Popular Post

Posted by : Sayantari Ghosh Thursday, March 31, 2016

ps.jpg

দুই
লোহিতের সামনে বসেছিলাম। আকাশ ভর্তি মাখাসন্দেশের মত মেঘ, সূর্য আছে না নেই টের’ই পাওয়া যায় না। সামনের বাগানটায় ছবি তুলছে হেম আর পারো। প্রথম আলাপ’ও আমাদের এই বাগানের সামনেটাতেই, হস্টেলে ঘরের চাবি পাওয়ার দিন’টায়। পশ্চিম বাংলার বাইরে প্রথম পা রেখে এই দূরশহরে এসে দক্ষিণের মেয়ে হেমাক্সি আর অসম থেকে আসা পার্বতি যে আমার নিঃশ্বাস আর প্রশ্বাসের নামান্তর হয়ে যাবে এমন’টা ভাবার কথাও ভাবিনি কোনোদিন! অবশ্য রুদ্র’কে বাদ দেবো না আমি। প্রথমবার এখানে আসার ট্রেন যেইই ছাড়লো, প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো বাবার মুখ’টা আবছা হয়ে গেল কিছু কুয়াশায়, কিছু’টা চোখ উপচানো জলে, সেই থেকে ওই দু’বছর যার চোখদুটোতে রাজ্যের আশ্বাস দেখতে পেতাম সারাক্ষন, ভিড়ে, ভয়ে, নির্দ্বিধায় যার হাত ধরতে পারতাম সুরক্ষা চেয়ে... সে রুদ্র। ও ছিল তাই এই অবাক-দুনিয়া দ্যাখা হয়েছে আমার। ও ছিল তাই কত কি শেখা হয়েছে.........
হেম বলত, ‘আমাদের ভেতর গ্লুয়িং রিয়েজেন্ট হল পারো’... আপনভোলার চূড়ান্ত মেয়ে! ওকে সামলাতে সামলাতেই আমাদের তিনজনের বন্ধুত্ব’টা কখন যেন ‘কভি টুটেগা নেহি’ মার্কা হয়ে গেছিল। আদ্ধেকদিন ঘর তালা দিতে ভুলে যেত, সাইকেল বাজারে স্ট্যান্ড করে হস্টেল চলে আসত নিশ্চিন্তে, অন্ততঃ একহাজার বার দরজায় টোকা দিয়ে ভুলে গেছে যে ঠিক কি বলতে এসেছিল...
কিন্তু অবাক কান্ড হল, যে এমন ভুলোমন মেয়ে্টা আশ্চর্য রকম খেয়াল করে সামলে রাখত একখানি জিনিস। তার মোবাইল! সাদামাটা পুরোনো হ্যান্ডসেট’টাকে হেম মজা করে বলত ‘সতীন’! মোবাইল’টি ছিল পারোর প্রাণ! তার যত্নের, আদরের, পরিচর্যার শেষ ছিল না কোন! আর সেইসব কিছুর কারণ ছিল মাত্র একটি। সেই ফোনে ঠিক রাত সাড়ে দশটায় একজন ফোন করত সুদূর গুয়াহাটি থেকে... সে তার সারামাসের বরাদ্দ থেকে অতিকষ্টে বাঁচিয়ে রাখত এস.টি.ডি. ফোনের রিচার্জের দামটুকু। গুনে গুনে দশমিনিট কথা হত সাধারণতঃ... আর অসাধারণ কিছু হলে কথা ফুরাতো না, ব্যালান্স ফুরিয়ে যেত তার আগে... সেসব রাত্রিগুলোয় যতক্ষণ ঘুম আসত না আমার, একটা খুব আবছা কান্না ঘরজুড়ে ঘুরঘুর করছে টের পেতাম। অতি রক্ষণশীল অসমিয়া পুরোহিত-বাড়ির মেয়ে পার্বতি গোস্বামী তার চরম ভুলোমনের সবটুকু দিয়ে গুয়াহাটি ইউনিভার্সিটির পড়ুয়া আর আপাদমস্তক বাঙালি আলোক ঘোষ’কে ভালোবাসত!
ভালোবাসা-টাসা’কে আবার এক্কেবারে পাত্তা দিত না হেম। সাঙ্ঘাতিক ডাকাবুকো মেয়ে। অন্ধ্রপ্রদেশের এলুরু থেকে কলকাতা এসেছিল যাদবপুরে ফিল্ম স্টাডি নিয়ে পড়াশুনো করতে। তারপর এখানে। এমন ঝরঝরে বাঙলা বলতো যে ওকে বাঙালি বলে ভুল হবে। জমিয়ে রাজনীতি করত, সারারাত জেগে একতলা বাড়ির সমান উঁচু অসাধারণ সব পোস্টার আঁকতো, একখানা স্‌প্লেন্ডার বাইক নিয়ে রিং রোড চষে বেড়াত রাতে-দিনে। হস্টেল থেকে স্কুল, প্রফেসর থেকে দারোয়ান সব্বাই তার প্রতাপে তটস্থ ছিল! কারোর তোয়াক্কা করত না এক কথায়!
মনে আছে একবার রাত্রি বারোটার পর খালি একটা ঢাউস টর্চ হাতে নিয়ে আমাদের সঞ্জয়-বনের গহনে ঢুকিয়ে নিয়ে গেছিল। ভয়ে আমাদের প্রান প্রায় ওষ্ঠাগত, গলা শুকিয়ে গেছে, হারিয়ে যাবো, আর ফিরতে পারবো না, আরো যা যা কুডাক ডাকা সম্ভব, মন সব ডেকে ফেলেছে... জানিনা কতদূর হেঁটে শেষে একখানি উঁচু পাথরের ওপর এনে বসালো আমাদের... সামনে খাদ, ঝুপসি জঙ্গল সেদিকটায়... আকাশে কানাউঁচু থালার মত পূর্ণিমার চাঁদ, কিন্তু সে আলো ওই আঁধারে নামার চেষ্টাও করে না... পাথরে, পাহাড়ে পিছলানো জ্যোত্‌স্না... আর জঙ্গলের ওপাশে, অনেক দূরে জ্বলজ্বল করছে ঘুমন্ত লোহিত হস্টেলের দু’শো ঘরের ছড়ানোছিটানো রাত-আলো... আবছা দ্যাখা যাচ্ছে সামলের রাস্তার হলুদ হয়ে আসা স্ট্রিটলাইটগুলো... মনে হল যেন স্বর্গ থেকে কেউ আমাকে আমার বাড়ির উঠোন দেখিয়ে দিয়েছে! কথা সরেনি কোন, আমি আর পারো চুপ... হেম শুধু বলেছিল, “আমরা খালি ওই ছাদ থেকে এই পাহাড়, এই জঙ্গল দেখি, বল? এখান থেকে এই জঙ্গল পেরিয়ে ওওওওই অব্দি যাওয়ার রাস্তা বানানোর কথা ভাবি না কেন?”
উত্তরে কি বলতে হত আজো জানি না।
একটু থেমে হেম বলেছিল, “আমি বানাবো, দেখিস...”
[ক্রমশঃ]

Leave a Reply

Subscribe to Posts | Subscribe to Comments

- Copyright © পাঁচমিশেলি - - Powered by Blogger - Designed by সায়ংতরী -