Popular Post

Posted by : Sayantari Ghosh Sunday, March 17, 2013



রবীন্দ্রনাথ ‘নষ্টনীড়’ লিখেছিলেন ১৯০১ সালে। সত্যজিত রায়ের ‘চারুলতা’ রিলিজ করে ১৯৬৪’র এপ্রিলে। ‘চারুলতা ২০১১’ এল ২০১১’তে,‘আমি চারুলতা’ আসতে চলেছে ২০১৩ তে। অর্থাৎ হিসেব অনুযায়ী দেখতে গেলে আমরা এক শতাব্দীকাল ধরে বার বার চারুলতার কাছে ফিরেছি। বার বার নানাভাবে আমরা চিনতে চেয়েছি সেই চারু কে ‘কাগজের আবরণ ভেদ করিয়া স্বামীকে অধিকার করা’ যার পক্ষে ‘দুরূহ’ হয়েছিল। ভূপতি,অমল আর চারু,এই তিনটি চরিত্রের হাত ধরে মনের আলো-অন্ধকার হাতড়ে হাতড়ে বেড়ানোটাকে বোধহয় ভালোবেসে ফেলেছি আমরা সকলেই। আরেকবার সেই একই অভিজ্ঞতা’কে অন্যভাবে অনুভব করতে গিয়েছিলাম স্টার থিয়েটার;‘যোজক’ সপ্তাহশেষের এক জমজমাট আসর বসিয়েছিল রবীন্দ্রনাথের জন্মসার্ধশতবর্ষ উদ্‌যাপনে। আর সেই আসরের শেষ নাটক ছিল ‘নষ্টনীড়’। অবশ্য নাটক না বলে ‘যোজক’ তাদের পরিবেশনার নাম দিয়েছিল সিনে-প্লে,সিনেম্যাটিক থিয়েটার।



গৌতম হালদার নিজে সিনেমা ও নাট্যজগতের একজন সফল পরিচালক। এবং উনি ভীষণ ভার্সেটাইল। ওনার আরেকটি সাঙ্ঘাতিক গুণ হল,প্রিয় লেখকদের প্রিয়তম কাহিনীগুলি নিয়ে নাটকের ফাটাফাটি এক্সিকিউশনে উনি অনবদ্য। নান্দীকারের সফল নাটক ‘বড়দা’(মুন্সি প্রেমচন্দ),‘চোখ-গেল’ (তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়),‘বাপ্পাদিত্য’ (অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর),‘দুলিয়া’ (লীলা মজুমদার),‘সজন বাদিয়ার ঘাট’ (জসীমুদ্দিন) এবং আরো অনেক নাটক তাঁর এই দক্ষতার জলজ্যান্ত প্রমাণ। এবার ‘যোজক’এর সাথে উনি হাত দিয়েছেন শহর কোলকাতার প্রথম সিনে-প্লে নির্মানে;প্রথম পছন্দের কাহিনীকার অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ আর কাহিনী ‘নষ্টনীড়’। খবরটা কানে যেতেই প্রাথমিক প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছিলুম। অপেক্ষা ছিল সপ্তাহান্তের,প্রস্তুত ছিলাম চমকে যাওয়ার জন্য। একটা ভিন্ন জাতের আনন্দের জন্য যেটা মেলে পুরোনো চিঠির ভেতর বছর কুড়ি পরে নতুন কোন সংকেত আবিষ্কারে।

কিন্তু নাটকের দিন সকাল থেকে সব কেমন গোলমাল হয়ে গেল। কাজ মিলল না,তার ওপরে তুমুল বর্ষণ। বৃষ্টি মাথায় করে,কাদায় সালোয়ার লেপ্টে ফেলে,আধঘন্টা স্টার থিয়েটারের দরজার লাইন দিয়ে ঢুকতে পেলুম। চেনাশোনা নামের আনাগোনা চারদিকে,গৌতম হালদার,দুলাল লাহিরী,রীতাভরী,শুভ্রজিত... তবু কেন জানি না,কাজের চাপেই হয়তঃ,মনে মনে বেশ ভারাক্রান্ত লাগছিল। মনে হচ্ছিল,সারাদিনের মত নাটকটাও ঝুলিয়ে দেবে নিশ্চয়ই। মুঠোফোনগুলি’কে নীরবতায় স্থান দেওয়ার হাল্কা কিছু পরিচিত অনুরোধ যখন চলছে,তখনও আমি নিজের আসনে একটু যেন অস্বস্তিতে। কিন্তু তারপর... তারপর যেন ডুবে গেলাম একটা যাদুমন্তরের ভেতরে। হুঁশ ফিরলো সমবেত হাততালির শব্দে। দু’ঘন্টা কোথা দিয়ে যেন পেরিয়ে গেছে। মনের ভেতর তখন শুধুই উথাল-পাথাল করছে হাজার’টা সংলাপ,হাজার’টা অনুভব।

‘নষ্টনীড়’এর কাহিনী নিয়ে তো আর নতুন করে কিছু বলার নেই। কাহিনী আমাদের চারু’র,যার অযথা-কাজে-আটকে-থাকা স্বামীর সময় হয় না তার দিকে তাকানোর। কেউ সে কথা মনে করিয়ে দিলেও তিনি চারুর সঙ্গী হিসেবে এনে দেন ‘শ্যালকজায়া মন্দাকিনীকে’। এ এক এমন গৃহস্থালীর গল্প যেখানে বিবাহিত জীবনের প্রাথমিক উচ্ছ্বলতাটাই নেই,যেখানে চারুলতা আর ভূপতি ‘নূতনত্বের স্বাদ না পাইয়াই উভয়ে উভয়ের কাছে পুরাতন পরিচিত অভ্যস্ত হইয়া গেল’। নিতান্ত একাকীত্বে,ঔদাসীন্যে স্থির হয়ে থাকা চারুর জীবনে একমাত্র নতুনত্ব যদি কিছু থেকে থাকে,তবে তা হল  ভূপতির পিসতুতো ভাই অমলের দৌরাত্ম,তার আবদার,তার নিত্যনতুন চাই-চাই। চারু’র সমস্যা ছিল এই যে ‘তাহার কাছে কেহ কিছু চায় না,অমল চায়-- সংসারে সেই একমাত্র প্রার্থীর রক্ষা না করিয়া সে থাকিতে পারে না।... প্রত্যেক বারেই চারুলতা আপত্তি প্রকাশ করিয়া কলহ করে এবং প্রত্যেক বারেই বহু যত্নে ও স্নেহে শৌখিন অমলের শখ মিটাইয়া দেয়...’ শুধু তাই নয়,চারুর পড়াশোনার সখ,তার বাগান করার গল্প,অমলের কাব্য নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা,তার পান থেকে শুরু করে কার্পেটের জুতোর আবদার... সব মিলিয়ে এই সম্পর্কে লাগে এক খুব কাছের,বড় নিজের বন্ধুতার রঙ। কিন্তু অমল তো চারুর জীবনের চিরস্থায়ী সত্য নয়,সেই সত্যের নাম ভূপতি। সম্পর্কের এই দোলাচলের নাম’ই ‘নষ্টনীড়’।

কিন্তু এখানেই কি শেষ?তা নয়। সত্যজিত রায়ের চারুলতা আর রবীন্দ্রনাথের নষ্টনীড়ের একটা বড় তফাত শেষ দৃশ্যে। অমলের চলে যাওয়ায় চারুলতার ভেঙে পড়াতেই কিন্তু রবীন্দ্রনাথ গল্পটাকে শেষ করে দেন নি। শেষ পর্যায়ে ভূপতির স্বগতোক্তি’তে বুঝতে পারি,এ কাহিনীর সারমর্ম শুধু ত্রিকোণ-প্রেম আর একাকীত্বেই শেষ হয়ে যায় না। দেখতে পাই,চারু অমল কে ভালোবাসে বুঝতে পেরে ভূপতি খুব সহজে ভাবতে পারে,‘আমার কথা সে একবার ভাবিয়া দেখিল না?... নির্জন বন্ধুহীন প্রবাসে প্রত্যহ তাহাকে সঙ্গদান করিতে হইবে?সমস্ত দিন পরিশ্রম করিয়া সন্ধ্যায় যখন ঘরে ফিরিব তখন নিস্তব্ধ শোকপরায়ণা নারীকে লইয়া সেই সন্ধ্যা কী ভয়ানক হইয়া উঠিবে। ... যে আশ্রয় চূর্ণ হইয়া ভাঙিয়া গেছে তাহার ভাঙা ইঁটকাঠগুলা ফেলিয়া যাইতে পারিব না,কাঁধে করিয়া বহিয়া বেড়াইতে হইবে?’ চারু অমল কে ভালোবাসে বলে ভূপতি খুব সহজে বলতে পারে,তোমাকে সঙ্গে নিয়ে চলা?‘না,সে আমি পারিব না...’
এ তো খুব সহজ স্বাভাবিক বক্তব্য স্বামীর ক্ষেত্রে,তাই না?বিবাহিতা স্ত্রী পরপুরুষে সমর্পিত-প্রাণ বোঝার পরে এই মনোভাবই তো হওয়া উচিত পতিদেবের...! আজকের দিনেও অজস্র মানুষ ভূপতির সঙ্গে একমত হয়ে যাবেন। এর প্রতিবাদ করতে গেলে ফেমিনিস্ট আখ্যা জুটতে বাধ্য। কিন্তু একশ বছরেরও বেশি আগে রবীন্দ্রনাথের চারুলতা ভূপতির দয়াপরবশতা কে প্রত্যাখ্যান করেছে,দৃঢ়কন্ঠে বলেছে,‘না থাক্...!’ এই একবিংশ শতকেও ক’জন সহধর্মিনী চারুলতার মত বলতে পারে,‘না থাক্’...?

রবীন্দ্রনাথের চারুলতার এই কাহিনীকে জীবন্ত হতে দেখলাম সেদিন স্টারে। গৌতমবাবু গল্পের আধুনিকীকরনের বিন্দুমাত্র চেষ্টা করেন নি। নাটকের সময় তাই ১৮৭০-৮০ তেই বাঁধা। কিন্তু শতাব্দীপ্রাচীন গল্পে এই শতকের রঙ লাগিয়েছে টেকনোলজি। আগে শুটিং হয়ে যাওয়া প্রি-এডিটেড কিছু দৃশ্য অসাধারণ আলো-শব্দের কারসাজিতে একাত্ম হয়ে গেছে স্টেজের লাইভ পারফর্মান্সের সাথে। চারুর জানলার বাইরে উন্মত্ত ঝড়,ছাদ থেকে চারুর ছুটতে ছুটতে ঘরে ফিরে আসা,জানলা দিয়ে দ্যাখা বাগানের দৃশ্য আর আয়নায় টিপ পরতে পরতে ‘বৌঠান’ ডাকের সাড়া দেওয়ার দৃশ্যগুলি রোমাঞ্চকর লাগে রীতিমত। Computer-Generated Imagery,যেটা মূলতঃ ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির ব্যবহার্য,তার তুলনাহীন ব্যবহারে তাক লেগে যায়। একাঙ্ক থিয়েটারের সীমা’কে ছাড়িয়ে স্ক্রিন আর সিনক্রোনাইজেশনের দূর্দান্ত নমুনা রেখে ‘যোজক’এর শিল্পীরা কার্যতঃ অবাক করে দেন দর্শককে। আর উপরি-পাওনা হিসেবে জুটে যায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কন্ঠের ভাষ্যপাঠ!
আগেই বলছিলাম,আমি যখন স্টার থেকে বেরোলাম সে দিন,মনের ভেতর সংলাপের ভিড়,অনুভবের আনাগোনা। একশ রকম যেন একসাথে খেলা করছে বুকের ভেতরে,কিন্তু তবু তার মধ্যে হলে ঢোকার আগের সেই মন-ভার’টা যেন কোথায় হারিয়ে গেছে দেখলাম। তখন স্বপ্নের মত কতকিছু মনে হতে লাগল,মনে হল বাসা বাঁধতে গেলে যে খড়কুটোগুলো লাগে সেগুলোর নাম ভালোবাসা-ভালোবাসা... সেগুলোর রঙ নীল,সবুজ,গোলাপী,আকাশি,কমলা... এই যে ছুটছি,রোজ হাঁপাতে হাঁপাতে ডেলিরুটিনের কাজগুলো সামলে ফেলছি রোজ,যদি এক মূহুর্ত সময় দি নিজেকে ভাবার এ সবের মাঝে,‘আমি সেই রঙগুলো হারিয়ে ফেলিনি তো...?’ যদি ওটুকু সময় নষ্টই করি,খুব কি ক্ষতি হয়ে যাবে?

দেরি হয়ে গেছিল একটু। সাড়ে ন’টার সময় যখন হাতিবাগানের মোড়ে হাত দেখিয়ে বাস’টাকে দাঁড় করিয়ে উঠে পড়লাম,তখন একটা কথাই মনে হয়ে গায়ে কাঁটা দিল হঠাৎ,‘ভদ্রলোক আজও কি সাঙ্ঘাতিক ভাবে রেলেভেন্ট... উফফ...’

Leave a Reply

Subscribe to Posts | Subscribe to Comments

- Copyright © পাঁচমিশেলি - - Powered by Blogger - Designed by সায়ংতরী -