Popular Post

Posted by : Sayantari Ghosh Wednesday, April 06, 2016



তিন

থালার ভাতগুলো কে নিয়ে খালি নাড়াচাড়া করছিল টুপুর; আজ যে কেন খেতে ইচ্ছে করছে না কে জানে... হঠাত্ টেবিলের ওপাশে চোখ পড়তেই দেখল শুভ একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। ও তাকাতেই থেমে থেমে বলল, “একদানা খেলি না কিন্তু! কি হয়েছে বলতো? দাদুমনি তো অনেক ঠিক আছে আজ... মুড ঠিক কর, টুপুর... খা!”
এক গ্রাস ভাত তুলে মুখে দিল টুপুর; গোটা গা-টা গুলিয়ে উঠল যেন... নাঃ! পারা যাচ্ছে না! জলের গ্লাসটা তুলে দু-ঢোঁক জল খেল ও...
—“কি রে? শরীর খারাপ লাগছে নাকি?”, এবার শাসনের জায়গায় উদ্বেগ শুভর গলায়, “থাক, জোর করিস না!অন্য কিছু খাবি? কোল্ডড্রিঙ্কস? বা আখের রস...? আনব?”
—“না রে... জাস্ট খিদেটা নেই এখন... খিদে পেলে পরে খেয়ে নেব আমি...”
শুভ আবার কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল ওর দিকে; তারপর বলল, “বেশ... চল, উঠি তাহলে... তুই বেরিয়ে দাঁড়া, আমি দামটা মিটিয়ে আসছি...”
দোকানটার থেকে বেরিয়ে এল টুপুর। হাসপাতাল থেকে এটা ওই মিনিট কুড়ির হাঁটা পথ।
পিছন ফিরে দেখল, ক্যাশ কাউন্টারের সামনের ভিড়টায় শুভকে দেখা যাচ্ছে। ও এসেছে আজ ভোরে। ভোর না বলে অবশ্য ভোররাত বলা উচিত... পৌনে চারটে-টাকে বোধহয় তাই-ই বলে। কাল রাত সাড়ে বারোটায় শহরে ফিরেছে ও... দিল্লি গেছিল... ইন্টারভিউ ছিল একটা...।
দাদুমনির খবরটা একরকম ইচ্ছে করেই শুভকে জানাতে দেয় নি টুপুর। প্রভাসকাকুকে নিজে গিয়ে বলেছিল, “কাকু, শুভকে জানিও না, প্লিজ... একেবারে ডিস্টার্বড হয়ে যাবে...”
টুপুর জানত, শুভ ফিরে এসে বাইরে বাইরে রাগ করবে, মেজাজ দেখাবে আর ভিতরে গুমরে মরবে... ভীষণ ভীষণ মনখারাপ করবে... কিন্তু ওকে তো আর এই আজ হঠাত্ করে দেখছে না টুপুর! সেই যখন ও ক্লাস ফাইভে, তখন প্রভাসকাকু ঝাঁঝা থেকে বদলি হয়ে এখানে এলেন বাপির অফিসে। সেই থেকে একসাথে ওরা... ক্লাসগুলো বদলে গেছে... ফাইভ, সেভেন, নাইন, ইলেভন... তারপর স্কুল বদলে গেছে কলেজে... কমেডি-ট্র্যাজেডি সবের আদল বদলে গেছে ধীরে ধীরে... মুখ আর নাম বার বার বদলেছে... সব পেরিয়ে একসাথে ওরা...
টুপুর জানে, শুভ পারত না, সব ফেলে ছুটে চলে আসত...! যেমন আজ ভোরে এল!
আজ সারা সকালটা শুভ ছিল এখানেই। বাপিরা আসার পর ডাক্তারের সাথে যা কথা হল তাতে ওদের হিসেবে দাদুমনি ইমপ্রুভ করছে...
—“চ!” পার্সটা পকেটে ঢোকাতে ঢোকাতে ওর পাশে এসে বলল শুভ, “আরেব্বাবা!! যা সেজেছে আকাশটা... আবার নামাবে মনে হচ্ছে...! চ জলদি! ভিজবো না আমি...”
দুজনে হাঁটা লাগালো। চুপচাপ। আজ সকাল থেকেই কে জানে কেন সেরকম কথাই হয় নি! টুপুর কত ভেবেছিল যে একবার শুভ আসুক... ব্যাস,তাহলে অন্ততঃ আর এই কথা জমিয়ে, দম বন্ধ করে থাকতে হবে না... কিন্তু কোথায়? কথাগুলোর কথা জড়িয়ে গেছে!
আকাশের একটা কোনা বেয়ে ধাপে ধাপে গাঢ় কালচে নীল মেঘ বড় হচ্ছে আস্তে আস্তে... রাস্তার ধুলোয় ছোট্ট ছোট্ট ঘূর্নি... একখানা খবরের কাগজ মাতাল হাওয়ার বেতালা ঘুড়ি হয়ে গেছে যেন... ঝড় উঠবে মনে হচ্ছে... কে জানে তাহলে আর বৃষ্টি হবে কি না...
—“সেই মাছধরা গুলো মনে পড়ছে বল!”, বলল শুভ, “আমি, তুই আর দাদুমনি...উফফফ! কি মজাটাই না হত!”
মনে পড়ছিল টুপুরেরও! তালপুকুরিয়ার ধারে ছিপ হাতে নিয়ে দুখানা কালো ছাতা খুলে উন্মুখ মেঘের দিকে পিছন ফিরে কাটানো সেই লম্বাআআ দুপুরগুলো... গোটা গরমের ছুটিটার প্রায় প্রতিটি দুপুর এভাবেই কেটে যেত সেসময়... তখন শুভরা প্রথম প্রথম এসছে এখানে...
—“হ্যাঁ... আমিও ভাবছিলাম”, হেসে বলল টুপুর, “তবে মাছ ধরা তো নামেই... সব মিলিয়ে কটা মাছ ধরতাম আমরা?”
—“ আররে!? থাকলে তো ধরবি? তালপুকুরিয়ায় মাছ ছিল? থাকার মধ্যে খালি পুঁটি ছিল... সে ত ধরতাম!”
—“যাঃ... রুই-এর পোনা ছিল... আমরা ধরেছি... আর তুই কিছু বলিস না... তুই কোনোকালেই কিছু ধরিসনি... ওই পুঁটি ছাড়া...” বলতে বলতেই হেসে ফেলল টুপুর
—“আমরা মানে কি? অমনি দাদুমনি কে নিজের দলে...না?” ঝুটমুট চোখ পাকিয়ে বলল শুভ।
—“সে তো দাদুমনি আমার দলেই... আর তাছাড়াও আমি ধরেছি... চারাপোনা ধরিনি আমি?”
কথার হারিয়ে যাওয়া খেই আবার ফিরে এল যেন... একযুগ আগের সেইসব দুপুরের বোকাবোকা স্মৃতি মেঘের সাথে মিশে আকাশ ভরাতে লাগল... কেঁচো দিয়ে তৈরি চার... তিন নম্বর বঁড়শি... ফাত্‌নার আলতো নাচন... আর ঘন্টার পর ঘন্টা সেই নিষ্পলক প্রতীক্ষা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা অজস্র গল্প... এদেশের বর্ষা আর ওদেশের বর্ষার গল্প... রাতদুপুরে পাগার উপছে আসা জলের তোড়ে কইজালা ফেলে রাশি রাশি কইমাছ ধরার গল্প... সিঙ্গি মাছের কাঁটায় জাল ছেঁড়া আর বোয়াল মাছের গায়ের জোরে হাতে বাঁধা ক্যাঁটার দড়ি সমেত জেলে কে টেনে নিয়ে যাবার গল্প... আর বর্ষা শেষ হলে পর ধানখেত ভর্তি হয়ে ছড়িয়ে থাকা মাছের কাঁটায় পা কেটে যাবার গল্প...
আকাশে মেঘের ওপর মেঘ জমছিল... গল্পের ওপর গল্পও জমে উঠছিল খুব...
ওরা খেলছিল, তর্ক করছিল নাকি ভুলে থাকার চেষ্টা... কে জানে! তবু বুকের ভিতর অব্দি ঢুকে যাওয়া হাসপাতালের ফিনাইলের আর ওষুধের গন্ধটাকে ছাপিয়ে উঠছিল ভেজা হাওয়া আর সোঁদা মাটির একটা সুবাস... সে সুগন্ধ খানিক আজকের... খানিক কে জানে কবেকার... দীর্ঘশ্বাসের গরম হলকা দূর হয়ে যেতে লাগল অজান্তেই...!

Leave a Reply

Subscribe to Posts | Subscribe to Comments

- Copyright © পাঁচমিশেলি - - Powered by Blogger - Designed by সায়ংতরী -