র বদলে ডিসেম্বর ১৯১৫ তে প্রথম যাত্রায় পাড়ি দিল সে,ততদিনে ব্রিটিশ জলবাহিনী অধিগ্রহন করে নিয়েছে তাকে,তার কাজ হয়েছে জলযুদ্ধে আহত সৈনিকদের সেবা,নাম বদলে হয়ে গেছে এইচ.এম.এইচ.এস. ব্রিটানিক, হিস ম্যাজেস্টিস হস্পিটাল শিপ 

প্রায় ১৫০০০ আহত যোদ্ধা'কে ঘরে পৌঁছেছিল ব্রিটানিক মাত্র পাঁচটি সমুদ্রযাত্রায়। ষষ্ঠ বার আর ঘরে ফেরে নি সে। নভেম্বর ২১,১৯১৬'র সকালে একটি মাইন'এর সাথে হঠাৎ ধাক্কা খেয়ে মাত্র ৫৫ মিনিটের মধ্যে তলিয়ে যায় বিশাল ব্রিটানিক। সেদিন আরোহীদের মধ্যে কোন আহত বা অসুস্থ কেউ ছিলেন না। ১১০০ জনের ভেতর ৩০ জন প্রাণ হারান, আর সঙ্গে হারিয়ে যায় অলিম্পিক-পরিবারের শেষ সদস্য'টি।

এই গল্পের সাথে একজনের কথা না বললে অনুচিত কাজ করা হয়। ভায়োলেট জেসপ। ইনি হোয়াইট ষ্টার লাইনে কর্মরতা ছিলেন জাহাজের পরিচারিকা হিসেবে। কাকতালীয় হলেও সত্যি কথা যে অলিম্পিক, টাইটানিক আর ব্রিটানিকের দূর্ভাগ্যের দিনগুলিতে জেসপ জাহাজে ছিলেন। আজ্ঞে হ্যাঁ, তিনটি দূর্ঘটনার'ই তিনি প্রত্যক্ষ সাক্ষী! এবং প্রতিবার'ই চূড়ান্ত ক্ষয়ক্ষতি,অব্যবস্থা আর প্রাণহানির মধ্যেও তিনি দিব্বি বেঁচে ঘরে ফিরে আসেন! হয়তঃ সমুদ্রের লোনা জলে ফুসফুস ভরে ফেলে পৃথিবী ছেড়ে যাওয়া কপালে ছিল না জেসপের,দীর্ঘ সুস্থ জীবন লেখা হয়েছিল বিধাতার দপ্তরে তার জন্যে। কথায় বলে না, রাখে হরি মারে কে?

হরির রক্ষা করার প্রসঙ্গ উঠলো যখন,তখন আরেকটা অদ্ভূত গল্প বলে আজকের মত শেষ করি।

ওয়েলসের কাছে প্রায় ২৫ কিলোমিটার লম্বা একটি জোয়ার জলের নদীখাতের স্থানীয় নাম দ্য মেনাই স্ট্রেইট।ডিসেম্বর ৫, ১৬৬৪, মেনাই স্ট্রেইটে একটি জাহাজডুবি হয়। মারা যান একজন আরোহী বাদে বাকি ৮১ জন মানুষ। আবার একই তারিখ। ডিসেম্বর ৫, সাল ১৭৮৫; মেনাই স্ট্রেইটে ডুবে যায় আরো একটি যাত্রীবাহী জাহাজ।ষাটজন মারা যান, জীবিত উদ্ধার করা যায় আবারও মাত্র একজন'কে। ডিসেম্বর ৫, ১৮২০, একই জায়গায় আরো একটি জাহাজ দূর্ঘটনা। মৃতের সংখ্যা এবার ২৫, অদ্ভূত ভাবে এবারেও প্রাণে বেঁচে যান একজন মাত্র যাত্রী।

স্থান আর কালের তথ্যটুকু তো দিলাম,পাত্র বিষয়ক সেরা তথ্য'টা এবার বলি।

যারা বেঁচে যান,ঘটনাচক্রে তাঁদের প্রত্যেকের নাম ছিল হিউ উইলিয়মস!

অবাক কান্ড না? টাইটানিক'কে আনসিঙ্কেবল বলে দাবী করেছিল হোয়াইট ষ্টার লাইন; এই গল্প তবে কি দাবী করবে? হিউ উইলিয়মস... দ্য আনসিঙ্কেবল...?


ভোর-রাত্রের স্বপ্ন

By : Sayantari Ghosh

ট্রেনের দরজার কাছে জমে থাকা ভিড়ের ফাঁক গলে কোনোক্রমে স্টেশনটায় নেমে পড়লো অর্ক; আর ট্রেনটাও ছেড়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে। অর্ক হাঁফাচ্ছিলো। হাত দশেক দূরে প্ল্যাটফর্ম ধরে সোজা হেঁটে চলে যাচ্ছে ঊর্মি। ও কি পাগল হয়ে গেছে? কি চাইছে ও? এখানে নেমে পড়লো কেন হঠাৎ? অর্ক ছুটতে শুরু করলো ঊর্মির পিছনে।

-“ঊর্মি-ই-ই... পাগল হলি কি? দাঁড়া...!”

ঘুরে দাঁড়ালো ঊর্মি। চোখদু’টো জ্বলছে যেন ওর, “তুই নেমেছিস কেন??” আঙুল তুলে জোর গলায় বললো ও, “তোকে কে আসতে বলেছে আমার পিছু পিছু? ক্যাচ আ ট্রেন আর গেট লস্ট...”

অর্ক ততক্ষণে পৌঁছে গেছে ঊর্মির কাছে, ওর হাত’টা ধরার চেষ্টা করে অর্ক বলতে গেল, “কি হয়েছে সোনা? কেন রাগ...”

 -“ডোন্ট ইউ ডেয়ার টু টাচ মি...!” গর্জে উঠলো ঊর্মি, হাত ছাড়িয়ে একটা ধাক্কা দিল অর্ক’কে, “বলছি না আমার তোকে দরকার নেই... কোনো সম্পর্ক নেই আর আমার তোর সাথে...”
-“ও’সব তোর রাগের কথা,” নরম গলায় অর্ক বলল, “এর আগেও এক’শ বার বলেছিস... কি হয়েছে রে? বল আমাকে... আমিই কিছু গোলমাল করেছি নির্ঘাত...” হাসার চেষ্টা করলো অর্ক।

-“শোন, বেকার এ’সব ঝুটামুটা এ্যাক্টিং বাদ দে তো”, ঊর্মি আরও গলা চড়ালো, “আমি তোকে নিয়ে বিরক্ত... ক্লান্ত... এমব্যারাস্‌ড্‌... আমি জানি না কেন, কি ভেবে, কি থেকে আমার মনে হয়েছিল যে তোর মত একটা মোস্ট অর্ডিনারি ক্যাবলা ছেলে আমার লাইফ পার্টনার হতে পারে... আয়াম সরি... মাই ফল্ট... এবার আমায় ছাড়ন দে,” শব্দ করে হাত জোড় করলো ঊর্মি, “গুড বাই...” বলে পিছন ফিরে জোরকদমে হাঁটা লাগালো সে।

-“আরেহ্‌...!!” অর্কও পা চালালো তাল মিলিয়ে। ঊর্মি কিছু একটা ব্যাপার নিয়ে সাংঘাতিক রেগে গেছে কে জানে কেন... ওর এইসব অদ্ভূত রাগের কোনো ব্যাখ্যা অর্ক খুঁজে পায় না কখনও… অভ্যস্ত হয়ে পড়তে পড়তে এখন আর খোঁজ করাটাও ছেড়ে দিয়েছে ও... রাগ হয়েছে, এটাই গুরুত্বপূর্ণ; ক্ষমা চাইতে হবে, এটাই জরুরী... কার্যকারণ ব্যাখ্যা খুঁজতে যাওয়া অর্থহীন। তাতে শক্তিক্ষয়। তাতে সময় নষ্ট।

হাঁটতে হাঁটতে ততক্ষণে ছোট্ট স্টেশনের ঘাসে-ঢাকা নামমাত্র প্ল্যাটফর্ম’টা থেকে বেরিয়ে এসেছে ততক্ষণে ওরা। কি আশ্চর্য পাগলামি করে মাঝপথে ট্রেন থেকে নেমে পড়লো আজ ঊর্মি...! হয়েছে রাগ, হয়েছে কথা কাটাকাটি, হয়তঃ দুটো কড়া কথাও বলে ফেলেছে অর্ক রাগের মাথায়, কিন্তু তা বলে কথা নেই, বার্তা নেই অজানা অচেনা স্টেশনে ট্রেন থেকে নেমে পড়বে? আশ্চর্য্য তো! কিন্তু এসব নিয়ে তর্ক করতে যাওয়াটা নিতান্ত বোকামী, তা জানে অর্ক খুব ভালো করে। ঘাড় ঘুরিয়ে স্টেশনের হলুদ-কালো বোর্ড’টার দিকে তাকিয়ে জায়গাটার নাম দেখে নিল সে একবার... ‘তালজোড়া’ লেখা আছে ইংরেজি, বাংলায়। যত গ্রাম্য নাম, তত অপ্রস্তুত দশা, মনে মনে এইরকম একটা হিসেব করেই যেন দীর্ঘশ্বাস পড়ল অর্ক’র...

-“ঊর্মি-ই-ই... লক্ষ্মী’টি... দাঁড়া, একটিবার...” আবার হাঁক দিল অর্ক।

ঊর্মি কিন্তু এবার তাকালোও না পিছন ফিরে। বাঁদিকের লাল রাস্তা’টা ধরে হাঁটতে লাগলো সোজা।  ঊর্মির বরাবরই অর্ক’র এইসব ন্যাকামোগুলো ভীষণ বোরিং লাগে। আজ মাথা গরমের চূড়ান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

স্টেশনের বাইরে নামমাত্র ক’টা দোকান... বিড়ি, সিগারেট, পানমশলা... চারটে আধবুড়ো লোক মেঠো কায়দায় হাঁটুর ওপর ধুতি গুটিয়ে বসে... তারা দাঁত বের করে হাসছে অর্ক’র দিকে তাকিয়ে... ‘শহুরে প্রেমের এমন নজারা টিভি সিনেমার বাইরে দ্যাখা তো এদের জোটে না, এনজয় করছে ব্যাটারা’... ভাবতে ভাবতে বাঁদিকের রাস্তাটা ধরলো অর্ক...

ঊর্মি অনেকটা এগিয়ে গেছিল। রাস্তা থেকে ধানক্ষেতের আলে নেমে পড়লো সে। ধানক্ষেত বলা’টা অবশ্য উচিত নয়... শীতকাল, মাঠ একেবারে ফাঁকা... যতদূর চোখ যায়, মনে হয় যেন একরাশ শূণ্যতার মধ্যে আল বরাবর সোজা সোজা দাগ টেনে কি একটা কঠিন জ্যামিতির আঁক কষা হয়েছে। ডানদিক-বাঁদিকে, সামনে-পিছনে, কোথাও কোনো তফাত নেই... কোনো এক সোনালি স্মৃতির দগদগে ধ্বংসস্তূপের মত অসমতল মাঠ জুড়ে ধানের গোড়াগুলো পড়ে আছে... শূণ্যতাই এখানে সব... মাথার ভেতরের ভারী ভাব’টা কেটে যাচ্ছিল যেন... কেমন উদাসীন হয়ে যেতে ইচ্ছে করছিল ঊর্মির...

-“ঊর্মি-ই-ই...!” অর্ক ডাকছে।

পিছন ফিরে চিৎকার করে উঠলো ঊর্মি, “কেন আসছিস এখনো? আমি বললাম তো আমি কোনো কথা বলতে চাই না...! আমার আর সহ্য হচ্ছে না তোকে...! আমায় একা থাকতে দে না একটু...! আমি একাই ভালো আছি... লিভ মি আলোন, প্লিজ...!”

অর্ক এগিয়ে আসতে গিয়েও থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো খানিক দূরে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল, তারপর থেমে থেমে বলল, “বেশ, একাই থাকিস... বাড়ি ফিরে যাই, তারপরে একা থাকিস? কেমন? জায়গাটা অচেনা, কোথায় কি বিপদ হয়, চল... প্লিজ...”

একটা আকুতির মত শোনালো অর্ক’র গলা’টা। আর শোনা মাত্রই একটা ছটফটে বিতৃষ্ণায় ভেতর’টা চিড়বিড়িয়ে উঠলো ঊর্মির। এই এক ভয়-পাওয়া কন্ঠস্বর, এই এক কাঁদো-কাঁদো চাইল্ডিশ ভাব... আগে মিষ্টি লাগতো ঊর্মির, এখন অসহ্য লাগে! কে বাধ্য করেছে ঊর্মি’কে এই ছেলেটাকে যাবতীয় অস্বস্তি সত্ত্বেও সহ্য করতে? কেউ না! তাহলে? ভাবামাত্র ইচ্ছে করলো অর্ক’কে সরিয়ে দিতে... নিজের সামনে থেকে, নিজের জীবন থেকে... ইচ্ছে করলো এমন ভাবে আঘাত করতে যাতে আর ও মুখ তুলে না চাইতে পারে... ইচ্ছে করলো এমন একটা ব্যবস্থা করতে যাতে “ঊর্মি” বলে যেন কক্ষনো ওকে পিছু না ডাকতে পারে অর্ক।

শান্ত ভাবে শব্দগুলোয় শান দিল ঊর্মি, “তুই থাকলেই আমার বিপদ, অর্ক... তুই আমার জীবন থেকে ভালো-থাকাটুকুকেই মুছে দিয়েছিস যেন... যেদিকে তাকাই খালি ফ্রাস্ট্রেশন, ভয়, প্যানিক... যেন জীবনটাই ফুরিয়ে গেছে আমার... তুই না থাকলে আমি খুশি... আমি নিশ্চিন্ত... আর আমার মনে হবে আমি বেঁচে আছি অন্ততঃ। সো স্টপ ফলোইং মি, ওকে? আমার ব্যাপার, আমি বুঝে নেবো... তোর ভাবার দরকার নেই... ইউ আর আ নো’বডি ফর মি...”

অর্ক স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল; মাঘ মাসের পড়ন্ত বিকেল... খুব ঠান্ডা একটা হাওয়া বইতে শুরু করেছে মাঠটায়... কয়েকটা মূহুর্ত কেটে গেল শীতল নিস্তব্ধতায়। অর্ক শেষ শক্তিটুকু একজোট করে বলল তারপর, “যাবি না... বাড়ি...?”

 -“তোর ভাবার দরকার নেই”, প্রতিটি শব্দে আলাদা করে জোর দিল ঊর্মি।
অর্ক আর দাঁড়ালো না। পিছন ফিরে হাঁটা লাগালো। ঊর্মি তাকিয়ে রইল। ওকে চলে যেতে দেখে ভালো লাগছিল। আর ওই ক্যাবলা, ভীতু, সাধারণস্য সাধারণ ছেলেটাকে বয়ে বেড়াতে হবে না ওকে। যার সাথে জীবনের প্রতিটি বিশেষ মূহুর্ত সাধারণ হয়ে যায়। যার সাথে প্রতিটি এ্যাডভেঞ্চার তেতো হয়ে যায় বিরক্তি আর লজ্জায়। ঊর্মি এখন স্বাধীন! বুক ভরে একবার শ্বাস নিল ঊর্মি। তারপর ব্যাগ থেকে ক্যামেরাটা বের করলো। একটু রিল্যাক্স করা দরকার। জায়গাটা অসাধারণ ফোটোজেনিক। কতগুলো দুরন্ত ছবি তোলা যাবে সূর্যাস্তের এফেক্ট’টাকে সাথে রেখে... ম্যাজিক লাইটে রঙিন হয়ে থাকা আজকের স্বাধীনতার দিন... পায়ে পায়ে এগোতে লাগলো ঊর্মি...

একটা ঝুড়িওয়ালা ঝুপসি বটগাছ... ক্লিক্‌...! ছবি উঠলো...!

আরেকটু এগিয়ে একটা আধপোড়ো মন্দির... ক্লিক্‌...! ক্লিক্‌...! আরো ছবি উঠলো...

এভাবে কতক্ষণ পেরোলো কে জানে! ঊর্মির খেয়াল হল তখন, যখন আলো কমে গেছে বলে আর ছবি উঠছে না ভালো... খেয়াল হল এমন করে যেন হঠাৎ নেশা কেটে গেছে এক ঝলক জলের ঝাপটায়... খেয়াল হল, ফিরতে হবে...

ফেরার পথ ধরলো ঊর্মি। কিন্তু খানিক বাদেই মনে হল, এ যেন ঠিক পথ নয়... কই, এ জায়গাটা তো পেরিয়ে আসে নি ও... আলরাস্তার প্রতিটি চৌমাথায় মনে হতে লাগলো কম্পাস যেন ঘুরছে বনবন করে... ডানদিক-বাঁদিকে, সামনে-পিছনে, কোথাও কোনো তফাত নেই... মনে হতে লাগলো এ সব ব্ল্যাক ম্যাজিক... গোটা পৃথিবীটাই যেন জ্যামিতির ছবি হয়ে গেছে... ক্ষতবিক্ষত, ক্ষুধার্ত, অসংখ্য নানামাপের চতুর্ভূজ ছাড়া আর সব মিথ্যে... সব মিথ্যে...

সন্ধ্যা গাঢ় হল... শীতের উত্তুরে হাওয়া নিষ্ঠুর হয়ে উঠতে লাগলো প্রতি মূহুর্তে... পুরোনো মন্দিরটা দু’বার পেরোলো, কিন্তু বটগাছ’টা কে জানে কেন কিছুতেই পাচ্ছে না খুঁজে... ব্যাগের ভেতর জল খুঁজলো ঊর্মি... গলা শুকিয়ে আসছে বারবার... মাথা ঘুরছে না কি? কেমন যেন মনে হচ্ছে, যেন একটা প্রতিধ্বনি দৌড়ে বেড়াচ্ছে আদিগন্ত শূণ্যতা জুড়ে, “আমি একাই ভালো আছি... লিভ মি আলোন, প্লিজ...!”

দম আটকে আসতে লাগলো। চিৎকার করতে গিয়ে একটা অদ্ভূত, বিকৃত স্বর বের হল গলা থেকে... তখনই, হঠাৎ, বিদ্যুৎচমকের মত মনে পড়লো মোবাইল’টার কথা! একটা ফোন, ব্যাস, তাহলেই তো আর কোনো চিন্তা করতে হবে না। কেউ না কেউ এসে পৌঁছাবেই ওকে নিতে!

কোনোক্রমে ব্যাগ হাতড়ে মোবাইল’টা বের করল ঊর্মি... আর বুকের ভেতর’টা যেন ফাঁকা হয়ে গেল তক্ষুনি... নেটওয়ার্কের ঘরে জ্বলজ্বল করছে শূণ্য... ঊর্মি ধপ করে বসে পড়লো মাটিতে... ...

আচ্ছা, অর্ক কি চলে গেছে? না কি... না কি স্টেশনে বসে এখনও অপেক্ষা করছে ওর জন্য? আধোঅন্ধকারে মরীচিকার মত একটা ছবি যেন দেখতে পেল ঊর্মি... যেন অর্ক একা বসে আছে ফাঁকা স্টেশনের একটা বেঞ্চে... বারবার ঘড়ি দেখছে... ঘুরে ঘুরে চাইছে লাল মাটির রাস্তাটার দিকে... ভাবছে, ‘কি করছে ঊর্মি’টা? এখনও ফিরল না?’

অন্ধকার হয়ে গেছে... এইবার কি ওকে খুঁজতে আসবে না অর্ক একবার?

অর্ক...? চলে গেছিস রে…?

- Copyright © পাঁচমিশেলি - - Powered by Blogger - Designed by সায়ংতরী -