Popular Post

Archive for December 2012

ফান টু সি

By : Sayantari Ghosh



আজ আতস কাচটাকে তাক থেকে পাড়ার আগে আসুন ভাবা যাক কয়েকজনের কথা;তাদের আমরা দৈনন্দিনে দেখি বটে, কিন্তু খুব যে একটা খেয়াল করি, খুব যে একটা ভাবতে বসি তাদের কথা, খুব যে কিছু করতে চাই তাদের জন্যে, তা নয়।ঘটনাচক্রে, আজ যাদের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছি, তারা সকলেই নারী, প্রত্যেকেই বিবাহিতা, তবে না, আপনি যা ভাবছেন তা নয়, তারা শ্বশুরবাড়িতে লাঞ্ছিতা নন, কেউ তাদের গায়ে হাত তোলে নি, কেউ তাদের খাদ্য-বস্ত্রের সংস্থান নিয়ে অভিযোগ করার সুযোগ দেন নি, মা-বাবা পণ দিতে পারেনি বলে কেউ তাদের গায়ে আগুন দিতে আসে নি বা পরপর তিনবার কন্যাসন্তানের জন্ম দেওয়ার অপরাধে তারা অপরাধীও নন।অর্থাৎ সেদিক দিয়ে ভাবতে গেলে তারা নিগৃহিতা বা অত্যাচারিতা নন, এমন একটা ধারণাই আপনি-আমি পোষণ করে থাকি।আসুন, একবার দেখি তারা কেমন আছেন?

১   প্রথমে কল্পনা করুন এমন একটা ছবি, যেখানে রয়েছেন এক পঞ্চাশোর্ধ দম্পতি।স্ত্রী তার স্বামীর হাতে তুলে দিচ্ছেন নিজের সাধের গয়নার বাক্সখানা আর স্বামীও গদগদ আপ্লুত মুখে বলছেন, “দাও, দাও, এ’সব আর তোমায় তেমন মানায়ও না...” মজার ব্যাপার হল, যে আপনার সাধারণ ভাবে মনে হবে,গয়নার বাক্স স্বামীর কোনো জরুরী দরকারে কোথাও বন্ধক রাখার কাজে দিচ্ছেন হয়তঃ ভদ্রমহিলা, কিন্তু সে রকম কিছু মোটেও না, উনি ওগুলো দিচ্ছেন স্বামীর বছর পঁচিশেকের নতুন প্রেমিকার জন্যে...!......কেন বলুন তো?......শুধু এই আশায় যে যদি এই সুযোগে, তাঁর এতবড় স্বার্থত্যাগের নজির দেখে স্বামী তাকে একটুখানি ভালো আবার করে বেসে ফেলেন কোনো ফাঁকে......কোনোভাবে যদি...

২  এবার, ভাবুন এ’রকম একটা দৃশ্য, যেখানে স্বামী যখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান কাজে, তখন সারাদিনের জন্য একটা হিংস্র, মানুষখেকো পাখি’কে রেখে যান সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী এর পাহারায়...!‘ভালোবাসি, তাই সুরক্ষা দিতে চাই’ এই হয় এই দৈনন্দিন পাহারার অজুহাত।পাখিটা মাথার ওপর গন্ডি কাটে, হাড়-হিম-করা চিতকার করে ডাকে আর গন্ডির বাইরে পা বাড়ালেই মাংস খুবলে খেতে চায়......স্বামী কিন্তু তখনও বলেন, ‘ভালোবাসি, তাই সুরক্ষা দিতে চাই’...

৩  তৃতীয় দৃশ্যে চলে আসি, আসুন।ছবিটায় আছেন এক আধুনিকা অর্ধাঙ্গিনী।সে স্বাধীনচেতা, শিক্ষিতা, বুদ্ধিমতী, স্বাবলম্বী।যেহেতু সে কথায় কথায় স্বামীর পায়ে লুটিয়ে পড়তে পারে না, যেহেতু সে পায়ের কাছে কাদা হয়ে পড়ে থাকতে শেখে নি, তাই বিয়ের কিছুদিনের মধ্যেই তার এই কোমলতাহীন সৌন্দর্য্য স্বামীকে টানে না আর।যুদ্ধে তছনছ হয়ে যাওয়া দেশ ছেড়ে আত্মরক্ষার আশ্রয় খুঁজে নিয়ে বেরিয়ে পড়ার সময় স্বামীর মনেই থাকে না মেয়েটির কথা!তিনি ভুলেই গেছেন তখন সাগ্নিক সপ্তপদীর শপথগুলো।মেয়েটি বেপরোয়া হয়ে পড়ে।কখনও অস্ত্র হাতে তুলে দুনিয়ার কাছে প্রমাণ করতে চায় নিজের যোগ্যতা, কখনো বা অযোগ্য কারো সাথে প্রেমের ভনিতায় প্রমাণ করতে চায় স্বামীর কাছে যে তার প্রেমে এখনও কেউ পড়তে পারে...এ কি খালি স্বামীর কাছে প্রমাণ করার চেষ্টা?জগত সংসারের কাছে প্রমাণ করার বাসনা?না কি নিজের কাছেও......

৪  শেষ দৃশ্য।ভয়ানক দৃশ্য।ভাবুন, জাস্ট ভাবার চেষ্টা করুন একটি এমন মেয়ের কথা, যার স্বামী ঘুমিয়ে আছে...!জীবিত, শ্বাস প্রশ্বাস চলছে, জেগে ওঠে এক বছরে একবার...উঠে স্বামীসুলভ সব অধিকার সব জোরজুলুম একবার ফলিয়ে নেয় স্ত্রী’র ওপরে।একদিন জেগে থাকে।একটা দিন।তারপর আবার কালঘুম...এক বছর আবার সব চুপচাপ.........

চরিত্রগুলোকে চিনতে পারলেন?চেনা-চেনা লাগলো, ভালোবাসার নামে, ‘বিবাহ’ নামক প্রহসনের নামে, ‘পতি পরম গুরু’ স্লোগানের আস্ফালনে অন্ধকুঠুরিতে বন্দিনী এই মেয়েগুলোকে?কি বললেন?আমাদের আশেপাশেই দেখেছেন মনে হল?ঠিক বলেছেন!তবে কি জানেন, আমার সাথে এদের দ্যাখা হল অন্যভাবে।

দেখতে গেছিলাম ‘সুন্দরম’এর নাটক ‘আশ্চৌর্য ফান্টুসি’।আর ওই দু’ঘন্টায় খুচরো হাসির ফাঁকতালে ভীষণ ভাবে খেয়াল করতে বাধ্য হলাম যে, মহাকাব্যের আড়ালে, যাকে বলে টাইম ইম্মেমোরিয়াল, সেই তবে থেকে ওরা ছিল আমাদের পাশেই।আমরাই কে জানে কি করে এতদিন খেয়াল করি নি।রাবণের স্ত্রী মন্দোদরী, মহাকাব্যের নায়িকা সীতা, বিভীষণের স্ত্রী সরমা আর কুম্ভকর্ণের স্ত্রী বজ্রমালা।ওরা ছিল।আমরা দেখি নি।আর তাইই হয়তঃ ওরা আজো রয়ে গেছে।

তবে এখানেই থামেন নি নাট্যকার।ওদের এই ভালো-থাকার সমস্যার একটা বিহীত করতে টেনে এনেছেন হনুমতী’কে!আজ্ঞে না, একে পাবেন না মহাকাব্যে।কিন্তু সেদিনের নাটকের বক্তদ্যটাই ছিল এ’রকম।যদি ধরুন, হনুমানের বদলে কোনো এক হনুমতী যেত সীতার কাছে রামের অঙ্গুরীয় নিয়ে?তা’হলে?তা’হলে কি রামায়ন লেখা হত একই ভাবে?

এই বদলটুকুর কারণে নাটকের নাম, ‘আশ্চৌর্য ফান্টুসি’।ভেঙে ভাবতে গেলে দাঁড়ায় আশ্চর্য চৌর্য আর ফান্টুসির সন্ধি-বিচ্ছেদে ফান-টু-সি।অর্থাৎ কি না যে অবাক করা চৌর্যবৃত্তি দেখতে ভারী মজা।বাল্মীকি রামায়নের গল্পের এমন সার্থক চৌর্যবৃত্তিকে স্বাগত!দু-ঘন্টার জমজমাট গানে গানে ভরা চিত্রনাট্য।‘ও আকাশ’, ‘আমি কবে হবো আমার’ এই গানগুলো নাটক শেষ হওয়ার অনেক পর পর্যন্ত কানে লেগে থাকে।নাটকটির চিত্রায়ণ গ্রামবাংলার পালাগানের সাথে মিল রেখে।এই বাঙালিয়ানা আর folk-মেজাজ আপাদমস্তক দূর্ধর্ষ।জয় সেনের পাপেট আর আলোর কাজ অনবদ্য।গানের সুর করেছেন ভূমি’র সৌমিত্র রায়।আর গানের কথা স্বয়ং নাট্যকার-কাম-নির্দেশকের।

সেদিন আকাদেমি থেকে মন ভর্তি করে রঙীন বুদবুদ সামলে আনতে আনতে তুলট কাগজের ধূলোটে মহাকাব্যটিকে নতুন করে চিনলাম যেন।সত্যি করে ভাবতে গেলে, হনুমানের পক্ষে খেয়াল করা সত্যিই মুশকিল যে আপাতসুখী সোনার লঙ্কা জুড়ে এতগুলো মেয়ে মোটেই ভালো নেই।খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থানের অভাব না থাকলেও তাদের জীবনে কতগুলো অতি প্রয়োজনীয় জিনিসের হাহাকার চলছে।যেমন, যথাযোগ্য সম্মান, খানিকটা মর্যাদা, একটুখানি ভালোবাসা।এই সত্য আবিষ্কারের জন্য একটি হনুমতীরই প্রয়োজন।যে কোনো বাধা মানে না।পাহাড়ী ঝর্ণার মত যে মুক্ত।যে কারো দাসী হতে শেখে নি।যা ঠিক বলে বোঝে, তাই করে।এমন একটি লক্ষ্মীছাড়া, বিশ্ববখাটে, অবাধ্য মেয়েই পারে ওদের’কে নিয়ে নতুন দেশের দিকে নাও ভাসাতে।

মনোজ মিত্র যে কেন বাংলা নাটকের লেজেন্ড, তা এতদিনে হাড়ে হাড়ে টের পেলাম।


- Copyright © পাঁচমিশেলি - - Powered by Blogger - Designed by সায়ংতরী -