Popular Post

Posted by : Sayantari Ghosh Tuesday, February 09, 2016

কলেজের পর সেই যে শহর ছেড়েছি, তারপর আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব মিলিয়ে অন্ততঃ খান তিরিশেক বিয়েবাড়ি মিস্‌ করেছি। তারজন্য অন্তরটিপুনিও খেয়েছি ঢের! খারাপও লেগেছে অনেকবার, ইচ্ছে থাকলেও আসতে পারিনি অনেকের বিয়েতে নানা কারণে। কিন্তু, চূর্ণির বিয়েতে কে জানে কি করে ছুটি’টা ম্যানেজ হয়ে গেল।
চূর্ণি আমার আজন্মকালের ক্লাসমেট। আমাদের ঠিক প্রিয়তম বান্ধবী বলা যায় না, তবে বয়সের হিসেবে আমাদের বন্ধুত্ব প্রায় আমাদেরই সমবয়সী। আমি চিরকালীন বইমুখো, মুখচোরা আর চূর্ণি দূর্ধর্ষ ডাকাবুকো, সুন্দরীও বটে। আর বিজ্ঞানে তো বলেই যে ‘বিপরীতে বন্ধুত্ব অবশ্যম্ভাবী...!’ আসলে সত্যি বলতে আমি ছিলাম চূর্ণির গুণপণায় মুগ্ধ। ওর বিশেষত্ব ছিল সব্বার থেকে আলাদা হয়ে থাকায়, মানে যাকে বলে অন্যরকম... ‘হট্‌কে!’
তখন আমরা স্কুলে। যে বয়েস’টা থেকে ছেলেদের সাইকেলগুলো ভিড় জমাতে শুরু করে গার্লস স্কুলের বাসস্টপে, সেই তেরো-চোদ্দ’র কাছাকাছি। ওইসময়টায় মেয়েদের আড্ডাতেও কিন্তু চুপিসারে ঢুকে পড়ে কিছু আপাত-সেন্সর্‌ড্‌ প্রশ্ন... “কেমন ছেলে ভালো লাগে?” “কেমন বর চাই?” “ফর্সা?” “টল, ডার্ক, হ্যান্ডসাম?”
পঁচিশ-ছাব্বিশ আসতে আসতে এইসব প্রশ্নের উত্তরে পালিশ পড়ে যায় প্রচুর, চোদ্দ’র সেই আনকোরা, ছিমছাম, টাটকা ভাব’টা থাকে না তখন আর। বছর এগারো বারো পেরিয়েও কারো উত্তর একতারার মত একসুরে বাজে চিরকাল, কারো উত্তর মাঝপথে আঘাত খেয়ে বিপ্রতীপ হয়ে দাঁড়ায় হঠাত্‌ কখনো, কারো উত্তরে আবার বয়েসের ছাপ পড়ে; ছেলেমানুষী কাটিয়ে ‘ম্যাচিউওর্‌ড্‌’ হয় সেগুলো। খুব হাতেগোনা কেউ কেউ এরকমও থাকে যাদের উত্তর’টা প্রথমদিন থেকেই পাকাপোক্ত, তাদের ম্যাচিউরিটির আর কিছু বাকি নেই! চূর্ণি ছিল এরকম একজন। প্রেমবিষয়ে তার এ’সব চোস্ত উত্তরের সৃষ্টিরহস্য কোনোকালেই আবিষ্কার করে উঠতে পারিনি বলেই বোধহয় ওর প্রতি মুগ্ধতা’টাও কাটিয়ে উঠতে পারিনি কখনও। স্কুল কিম্বা কলেজ, চিরকাল ওর “কেমন বর চাই” এর উত্তর ছিল ঝরঝরে, চাঁচাছোলা আর সাঙ্ঘাতিক ‘ম্যাচিউওর্‌ড্‌’, “ওসব লম্বা, ফর্সা, কোঁকড়ানো চুল নিয়ে কি চলবে সারাজীবন? চিরদিন থাকবে নাকি ওসব? আমি তো বলবো আমার বর কালো হোক, ভূঁড়িওয়ালা হোক, একমাথা টাক হোক... এমন হোক যাতে তোদের কারোর পছন্দ না হয়... কিছু পেটে কিছু বিদ্যে থাক, বুদ্ধি থাক কিছু ঘটে, একটা ঠিকঠাক চাকরি আর একটা ভালো মন... ব্যাস, আর কিচ্ছু চাই না!” ক্লাস এইটে ওর এইসব ধারালো জবাব শুনে শুধু আমি নই (আমি তো না হয় ক্লাসের চিরকালীন শ্রীমতি হাঁদাগঙ্গারাম) অনেক চোখা-বাক্যবাগীশও বেশ খানিকটা থমকে যেত বই কি!
সেভেন-এইটে ‘বর’ সংক্রান্ত আলোচনার বসবাস ছিল কানাঘুষোয় আর ফিস্‌ফিসানিতে; বছর তিনেক পেরোতে না পেরোতেই সে সব আড্ডা ‘রে রে’ করে ফ্রন্ট পেজে এসে পড়লো। টিউশনের খাতা দেওয়া-নেওয়ার গল্পগুলোই তখন হল মুখ্য সমাচার! অনেকেই সগৌরবে প্রেমে পড়ার খবর দিল, দু’একজন মনের আনন্দে চকোলেটও খাওয়ালো! আর আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম যে কোচিং সেন্টারের মোস্ট এলিজিবল ব্যাচেলার, যাকে দেখে ক্লাসের অনেকেই “কী ভীষওওওণ কিউউউট...!!” বলতে গিয়ে দম আটকে ফেলত, কে জানে কি করে, চূর্ণির সাইকেল জুড়ি বেঁধেছে সেই শাহনওয়াজ হুসেনের সাইকেলের সাথে। এক্কেরে অবাক হয়ে গেছিলাম। ভেবেছিলাম, শাহনওয়াজের বিদ্যেবুদ্ধির বহর, কই, নজরে তো পড়ে নি আমার সে ভাবে... ইলেভেনে একবার ফেল করে আমাদের সাথে পড়েছে যদ্দূর জানি... হ্যাঁ, সে লম্বা বটে, ফর্সাও বটে, খানিকটা ‘কিউট্‌’ও হয়তো... কিন্তু... চূর্ণির পছন্দ তো অন্যরকম!
একদিন আর থাকতে না পেরে প্রশ্নটা করেই ফেলেছিলাম চূর্ণি’কে। শুনে সে কাঁদো কাঁদো গলায় বলেছিল, “আর বলিস না, ভালোবাসি না বলতেই ব্লেড দিয়ে হাতের পাতায় কেটে কেটে আমার নাম লিখেছে...”
-“অ্যাঁ...! সে কি রে?” আমি বরাবরই ভীতু, দৃশ্য’টা কল্পনা করেই আঁতকে উঠেছিলাম!
-“তাহলে আর বলছি কি? ‘হ্যাঁ’ বলতেই হয়েছে বাধ্য হয়ে, বিশ্বাস কর...”
ওকে বিশ্বাস করি, তাই বিশ্বাস করেছিলাম।
বছর দুয়েকের মধ্যে স্কুলের ব্যাকড্রপ বদলে হল কলেজ। প্রেমের ছবিও বদলালো আরো। আমি যথারীতি দর্শকের ভূমিকায়। প্র্যাক্টিকালের রীডিং আর ক্লাসনোটের খাতা থেকে মুখ তোলার সুযোগ হলেই চলমান লাভস্টোরি’গুলোর খবর নিই। ব্যাপারটা অনেকটা মেগাসিরিয়াল দ্যাখার মত। সাধারণতঃ দিন সাতেকের এপিসোড মিস করে গেলেও বুঝতে খুব একটা সমস্যা হয় না।
চূর্ণি-শাহনওয়াজের কাহিনী খুব ‘প্রেডিক্টেবল টার্নিং’ নিল যখন চূর্ণি ফিলোসফি অনার্স নিয়ে আমার সাথেই কলেজে ঢুকলো আর শাহনওয়াজ দ্বিতীয়বার উচ্চমাধ্যমিক দেওয়ার তোড়জোড় শুরু করলো। আমি মনে মনে ভাবলাম, ‘এ তো হওয়ারই ছিল... চূর্ণির তো পছন্দ’টাই অন্যরকম!’
সুতরাং এমনটা যে হবে আমি খানিকটা আশা’ই করেছিলাম। তবে যেটা মোটেই আশা করিনি সেটা হল চূর্ণি এতজন প্রতিযোগিনীকে টেক্কা দিয়ে মিলন আগরওয়ালের ঝাঁ-চকচকে স্পোর্টস বাইকের পিছনের সিট’টা দখল করে ফেলবে! অনেক মেয়ে দুঃখ পেল, অনেকে চোখ টাটালো, সন্দেহ নেই। অনেকে অবাকও হল, কিন্তু আমি যে কারণে অবাক হলাম, সেটি ছিল সক্কলের চেয়ে আলাদা। আমার মনে মনে আশা ছিল, শাহনওয়াজের ফাঁড়া কাটানোর পর গোলগাল, চশমাপরা, ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট সিনিয়র রূপক সান্যালের সাথেই বোধহয় চূর্ণি পাকাপাকিভাবে সব বন্দোবস্ত করে ফেলবে। রূপকের সাথে চূর্ণির ভাব’ও খুব... বই নেওয়া, খাতা নেওয়া… তবে? মিলন কোত্থেকে ঢুকে পড়ে মাঝখান থেকে?
কৌতূহলের তাড়নায় একদিন চূর্ণিকে পাকড়াও করা গেল। সে খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো, “মাইরি! সব্বাই ভাবছে ভাবুক... তুইও?!”
ভ্যাবাচাকা খেয়ে বললাম, “ম্‌ম্‌... মানে?”
-“মধু, উই আর জাস্ট গুড ফ্রেন্ডস্‌... মি অ্যান্ড মিলন... দু’দিন আমাকে বাসস্টপে কি ড্রপ করেছে, সব্বাই ভাবছে যেন... ... এরকম কিচ্ছু নয়”, শেষ শব্দক’টায় বাড়তি জোর দিয়ে বলল চূর্ণি, “আর আমি এনগেজ হলে তোকে বলবো না মধু? আশ্চর্য্য, তুই তো জানিস আমার কেমন ছেলে পছন্দ...”
মনে মনে বলেছিলাম, “জানি হে জানি, রূপক সান্যাল”, মুখে কিছু বলিনি, হেসেছিলাম খালি।
কলেজের পর খাপছাড়া অরকুট-চিরকুট ছাড়া চূর্ণির সাথে যোগাযোগ তেমন ছিল না। তারপর একদিন হঠাত্‌ ই-মেলে ওর বিয়ের চিঠি পেলাম। মন’টা ভালো হয়ে গেল যখন শুনলাম ছেলে সেরা কলেজের ইঞ্জিনিয়ার, সেরা সরকারি সংস্থার উঁচুপদে ভালো চাকরি করে। রূপক সান্যালের নাম’টা মনে পড়ে হাসি পেল খানিকটা; যাক গে, সে না হোক, মনের মত ছেলে পেয়েছে শেষ অব্দি চূর্ণি।
বহুদিন বাদে শহরে ফেরা, তাও বন্ধুর বিয়েতে। স্কুল কলেজের বন্ধুদের সাথে দ্যাখা, রাতজাগা, ধুন্ধুমার আনন্দ- খুনসুটি-ছেলেমানুষি ঠাট্টায় আর আড্ডায় সন্ধ্যেটা চমত্‌কার কাটলো। চূর্ণিকে দারুণ দেখাচ্ছিল মেরুন বেনারসী’তে। একটা অদ্ভূত আলগা-বিষন্নতা, আলগা-কৌতূহলে, খানিক ক্লান্তি, খানিক টেনশনে আর কনের সাজে মিশ খেয়েছিল বেশ। মনে হচ্ছিল, সে রকম কোনো ফোটোগ্রাফার থাকলে চিরকালীন-বাঙালী-বধূ’র কনসেপ্টে কয়েকটা দূর্দান্ত ছবি তুলতে পারতো!
বিয়ের আসরও ভালো করেই মিটলো। তবে বন্ধুদের অনেকেই যে ঠোঁট টিপে হাসছিল, তা খেয়াল করলাম। খারাপ লাগলো। হ্যাঁ, মানছি, চূর্ণির বর তেমন রাজপুত্তুরটির মত দেখতে হয় নি। গায়ের রঙ হয়তঃ বা একটু বেশিই কালো, মাথার চুল না হয় একটু বেশিই পাতলা, চোখের চশমার কাঁচ না হয় একটু বেশিই পুরু... কিন্তু তাতে কি? চূর্ণির পছন্দ’টা তো অন্যরকম বরাবরই... সব্বাই জানে সেটা।
আজ ফিরছি আমার প্রাণের শহর ছেড়ে আমার কাজের শহরে। চূর্ণির ছোঁয়া লেগে থাকা স্মৃতিগুলো তাই একসাথে মনে আসছে কোলাজের মত। খুব ভালো লাগছিল ভেবে... ওই শাহনওয়াজ, ওই মিলন আগরওয়াল... কোনোভাবেই ওরা চূর্ণির মনোমত ছিল না। সুন্দরী মেয়ে মানেই কি তার ‘সুন্দর বর চাই’ হতে হবে না কি? ভালো লাগছিল, ওর ওই ক্লাস এইট থেকে চলে আসা ধারালো, স্মার্ট, হবু-বরের সংজ্ঞা’টার শেষ অব্দি মানরক্ষা হল বলে। মনে পড়ে গেল, বিয়ের চিঠি পেয়ে যেদিন ওকে ফোন করেছিলাম চূর্ণিকে, হাসতে হাসতে বলেছিল, “বিদ্যে-বুদ্ধি, চাকরি-বাকরির কথাটা যদি বাদ’ও দিই, মানুষটাও কিন্তু খুব ভালো, জানিস তো?”
আমিও হাসিমুখে বলেছিলাম, “কেমন এক্স্যাক্টলি মিলে গেছে... বল্‌?”
ভেবে ভালো লাগলো আবার; আর তখুনি একটা অদ্ভূত ব্যাপারও মনে পড়ে গেল। কথাক’টা শুনেই কে জানে কেন ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেছিল চূর্ণি... চুপ করাতে গেছিলাম, কিছুতেই চুপ করেই নি, কতবার জিগেস করেছিলাম, “কেন কাঁদছিস, চূর্ণি?" "কি হয়েছে?" "মন খারাপ করছে কিছু নিয়ে?”
কিচ্ছু বলে নি, কোনো কিচ্ছু বলে নি, শুধু অঝোরে কেঁদেছিল মিনিট তিনেক... তারপর হঠাত্‌ কান্না থামিয়ে ফেলেছিল নিজের থেকেই, থেমে থেমে বলেছিল, “সত্যি, এক্স্যাক্টলি মিলে গেল কেমন... বলা-কথা এভাবেও সত্যি হয়? ভাবতেই পারছি না জানিস... আনন্দে জল এসে গেছে চোখে, বিশ্বাস কর...”
ওকে বিশ্বাস করি, তাই বিশ্বাস করেছিলাম।

Leave a Reply

Subscribe to Posts | Subscribe to Comments

- Copyright © পাঁচমিশেলি - - Powered by Blogger - Designed by সায়ংতরী -