Popular Post

Posted by : Sayantari Ghosh Sunday, September 12, 2021

[কল্পবিজ্ঞানকে যিনি সমাজের প্রতিবিম্ব করে গড়েছিলেন, সেই অসামান্য স্রষ্টা স্তানিসোয়াভ লেমের জন্মদিন আজ। শতবর্ষে পা দিলেন বিশ্বখ্যাত কল্পবিজ্ঞানের এই লেজেন্ড। তাঁরই ‘দ্য হান্ট’ কাহিনীর ভাবানুবাদের প্রচেষ্টা করলাম। এই গল্পটি দীর্ঘকাল অপ্রকাশিত ছিল। একই নামের লেখকের আরেকটি পরিচিত গল্প থাকার দরুণই বোধহয় এই লেখাটি এতদিন যাবৎ পাঠকের চোখ থেকে দূরে লুকিয়ে থাকতে পেরেছে। ২০১৮ সালে প্রথম প্রকাশিত এই কাহিনীর রচনাকাল খুব সম্ভবতঃ পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিক।]


প্রায় মাইলখানেক ধরে সে টানা ছুটছে, একটুও ক্লান্ত হয়নি। অবিন্যস্ত পাইন বন তার চারপাশে। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকা পাইনগাছের সুঠাম শরীরগুলো সটান উঠে গেছে উপরের দিকে, পাহাড়ের সাথে একটা কোণাকুণি ভঙ্গিমায়। গাছের সুউচ্চ চূড়াগুলো আজ কুয়াশায় মুখ লুকিয়েছে যেন ভীষণ বিষাদে। সেই কুয়াশাচ্ছন্ন জঙ্গলের পিছন থেকে আলতোভাবে ভেসে আসছে অজানা নদীর কুলুকুলু শব্দ।
এদিকটা সে খুব একটা চেনে না। ঠিক কোথায় যে যাচ্ছে তাও সে জানেনা। কতকটা দিশাহীন ভাবেই সে আজ ছুটছে। এ পথটুকু’তে এখনো পর্যন্ত অবশ্য কোন জনপ্রাণী তার চোখে পড়েনি। পুরনো কোনো চড়ুইভাতির আগুনের ধ্বংসস্তূপ বা কারো ফেলে যাওয়া আধময়লা ব্যবহারী জিনিস -- জঙ্গলের কোথাও সে সব কিছু নেই। এদিকটায় মনে হয় বড় একটা কেউ আসে না। আসলে এদিকটাতে রাস্তাঘাট নেই তো, সবাই বলে পাহাড়ের দৃশ্যও নাকি এখানে সাংঘাতিক আহামরি কিছু নয়। শুধু জঙ্গল আর জঙ্গল। ঘন হয়ে কাছিয়ে-আসা বিশাল উঁচু উঁচু সব গাছ। কোথাও আলো-আঁধারি, কোথাও বা অন্ধকার । কোথাও গাঢ় সবুজ, কোথাও গাঢ়তর।
সেই সবুজের সমারোহে যেটুকু সাদার ছাপ, সেদিকে এগোলে দেখা যাবে কিছু মরা গাছের দুধসাদা কান্ড দাঁত বের করে রয়েছে। হয় ঝড়ে ভেঙে পড়েছে, নয় বয়সজনিত কারনে। দূর থেকে মরা গাছ দেখলেই সে দৌড়াতে দৌড়াতে হিসেব করে নিচ্ছিল। টপকে যাওয়ার দরকার না পড়লে শুকনো ডালপালা ঠেলে নীচ দিয়েই পার হচ্ছিল সে। অকারণ শক্তি নষ্ট করে লাভ কি?
অনেক উঁচুতে আকাশ ঝলমল করছে। সে চট করে একবার পিছনে তাকালো। এ গাছ ও গাছ ধাক্কা খেতে খেতে তার দৃষ্টি চলে গেল যতদূর যাওয়া যায়। কান খাড়া করল সে। না, আপাতত শুধু নির্জনতা। নৈঃশব্দ। আছে শুধু সেই নদীটার শব্দ। আর পাতায় হাওয়ার সরসরানী। তার চোখ কিন্তু ভীষণ তীক্ষ্ণ। উজ্জ্বল আকাশের দৃশ্যপটে কোন গাছের ডাল সামান্য একটুখানি নড়লেও সে টের পাচ্ছিল পরিষ্কার। উল্টোদিকের পাহাড়েও বৃষ্টিধোয়া পাইনের ঘন গালিচার আস্তরণ। সবুজের ফাঁক দিয়ে, ঠেলে-বেড়িয়ে-আসা হাড়ের মতো উঁচু হয়ে আছে কতগুলো চুনাপাথরের পাহাড়। নিশ্চয়ই গুহা আছে ওর আড়ালে। নিশ্চয়ই বহু শিকারের দৌড় ওদিকে গিয়েই শেষ হয়েছে। ওদিকে যাওয়ার বিশেষ জায়গা নেই, ভাবারও বিশেষ সুযোগ নেই।
সুযোগ কি আদৌ কখনো থাকে? তারও কি আছে? তা হলে সে কেন ছুটছে? তার আগে বাকিরাও কেন ছুটেছে? পাহাড়-নদী ভেঙে, জলে-জঙ্গলে প্রাণপাত করে, নিজের শক্তির সীমার উপরে উঠে কেন ছুটেছে তারা? কেন অযথা এত কষ্ট না করে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে পিঠে গুলি খেয়ে মরেনি তারা? এর উত্তর সে জানেনা। এসব সে ভাবেও না, এত ভাবার সময়ও তার নেই।
পায়ে পায়ে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসে খাদের পাশটায় দাঁড়িয়ে সে নিচের দিকে তাকালো। অনেক নিচে রূপোলি ফিতের মত নদীটা দেখা যাচ্ছে এখন। আর দূরে জঙ্গলে কোথাও অজানা অচেনা একটা পাখি একঘেয়ে ডেকে চলেছে ঘুরে ঘুরে একটাই বিষন্ন সুরে। নদীর দিকটায় নেমে যাবে কি? না, না… তাহলে এতটা উপরে ওঠার কসরত তার একেবারে বিফলে যাবে। তার পিছু-ধাওয়া-করা দলটার সাথে কুকুর আছে। ওরা ঠিক গন্ধ পেয়ে খুঁজে বের করবে ওকে। তাহলে কি জঙ্গলে? জঙ্গল কিন্তু পাহাড়ের গা বেয়ে উঠে গেছে সোজা। অনেকটা চড়াই। ‘কষ্ট হবে’, ভাবলো সে, ‘তবু তাই ভালো।’ আরেকবার চট করে পিছন দিকটা দেখে নিল সে। আর ঠিক তখনই, অনেক দূরে, জঙ্গলের গভীরতম অন্ধকার কোণ’টা যেন একটু নড়ে উঠলো।
তক্ষুণি সে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে লাগল পাহাড় বেয়ে সোজা উপরের দিকে। লাফিয়ে লাফিয়ে বড় বড় পা ফেলে সে এগোতে লাগলো। এ কিন্তু ভয় নয়, এ যেন অভ্যেস। এমন নয় যে তার হৃদস্পন্দনের গতি বেড়েছে, এমন নয় যে সে প্রচণ্ড হাঁপাচ্ছিল, এমনও নয় যে তার কপালের শির ফুলে উঠেছে। শুধু বুকের মধ্যে কোথায় যেন একটা কোনো তারে প্রচন্ড টান লেগে গেছে। বুকের মাঝখানটাতে যেন একটা কান্না তিরতির করে উঠলো।
জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ছুটতে ছুটতে হঠাৎই সে বুঝতে পারলো যে আসলে এক শুকনো নদীখাত বরাবর সে ছুটছে। কোনো এক বর্ষাকালে হয়তো কোন ঝরনা এ পথে নেমেছিল কোনদিন। সামনে ছুটতে ছুটতে একবার আকাশের দিকে তাকালো সে। না, এই রোদ-ঝলমলে দিনে বৃষ্টির কোন সম্ভাবনা নেই । এখন তুমুল বৃষ্টি হলে, ঝড় হলে তার বেঁচে যাওয়ার হয়তো একটা সম্ভাবনা ছিল। গতকাল রাতেও খুব বৃষ্টি হয়েছে। টিনের ছাদে বৃষ্টির অবিরত আওয়াজ তাকে জাগিয়ে রেখেছিল অনেকক্ষণ। সারারাত জেগে সে আশায় বুক বাঁধছিলো। তার মনে হচ্ছিল এ বৃষ্টি যদি না থামে, তবে আজকের এই শিকার হয়তো পিছিয়ে যাবে। গতকালের বৃষ্টির দু-একফোঁটা জল গাছের পাতা থেকে টুপ টুপ করে ঝরে পড়ল তার ধাতব হাতের পাতায়, আর চকচক করতে লাগলো কতগুলো হীরের টুকরোর মতন। একমুহূর্ত সেদিকে মন যেতেই সে জোর হোঁচট খেলো। তার পায়ের লোহার জুতো ঢং করে ঠুকে গেলো মাটিতে পড়ে থাকা একখানা বিশাল পাথরে। শব্দটা শুনে আঁতকে উঠল সে। ওরা এমনও কিছু দূরে নেই যে এই আওয়াজ ওদের কানে যাবে না।
হোঁচট’টা খেয়ে এক মুহূর্তের জন্য সে থেমেছিল। আর তক্ষুনি কানে এলো পাহাড়ের নিচে থেকে, জঙ্গলের ভেতর থেকে তীব্র, হিংস্র হাউন্ডের চিৎকার। এই কুকুরগুলোকে সে ভয় পায় না, কিন্তু কুকুর মানেই সঙ্গে মানুষ আছে। এই প্রাণীগুলোকে কি সে একেবারে সহ্য করতে পারেনা? জীবনে এসব নিয়ে খানিকটা ভাবার সময় পেলে হয়তো এদের সে ঘৃণাই করত। তবে এখন তাতে কিছু আর এসে যায় না।
তার মাথার ভেতর কত ভাবনা যেন বয়ে গেল! সামনে দিগন্তবিস্তৃত পাহাড়ি জঙ্গল ধাপে ধাপে ঢেউ খেলিয়ে উঠে গেছে উপরদিকে। পাহাড়ের চূড়ায় থোকা থোকা মেঘ গায়ে গায়ে লেগে আছে বরফের সাথে। যতদূর চোখ যায় তন্বী নদীর বাঁকে বাঁকে সবুজ, গাঢ় সবুজ ধীরে ধীরে ঘন নীলে মিলেমিশে গেছে। কি সুন্দর এই পাহাড়! আগে কখনো কোনদিন এ জায়গাটার কথা সে ভাবেনি, কোনদিনও এখানে আসেনি। তবু যেন শরীর নিংড়ে রূপোলি তরলের একবিন্দু তার বুকের এপাশ থেকে ওপাশে গড়িয়ে পড়লো। আর কি কখনো দেখতে পাবে সে এই দৃশ্যগুলো? হাতে হয়তো আর ঘন্টা খানেক সময় মাত্র, অথবা হয়তো কয়েক মিনিট।
এবার কি একটু ভয় পেল সে? দৌড় শুরু করতেই আপনা-আপনিই যেন এবার গতিবেগ তার আরো বেড়ে গেল। জোরে। আরো জোরে। এভাবে যেন আগে কেউ কখনো ছোটেনি। এক-একটা পদক্ষেপে চার-পাঁচ মিটার করে লাফিয়ে পেরিয়ে যেতে লাগল সে। এবার যেন কপাল দপদপ করছে তার, এবার যেন চোখের সামনে আলো ঝলসে উঠছে মাঝে মাঝে। তার ভারি পদক্ষেপে উপড়ে যেতে লাগল ঘাস। তার হাত-পা যেন টনটন করে উঠল। সে বুঝতে পারল হয়তঃ তার একটু আস্তে ছোটা উচিত, কিন্তু নিজের উপর থেকে সমস্ত নিয়ন্ত্রণ তার যেন চলে গেছে। সে থামতে চাইল না, কিংবা হয়তঃ থামতে পারল না। এ দুটোর মধ্যে তফাৎ করার ক্ষমতা ঈশ্বর তাকে দেননি।
আয়নার মত স্বচ্ছ্ব একখানি সরোবর গাছের ফাঁক দিয়ে চিকচিক করে উঠলো। জলের ধারে হয়তো কিছু তাঁবু থাকতে পারে। সে সাবধান হলো। নিঃশব্দে, শান্ত ভাবে এগোতে লাগলো। ওই তো তাঁবুর গর্ত, ওই তো জলের ধারে নৌকো বাঁধার সুগভীর আঁচড়। তবে যাক, কোনো মানুষ নেই। সরোবরের ধার ঘেঁষে প্রায় কয়েকশো গাছ কে জানে কোন ঝড়ের তান্ডবে কবে থেকে উৎখাত হয়ে পড়ে আছে। যেন সারি সারি মৃতদেহ শোয়ানো। জায়গাটা পেরোনো সোজা নয়, কোনোক্রমে নিজের সুবিশাল দেহটাকে টেনে টেনে সে এগিয়ে চলল।
শেষ গাছটা পেরোতেই সামনের সবুজের মাথার উপর দিয়ে সে দেখতে পেল মাস্তুলের মত মাথা উচু করে আছে একখানা লোহার স্তম্ভ। ওটা কি? তখনই বিদ্যুৎ ঝলকের মতো মনে পড়ল, এখান দিয়েই তো হাইভোল্টেজ পাওয়ার লাইন গেছে। জঙ্গলের মাঝের এই টাওয়ারগুলোকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে চলে গেছে একেবারে নিচের সমতল পর্যন্ত। সে দৌড়ে গিয়ে স্তম্ভের গোড়ার কাছটাতে নিজেকে লুকিয়ে নিল। শিকারি দলের কাছে একরকম এক্স-রে মেটাল ডিটেক্টর আছে। গাছের কান্ডের ফাঁকে ফাঁকে লোহার চিহ্নমাত্র টের পেলে সে যন্ত্র চিৎকার করে তাদের জানিয়ে দেয় যে শিকার কাছেই আছে। কিন্তু এই স্তম্ভের কাছাকাছি দাঁড়ালে তাকে ও যন্ত্র আর খুঁজে পাবেনা। তবে ওদের কাছে কুকুর আছে, তারা গন্ধ পাবে ঠিক। ওরা গেল কোথায়? এতক্ষণে তো ওদের পায়ের শব্দ তার কানে আসা উচিত ছিল। কোন কিছুতে আটকে পড়েছে কি?
এতক্ষণে সে টের পেল যে দাঁড়ানোমাত্র তার সারা শরীরে যেন আগুন জ্বলে উঠেছে, কলকব্জাগুলো যেন ঢিলে হয়ে আসছে। সে হাত-পা ছড়িয়ে দিলো একটু। হু হু করে আগুনের স্রোত যেন বেরিয়ে যাচ্ছে শরীর থেকে। সে বুঝতে পারছিল এখানে দাঁড়িয়ে পড়লে তার সময় শেষ হয়ে যাবে খুব শিগগিরি। এসব তার বহুবার দেখা। এরকম শিকারের সে পাঁচ-পাঁচ বার এসেছে। তবে, সেবারগুলোতে সে শিকার ছিল না। সে এসেছিল শিখতে; সমগোত্রীয় আরেকজনের মৃত্যুউৎসবে শিক্ষানবীশ হয়ে। আর প্রত্যেক বার একটা জিনিস শিখেই সে ফিরে গিয়েছিল। যে এই দৌড় শিকারের অন্তিম দৌড়। শিকারীর জন্য অবশ্য এ হল সেই চিরকালের আদিম আনন্দ খুঁজে পাওয়ার একটা ব্যবস্থামাত্র। পশুহত্যা তো এখন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ, তাদের সংখ্যা এতটাই কমে গেছে যে পশুশিকার চলতে থাকলে ক’বছরেই মানুষ ছাড়া অন্য কোনো পশু আর থাকত না পৃথিবীতে। অথচ শিকারের আনন্দের কি কোনো তুলনা হয়? তাই এই ব্যবস্থা। তাই কুকুর থেকে শুরু করে আধুনিক সমস্ত যন্ত্রপাতি, অস্ত্রশস্ত্রের ব্যবস্থা রয়েছে ওদের ওই ছোট্ট স্কুল ব্যাগে। যাতে কোনভাবে কোন গোলমাল না হয়। হরিষে বিষাদ না হয় যেন!
না, দিগন্তে কোন ছায়ামূর্তির দল ভেসে উঠলো না। হয়তো ওরা জ্বালানি বাঁচাচ্ছে। এতে যে সে খুব নিশ্চিন্ত হল তা নয়, বরং ভেতরে ভেতরে ভীষণ এক নিরাপত্তাহীনতা তাকে পেয়ে বসলো। হয়তঃ শিকারীরা অন্য কোনো প্যাঁচ কষছে। তার চোখ নিজে থেকেই চলে গেল ডানদিকে ওই জাহাজের মাস্তুলের মত উঁচু লৌহস্তম্ভটার দিকে। তার থেকে সার বেঁধে ধাতব ইলেকট্রিক তার সোজা নেমে গেছে নিচের সমতলে। বিদ্যুৎ নিয়ে চলেছে বিশালাকৃতি লৌহমিনার! মানুষের নাগালের সম্পূর্ণ বাইরে!
এক পলকে সে লৌহস্তম্ভটা বেয়ে উঠতে শুরু করলো। দূর থেকে তাকে দেখলে মনে হবে যেন একটা শিম্পাঞ্জী তরতর করে চড়ছে গাছে। তামা আর অ্যালুমিনিয়ামের তারগুলো ঝকঝক করছে সূর্যের আলোয়। মাশরুমের মতো উঁচু হয়ে থাকা চিনামাটির ছোট ছোট বাটির মালার অন্তরকের সুরক্ষা সেই তারের গায়ে। চিনামাটি তার ভার নিতে পারবে না। সে আস্তে করে ঝুঁকে পড়ে তামার তারের উপরেই হাত রাখল সরাসরি। তারপর অন্য হাত। তারপর বাকি দুটো পাও। তারপর এক মূহুর্তে চার হাত-পায়ে ওই তার ধরে ঝুলে পড়ে সরসর করে নামতে থাকলো নিচে সমতলভূমির দিকে, ভীষণ দ্রুতগতি’তে।
অভিকর্ষের টানে দূর্বার গতিতে। হাইটেনশন তারের বিদ্যুৎ ওর হাতের ছোঁয়া পেয়ে যেন চমকে উঠলো। অথচ, তার চোখ নির্বিকার। সূর্যের ঝলমলে আলোতে সে যেন দেখতেই পেল না তার দুই হাতের তালু ঝলসে যাচ্ছে কয়েকশো ভোল্টের ইলেকট্রিক শকে। আগুনের ফুলকি উড়তে লেগেছে চতুর্দিকে। তার দৃষ্টি নিচের উপত্যকার দিকে স্থির হয়ে আছে। ঘাসের কাছাকাছি আসতেই সে লাফিয়ে নামল নিচে। আর তক্ষুনি নীল আলোয় চারদিক ঝলসে দিয়ে প্রচন্ড বিদ্যুৎ তার শরীর দিয়ে বয়ে গেল। সে মাটিতে পড়ে ছটফট করতে লাগলো। নিদারুণ যন্ত্রণায় ঘাস ছিঁড়তে লাগল মুঠো মুঠো। সমস্ত শরীর যেন নিস্তেজ হয়ে আসছে। তবু সে আড়চোখে তাকালো ফেলে আসা পাহাড়ের চূড়াটার দিকে। দেখতে দেখতে যেন ছোট ছোট কতগুলো ছায়ামূর্তি এসে দাঁড়ালো সেখানে। মানুষ, না কুকুর, বোঝা যায় না। সে মুচকি হাসল, এই দৌড় সে এত তাড়াতাড়ি শেষ হতে দেবে না।
এখনো তার শরীরে এখানে-ওখানে কালো আর নীলচে ক্ষত। বিদ্যুতের চাবুকের দাগ। সে কুঁকড়ে গেল মাটির উপর শুয়ে। একটা মিনিট কি অন্ততঃ থেমে থাকতে পারে সে? শিকারীদেরকে তো সে অনেক পিছনে ফেলে এসেছে। একটু কি বিশ্রাম নিতে পারে? মনে হচ্ছে যেন প্রবল জ্বর আসছে, শরীর পুড়ে যাচ্ছে যেন। সে মরার মত পড়ে রইল কিছুক্ষণ। বিহ্বলের মত তাকিয়ে রইলো নিজের বাঁ’হাতের অস্বাভাবিক রকম মুচড়ে-যাওয়া কনুই’টার দিকে। কনুই’এর কাছে, হাঁটুর কাছে এ সব কি লেগে আছে? এ তো রক্তের মত দেখাচ্ছে!
না। রক্ত নয়। ওর যান্ত্রিক শরীরে রক্ত কোথায়? যে নাম-না-জানা ফুলের ঝোপখানাকে তছনছ করে সে পড়েছে, তার থেৎলে-যাওয়া লালচে ফল থকথকে রক্তের মত লেগে আছে তার গায়ে। জামের মতন ছোট ছোট ফল। কি অদ্ভূত গাঢ় মেরুণ তার রঙ। শুয়ে শুয়ে ফলে-ছেয়ে-থাকা ঘাসজমি’টাকে দেখতে দেখতে তার মনে হল, ‘যদি কিচ্ছুটি না করতে হত… যদি এভাবেই চিরটাকাল কাটানো যেত…’

তবে তেমন ভাগ্য তার নয়। তাই নিজেকে হারিয়ে ফেলার আগের মূহুর্তে ব্যথায় কাতর শরীরটাকে টেনে তুললো সে। কুকুরগুলো খানিকক্ষণ দিশেহারা হয়ে পড়বে বটে, কিন্তু বুদ্ধিমান শিকারীর দলের ব্যাপারটা বুঝতে খুব বেশী সময় লাগবে না। ওরা আবার যেই গোড়ার থেকে শুরু করবে, তক্ষুণি ওর খোঁজ পেয়ে যাবে।
জঙ্গলের ধার বরাবর ও দৌড় শুরু করলো। ওদিকের পাহাড়ের তুলনায় এদিক’টা অনেক আলাদা। নদীটা অদূরে বইছে। সামনে তাকালে জঙ্গল বেশীদূর নেই আর। ওই যে দূরে আবছা ছবির মত বড় রাস্তাটা, নদীর ওপর দিয়ে এ চূড়া থেকে ও চূড়ায় রেলের ব্রিজ, পাহাড়ের গায়ে ইতস্ততঃ ছড়ানো লাল-সাদা চালের বাড়ি, ওই ততদূরই ওর সীমারেখা। তার ওপারে আর যেতে পারবে না সে।
হাওয়া’টা ধাক্কা দিচ্ছে তার পিঠে। এক দিক থেকে ভালো। কুকুরগুলো সহজে গন্ধ পাবে না। তবে সেই হাওয়াতেই ভেসে এল প্রাণীগুলোর গর্জন। খুব কাছে নয়। তবে তাদের বিরক্তি, ক্লান্তি, রাগ সব মিলেমিশে গেছে সেই ডাকে। ভয় কাঁপিয়ে দিল তাকে। নাকি প্রচন্ড পরিশ্রমে শরীর সঙ্গ দিচ্ছে না আর। সে বাঁ-দিকে বাঁক নিয়ে এবার জঙ্গলে ঢুকে পড়লো। আর ঢুকেই একটা গাছের উঁচু শিকড়ে হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়লো মাটি’তে। মিনিটখানেক চোখের সামনেটা অন্ধকার হয়ে গেল তার। তারপর ধীরে ধীরে চোখ খুললো সে।
জঙ্গলের ভেতরে গাছের ফাঁক দিয়ে এখানে ওখানে সূর্যের আলো স্পটলাইটের মতন এসে পড়েছে। মাটিয়ে ছিড়িয়েছিটিয়ে আছে সাদাটে কচ্ছপের খোলের মত পাথর। আর একটু দূরে একটা বড় পাথরের চাঁইয়ের ওপরে রাখা এক গুচ্ছ রূপোলী ফিতে হাওয়ার তালে তালে উড়ছে আস্তে আস্তে।
সে আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল ছেলেমানুষের মত অমোঘ কৌতূহলে। টিনের পাত পাতলা করে কেটে কেউ বানিয়েছে এগুলো। পাথরের ওপরে রাখা গোছা’টা থেকে কয়েকটা রূপোলি সুতো উড়ে বেড়াচ্ছে হাওয়ায়। আটকে যাচ্ছে গাছের ডালে। কে বানিয়েছে এগুলো? কেন? পরমূহুর্তেই সন্দেহ ফিরে আসে হুড়মুড় করে। ফাঁদ! নিশ্চয়ই কোনো ফাঁদ এটা! তার শিকারীরা যে বহুদূরে অন্যদিকে পাহাড়ী পথে তার পিছুধাওয়া করেছিল সে কথা মন থেকে মুছে ফেলে একটা সর্বগ্রাসী আশঙ্কা তাকে চেপে ধরে। চকিতে ফাঁকা জায়গাটা থেকে সরে এসে ছিটকে আরো গভীর জঙ্গলের দিকটাতে ঢুকে পড়লো সে। এতক্ষণে হয়তঃ কুকুরের দল আবার গন্ধে গন্ধে ওর পিছু ধরেছে। দূরত্ব কমতে দেওয়া চলবে না। ততক্ষণ, যতক্ষণ না ক্লান্ত কুকুরের দলের গর্জন ক্ষীণ ঘ্যানঘ্যানানিতে বদলে যায়। ততক্ষণ, যতক্ষণ না তারা দিশাহারা হয়ে শিকারীর দলে কাছে কাঁচুমাচু মুখে ফিরে যায়।
সামনের জায়গাটায় চুনাপাথরের কিছু টিলা সার বেঁধে উঠে গেছে একে একে। অতি সংকীর্ণ কিছু গিরিপথ তার ফাঁকে ফাঁকে। টুপটাপ জলের ফোঁটা ঝরে পড়ছে পাথরের গা বেয়ে, গতরাত্রের বৃষ্টির সাক্ষী হয়ে। গুহার মত অন্ধকার সে সব পথ সোজা নেমে গেছে আরো নিচের দিকে। বেছে বেছে একটা গিরিপথের সামনে এসে দাঁড়ালো সে। ফার্ণ আর মসের স্যাঁতস্যাতে গুহাটার শেষ প্রান্তে সামান্য একটু আলোর আভাস। এক মূহুর্ত সে এক কঠিন সম্ভব-অসম্ভবের হিসেব কষে নিল। তারপর বুকের কাছে দু’হাত জড়ো করে নিজেকে গড়িয়ে দিল সেই ঢালু অপ্রশস্ত পথ বরাবর।
যেন অনন্ত এক অন্ধকূপে তার পতন শুরু হল। মনে হল যেন এক যুগ পরে (আসলে কয়েক মিনিট) সে ছিটকে বেরোলো পথের অন্য প্রান্তে, সূর্যের আলোয়। বেরোতেই একখানা ফার ঘাছে প্রচন্ড ধাক্কা খেয়ে এক রাশ নুড়ি পাথরের ওপর পড়ল সে। কনকনে ব্যথায় মনে হল বাঁ পা’টা বোধহয় এক্কেবারে অকেজো হয়ে গেছে। সে চোখ খুলে দেখলো গুহার মুখটায় আরো কয়েকটা রূপোলি সুতো উড়ছে। আর তক্ষুণি খুব কাছে কারো পদক্ষেপের অস্পষ্ট শব্দ শুনে তার সমস্ত শরীর কাঠ হয়ে গেল।


[বাকিটা শেষ পর্বে...]

Leave a Reply

Subscribe to Posts | Subscribe to Comments

- Copyright © পাঁচমিশেলি - - Powered by Blogger - Designed by সায়ংতরী -