Popular Post

Archive for 2015

ফ্রুটকেক

By : Sayantari Ghosh


খচখচানি’টার শুরু সেই পরশু দিন... অর্থাত তেইশ তারিখ।


তেইশ তারিখ সন্ধ্যেবেলা যখন অফিস থেকে বেরোলাম পার্কস্ট্রিট যাবো বলে তখনও কেক কেনার ব্যাপার’টা “আজ সন্ধ্যের কাজ”এর লিস্টে জ্বলজ্বল করছে মাথার ভেতরে। অথচঃ ঘন্টাদুয়েক মিতের সাথে বকবক করে তিনবার পার্কস্ট্রিট চক্কর দেওয়ার পর হিজিবিজি ভাবতে ভাবতে যখন মেট্রোয় উঠে পড়লাম, তখন ফ্রুটকেক চাপা পড়ে গেছে দেশ ও জাতির উন্নতি ও পিছিয়ে পড়া বিষয়ক সুদীর্ঘ আলোচনার নিচে!


পরদিন বাড়ি ফেরা! ভাবলুম পার্কস্ট্রিট হল না, কিছু একটা অফিসের পাশ থেকেই কিনে নেবো, ট্রেন ধরার তাড়াহুড়োয় সেটায় ভুলে গেলাম বেমালুম। সন্ধ্যে রাত্তিরে যখন বাড়ি ঢুকছি, মন খারাপ হয়ে গেল এক্কেবারে! এত করে ভেবে রেখেও বড়দিনের আগে একটা কেক আনতে পারলাম না!? মার্কামারা স্মৃতিশক্তি বটে!!


যা হোক গে, আমি ভুললেও মা ভুলে যায় নি মোটেই! এখন আমি আর বোন দু’জনেই হপ্তাবাবু হয়ে গেছি, মাসে বা সেমেস্টারে বাড়ি ফেরে যারা হপ্তাবাবু’দের দর তাদের থেকে কম যদিও, তবু মা উইকএন্ড উত্‌সবগুলো’কে চট করে মিস করেন না। দেখলাম, চার-পাঁচ রকমের বিভিন্ন স্বাদের কেক জড়ো করা হয়েছে বাজার ঘুরে। নানারকম রঙিন বাক্স, জড়ির ফিতে... বাড়ি ঢুকেই ঝাঁপিয়ে পড়লাম একরকম!গপাগপ মুখে পুরে ফেললাম অনেকখানি। কিন্তু কেমন যেন একটা খচখচানি... কে জানে কেন, মনে হল, “কি যেন নেই-নেই... কেমন ”... সে’কথা আর মা’কে বললাম না!


পরদিন বোনের সাথে বাজার বেরিয়েছি। আরো কতগুলো “দ্য রিয়েল ফ্রুটকেক” ইত্যাদি লেখা, নামী কোম্পানীর সিল-মারা বাক্স কিনে বাড়ি ফিরলাম! মা চোখ পাকালেন, আমি অপরাধীর মত মুখ করে নতুন আনা বাক্সগুলো থেকে কোণা ভেঙ্গে মুখে দিলাম...
দুত্তেরি!! এ কি রে বাবা? রিয়েল ফ্রুটকেক?! রাশি রাশি টাকা নিলে এরজন্যে?! মাথা গরম হয়ে গেল!


বোন সেই কেক দু'খানা ঝপাঝপ সাবাড় করে ঘোষনা করল যে আমার কেকটেস্টিং’এর কাজ ছেড়ে ইমিডিয়েটলি তেলেভাজায় শিফট করা উচিত, আমার কিছু একটা সিভিয়ার প্রবলেম হয়েছে!


মন খারাপ করে বেরিয়ে পড়লাম। তখন সন্ধ্যে হয়ে গেছে, আমাদের পাড়ার মোড় থেকে মিশনারি গার্লস স্কুলের চার্চ’টা দ্যাখা যায়, ইচ্ছে করলো ও’দিক থেকে ঘুরে আসি। গলি’র মুখের স্ট্রিটলাইট’টা ক’দিন থেকে খালি দপদপ করছে... আলোছায়া, ছায়া আলো... আমি কিছু একটা ভাবছিলাম, তবে খুব নিটোল কিছু নয়, অন্যমনস্ক’ই ছিলাম হয়তঃ... হঠাত একটা আচমকা ‘ভোঁওওপুউ! ভোঁওওপুউ!’ শব্দ শুনে বিচ্ছিরি রকম চমকে গেলাম! তাকিয়ে দেখি, আমাদের নয়ন পাউরুটিওয়ালা।

নয়ন পাউরুটিওয়ালার খালি নাম বললে পুরো’টা বলা হয় না। ওর সাথে আমার আলাপ তখন, যখন আমি ক্লাস ওয়ান। তখন এই পাড়া’টা নতুন, আমাদের বাড়ি’টা নতুন; পাউরুটিওয়ালার ঠেলাগাড়িটাও নতুন ছিল তখন। আমি আর বোন তখন একই রকম ফ্রক পরতাম দু’সাইজ ছোট-বড়। স্কুল থেকে ফিরে বাড়ির সামনের খোলা চত্ত্বর’টায় ছোঁয়াছুয়ি... কুমীরডাঙা... তখন পাউরুটিওয়ালা আসতো। আমাদের প্রতিদিনের টিফিনের বরাদ্দ পাউরুটি নেওয়া হত তার কাছ থেকে। বাপি স্কুল থেকে ফিরে তিন টাকা রেখে দিত টি.ভি.’র টেবিলে। পাউরুটিওয়ালা ডোরবেল বাজালেই আমি আর বোন ছুট ছুট! কে আগে টাকা নিতে পারে, কে আগে দাম দিতে পারে, কারণ আড়াই টাকার পাউরুটি’র পর বাকি আট আনার প্রজাপতি বিস্কুট বা কাপ কেক প্রাথমিকভাবে তার পাওনা হত। সে দয়া করে অন্যজন’কে দিতে পারে (দয়া অবশ্য রোজ’ই করা হত, পরেরদিন যে কেউ জিততে পারে সেইটে মাথায় রেখে)! নয়ন পাউরুটিওয়ালা হাসতো আমাদের দেখে। ছোটখাটো চেহারা লোকটা’র, ভেবে অবাক লাগতো কি ভাবে ওই একটা গাড়ি ঠেলে ঠেলে গোটা শহর চক্কর মারে সে! জিগেস করতাম মাঝে মাঝে,
“তোমার খিদে পায় না? এত যে হাঁটো?”
“পাবে না কেন? তখন খেয়ে নি!”
“কি খাও? পাউরুটি? কেক?”
“না না!!” হো হো করে হাসতো নয়ন পাউরুটিওয়ালা, “ভাত খাই, দোকানে গিয়ে...”
“এত কেক থাকতেও ভাত খাও?”
“ওটা তো বেচার কেক, খেলে হবে?”
….
“আচ্ছা, তুমি চান করলে কোথায়?”
“পুকুরে!”
“জামা কই? গামছা কই?”
“গাড়ির ভেতর বাক্স আছে, তাতে জামা আছে, গামছা আছে, তেল সাবান সব আছে...”
“কোন পুকুরটার চান করো? সরকার কাকুদের পুকুরে?”
“ওখানে আমায় ঢুকতেই দিবে না...”
“ও... তাহলে?”
“কত পুকুর আছে...”


পাউরুটির দাম আড়াই থেকে তিন, সাড়ে তিন, চার, সাড়ে চার, পাঁচ, ছয়, সাত হয়ে গেল। আমিও পাউরুটিওয়ালার থেকে অনেক ছোট থেকে তার সমান হয়ে তার চেয়েও লম্বা হয়ে গেলাম! প্রথমে যখন পাউরুটিওয়ালা আসত আমরা কুমীরডাঙা খেলতাম... তারপর খেলতাম ব্যাডমিন্টন... তারপর কলেজ থেকে ফেরার পথে শুনতাম ‘ভোঁওওপুউ! ভোঁওওপুউ!’ অন্য পাড়ায় পাউরুটিওয়ালার গাড়ি ঘুরছে।  আমি তখন ক্যান্টিনে লাঞ্চ করি, বোন কলকাতায় চলে এসেছে, টিফিনে আর আমাদের বাড়িতে পাউরুটি খায় না কেউ।

লোকটার সাথে আমার পরিচয় বছর পনেরো’র। অবাক লাগতো ভেবে যে ওর নামটাও জানতাম না! নয়ন পাউরুটিওয়ালার নাম’টা হল বেকারির নাম... নয়ন বেকারি... পাউরুটিওয়ালার নাম’টা মো্টেই জানতাম না। ওর ব্যাপারে ব্যাক্তিগত খবর জানতাম দু’টো। এক, লোকটা মুসলমান, ঈদ আর মুহাররমে আসতো না, ঈদের আগের দিন “আমি তো কাল আসবো না” বলে দুটো পাউরুটি দিয়ে যেত... আর দুই, লোকটার একটা মেয়ে ছিল, আমাদের চেয়ে অনেক ছোট, তার জন্যে আমাদের পুরোনো বই, পুরোনো সোয়েটার মা দিত ওকে মাঝে মাঝে, দেখেছি। আর কিছু জানতাম না ওর ব্যাপারে, আর কে জানে কেন, জানার তাগিদও অনুভব করিনি কখনও...


আলোআঁধারির ভেতর হঠাত সেই খুব চেনা ‘ভোঁওওপুউ! ভোঁওওপুউ!’ শুনে নস্টালজিয়ায় ভেসে গেছিলাম ক’টা মুহুর্ত, নয়ন পাউরুটিওয়ালা একগাল হেসে বলল, “ভালো আছো? তোমাকে তো দেখিইনা আজকাল... অনেক দিন দেখি না...”


আমিও হাসলাম, “হ্যাঁ, এখন কলকাতা চলে গেছি গো... বছরতিনেক হল... চাকরি... তুমি ভালো আছো?”


হেসে ঘাড় হেলালো নয়ন পাউরুটিওয়ালা, ভালো আছে। আলো দপদপ করছে যদিও, তবু মনে হল যেন অনেকটা বুড়ো হয়ে গেছে এক ঝটকায়, হয়তঃ অনেকদিন দেখিনি, তাই এরকম লাগছে... হতে পারে...


“কেক নেবে? বড়দিনের ভালো ফ্রুটকেক আছে...” জিগেস করল ও।
“দাও”, কতকটা ভদ্রতা রাখতেই বললাম... তেইশ তারিখ থেকে পাগলামি করে চলা খচখচানি’টা আবার হাত গোটাল যেন... কেক নিয়ে যা কান্ড চলছে কাল থেকে... নেব আবার?!

“ছোট একটা দাও...” যোগ করে দিলাম আমি।
“ছোট নেবে? বোন, মা... সবার হবে ছোট’তে?... এইটা নাও...” আমার হয়ে নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় সে, “এটা ভালো হবে...”


দাম দিতে দিতে বললাম, “তোমার মেয়ে কেমন আছে?” এখন তো আর ছোটবেলার সেই অর্থহীন প্রশ্নগুলো করতে পারি না, তাই সামান্য যে ব্যাক্তিগত অংশটুকু তার জানি, তার থেকেই আদ্ধেকটা সম্বল করে জিগেস করলাম, “ভালো?”


একগাল হাসল নয়ন পাউরুটিওয়ালা, “ভালো আছে... ওকে বারাসতের কাছে একটা ইস্কুলে দিলাম, মাসে ন’শো টাকা লাগে, থাকা, খাওয়া, পড়া, টিউশনি... ইলেবেনে উঠলো তো... ভালো পাশ করেছে আগের বার...”


“বাহ্‌!!” আমিও হাসলাম, “ভালো হবে, দেখো...”


ঘাড় হেলিয়ে আরেকবার হেসে হাঁটা লাগালো লোকটা। মোড় ঘুরে গেল গাড়ি। খানিকবাদে শোনা গেল একবার, ‘ভোঁওওপুউ! ভোঁওওপুউ!’


গার্লস স্কুলের দিকে আর গেলাম না। উলটো পথ ধরলাম বাড়ি ফেরার। নানারকম সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে ডোরবেল বাজালাম। দরজা খুলেই আঁতকে উঠল বোন, “আবাআআআর...!?!”

বুঝলাম, হাতে কেকের বাক্স, ও নিঃসন্দেহে আমায় পাগল ভাবছে। কি আর বলবো! বিড়বিড় করে বললাম, “নয়ন পাউরুটিওয়ালা ধরিয়ে দিল...”
বোন গজগজ করে বলল, “কিনছো কেনো, তু্মি খাবে সব...!”
তুই থেকে তুমি... মানে বোন সিরিয়াস!


আর কথা বাড়ালাম না। পড়ার টেবিলে বসলাম বই খুলে। ঝামেলার সময় এটাই আমার বাড়ির যাকে বলে 'সেফেস্ট কর্ণার', আমার একুশ বছরের অভিজ্ঞতা তাই বলে!


খানিক বাদে মা “জলখাবার!” বলে ঠকাস করে এক ডিশ ভর্তি আমার সদ্য কেনা কেকের টুকরো  রেখে গেল। আমতা আমতা করে কিছু একটা বলতে বলতে একটুকরো কেক মুখে ঢুকিয়েছি আর...

আর... কিছু বলতেই ইচ্ছে করল না! আমেজে চোখ বুজে এল যেন! আরেকখানা টুকরো মুখে ঢোকালাম তক্ষুনি... আহা...


মুখে যা ঢুকিয়েছি সেটা হল একটা টিপিক্যাল ফ্রুটকেক... সেটা প্রাথমিকভাবে একটা হলদেটে প্যাকেটে মোড়ানো ছিল, ‘নয়ন বেকারি’ লেখা একটা কাগজ প্যাকেটের গায়ে সাঁটা ছিল... কেকের ওপরটা শক্ত শক্ত, ভেতরে কালো কালো কিসমিস, বড় বড় মোরব্বা, একখানা কাজু আর খুব কপাল ভালো থাকলে নিচের কোণার দিকে আধখানা চেরি পাওয়া গেলেও যেতে পারে। কিন্তু সেই মূহুর্তে সেটা আমার কাছে অমৃতের বাড়া মনে হল আর প্যারালেলি মনে হল, এতক্ষণে ক্রিসমাস’টা বেশ ‘মেরি’ ক্রিসমাস হল!

মৌন দিয়ে ছোঁয়া / দুই

By : Sayantari Ghosh
অপব্যয়
এখনও কাগজ দিয়ে যায়নি...!
অন্যদিন হলে এক্ষুনি মেজাজটা খিঁচড়ে যেত দীপ্তাভ'র... কিন্তু আজ কিছু হল না... এম্নিই... অকারণে... আজ যেন কাগজ না দেখলেও চলে... দুনিয়ার খবরাখবর না জানলেও... অকারণে... অকারণে আজ ছুটি নেওয়া যায়...
এখুনি করা চা কাপে ঢেলে নিয়ে ব্যালকনিতে চলে এল ও... পাঁচতলার ওপর থেকে খুব বেপরোয়া লাগে নিচের রাস্তাটাকে... এটা চিরকালই লাগে ওর... এই ফ্ল্যাটে আসা থেকে... নিচের রাস্তাটা যেন সারাক্ষণ “আয় আয়” করে ডাকে... ঝাঁপিয়ে কোলে চলে আসতে বলে... আজও বলছে...আরও যেন বেশি করে বলছে... ভোরটা আজকে কেমন যেন অন্যরকম... ঝিম্‌ম্‌ ধরানো... ভোর বলে মনেই হয়না... যেন এখনও অনেএএক দেরি রাত্তিরের ঘুম ভাঙতে। ব্যালকনির বেতের চেয়ারে হিম-হিম ছোপ... কাল রাত্তিরে বৃষ্টি হয়েছে...? নাকি হবে... এখন......
চায়ের কাপের প্রথম চুমুকই জানান দিয়ে দিল, চিনি কম! ভালো... বয়স হচ্ছে না? চিনি কম খাওয়া ভালো... তনু কি ঘ্যানঘ্যান করতো এই নিয়ে...!! এলেই মিতাকে জড়িয়ে ধরে বলতো, “মণি, তেল মশলা মিষ্টি সবেতে রেস্ট্রিক্‌শন করে দাও দীপের... আররে বয়েস হচ্ছেনা না কি?”
একটা হাসি টুপ করে ছুঁয়ে গেল সকালের রাশভারি মেঘ সরিয়ে...
তনু...
রীতিমত যুদ্ধ করেও কোনোদিন 'দাদা' হতে পারা যায়নি ওর... 'দীপ' হয়ে গেছে দীপ্তাভ... “ছয়মাসের বড়, তায় আবার ক্লাসমেট... দাদা কিসের রে?” বলতো তনু... বললেই রাগারাগি... হাত ধরে মোচড়... কলাবেণীতে টান..... ওদের থামাতে না পেরে দিদু সিধে গিয়ে নালিশ ঠুকতো মামিমার দপ্তরে, “আরে অ তনুর মা... তর মাইয়ার একগাসি সুল রইবো না আর... কথা সনে না মুখপুড়ি...! বলি কি করে কি অ দুইটায় মিইল্যা সারাখন?!”
তনু...
একটা ছিমছাম একতারার সুরের মত... খালি ভালোবাসতে জানত... তার মানে আসলে তনু সঅঅব জানত..!! খুব আনন্দে আদরে ভাসিয়ে দেওয়া যায় এমন বোন হতে জানত... মনখারাপে স্বপ্ন-স্বপ্ন আলো-আলো রূপকথা হতে জানত... গোপন খবরের জাদুআয়না, বেস্টফ্রেন্ড হতে জানত... আর... আর অদ্ভূতভাবে, খুব অদ্ভূতভাবে দারুণ অন্ধকারে তনু একেবারে মায়ের মতন হয়ে যেতে জানত...
তনু খালি ভালোবাসতে জানত...
হাসির গায়ে জড়িয়ে জড়িয়ে স্বর্ণলতার মত দীর্ঘশ্বাস বাড়তে লাগল...
এককণা ভরসা হতে পারেনি দীপ্তাভ... বিশ্ব ওভাবে চলে গেল... হঠাত্‌...
কি বলতে হয়...?? কি বলতে হত তনুকে...? ঠিক কি দিলে ভালো রাখা যেতো ওকে? সব সঅঅব গুলিয়ে গেছিল মূহুর্তে...
দেরি হয়ে গেছিল খুব ডাকতে... সে বেচারি চেয়ে চেয়ে থেকে শেষকালে চোখ নামিয়ে নিয়েছিল পথ থেকে...
“অপব্যয়...! তোর সময়ের অপব্যয়, দীপ...! আমি একেবারে ঠিক আছি রে...”
বুকের ঠিক মাঝখানে ঠং করে কাচ ভাঙলো একটা... কাচ না, আয়না ভাঙলো... কে জানে বাইরে শোনা গেল কি না... এখানে, ওখানে, ওইখানে... ওই মেঘ-অব্দি শোনা গেল? মেঘের ওপাশে...? গেল শোনা? একটা কি যেন পাখি টেনে টেনে সুর করে কত কি অভিযোগ করতে লাগলো চোখের আড়ালে থেকে... তারপর হঠাত থেমে গেল... শব্দ নেই...... কোনো শব্দ নেই...... শব্দ বলে কিচ্ছু হয়না এ সকালে......
দীপও হতে পারেনি দীপ্তাভ...
..................................................................
মৌনতা অপরাধ...?
মৌনতা শাস্তি।
[ক্রমশঃ]

মৌন দিয়ে ছোঁয়া... / এক

By : Sayantari Ghosh

শঙ্খলতা

.....................................................

........ তারপরে মনে হল যেন ছাদ থেকে নীলকালি ঢেলে দেওয়া হল এক শিশি... পরীক্ষার হলটা তাতে গুলে গুলে একটা রাস্তা হয়ে গেল... কোন রাস্তা? চেনা... সন্দেহ নেই, কিন্তু... কোন রাস্তা... মনে পড়ছে না...
“এই! চ ফুচকা খাবি...?” চমকে পিছন ফিরল তনু...
দীপ...!
“হ্যাঁ...” মাথা নাড়ালো তনু... “কিন্তু বিশ্ব...?”
“বিশ্ব তো চলে গেছে...”
“কোথায়...?” খুব অবাক হয়ে গেল তনু, “আমায় না বলে... এভাবে চলে গেল...?”
কেমন একটা হাসলো দীপ... আর ঝুপ্সি অন্ধকার হয়ে গেল চারদিকে... শিরশিরে ছায়াগুলো নড়তে লাগল কেমন... ভয় করছে... খুব ভয়... বিশ্ব কই...? কোথায় গেল ও...?
“বিশ্ব্‌...!!!” খুব জোরে ডাকতে গেল তনু... কিন্তু ডাকা যাচ্ছেনা কেন??
“বিশ্ব...!!!” আবার... আবার...

দলাদলা অন্ধকার হাতড়াতে লাগল তনু... একদিন কেটে গেল যেন... একযুগ... গলা শুকিয়ে আসছে... বিশ্ব কোথায়?... ওকে ছাড়া যে এক’পা হাঁটার অভ্যেস নেই তনুর... ওকে ছাড়া...

“বিশ্ব...!!!”
“খুঁজছিলি...?” খুব চেনা একটা হাত আঙ্গুল ছোঁয়ালো কনুইয়ে...
আর পিছন ফিরতেই...

“বৌদি গো!!! দাদা আর ফিরবে না... দাদা চলে গেছে...”

এক ঝটকায় ঘুম ভেঙে গেল তনুর... চোখে লেগে আছে ওর হাত ধরে থাকা দীপের মুখটা... বুকের ভিতর তিরতির করে কাঁপছে সুমির কান্নাডোবানো চিত্‌কার...

স্বপ্ন...!?! স্বপ্নই তো...?
হ্যাঁ...তাই। সব দিব্বি চেনা যাচ্ছে এখন। চেনা বালিশ, চেনা বিছানার চাদর, চেনা নীল নাইটল্যাম্প... ওর খুব চেনা শোবার ঘর ঝিমাচ্ছে... জানলার কাছে রাতের হাওয়া দুলে দুলে নতুন সুর বাঁধছে উইন্ডচিমারে... পাশে তুতাই অঘোরে ঘুমাচ্ছে... মাথার কাছের টেবিলে ঘড়িটা রাত্রি দু’টোর কাছাকাছি তিনখানা কাঁটার জটিল সমস্ত হিসেব সামলাচ্ছে... আর তার পাশে ওরই দিকে তাকিয়ে সেই দুষ্টু হাসিটা হাসছে বিশ্ব... জুঁইফুলের মালাটা আজ সন্ধ্যেতেই পরানো... সাদা ফুল ওর বড্ড প্রিয় তো...! এতরাতেও, কাঁচের ফ্রেমের ওপাশের দুনিয়া থেকেও ওর চোখদুটো ঠিক তেম্নিই ঝকঝক করছে... যেন এক্ষুনি কিছু বলবে...

“কিছু বলবে?” আপন মনেই খুব চাপাস্বরে বলল তনু
ওভাবেই ওর দিকে তাকিয়ে রইল বিশ্ব...
জানলার পর্দাটা খামখেয়ালে উড়ল একবার... জুঁইয়ের জমাট গন্ধ গোল করে ঘুরে নিল খাটের চারপাশ... আর উইন্ডচিমারের সাথে খুনসুটি করে নিল হাওয়া এই ফাঁকে... রিনরিন্‌ রিনরিন্‌...

হাওয়াঘন্টি / ২

By : Sayantari Ghosh




[শেষটুকু...]

ভয় করল ভীষণ! গলা শুকিয়ে গেল মূহুর্তে... এই ভরদুপুরে, দিনের আলোয় এ কিরকম পাগলামিতে পেয়ে বসল আমাকে...?

কি রে?” চমকে পিছনে ফিরলাম রিদ্‌মের ডাকে, “রেস্ট নিতে বললাম তোকে... আর তুই...... এইইই, এরকমভাবে ঘেমেছিস কেন রে...? কি হল'টা কি তোর...? শরীর খারাপ করছে না কি?”

না না, আয়াম ফাইন... আমি... আমি ঠিক আছি... জাস্ট টায়ার্ড...বললাম, কিন্তু নিজের গলাটাই চিনতে পারলাম না নিজের বলে... গলার কাছে কি যেন দলা পাকিয়ে আটকে গেছে...!!

সারা দুপুর চুপটি করে বসে রইলাম... জেনের জার্মান স্পিত্‌জ্‌ চেরি আমার কোলে উঠে বসেছিল... আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলাম ওর মাথায়... ঠুন্‌ন্‌-ঠুন্‌ন্‌‌ করে উইন্ডচিমার বাজছে বারান্দায়... ফালি ফালি পড়ন্ত রোদ ঢুকে পড়ছে বাগানের ওক গাছটার ফাঁক দিয়ে... ঘরের হাওয়াটা কেমন যেন ভারি ঠেকছে আমার... যেন পলিথিনের প্যাকেটে মোড়ানো হয়েছে হাওয়াটাকে... একটা ছায়া যেন ঘিরে ধরে আছে...

রিদ্‌ম বলল বিকেলে সেন্ট এডওয়ার্ড স্কুলের পাশের চার্চে যাবে। ওর লাগোয়া গোরস্থানটাও বেশ পুরোনো... এখন আর লোকজনের সেরকম যাতায়াতও নেই সেখানে...

তুই যাবি...? না কি...... আই থিঙ্ক ইউ শুড টেক রেস্ট... ঘোরাঘুরি করতে হবে না আর...বলল ও...
বুঝতে পারছিলাম না! বেরোতে ইচ্ছে করছে না, কিন্তু একা থাকার কথা ভাবতেই কেমন একটা বোকাবোকা ভয় চেপে ধরছে যেন। বললাম, “জেন কখন ফিরবে রে...?”

আজ তাড়াতাড়ি ট্রাই করবে... মে বি ফাইভ থার্টি অর সিক্স... কেন...?”

টেবিলের ওপর থেকে হাতঘড়িটা তুলে দেখলাম। চারটে। বললাম, “তাহলে... তাহলে আমি আর বেরোবো না...
ওকে দেন... আমি বেরোই, কেমন...? কিছু নিয়ে আসব? কিছু চাই...?”

বলতে ইচ্ছে করল, “রিদ্‌ম্‌... আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে... আমি চন্ডীগড় ফিরতে চাই...

বলা গেল না।

........................................................................................................

রিদ্‌ম্‌ বেরিয়ে যাবার পর সোফায় বসে বসে চেরিটাকে জড়িয়ে ধরে কখন জানি চোখ লেগে গেছিল। চোখ খুললাম যখন, আলো কমে এসেছে ঘরটায়। এত তাড়াতাড়ি সন্ধ্যে হয়ে গেল বুঝি? 'টা বাজছে...? চোখ রগড়ে টেবিলের উপরটা হাতড়ালাম অন্ধকারেই...

খুব ঠান্ডা কি একটা হাতে ঠেকলো... চমকে উঠে বসলাম... একটা জলের বোতল...! কেউ এক্ষুণি ফ্রিজ থেকে বের করে রেখেছে... এতটুকু জল গড়ায় নি সেটা থেকে এখনও... আর গোটা টেবিলে কোথাও রিস্টওয়াচ'টা নেই...!

ঝট করে উঠে দাঁড়াতেই মাথাটা ঝিমঝিম করতে লাগল... পা টলছে... চেরি কোথায় গেল...?
চেরি...!ডাকলাম...

সাড়া নেই...

সোফার নিচেটা দেখলাম উঁকি দিয়ে... ঘর'টা বেশ অগোছালো, টের পাচ্ছি রীতিমতো... ডায়নিং টেবিলের ওপর আমার শেষ-করা কফির কাপ'টা ধুয়ে উলটে রাখা, ওয়াশ বেসিনের পাশে জল ছড়িয়ে আছে, একটা চেয়ার টেনে একটু বেঁকিয়ে রাখা... যেন কেউ বসেছিল সোফাটার দিকে তাকিয়ে...

চেরি নেই কোত্থাও!

চেরি...?” ডাকলাম আরেকবার... পাত্তা নেই কারো...

আস্তে আস্তে বারান্দায় বেরিয়ে এলাম.....উইন্ডচিমারটা সেরকমই বাজছে এখনও... ওকগাছটাকে কেমন ডাইনিবুড়ির মতন দেখতে লাগল একবার তাকিয়ে...

ঘরে ফিরে এলাম; এক গ্লাস জল খাবো... টেবিলে রাখা বোতল'টা নিতে গেলাম আর রক্ত হিম হয়ে গেল মূহুর্তে...

সোফাটার কোল জুড়ে অন্ধকার বেশ গাঢ় হয়েছে ততক্ষনে... দেখলাম, চেরি সোফার কুশনে গা ঘষছে আনমনে... যেন খুব করে আদর খাচ্ছে কারো কাছে...

কে...???? কে ওখানে...?” চেঁচিয়ে উঠলাম খুব জোরে...

একঝাঁক হাওয়া ঢুকলো খালি জানলার পর্দাটা উড়িয়ে দিয়ে...

কে...??? কেন ভয় দ্যাখাচ্ছো...? জেন...? জেন ফিরে এসেছো বুঝি...? না কি... না কি তুই রিদ্‌ম্‌...? প্লিজ আমায় আর ভয় দেখাস না তোরা, ভাল্লাগছেনা আমার, প্লিজ...

গলা ভেঙে গেল আমার কথা'কটা বলতে গিয়ে... বুকের ভেতর কেউ যেন ভয়ে চোখ বন্ধ করে বলছিল যে ঘরে কেউ আছে... নিশ্চিত আছে... কিন্তু সে রিদ্‌ম্‌ নয়... জেনও নয়... তাকে আমি চিনি না...!!
আরেকবার পর্দাটা উড়ল... এবার খুব জোর হাওয়া... টেবিলের নিচের তাক থেকে খবরের কাগজগুলো উড়ে ঘরময় হয়ে গেল একেবারে... চেরি এবার আমার দিকে তাকাল অবাক হয়ে...

কেন...? কেন...? কি চাও...? কি.........বলতে বলতে চোখ জল এসে গেল আমার... নড়তে পারছি না এতটুকু... গলার স্বর তলিয়ে যাচ্ছে যেন চিরকালের জন্যে...

..........আরেকজনও কিছু বলতে চায়... ভীষণ ভাবে বলতে চায়... ঘরজোড়া টানটান অন্ধকার সেটা জানান দিইয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত...

আরেকবার হাওয়া দিল... আর পাক খেয়ে খবরের কাগজের একটা পাতা আমার পায়ে জড়িয়ে গেল...
আর সাথে সাথে হাওয়া থেমে গেল একেবারে...

সব চুপ... সব শান্ত... যেন ত্রিভুবনে শব্দ বলে কিছু হয়'ই না এ'রকম নীরবতা... উত্‌কন্ঠায় উপচে যাওয়া নীরবতা... সব্বাই যেন অপেক্ষা করছে আকুল হয়ে...

আঙুল হিম... হাত কাঁপছে... কোনোরকমে কাগজটা কুড়িয়ে নিলাম...

গত চোদ্দ'ই ফেব্রুয়ারির খবরের কাগজ...

পাতাজোড়া গোলাপি রঙের বিজ্ঞাপন কোনো এক গ্রিটিংস্‌ কার্ড কোম্পানির... বড় বড় অক্ষরে লেখা...

Some day, when I'm awfully low
When the world is cold
I will feel a glow just thinking of you
And the way you look tonight

পড়া শেষ... আস্তে আস্তে মাথা তুললাম... হাঁটুর আশেপাশে জোরালো কাঁপুনি... শিরদাঁড়ায় ঠান্ডা ঝিমুনি... ঘরের আলোআঁধারের মধ্যে কাউকে খুঁজে চলেছে আমার দু’চোখের মণি... স্ট্যাচু হয়ে তাকিয়ে রইলাম সামনের দিকে...

চেরি আবদারি জুলুজুলু চোখে তাকালো আমার দিকে...

নরম আকুতির মতন খুব আলতো একটা হাওয়া দিল ঘরটায়...

[শেষ]


হাওয়াঘন্টি

By : Sayantari Ghosh


মেজর চার্লস ক্রস্‌বি...? তাই তো...?” আরেকবার জিগেস করলাম আমি।

ইয়াপ্‌, তাই...বলে কবরগুলো থেকে চোখ তুলে আমার দিকে তাকালো রিদ্‌ম্‌, “ফিলিং টায়ার্ড, না?”

আসলে তাই! সকাল সাতটায় ঢুকেছি সঞ্জৌলি গোরস্থানে;  এখন মাথায় ওপর চনচন করছে রোদ... ঘড়ির কাঁটা বারোটা পেরিয়ে গেছে...

কাল এসেছি সিমলায়। চন্ডীগড়-সিমলা যাতায়াত'টা আমি আর রিদ্‌ম্‌ ইচ্ছে হলেই করে থাকি... উইকএন্ড, অফিসে ছুটি, সেলিব্রেশন বা মনখারাপ... গাড়ি বের করে সোজা সিমলা! তবে হুজুগটা বেড়েছে রিসেন্টলি... যবে থেকে এই জিনিওলজির ভূত'টি এসে রিদ্‌মের মাথায় চেপেছে! বোধহয় একটা পুরোনো ডায়েরি থেকে শুরু হয়েছিল ব্যাপারটা... তারপর এখন নিজের পরিবারের ইতিহাস ঘেঁটে দ্যাখাটা শখ হয়ে গেছে রিদ্‌মের; আর পুরোনো জায়গায় ঘুরঘুর করতে চাইলে আমার ঝুলে পড়তে আপত্তি থাকেনা কখনই.....

তিনদিন আগে থেকে এই চার্লস ক্রস্‌বির নামটি মাথায় ঢুকেছে ওর। বুধবার রিসেস আওয়ারে দুম করে আমার ক্যাবিনে ঢুকে এক গাল হেসে বলল, “তোর বর পাওয়া গেছে রে...!” সত্যি বলতে কি, শোনামাত্র আমার বুকের ভেতর ধুকপুকুনি বেড়ে গেছিল! বলে কি ছেলেটা? প্রপোস'টা এভাবে করবে বুঝি? মাথা'টা কি খারাপ হয়ে গেল একেবারেই ওর? এক মিনিট পরে থতমত ভাবটা কাটিয়ে উঠলাম যখন রিদ্‌ম্‌ খোলসা করে বলল গল্প'টা। পুরো'টা শুনে মজা পেলাম ঠিক'ই, কিন্তু ভেতর ভেতর নিজেকে বড্ড বোকা মনে হচ্ছিল। হপ্তাখানেক আগে ভ্যালেন্টাইনস ডে'র দিনও এই একই রকম পাগলামি করছিল মন'টা! নিজেকে একটা আস্ত হাঁদাগঙ্গারাম মনে হল।  প্রপোস-টোপোস কত কি ভেবে ফেলেছিলাম, ধূর! 

রিদমের গল্পের মুখ্য ভূমিকায় আছেন এই চার্লস ক্রস্‌বি বলে ভদ্রলোক'টি। সম্পর্কে ওর ঠাকুর্দার মাসতুতো ভাই... প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় সিমলায় পোস্টিং ছিল তাঁর... সারা সিমলায় ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীর হত্তাকত্তাদের মধ্যে মেজর ক্রস্‌বির নামযশ ছিল নাকি খুব... বাড়ির বাতিল কাগজের স্তূপের কোত্থেকে জানি রিদ্‌ম্‌ একখানা ঘষে যাওয়া হলদেটে ছবি পেয়েছে... চাড়া-দেওয়া গোঁফের ক্রস্‌বি সাহেব আর তাঁর সদ্যবিবাহিতা স্ত্রী'র... রিদ্‌মের চাপাচাপি’তে মানতে বাধ্য হলাম মেজর সাহেব যতই জাঁদরেল চেহারার হোন না কেন, ভদ্রমহিলাকে সত্যি সত্যি অনেকটাই আমার মতন দেখতে... ব্যাস, ছেলে খেপে উঠলো একেবারে, “চল না এই উইকএন্ডে ঘুরে আসি একবার, জাস্ট দ্য সেমেটারিস্‌... উই উইল লুক ফর এ হোয়াইল অ্যান্ড কাম ব্যাক...

ঘ্যানঘ্যান করলে ওকে 'না' বলতে পারিনা কখনও... কে জানে কেন... মোক্ষম ব্যাপারটা হল, রিদ্‌ম্‌ ডাকলে আপত্তি করার ক্ষমতাই থাকেনা আমার... মনে হয় সারাটা জীবন যদি এভাবে হুঠহাঠ ওর সাথে বেরিয়ে পড়া যেত...... ধুর! সেসব কথা ওকে বলাই হয়না আমার... ডিয়ারেস্ট কলিগ, বেস্ট ফ্রেন্ড এই বেশ ভালো আছি... কি দরকার ঝামেলা বাড়িয়ে...

যাগগে সেসব কথা... উইকএন্ড এসে পড়তেই তাই কাল বেরিয়ে পড়েছিলাম... আর আজ অভিযান সঞ্জৌলি...

লেট্‌স্‌ গো ব্যাক দেন ফর নাও,” আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রিদ্‌ম্‌ বলল, “তোকে খুব ক্লান্ত দ্যাখাচ্ছে...
ওক্কে...আমি হেসে বললাম, “একটু বসে নিই? এক্কেবারে হাঁফিয়ে গেছি...

একটা বিশাল রডোডেন্ড্রনের নিচে বসলাম পা ছড়িয়ে। জায়গাটা এম্নিতে বেশ চুপচাপ, তারসাথে গলাজড়াজড়ি করে রয়েছে একটা পুরোনো গন্ধ... সারসার পুরোনো পাথর আর আদ্যিকালের পাহাড়ি গাছেদের ভিড়... মানুষগুলো ঘুমোচ্ছে কে জানে কবে থেকে... ডরোথি ড্যালি, ১৯২৯... ব্যারনাবি মারফি, ১৯৩৪... উইলিয়ম ক্যাহিল, ১৯৩৮... সবাই অঘোর ঘুমে... আগে হয়তঃ প্রতি সপ্তাহে কেউ দেখা করতে আসত... একটা গোলাপ ফুল রেখে যেত ঘুমিয়ে পড়া বুকের ওপর... ছুঁয়ে বসে থাকত... কেঁদে যেত অঝোরে... তারপর কতযুগ, কতযুগ পেরিয়ে গেছে... আর কেউ আসেনা... কেউ আসে না...

ঝুপ করে আচমকা একটা শব্দ হল আমার ঠিক পিছনে! খেয়ালে এমন ডুবেছিলাম যে ভেতর অব্দি কেঁপে গেল আওয়াজ'টায়... উঠে দাঁড়িয়ে পড়লাম হুট করে...

হেই... হোয়াট হ্যাপেন্‌ড্‌?” রিদ্‌ম অবাক হয়ে বলল, “এনিথিং রং?”

জানিনা...! পিছনের ঝোপটার দিকে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ... অন্ধকার করে রয়েছে সাদা ফুল ফোটানো একটা বুনো লতা... আর... আর যেন তার ওপাশ থেকে কেউ দেখছে আমাকে... মনে হল ঝুপসি হয়ে নেমে আসা পাতাগুলো সরানোর অপেক্ষা... কেউ আছে ওখানে...

মিলি...? কি হয়েছে...? বলবি তো...?”
নাথিং!একটা ঢোঁক গিলে বললাম, “বেরিয়ে পড়ি, চ... দেরি হচ্ছে...

সিমলা এলে আমাদের ঠিকানা হয় জেনের বাড়ি। তার দুটি পরিচয়... রিদ্‌মের খুড়তুতো দিদি; আর সোনায় বাঁধানো মনের একজন মানুষ। সারাটাদিন মনিপাল ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসে পড়ে থাকে; আর সন্ধ্যেয় ফিরে দারুণ দারুণ সব গল্প আর তারচেয়েও ভাল ভাল রান্না দিয়ে আড্ডা জমিয়ে দিতে পারে...
বাড়ির সামনে পৌঁছাতেই পাশের দোকানের মেয়েটা দৌড়ে এসে চাবি ধরিয়ে দিল রিদ্‌মের হাতে; সঙ্গে একটা ছোট্ট চিঠি...
খিদে-টিদে পেয়ে গেছে নিশ্চয়ই... রান্নাঘর এবং ফ্রিজ তোমাদেরই... আগুন-টাগুন ধরিয়ে দমকল ডাকা ছাড়া যা খুশি করতে পারো... :)

এই হল জেন... মন'টা ভালো হয়ে গেল এক মিনিটেই...

ঘরে ঢুকে সোফায় এলিয়ে বোস...তালা-চাবি আমার হাতে ধরিয়ে রিদ্‌ম বলল, “আমি একটা দারুণ করে কফি করছি...

সদর দরজায় ছিটকিনি দিয়ে বাগান পেরিয়ে ঘরে ঢুকলাম; বাগান’টা মরসুমি ফুলের ভিড়ে রংরঙিন। বিশাল ওকে গাছটায় ঝিকিয়ে উঠেছে রোদ। বারান্দায় সেই চেনা উইন্ডচিমার'টা হাওয়ায় দুলছে। মন'টা জুড়িয়ে আসছিল। বসার ঘরের সোফায় এলিয়ে থাকবো এখন খানিক, তাহলেই ফ্রেশ হয়ে যাবো। হয়তঃ সত্যিই খুব ধকল হয়ে গেছে, তাই অস্বস্তি হচ্ছিল তখন। 

টেবিলে তালাটা রাখতে গিয়েই জানলার বাইরে চোখ চলে গেল...

একি! সদর'টা হাট করে খোলা...! সঞ্জৌলির ধুকপুকুনিটা হুড়মুড়িয়ে ফিরে এল বুকের মধ্যে... আমি যে... আমি যে এখুনি লাগিয়ে এলাম দরজাটা...!! কে খুলে দিল তাহলে?


হুশ করে জানলার পর্দাটা উড়ে চোখ ঢেকে দিল আমার... আর সঙ্গে সঙ্গে কিরকম একটা অস্বস্তি পাক দিয়ে উঠল সারা শরীরে... মনে হল যেন ঠিক আমার পিছনে দাঁড়িয়ে কেউ দেখছে আমায়...!!

[পরের কিস্তি'তে শেষ]

- Copyright © পাঁচমিশেলি - - Powered by Blogger - Designed by সায়ংতরী -