Popular Post

Posted by : Sayantari Ghosh Tuesday, May 24, 2016



[প্রথমার্ধের পর...]

-“কুছ পরেশানি হ্যায়?” লোকটা আবার বলল, শান্ত, নিরুত্তাপ গলা, “গাড়ি মে প্রবলেম? হম দেখে ক্যা?”

মাধবী এক মূহুর্ত সময় নিল নিজেকে সামলে নিতে, তারপর বলল, “নহি, গাড়ি নহি, হোটেল...”
- “হমকো গাড়ি মালুম, হোটেল মালুম...একই রকম শান্ত স্বর, “আইয়ে হামারে সাথ... হম লেকে চলেঙ্গে...”
- “পতা হ্যায় আপকো? হোটেল গ্রিন প্যারাডাইস?”
- “হাঁ জি... আইয়ে হামারে সাথ... হম লেকে চলেঙ্গে আপকো...

মূহুর্তের মধ্যে একজোট হয়ে গেল ওরা সকলে!

-“তাই নাকি! বড়িয়া হ্যায় ভইয়া!”
- “ভগবান নাকি ভাই তুমি! উফফ, কি বাঁচাটাই না বাঁচালে!”
-“নিসার, মিতালী জলদি আয়, থ্যাঙ্কু ভাই... অনেক অনেক থ্যাঙ্কু!”

পকেট থেকে একশ টাকার একটা নোট বের করে এগিয়ে দিল মানিক, “বহোত সুক্রিয়া...”... লোকটা কিন্তু টাকা নিল না, “হামকো পেরাডাইস হোটেল মালুম... চলিয়ে... পঁহুচকে প্যায়সা দেনা...”
-“গ্রিন প্যারাডাইস...”
-“হাঁ জি... গাড়ি স্টার্ট কিজিয়ে..”
-“আপ ফ্রন্ট সিট মে আ জাইয়ে” লোকটাকে ডাকলো মানিক।
-“নহি সাব, হম বাহার হ্যায় সাব, আপ চলিয়ে...” বলে লোকটা মাধবীর পাশের জানলাটা হাতে করে ধরে ফুটরেস্টের ওপর উঠে পড়লো। মানিক উঠে পড়ল ড্রাইভিং সিটে, গাড়ি ছেড়ে দিল। জানলার কাঁচ একটু খোলা, লোকটার মুখ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না আর, কিন্তু কথা পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে...

-“সিধা চলিয়ে... অব বাঁয়ে... চলিয়ে... সিধা... হাঁ জি... ডাঁয়ে মুড়িয়ে আগে সে...”

ডাইনে... বাঁয়ে... ডাইনে... বাঁয়ে...  গাড়ি চলেছে লোকটার নির্দেশমত... রাস্তা খুব একটা সরু নয় এদিকে, কিন্তু বেশ ভাঙাচোরা... হেডলাইটের আলোটা মাতালের মত টলতে টলতে চলেছে যেন। এদিকটায় ওরা আগেরবার আসেনি। লোকটা সত্যিই রাস্তা’টা চেনে, ওর কথায় কোনো জড়তা কোনো দ্বিধা নেই!

-“অভি সামনে চলিয়ে... হাঁ জি... ইয়ে আগে সে রাইট...”

বেশ তাড়াতাড়ি এগোচ্ছিল ওরা। জানলার কাঁচের ফাঁকটুকু দিয়ে তীরের ফলার মত শিরশিরে হাওয়া ঢুকছে। মাধবীর চোখ বুজে আসছিল ক্লান্তিতে... উফ... আর একটু... তারপরেই গরম ঘর... নরম বিছানা...

-“সামনে’সে অউর এক টার্ন বাবুজি... লেফট... উয়ো আ গয়া আপকা গিরিন প্যারাডাইস...” বলল লোকটা। 

আর তখুনি মাধবীর মনে হল জানলার বাইরে থেকে লোকটা যেন হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে! যেন উড়ে যাচ্ছে এক টুকরো কাগজের মত, যেন একটা ছবি হয়ে উড়ে চলে যাচ্ছে জানলার বাইরে দিয়ে, এক চিলতে নিষ্ঠুর হাসি লেগে আছে যেন সেই ছবিটার ঠোঁটের কোণে। ব্যাপারটা বুঝে উঠে মাধবীর কিছু বলার আগেই মানিক স্টিয়ারিং ঘোরালো বাঁদিকে... আর সঙ্গে সঙ্গে একটা প্রচন্ড শব্দ, তোলপাড় ঝাঁকুনি আর ঘষটে যাওয়া চাকার তীব্র আর্তনাদ! মনে হল পৃথিবী আর আকাশ একসাথে তালগোল পাকিয়ে গেল যেন। মাধবীর কপাল’টা খুব জোরে ঠুকে গেল কিছু’তে, ও শুধু বুঝতে পারল একটা ভীষণ অঘটন ঘটে গেছে, গাড়ি’টা খাদের ঢাল বরাবর পিছলে চলেছে নিচের দিকে, অভিকর্ষ ছাড়া আর কারো কথা শুনছে না! ভয়ে চোখ বন্ধ করে নিল ও!

*****

এক মিনিট বাদে যখন চোখ খুললো গাড়ি’টা একটা বড় গাছের গায়ে মুখ গুঁজে দাঁড়িয়ে। যে রাস্তা’টা দিয়ে ওরা যাচ্ছিল, সেটা দেখাই যাচ্ছে না কোথাও আর!

-“সবাই ঠিক আছিস?” সোহমের গলা। নিসার পিছনের সিট থেকে সাড়া দিল একটা হালকা গোঙানি’তে, মিতালী তখনও মাধবীর হাত’টা আঁকড়ে ধরে আছে। মানিকের কপাল থেকে দরদর করে রক্ত পড়ছে।

আস্তে আস্তে দরজা খুলে মাধবী নেমে এল গাড়ি থেকে। রাস্তা’টা এবার দেখা যাচ্ছে, বোঝা যাচ্ছে যে প্রায় পনের-কুড়ি ফুট উপর থেকে সটানে নিচে পড়েছে গাড়ি’টা। দেওদার গাছ’টার গায়ে হেলান দিয়ে তিরিশ ডিগ্রি কোণে ঝুলে আছে খাদের দিকে মুখ করে। পাশেই পড়ে আছে “রোড এন্ড্‌স হিয়ার” লেখা একটা তুবড়ে যাওয়া সাইনবোর্ড, বোঝা যাচ্ছে গাড়ির ধাক্কা’তে সেটিও ওদের সাথেই রাস্তা ছেড়ে এখানে এসে পড়েছে। সামনে এক ফুটের পরেই ঝুপ করে নেমে গেছে অন্ধকার অতল পাইনের সারি। ওরা যে ওই খাদে তলিয়ে যায় নি, এখনও বেঁচে আছে সেটাই আশ্চর্যের!

-“সবাই ঠিক আছিস তো?” সোহম আবার প্রশ্ন’টা করলো। এক এক করে সকলেই নেমে আসছে তখন গাড়িটার থেকে।

-“গাইড’টা কোথায় গেল? গাইড’টা?”

মাধবী কিছু বলতে পারল না। লোকটা ওর চোখের সামনে সত্যিই কি মিলিয়ে গেল হাওয়ায়?? ঠিক দেখেছিল কি ও? না কি চোখের ভুল? কে জানে...

****

একে অপরের হাত ধরে যেন একটা ঘোরের মধ্যে ওরা সেই গভীর রাতে পাহাড় ভেঙে উপরে উঠে এল। ভাঙাচোরা রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সদ্য হয়ে যাওয়া অ্যাক্সিডেন্টের ছাপ...  উপড়ে যাওয়া সাইনবোর্ড’টার লোহা, গাড়িটার ছোটখাটো এক-দুটো খুলে পড়া পার্টস... হোঁচট খেতে খেতে ওরা হাঁটা দিল ফিরতি পথে, মোবাইলের নিবু নিবু আলো’তে সদ্য আসা গাড়ির টায়ারের দাগ দেখে হাঁটতে থাকলে ভোররাতের আগে পৌঁছে’ই যাবে নিশ্চয়ই বাজার এলাকাটায়।

ওরা হাঁটছিল, কিন্তু কারো মুখে কোনও কথা ছিল না। সকলেই বোধহয় ব্যস্ত নিজের মত করে ধাঁধাটার উত্তর খুঁজতে। মনের ভেতর হাজারটা প্রশ্ন উত্তাল হয়ে উঠছে প্রতি মূহুর্তে... কে ছিল লোক’টা? কোথায় উবে গেল হঠাত্‌? চোর-ডাকাত হলেও হয়তঃ এর থেকে সহজ হত ব্যাপার’টা বোঝা। কেন কয়েকজন ট্যুরিস্ট’কে বাজারের মাঝখান থেকে এই শেষ হয়ে যাওয়া রাস্তায় টেনে এনে খাদে ফেলে দিতে চাইল? পাগল কি? না কি ফ্রাস্ট্রেটেড নেশাখোর মাতাল কোনো? উন্মাদ কোনো খুনি? না কি আরো অবিশ্বাস্য অভাবনীয় কিছু?

ওরা হাঁটছিল। মাঝেমাঝে চোটের ব্যথা জানান দিয়ে যাচ্ছিল, মাঝেমাঝে নাড়া দিয়ে যাচ্ছিল গা ছমছমে ভয়। মাঝরাত পেরিয়ে গেছে। আকাশে এক ফোঁটা মেঘ নেই। চাঁদ উঠছে আস্তে আস্তে। খাদের মধ্যেকার অতলান্ত সবুজ পাইনের জঙ্গল থেকে হু হু করে উল্মাদ হাওয়া ছুটে চলেছে। যেন একসাথে মাথা দুলিয়ে অট্টহাসি হাসছে শয়তানের শাগরেদের দল, “হম লেকে চলেঙ্গে আপকো... উয়ো আ গয়া আপকা গিরিন প্যারাডাইস...”

[শেষ]

Leave a Reply

Subscribe to Posts | Subscribe to Comments

- Copyright © পাঁচমিশেলি - - Powered by Blogger - Designed by সায়ংতরী -