Popular Post

Posted by : Sayantari Ghosh Friday, December 25, 2015



খচখচানি’টার শুরু সেই পরশু দিন... অর্থাত তেইশ তারিখ।


তেইশ তারিখ সন্ধ্যেবেলা যখন অফিস থেকে বেরোলাম পার্কস্ট্রিট যাবো বলে তখনও কেক কেনার ব্যাপার’টা “আজ সন্ধ্যের কাজ”এর লিস্টে জ্বলজ্বল করছে মাথার ভেতরে। অথচঃ ঘন্টাদুয়েক মিতের সাথে বকবক করে তিনবার পার্কস্ট্রিট চক্কর দেওয়ার পর হিজিবিজি ভাবতে ভাবতে যখন মেট্রোয় উঠে পড়লাম, তখন ফ্রুটকেক চাপা পড়ে গেছে দেশ ও জাতির উন্নতি ও পিছিয়ে পড়া বিষয়ক সুদীর্ঘ আলোচনার নিচে!


পরদিন বাড়ি ফেরা! ভাবলুম পার্কস্ট্রিট হল না, কিছু একটা অফিসের পাশ থেকেই কিনে নেবো, ট্রেন ধরার তাড়াহুড়োয় সেটায় ভুলে গেলাম বেমালুম। সন্ধ্যে রাত্তিরে যখন বাড়ি ঢুকছি, মন খারাপ হয়ে গেল এক্কেবারে! এত করে ভেবে রেখেও বড়দিনের আগে একটা কেক আনতে পারলাম না!? মার্কামারা স্মৃতিশক্তি বটে!!


যা হোক গে, আমি ভুললেও মা ভুলে যায় নি মোটেই! এখন আমি আর বোন দু’জনেই হপ্তাবাবু হয়ে গেছি, মাসে বা সেমেস্টারে বাড়ি ফেরে যারা হপ্তাবাবু’দের দর তাদের থেকে কম যদিও, তবু মা উইকএন্ড উত্‌সবগুলো’কে চট করে মিস করেন না। দেখলাম, চার-পাঁচ রকমের বিভিন্ন স্বাদের কেক জড়ো করা হয়েছে বাজার ঘুরে। নানারকম রঙিন বাক্স, জড়ির ফিতে... বাড়ি ঢুকেই ঝাঁপিয়ে পড়লাম একরকম!গপাগপ মুখে পুরে ফেললাম অনেকখানি। কিন্তু কেমন যেন একটা খচখচানি... কে জানে কেন, মনে হল, “কি যেন নেই-নেই... কেমন ”... সে’কথা আর মা’কে বললাম না!


পরদিন বোনের সাথে বাজার বেরিয়েছি। আরো কতগুলো “দ্য রিয়েল ফ্রুটকেক” ইত্যাদি লেখা, নামী কোম্পানীর সিল-মারা বাক্স কিনে বাড়ি ফিরলাম! মা চোখ পাকালেন, আমি অপরাধীর মত মুখ করে নতুন আনা বাক্সগুলো থেকে কোণা ভেঙ্গে মুখে দিলাম...
দুত্তেরি!! এ কি রে বাবা? রিয়েল ফ্রুটকেক?! রাশি রাশি টাকা নিলে এরজন্যে?! মাথা গরম হয়ে গেল!


বোন সেই কেক দু'খানা ঝপাঝপ সাবাড় করে ঘোষনা করল যে আমার কেকটেস্টিং’এর কাজ ছেড়ে ইমিডিয়েটলি তেলেভাজায় শিফট করা উচিত, আমার কিছু একটা সিভিয়ার প্রবলেম হয়েছে!


মন খারাপ করে বেরিয়ে পড়লাম। তখন সন্ধ্যে হয়ে গেছে, আমাদের পাড়ার মোড় থেকে মিশনারি গার্লস স্কুলের চার্চ’টা দ্যাখা যায়, ইচ্ছে করলো ও’দিক থেকে ঘুরে আসি। গলি’র মুখের স্ট্রিটলাইট’টা ক’দিন থেকে খালি দপদপ করছে... আলোছায়া, ছায়া আলো... আমি কিছু একটা ভাবছিলাম, তবে খুব নিটোল কিছু নয়, অন্যমনস্ক’ই ছিলাম হয়তঃ... হঠাত একটা আচমকা ‘ভোঁওওপুউ! ভোঁওওপুউ!’ শব্দ শুনে বিচ্ছিরি রকম চমকে গেলাম! তাকিয়ে দেখি, আমাদের নয়ন পাউরুটিওয়ালা।

নয়ন পাউরুটিওয়ালার খালি নাম বললে পুরো’টা বলা হয় না। ওর সাথে আমার আলাপ তখন, যখন আমি ক্লাস ওয়ান। তখন এই পাড়া’টা নতুন, আমাদের বাড়ি’টা নতুন; পাউরুটিওয়ালার ঠেলাগাড়িটাও নতুন ছিল তখন। আমি আর বোন তখন একই রকম ফ্রক পরতাম দু’সাইজ ছোট-বড়। স্কুল থেকে ফিরে বাড়ির সামনের খোলা চত্ত্বর’টায় ছোঁয়াছুয়ি... কুমীরডাঙা... তখন পাউরুটিওয়ালা আসতো। আমাদের প্রতিদিনের টিফিনের বরাদ্দ পাউরুটি নেওয়া হত তার কাছ থেকে। বাপি স্কুল থেকে ফিরে তিন টাকা রেখে দিত টি.ভি.’র টেবিলে। পাউরুটিওয়ালা ডোরবেল বাজালেই আমি আর বোন ছুট ছুট! কে আগে টাকা নিতে পারে, কে আগে দাম দিতে পারে, কারণ আড়াই টাকার পাউরুটি’র পর বাকি আট আনার প্রজাপতি বিস্কুট বা কাপ কেক প্রাথমিকভাবে তার পাওনা হত। সে দয়া করে অন্যজন’কে দিতে পারে (দয়া অবশ্য রোজ’ই করা হত, পরেরদিন যে কেউ জিততে পারে সেইটে মাথায় রেখে)! নয়ন পাউরুটিওয়ালা হাসতো আমাদের দেখে। ছোটখাটো চেহারা লোকটা’র, ভেবে অবাক লাগতো কি ভাবে ওই একটা গাড়ি ঠেলে ঠেলে গোটা শহর চক্কর মারে সে! জিগেস করতাম মাঝে মাঝে,
“তোমার খিদে পায় না? এত যে হাঁটো?”
“পাবে না কেন? তখন খেয়ে নি!”
“কি খাও? পাউরুটি? কেক?”
“না না!!” হো হো করে হাসতো নয়ন পাউরুটিওয়ালা, “ভাত খাই, দোকানে গিয়ে...”
“এত কেক থাকতেও ভাত খাও?”
“ওটা তো বেচার কেক, খেলে হবে?”
….
“আচ্ছা, তুমি চান করলে কোথায়?”
“পুকুরে!”
“জামা কই? গামছা কই?”
“গাড়ির ভেতর বাক্স আছে, তাতে জামা আছে, গামছা আছে, তেল সাবান সব আছে...”
“কোন পুকুরটার চান করো? সরকার কাকুদের পুকুরে?”
“ওখানে আমায় ঢুকতেই দিবে না...”
“ও... তাহলে?”
“কত পুকুর আছে...”


পাউরুটির দাম আড়াই থেকে তিন, সাড়ে তিন, চার, সাড়ে চার, পাঁচ, ছয়, সাত হয়ে গেল। আমিও পাউরুটিওয়ালার থেকে অনেক ছোট থেকে তার সমান হয়ে তার চেয়েও লম্বা হয়ে গেলাম! প্রথমে যখন পাউরুটিওয়ালা আসত আমরা কুমীরডাঙা খেলতাম... তারপর খেলতাম ব্যাডমিন্টন... তারপর কলেজ থেকে ফেরার পথে শুনতাম ‘ভোঁওওপুউ! ভোঁওওপুউ!’ অন্য পাড়ায় পাউরুটিওয়ালার গাড়ি ঘুরছে।  আমি তখন ক্যান্টিনে লাঞ্চ করি, বোন কলকাতায় চলে এসেছে, টিফিনে আর আমাদের বাড়িতে পাউরুটি খায় না কেউ।

লোকটার সাথে আমার পরিচয় বছর পনেরো’র। অবাক লাগতো ভেবে যে ওর নামটাও জানতাম না! নয়ন পাউরুটিওয়ালার নাম’টা হল বেকারির নাম... নয়ন বেকারি... পাউরুটিওয়ালার নাম’টা মো্টেই জানতাম না। ওর ব্যাপারে ব্যাক্তিগত খবর জানতাম দু’টো। এক, লোকটা মুসলমান, ঈদ আর মুহাররমে আসতো না, ঈদের আগের দিন “আমি তো কাল আসবো না” বলে দুটো পাউরুটি দিয়ে যেত... আর দুই, লোকটার একটা মেয়ে ছিল, আমাদের চেয়ে অনেক ছোট, তার জন্যে আমাদের পুরোনো বই, পুরোনো সোয়েটার মা দিত ওকে মাঝে মাঝে, দেখেছি। আর কিছু জানতাম না ওর ব্যাপারে, আর কে জানে কেন, জানার তাগিদও অনুভব করিনি কখনও...


আলোআঁধারির ভেতর হঠাত সেই খুব চেনা ‘ভোঁওওপুউ! ভোঁওওপুউ!’ শুনে নস্টালজিয়ায় ভেসে গেছিলাম ক’টা মুহুর্ত, নয়ন পাউরুটিওয়ালা একগাল হেসে বলল, “ভালো আছো? তোমাকে তো দেখিইনা আজকাল... অনেক দিন দেখি না...”


আমিও হাসলাম, “হ্যাঁ, এখন কলকাতা চলে গেছি গো... বছরতিনেক হল... চাকরি... তুমি ভালো আছো?”


হেসে ঘাড় হেলালো নয়ন পাউরুটিওয়ালা, ভালো আছে। আলো দপদপ করছে যদিও, তবু মনে হল যেন অনেকটা বুড়ো হয়ে গেছে এক ঝটকায়, হয়তঃ অনেকদিন দেখিনি, তাই এরকম লাগছে... হতে পারে...


“কেক নেবে? বড়দিনের ভালো ফ্রুটকেক আছে...” জিগেস করল ও।
“দাও”, কতকটা ভদ্রতা রাখতেই বললাম... তেইশ তারিখ থেকে পাগলামি করে চলা খচখচানি’টা আবার হাত গোটাল যেন... কেক নিয়ে যা কান্ড চলছে কাল থেকে... নেব আবার?!

“ছোট একটা দাও...” যোগ করে দিলাম আমি।
“ছোট নেবে? বোন, মা... সবার হবে ছোট’তে?... এইটা নাও...” আমার হয়ে নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় সে, “এটা ভালো হবে...”


দাম দিতে দিতে বললাম, “তোমার মেয়ে কেমন আছে?” এখন তো আর ছোটবেলার সেই অর্থহীন প্রশ্নগুলো করতে পারি না, তাই সামান্য যে ব্যাক্তিগত অংশটুকু তার জানি, তার থেকেই আদ্ধেকটা সম্বল করে জিগেস করলাম, “ভালো?”


একগাল হাসল নয়ন পাউরুটিওয়ালা, “ভালো আছে... ওকে বারাসতের কাছে একটা ইস্কুলে দিলাম, মাসে ন’শো টাকা লাগে, থাকা, খাওয়া, পড়া, টিউশনি... ইলেবেনে উঠলো তো... ভালো পাশ করেছে আগের বার...”


“বাহ্‌!!” আমিও হাসলাম, “ভালো হবে, দেখো...”


ঘাড় হেলিয়ে আরেকবার হেসে হাঁটা লাগালো লোকটা। মোড় ঘুরে গেল গাড়ি। খানিকবাদে শোনা গেল একবার, ‘ভোঁওওপুউ! ভোঁওওপুউ!’


গার্লস স্কুলের দিকে আর গেলাম না। উলটো পথ ধরলাম বাড়ি ফেরার। নানারকম সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে ডোরবেল বাজালাম। দরজা খুলেই আঁতকে উঠল বোন, “আবাআআআর...!?!”

বুঝলাম, হাতে কেকের বাক্স, ও নিঃসন্দেহে আমায় পাগল ভাবছে। কি আর বলবো! বিড়বিড় করে বললাম, “নয়ন পাউরুটিওয়ালা ধরিয়ে দিল...”
বোন গজগজ করে বলল, “কিনছো কেনো, তু্মি খাবে সব...!”
তুই থেকে তুমি... মানে বোন সিরিয়াস!


আর কথা বাড়ালাম না। পড়ার টেবিলে বসলাম বই খুলে। ঝামেলার সময় এটাই আমার বাড়ির যাকে বলে 'সেফেস্ট কর্ণার', আমার একুশ বছরের অভিজ্ঞতা তাই বলে!


খানিক বাদে মা “জলখাবার!” বলে ঠকাস করে এক ডিশ ভর্তি আমার সদ্য কেনা কেকের টুকরো  রেখে গেল। আমতা আমতা করে কিছু একটা বলতে বলতে একটুকরো কেক মুখে ঢুকিয়েছি আর...

আর... কিছু বলতেই ইচ্ছে করল না! আমেজে চোখ বুজে এল যেন! আরেকখানা টুকরো মুখে ঢোকালাম তক্ষুনি... আহা...


মুখে যা ঢুকিয়েছি সেটা হল একটা টিপিক্যাল ফ্রুটকেক... সেটা প্রাথমিকভাবে একটা হলদেটে প্যাকেটে মোড়ানো ছিল, ‘নয়ন বেকারি’ লেখা একটা কাগজ প্যাকেটের গায়ে সাঁটা ছিল... কেকের ওপরটা শক্ত শক্ত, ভেতরে কালো কালো কিসমিস, বড় বড় মোরব্বা, একখানা কাজু আর খুব কপাল ভালো থাকলে নিচের কোণার দিকে আধখানা চেরি পাওয়া গেলেও যেতে পারে। কিন্তু সেই মূহুর্তে সেটা আমার কাছে অমৃতের বাড়া মনে হল আর প্যারালেলি মনে হল, এতক্ষণে ক্রিসমাস’টা বেশ ‘মেরি’ ক্রিসমাস হল!

Leave a Reply

Subscribe to Posts | Subscribe to Comments

- Copyright © পাঁচমিশেলি - - Powered by Blogger - Designed by সায়ংতরী -