Popular Post

Posted by : Sayantari Ghosh Wednesday, March 09, 2016



এক

হাসপাতালটার একটা দিকের দেওয়ালের জায়গায় সাততলা-জোড়া কাঁচ— তার মধ্যে দিয়ে দেখলে বাইরের উত্তপ্ত জ্যৈষ্ঠের দুপুরটাকেও সবজে ছায়ায় ঢাকা মনে হয়। তিনতলার সেইরকম একটা কাঁচের সামনে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল টুপুর। বাইরের গাছপালা,বাড়িঘর— নির্জন রাস্তায় মাঝেমাঝে হুশ করে ধুলো উড়িয়ে চলে যাওয়া এক-একটা গাড়ি— সবকিছুর মধ্যেই যেন একটা জড়তা— সময়টা খারাপ ক্যাসেটের রিলের মত জড়িয়ে গেছে যেন! এখান থেকে বোঝাই যায় না এটা ভোর, দুপুর নাকি বিকেল গড়িয়ে গেছে— ইচ্ছে করে এরকম কাঁচ লাগিয়েছে এরা— জোর করে সময়টাকে আটকে দিতে চায়। ভীষণ একটা ভাঁওতার মধ্যে রেখে দিতে চায়— একটা ধাঁধার মধ্যে।

এভাবেই তিনটে দিন কেটে গেল— দিনরাতের হিসেবটাও গোলমাল হয়ে যাচ্ছে এবারে—
একটু দূরে ওয়েটিং হলের বেঞ্চিতে মা-কে জড়িয়ে ধরে, চোখ বন্ধ করে নূপুরটা বসে আছে— মায়ের চোখ ফোলা, মুখ লাল— বাপি আর কাক্কা অনেকখন ধরে কথা বলছিল; এখন চুপ— বাপির চোখ বন্ধ; চোখের পাতাটা তিরতির করে কাঁপছে— কথা আর কান্না তে কিই বা আসে-যায়? হিসেব তো মনেমনে সব্বাই করছে!

টুপুর আবার রাস্তার দিকে তাকালো—গলার কাছটায় কেমন যেন একটা অস্বস্তি হচ্ছে—
দাদুমণির এই ভাবে অসুখে পড়াটা ঠিক মেনেই নেওয়া যাচ্ছে না। সেদিনও তো বিকেলে হাঁটতে বেরোলো— টুপুর স্কুল থেকে ফিরেছে তক্ষুনি— M.A.-এর রেসান্টটা বেরোয়নি—এই ফাঁকে একটু হাত পাকানো আর কি! 

সদরের কাছটাতে দাদুমণির সাথে দেখা, বলল, “কি বড়দি? মুখ গোমড়া কেন? ছাত্তররা কথা শুনছে না বুঝি?”
-“কি যে বল,দাদুমনি? আমার কথা শুনবে না?জানো, আমি সারাক্ষণ হাতে বেত রাখি!”,হেসে জবাব দিয়েছিল টুপুর, “দু-মিনিট দাঁড়াও না গো! এক কাপ চা খেয়ে নিই— দিয়ে আমিও তোমার সাথে ঘুরে আসি একটু...”
-“না ভাই, তুই বড় দেরি করে দিস!” মাথা নেড়ে বলেছিল দাদুমনি, “তোর সাথে আরেকদিন ঘুরতে যাব... যেদিন ব্যাগপত্তর কিনতে নিয়ে যাবি, সেইদিন... কবে যাবি বল তো?”
-“ইইইস!! ব্যাগপত্তর কেনার আর তর সইছে না,বলো?! রোববার যাব, দাদুমনি... পাক্কা...!”

আজ রোববার! ভাবতেই বুকের ভেতর'টা যেন দুলে উঠল একেবারে... বৃহস্পতিবার থেকে আজ রোববার— দাদুমনি কথাই বলছে না— সেইরাত থেকে আজ তিনদিন টানা এখানেই টুপুর— বাড়িমুখো হয়নি সে— মা আজ সকালে বলছিল,"বাড়ি গিয়ে একটু ঘুমিয়ে নে মামনি, এবার শরীর খারাপ করবে কিন্তু...”

ঘুমিয়ে?! এই তিনদিনে বসে বসে মাঝেমাঝে ঝিমুনি এলেও একটা দারুণ ঝটকা দিয়ে উঠেছে ভিতর থেকে— ঘুমের মধ্যে মারাত্মক দুঃস্বপ্ন দেখে যেমন ঘুম ভেঙে যায়, সেইরকম— চমকে সোজা হয়ে উঠে বসেছে টুপুর প্রতিবার!

-“না ভাই, তুই বড় দেরি করে দিস!” বলেছিল বটে দাদুমনি— খুব দেরি হয়ে গেল কি? কে জানে... বেশী কিছু তো নয়— শুধু একবার ঘরে ফিরতে চায় মানুষটা—তারও কি অনুমতি মিলবে না?? ভগবান...!

ঘরে ফেরা। এই একটা ইচ্ছে নিয়ে প্রতিটি রাত স্বপ্ন দেখত দাদুমনি; প্রতিটা দিন স্বপ্ন লিখত! দু'বছর আগে সেপ্টেম্বরে যখন হুঠ করে দিদুন চলে গেল, তার পর থেকেই আস্তে আস্তে এই ছেলেমানুষিটা পেয়ে বসেছে দাদুমনিকে... ঘরে ফিরবে! একবার! সেই গ্রাম, সেই মাটি, সেই ঘাস, সেই নদী, সেই সঅঅব কিছু একবার, শুধু একবার আলতো করে ছুঁয়ে আসবে! একটিবারের জন্য বাংলাদেশ ফিরবে! “ছানি পড়া চোখ, তবু দেখবো রে... কালা কান, তবু যেটুক শোনা যায়!” যেটা বলেনি সেটা হল,এখনও জীবন্ত প্রাণ... তাই বাঁচবো রে, যেটুক বাঁচা যায়!!

হুজুগ?! বলা যায়। অনেকে বলেও ছিল— তোতোনপিসি, দীপ্তিবউদি এমনকি মিতুলদা অবদি!দাদুমনির বাংলাদেশে যাওয়ার এই পাগলপারা ইচ্ছেটাকে আশকারা দিতে মানাও করেছিল বাপিকে। বাপি কোনোদিন কারো কথায় কান দেয় না; এবারও দেয় নি। বলেছিল, “যেতে ইচ্ছে তো যাক না!”

সেই দেশভাগের সময় থেকে মাটিছাড়া দাদুমনি। তারপর কোনোদিন, কখখনো ফিরে যায় নি। ফিরতে চায়ও নি। কিন্তু স্মৃতিজুড়ে ছিল সেই মাটির সোঁদা গন্ধ। এখনও মনে পড়ে— সে কবেকার কথা— টুপুর তখন স্কুলে পড়ে— শীতকালে ওপরের বারান্দার রোদে-ভেজা খাটটায় বসে বসে কত গল্প বলে যেত দাদুমনি আর দিদুন— টুপুরের আপাদমস্তক শহুরে মনটার কাছে রূপকথার থেকেও অবিশ্বাস্য লাগত সেসব কথা— দেখতে দেখতে ওর মনটাও ছুটতে শুরু করত সবুজ ধানের শিষে হাত ছুঁইয়ে— সরু আল বেয়ে— নীল আকাশটা নুইয়ে পড়ছে ওকে দেখতে— দূরে একদল সাদাকাশ একসাথে হৈ হৈ করছে— ছুট, ছুট, ছুট— “রুপুউউউ...!! ওওওওওই বুড়ো অর্জুনতলা অবদি কিন্তু— আজ আবাআআআর তুই হেরে যাবি...!!!” —আআআর এই যে গাছ ছুঁয়ে দিয়েছি— জিতে গিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠত টুপুর— শুনতে শুনতে ভুলেই যেত যে স্মৃতিটা আসলে কার...! মনে হত কবেকার সেই জোড়া-বাংলার অজপাড়াগাঁয়ের ছেলেমেয়ে রুপু, মদন, গীতা, নাজিম, সুজয়... এরা যেন ওরই ক্লাসে পড়ে, ওরই অভিন্নহৃদয় বন্ধু...

তাই যেচেই দায়িত্বটা নিয়েছিল ও। আর সবাই যখন সময়-সুযোগের অভাব-টভাব নিয়ে সাতপাঁচ ভাবছে, নিজেই বলেছিল, “আহা!কি দরকার ঝামেলা বাড়িয়ে? আমিই যাবো সাথে...!”

মনে মনে হেসেছিল তখন। দিদুন টুপুরকে “সতীন” বলতো আদিখ্যেতা করে... দিদুন নেই, দায়িত্বটা ওরই ওপর বর্তায় বইকি!!

সেই ঘরে ফেরা। তার কত আয়োজন! রীতিমত পাগল হয়ে উঠেছিল দাদুমনি। কত কিছু গোছগাছ, কেনাকাটা... আজ রোববার... আজ বড় দেখে একটা ব্যাগ কিনে দেবে বলেছিল টুপুর... আর আজ...
-“মামনি!”

চমকে উঠল টুপুর! মা কখন কে জানে পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে।

-“ চল, আজ বাড়ি ফিরে চল তুই! টানা তিনদিন হল। মিতুল বলছে, ও না'হয় থেকে যাবে আজ রাতটা...!”

-“কি দরকার মা? আমিই থাকছি— মিতুল'দার আর কষ্ট করার দরকার নেই... বাড়ি গিয়ে আমার লাভ কিছুই হবে না”, কবজি উলটে ঘড়িটা দেখল টুপুর, “সাড়ে সাতটা বাজল। তোমরা বরং বেরিয়ে পড়ো!”

[চলবে]

Leave a Reply

Subscribe to Posts | Subscribe to Comments

- Copyright © পাঁচমিশেলি - - Powered by Blogger - Designed by সায়ংতরী -