Popular Post

Posted by : Sayantari Ghosh Wednesday, April 20, 2016

dsw.jpg

চার
“পারো’টা বেশ বদলে গেছে, বল?”
প্রশ্ন’টা হেম করল আমাকে।
ডিপার্টমেন্ট অফ স্টুডেন্ট ওয়েলফেয়ারের পাশ দিয়ে যে রাস্তা’টা জঙ্গলের দিকে নেমে গেছে, তার মুখেই একটা বাঁধানো বেঞ্চে বসে আছি আমরা দু’জন। পাশটাতেই সেই কবেকার শিশুগাছ’টা… রাস্তায় মেঘ ফেটে ফালি ফালি রোদ এসে পড়েছে এখন। আমরা ছায়াতে, পায়ের কাছে গোল গোল রোদের মোজাইক করা ধূলোমাটি…
সামনে, একটু দূরে, রাস্তায় ঘুরে ঘুরে পারো ফোনে কথা বলছে আলোকের সাথে। আগের সাথে অনেক তফাত্ এখন… এস.টি.ডি.ও সস্তা হয়ে গেছে আগের চেয়ে আর ব্যালান্সও অনেক বেড়ে গেছে মোবাইলে…
পারোর কাছে তার বিবাহ অভিযানের লাইল-বাই-লাইন বর্ণনা শুনছিলাম গত ঘন্টাখানেক ধরে; গল্প শেষ হয়েছে এইমাত্র। বুঝতে পারলাম হেমের প্রশ্ন’টা সেই সূত্র ধরেই। সত্যি সত্যি গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল আমারো।
ভাবতেই পারছিলাম না…!
যে মেয়েটাকে কোনোদিন তার বাবার কাছে ফোনে 'আচ্ছা' আর 'হ্যাঁ' ছাড়া কিছু বলতে শুনিনি, যে মেয়েটা চুপ করে বসে থাকতে থাকতে কি জানি কিসের ভয়ে হঠাত্‌ কেঁদে ফেলত মাঝেমাঝে, বাড়িতে আলোকের কথা জানলে কি হবে, একথা যেদিন ভাবতে বসতো, সেদিন মাঝরাত পেরিয়ে যাওয়ার পর টের পেতাম চুপিচুপি নিজের বিছানা ছেড়ে আমার পাশে এসে শুয়ে ঘুমিয়েছে কোনোমতে… ভাবতেই পারছিলাম না যে এ গল্প’টার মুখ্য চরিত্র’টি সে! ইউনিভার্সিটির পর গুরগাঁও’এ চাকরি, সেই চাকরির ভরসায় বাড়িতে সবাইকে বিয়েতে রাজি করানো, তারপর কতদূরে বীরভূমের কোন গ্রামে এসে আলোকের বাড়িতে সবার সাথে আলাপ করা, আর আজ সগর্বে বলা যে ‘কার্ড এখন প্রেসে…’… টুকরো টুকরো এ গল্প আমরা জানতাম বটে, কিন্তু, এইভাবে, এক তোড়ে, একটানা শুনে মনেই হচ্ছিল না যে এই পারো নিজেকেই সামলাতে পারত না একসময়ে… আর এখন…
“বদলে গেছে বলিস না…” হেম’কে বললাম হেসে, “বল, বড় হয়ে গেছে মেয়ে’টা…”
তা নয়তঃ কি? নিজেই বলে চললাম মনে মনে... বড় হওয়া মানে নিজেকেই চেনা বেশী করে...
আর নিজেকে শুধরে নেওয়া পদে পদে শুধু... খুব প্রিয় ভুল’দের মুছে দেওয়া ইরেজার ঘষে... কত দাবী জন্মায়, আর কত অজস্র মরে যায় এই পথে... বড় হতে গিয়ে...
হেম'ও হাসল আমার কথা’টা শুনে। আসলে আমরা দুজনেই জানি যে পারো আর আলোকের গল্প’টাতে যে এরকম একটা দিন আসতে পারে, আমরা ভাবিনি। ভেবেছিলাম, এভাবেই দশ মিনিটের ফোন, গোটা রাতজাগা, কান্নাকাটি, ভয়, অভিমান আর না-বলে ওঠা গুচ্ছের এক্সপেকটেশন নিয়েই গল্প’টা ফুরিয়ে যাবে একদিন। পরিনতি’টা আমাদের চোখে স্পষ্ট ছিল জলের মত। খারাপ লাগত খুব পারো’টার জন্যে। কিন্তু ওকে দোষ দিতে পারতাম না একটুও। আলোক’কে তো কখনও দেখিনি আমরা। তারই একরকম সুযোগ নিয়ে এই খারাপ লাগার সমস্ত দায়, নিজেদের এই হাত-পা-বাঁধা অবস্থার সবটুকু ফ্রাস্ট্রেশন সোজা ওর ঘাড়ে চাপিয়ে দিতাম।কখনও আমি বলিনি হেম’কে, হেমও বলেনি কখনও… কিন্তু দুজনে’ই বুঝতে পারতাম যে এ কাহিনীর শেষ নিয়ে আমরা মনে মনে মোটামুটি একমত। আমাদের ভোলামন বান্ধবী’টি যে এইভাবে আমাদের ভুল প্রমাণ করে দেবে কক্ষনো ভাবিনি।
ফোন শেষ। পারো ফিরছে। রাস্তার সোনা-সোনা রোদে ওকে আলোর পুতুল মনে হচ্ছে একটা। আলোয় আলো পারো… চোখে আলো, কপালে আলো, বুকে আলো, পায়ের তলাতে আলো… প্রতিটি চলাতে আলো…
“তোর কথাই হচ্ছিল মিস”, হেম বলল পারো’কে, “ঠিক কি বললে যে তোকে একটা যুত্সই ‘ব্রাভো’ বলা হবে ভেবে পাচ্ছি না আমরা…”
“কিছু বলতে হবে না”, হাসিতে আরেকচোট রোদ ছড়িয়ে পারো বলল, “একটা কাজ করে দ্যাখা দেখিনি… মেক আ লাভ স্টোরি অফ ইয়োর ওন টু কমপিট উইথ মি…”
হো হো করে হেসে উঠলাম তিনজনেই, হেম বলে উঠল, “আরে আমি আট লিস্ট ট্রাই তো করেছি… রিনিটা কে দ্যাখ… কাম অন সুইটি, গেট ইন্সপাইয়ার্ড…”
“শোন শোন”, পারো বলে উঠল আমাকে কিছু বলতে না দিয়ে, “দ্যাখ এই মেয়ে আমায় কি মেসেজ করেছিল হোয়েন আই টোল্ড হার দ্য সেম থিং… হিয়ার ইট ইস… লিস্‌ন্‌…”, খচখচ করে মোবাইলের ইনবক্স খুলে একটা মেসেজ পড়তে লাগল পারো, বাধা দিলাম, বারণ করলাম, শুনলোই না…
….. মেসেজটায় লিখেছিলাম কোনো এক অস্থির বিকেলে,
“জানিনা রে! আসলে খুব অনেস্টলি বলতে গেলে, যখন ভাবা যেত, যখন সুযোগ ছিল, তখন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলা’টা কেন জরুরি, বুঝিনি আমি। ভেবেছিলাম, যে পাশে আছে, আর থাকবে জীবনভর এমন দাবীও করে, কেন সে সম্পর্কের নাম এক্ষুনি ভেবে ফেলতে হবে? কি দরকার? সারা’টা জীবন তো রয়েছে পড়ে… পরে দেখলাম, সে যখন উত্তর চেয়েছিল, নিজের জীবনের ভাগ বাঁটোয়ারা করছিল তখন আসলে। আমিও ঘাড় নেড়ে দিয়েছি আর সেও আমার ভাগের তার জীবনটাকে কেটেছেঁটে এত্তটুকু করে দিয়েছে…”
“উফফফ… আ লঅঅঅং বাউন্সার…” মেসেজ পড়া শেষ করে ফোন’টা ব্যাগে পুরলো পারো।
বুকের ভেতর একটা অস্বস্তি। চোখদুটো বন্ধ করে ফেললাম। কানদুটোতে হাত চাপা দিতে ইচ্ছে করল খুব! মনে হল মাথার ভেতরের ঘরটার সমস্ত জানলার শাটারগুলো ভীষণ শব্দ করে কেউ বন্ধ করে দিচ্ছে একে একে, অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে চারদিক… আর আমি একটা দেওয়ালজোড়া ফ্রেমে-বাঁধা ছবির সামনে একা দাঁড়িয়ে আছি… নর্মদা আর সাবরমতির মাঝের সেই ঝুপসি অন্ধকার, আকাশে মৃতপ্রায় চাঁদ মেঘঢাকা দিয়ে শুয়ে, জংলা ফুলের গন্ধে মাতাল রাস্তা… হাতের কব্জি’তে মোচড়… ‘লাগছে রুদ্র, লাগছে!’… … ‘ভালবাসিস না রিনি? বল??’… … ‘বলেছি তো না... না, না, না’ … … জোরালো প্রশ্ন আর গোয়ার্তুমির উত্তর… …
মাথা নিচু করে বসে রইলাম চুপ করে। পরিষ্কার বুঝতে পারছিলাম, একজোড়া চোখ আমার পাশ থেকে আমার দিকে তাকিয়ে… সোজা, একদৃষ্টে… সে দৃষ্টি’তে আবিষ্কারের বিহ্বলতা… আমার বুকের ভেতর এতদিন ধরে লুকিয়ে রাখা ঘরটার খোলনলচে নেড়েচেড়ে দেখছে যেন সে তার সব কৌতূহল দিয়ে…
তোকে যা নির্দ্বিধায় বলা যায়, শুধু একটু শ্বাস নিতে গিয়ে, তুই বুঝবি না, কষ্ট পাবি না এই ভরসায়, হেম’কে কি সে সঅঅব বলতে আছে, পারো? সে যে অভিমানে মরে যাবে তাকে জানাইনি বলে?
জঙ্গলের কোন এক না-দেখা পাখিরও বুঝি মন-আনচান করে উঠল খুব… আকাশ ভাসিয়ে বলে উঠল, ‘পিউ কাঁহা… পিউ কাঁহা… পিউ কাঁহা…’
[ক্রমশঃ]

Leave a Reply

Subscribe to Posts | Subscribe to Comments

- Copyright © পাঁচমিশেলি - - Powered by Blogger - Designed by সায়ংতরী -