Popular Post

Posted by : Sayantari Ghosh Thursday, April 21, 2016



চার
হাসপাতালটা জুড়ে একটি মেয়ের মোলায়েম গলা মাঝেমধ্যেই ছড়িয়ে পড়ে... একতলার রিসেপসন থেকে সেই কন্ঠস্বর অনাগত অনাহুত ভবিতব্যের কথা ইঙ্গিতে বলে দেয় প্রায়শই...
—“রিলেটভ্‌স্‌ অফ দ্য পেশেন্ট ইন বেড নাম্বার ‘দিস’ অফ আই.সি.ইউ আর রিকোয়েস্টেড টু কাম অ্যাট দ্য রিসেপসন। দ্য ডক্টর নিড্‌স্‌ টু টক... ইট্‌স্‌ অ্যান এমারজেন্সি...”
তিনতলার লাউঞ্জে বসে কান পেতে থাকে দিনরাত-জাগা একদল মানুষ... বুকে শুধু প্রার্থনা... “কোনোভাবে ওই কন্ঠস্বরে যেন ওর নাম না থাকে!!” লাউঞ্জটা বদলায় না... পাঁচদিনে এ ব্যাপারটা খেয়াল করেছে টুপুর... মুখগুলো পালটে যায় খালি... চোখের ক্লান্তি দিনে দিনে বাড়ে... কথাকে সরিয়ে দিয়ে নীরবতা জিতে যায়... তারপর হুট করে একদল মানুষের কালিপড়া মুখ একদিন অদৃশ্য হয়ে যায় লাউঞ্জের ক’টা চেয়ার খালি করে দিয়ে... গল্পের বাকিটুকু বাকিরা বুঝে নেয় বিনা চেষ্টায়... দীর্ঘশ্বাস বলে দেয়, কোন একটি গল্প চিরতরে ফুরিয়ে গেছে...!
টুপুর আর শুভ হাসপাতালে পা রাখা মাত্র ভীষণ শব্দ করে একটা বাজ পড়ল কোথাও... একেবারে ভিতরে কোথাও একটা রিন্‌রিনে কাঁপুনি ধরিয়ে দিল যেন... আর সঙ্গে সঙ্গে হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি নেমে গেল... যেন ওদের জন্যই পুরো ব্যাপারটা থেমে ছিল এতক্ষণ।
এগিয়ে গিয়ে একটা খালি চেয়ারে বসল টুপুর। শুভকে হাতছানি দিয়ে ডেকে নিলেন প্রভাসকাকু; বোধহয় বিলিং সেকশনে যেতে হবে! এদিকে তিনটে থেকে ভিজিটিং আওয়ার। পুরো সময়টাতে জাস্ট একজনকে ঢুকতে দেয়... কথা নয়, ছোঁয়া নয়, শুধু এককোনে দাঁড়িয়ে দেখা আর ফিরে আসা... তবুও... দেখতে ইচ্ছে টুপুরেরও করেছে, বার বার। কিন্তু............ হয় নি!
মাথাটাকে দুহাত দিয়ে ধরে মেঝের টাইল্‌সে চোখ রাখল টুপুর। আজ আবার হয়তঃ বড়পিসি যেতে চাইবে। দেখে এসে আবার কান্নাকাটি করবে। কাউকে ওভাবে কাঁদতে দেখলে ভয়ানক অসহায় লাগে নিজেকে... খুব খুব রাগ হয়... অথচঃ কার ওপরে রাগ, সেটাই ঠিক বোঝা যায় না!
কাঁধে একটা ছোঁয়া পেয়ে চোখ খুলল টুপুর। বাপি।
—“কিছু বলবে বাপি?”
আস্তে আস্তে হাতটা ওর মাথায় দিল বাপি, “আজ যাবি তুই ভিতরে? দেখে আসবি একবার?”
চুপ করে বাপির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল টুপুর; তারপর হাত বাড়িয়ে বাপির হাতটা শক্ত করে ধরল...
মাঝেমাঝে কি করে কে জানে বাপি এত বোঝে ওকে? কি করে কে জানে এত হিসেবের মাঝেও ওর মনের এতটুকু ভালোলাগার কথা মনে রাখে...? এখনও মাঝে মাঝে তাই ছোট্টবেলার মত বলে উঠতে ইচ্ছে করে, “আমি আমার বাপির মতন হব!” মনে মনে নয়... জোরে বলে উঠতে ইচ্ছে করে...!
—“এখন তো সবে দেড়টা... একটু রেস্ট করে নে... চুপ করে চোখ বন্ধ করে থাক একটু... ঘুম এলে ঘুমিয়ে নে... আমি ডেকে দেব ঠিক সময়ে...”, বলে আলতো করে একটু হাসলো বাপি।
কোণের চেয়ারটায় বসে দেয়ালজোড়া কাঁচটার দিকে চোখ ফেরালো টুপুর... গোটা দেয়ালটা জুড়ে আল্পনার খেলায় মেতেছে বৃষ্টি... বাকি সব ভুলে গিয়ে, স্মৃতি হাতড়িয়ে, কারো খুব চেনা মুখ আঁকতে চাইছে যেন জলছবি করে... এরকম বৃষ্টি দেখলেই ছুটে গিয়ে ভিজতে ইচ্ছে করে... মনে হয় সবটুকু কালি মুছে যাবে তাহলেই... অপেক্ষা, দুশ্চিন্তা, হিসেব, প্রমাণ— এসব কালো শব্দগুলো সব ধুয়ে যাবে... কাঁচের ওপার থেকেই চোখের ওপর দিয়ে ভেজা হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলো বৃষ্টির ফোঁটাগুলো... একটা শান্তি আস্তে আস্তে পেয়ে বসছিল যেন... শান্তি না কি ক্লান্তি কে জানে... কিন্তু বেশ লাগছিল ডুবে যেতে...
চোখ বন্ধ করল টুপুর... দাদুমনি ঠিক আছে আজ... আজই ও দেখে আসবে একবার... কে জানে দাদুমনি জেগে থাকবে কি না... ওকে দেখলে নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে... যদি কিছু বলা যায়, কি বলবে টুপুর...? কি বললে দাদুমনি আরও জোর পাবে মনে...? নাঃ থাক... কিছু বলবে না... শুধু থাম্বস্‌ আপ... একবার...
ভেবেই ঠোঁটের কোনে এক চিলতে হাসি খেলে গেল... একটা অকারণ ভালোলাগা মনের দখল নিয়ে নিল আস্তে আস্তে... আর বহুযুগ ধরে নির্বাসনে থাকার পর একটুকরো ঘুম কোত্থেকে এসে জড়িয়ে ধরল চোখদুটোকে...
......................................................................................................................
—“দিদিভাই!”, কে যেন ঝাঁকুনি দিল টুপুরের ডানহাতটা ধরে, “সি.সি.ইউ, বারো নম্বরের বাড়ির লোককে ডাকছে নিচে রিসেপশনে... বাপি একা চলে গেল... তুই যা দিদিভাই...”
নূপুরের চোখ জুড়ে খালি উদ্বেগ আর উদ্বেগ... যন্ত্রচালিতের মত উঠে দাঁড়াল টুপুর... নূপুরকে দেখে মনে হল ভরসা, শুধু একটু ভরসা ও খুঁজছে বেপরোয়া হয়ে... কি বলা যায়? কিছু কি বলা যায়? গলা কেঁপে গেলে.........?
হাত বাড়িয়ে ওর হাতটা ধরল টুপুর...
—“ভয় পাস না... কিচ্ছু হবে না... যাচ্ছি আমি...”
ছুট! ছুট! ছুট!
লিফটটা ছয় আর সাততলার মাঝামাঝি কোথাও ঘুরপাক খাচ্ছে...
সিঁড়ি...??? সিঁড়িটা যেন কোনদিকে...?!
রিসেপসনের সামনে বাপিকে দেখা গেল বটে... সামনে থমথমে মুখে ডক্টর পারেখ্‌... তিনতলা থেকে নেমে আসতে তিন মিনিটও লাগেনি টুপুরের... অথচঃ এই কুড়ি পা দূর,বহু বহু দূর মনে হচ্ছিল যেন...
দু-চার পা দূর থেকেই টুকরো কিছু কথা উড়ে আসতে লাগল কানে, “... আণ্ড দেন সাড্‌নলি হি ওয়াস স্ট্রাগলিং...... উই ট্রায়েড আওয়ার লেভেল বেস্ট... বাট উনি পারছিলেন না... তাই ফাইনালি আমরা বাধ্য হয়েই... উই নেভার প্রেফার দিস ওভার এনি আদার অপ্‌শন... বাট...”
আর পারা গেল না...
—“কি হয়েছে বাপি? কি...?”
কয়েক মূহুর্ত চুপ করে থেকে একটা মাত্র শব্দ বলল বাপি,
—“ভেন্টিলেশন!”
...........................................................................................
ভীষণ শব্দ করে একটা বাজ পড়ল কোথাও... একেবারে ভিতরে কোথাও একটা রিন্‌রিনে কাঁপুনি ধরিয়ে দিল যেন... !!

Leave a Reply

Subscribe to Posts | Subscribe to Comments

- Copyright © পাঁচমিশেলি - - Powered by Blogger - Designed by সায়ংতরী -