Popular Post

Showing posts with label প্রতিদিনের গল্প. Show all posts

স্বীকারোক্তি, আমি আর একরাশ বাজে-বকা

By : Sayantari Ghosh


জানেন ত, আজকে স্বীকারোক্তি দিবস...? (কি যেন একটা ইংরিজি নামও ছিল...ভুলে গেছি!)
একখানা সিরিয়াস স্বীকারোক্তি করা নাকি আজকের দিনে যাকে বলে একেবারে মাস্ট! “সিরিয়াস স্বীকারোক্তি” বুঝলেন না? মানে ওই ধরুন “ছোটবেলায় আমি ধুলোবালি, মাটি, ছাই এসব হাতে পেলেই বেমালুম খেয়ে ফেলতাম” বা “গতকাল আমি ২১৫ নয়,৭১ নম্বর বাসে উঠেছিলাম আসলে” কিম্বা “ওই কাঁচের ফুলদানিটা... মানে আমারই হাত থেকে পড়ে...” এই জাতীয় অ-সিরিয়াস স্বীকারোক্তি সব বাতিলের খাতায়... বুঝলেন এইবারে?
এখন আপনারা ত জানেন (?) এসব দিনক্ষণ আমি কি নিষ্ঠার সাথে মেনে চলি! অনেক ভেবে দেখলাম, কাজটা যখন করতেই হবে তখন ব্লগটাই সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা... আমার ভ্যাজর-ভ্যাজরে চূড়ান্ত বিরক্ত হলেও কেউ আমায় চাঁদা তুলে গণপিটুনি অন্ততঃ দিতে পারবে না এখানে!
অতএব......শুরু করি তাহলে...!
শুরু'টা করবো একটা প্রশ্ন দিয়ে। আচ্ছা, মনে করুন, আপনাকে জিগেস করলুম যে একখানা এরকম টপিক বলুন দেখি, যেটা নিয়ে আপনার বেসিকালি কিচ্ছু এসে যায় না, কিন্তু তবু  কেউ সেই নিয়ে গল্প শোনাতে চাইলে আপনি নন্দলালের মালাই চমচম খাওয়ার অফার'ও হেলায় উপেক্ষা করে বসে পড়বেন? নিশ্চয়ই এরকম পছন্দের বিষয় কিছু আছে... যেমন ধরুন ভূত? বা ভিন গ্রহের প্রাণী...? বা ধরুন, দাম্পত্য-কলহ? আছে নিশ্চয়ই...? আমার তেমনই বহুদিনের আকর্ষণ একটি শব্দের প্রতি ... শব্দটি হল “ক্রাশ”! এই সব গল্পের চুম্বকে আমি এক্কেবারে বাঁধা, সে মায়া বোধহয় এ-জন্মে আর কাটিয়ে উঠতে পারব না!!! আমি ক্রাশের আড্ডা বড্ড ভালোবাসি, আর সে সব আড্ডা বসলেই আমার মনের অন্ধকার আউটহাউসের বাসিন্দা আমারই অংশবিশেষ কোনো এক দুরাত্মা (তার কদমছাঁট চুল, মারাত্মক লালচে চোখ আর মাথায় দুখানা ছোট্ট ছোট্ট শিং!! তাকে আমি মাঝেমধ্যেই মানসচক্ষে দেখতে পাই!) বসে বসে বিচ্ছিরিভাবে দাঁত বের করে হাসে আর বলে, “ভাবছিস কি?? সবাই এখানে ক্রাশের গল্প শোনাবে...?! খুব মজা, না? খ্যাঁক খ্যাঁক, খোঁক খোঁক...”
আজ বড় ভালো দিন— মিথ্যে বলব না— ওই শিংওয়ালা শয়তানটার কথার পুরোপরি সত্যি— ক্রাশ-টাশের গল্প আমার ভাই বেজায় ভাল লাগে— আপনারা হয়তঃ বিশ্বাস করবেন না, ভাববেন বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলছি, কিন্তু সেরকম গল্প বলার লোক পেলে আমি সারাজীবনটা খাটের ওপর এলিয়ে বসে, বাদামভাজা খেয়ে আর ক্রাশের গল্প শুনে মজাসে কাটিয়ে দিতে পারি— এসব রোমাঞ্চকর কাহিনীর আমি চিরন্তন একনিষ্ঠ শ্রোতা!
কিন্তু ভাল শ্রোতা হওয়ার একটা গুরুতর অসুবিধা আছে। তাতে আপনি চিরকাল শুনতেই থাকেন, কেউ আর আপনার কাছে কখনো কিচ্ছুটি শুনতে চায় না!
আমারও সেই একই ঝামেলা! রাজ্যের লোকজন এসে আমাকে রকমারি গল্প শুনিয়ে যায়, আমিও শোনার আনন্দে সেসব গোগ্রাসে গিলে ফেলি... কিন্তু তাই বলে বুঝি আমার বলার মত কিছু থাকেনা? আমার বুঝি এক-দুটো ক্রাশের গল্প থাকতে নেই? যাচ্ছেতাই একেবারে...!
সে যাই হোক, আজ তাই আমার সিরিয়াস স্বীকারোক্তিটি আমার প্রথম ক্রাশ বিষয়ক একখানি দূর্লভ কাহিনী। দীর্ঘকাল যাবত্ পুরনো গল্পের বস্তায় পড়ে থাকার দরুন পচে-টচে গেলে অবিশ্যি জানিনে...!(শুনেছি স্বীকারোক্তি ব্যাপারটা নাকি বেশ কষ্টকর; আমার এরকম ভয়ানক আনন্দ হচ্ছে কেন, কে জানে!)
প্রথম ক্রাশ জিনিসটা আমার বান্ধবীদের মধ্যে ঘটে গেছিল ওই ক্লাস সেভেন-টেভেন নাগাদ। আমি সেই সময় ঠিক কি করছিলাম অনেক চেষ্টা করেও কখনও সেটা মনে পড়েনা! ওই সবার গপ্পোগাছা শুনতে গিয়েই কাল হয়েছিল হয়তঃ...
আমার বাবার ইস্কুলের ছাত্র'রা সকাল-বিকেল দঙ্গল বেঁধে আমাদের বাড়ি আসত মাঝে মাঝেই। সেদিকেও আমার তেমন উত্সাহ ছিল না। কিন্তু...... ব্যাতিক্রমী ঘটনাটি ঘটল! তখন আমি ক্লাস নাইন। এক শনিবারে স্কুলের পর ঘন্টাদেড়েক গানের রিহার্সাল করে, খিঁচড়ানো মেজাজে, স্কুলড্রেসের হলুদ শাড়িতে হোঁচট খেতে খেতে বাড়ি ফিরছি। মাথায় তখন খালি ঘুরছে পরদিনের টিউশনের পরীক্ষাটার কথা...

হঠাত্ রাস্তার পাশ থেকে কে যেন বলে উঠল, “আচ্ছা, সুজনস্যারের বাড়িটা কোনদিকে?”
গলার স্বরের মালিকের দিকে চোখ পড়তেই আমি থ! বুকের মধ্যে একসাথে হাজারখানা কাঁসর-ঘন্টা বাজতে শুরু করল হঠাত্! একি দেবদূত নাকি রে বাবা? কিছুক্ষন হাঁ করে তাকিয়ে থাকার পর বুঝলাম যে, না, এ দেবদূত নয়; দেবদূতরা CBZ বাইক চালায় না!
সে আমার এই বিহ্বলতা লক্ষ্য করেছিল কিনা জানিনা। সে আবার বলল, “আমি সুজনস্যারের বাড়িটা খুঁজছিলাম; আপনি চেনেন?”
কোনোক্রমে হাত উঠিয়ে বাড়ির দরজাটা দেখিয়ে দিলাম। এটুকুও বলা গেল না যে সেতো আমাদেরই বাড়ি..! যাকে বলে একেবারে দর্শন এবং সম্মোহন... কয়েক ন্যানোসেকেন্ড সময় লেগেছিল হয়তঃ...
পরে জেনেছিলাম বাপির কোন এক চেনা ডাক্তারবাবু তাঁর তনয়রতনটির জয়েন্টের স্পেশাল কোচিং-এর জন্য বাপিকে রিকোয়েস্ট করেছেন। বাপিকে সাধারণতঃ এ ধরনের অনুরোধের ফাঁদে ফেলা যায় না; এবারেই কি করে না জানি অঘটনটা ঘটে গেছে। ব্যাপারটা শোনামাত্র আমার উত্তেজিত প্রাণের মধ্যে একটা দৈব-নির্দেশিত ঘটনার ইঙ্গিত আরো স্পষ্ট হয়ে গেল এক্কেবারে! আর তার ওপরে যখন শুনলাম যে প্রতি শনিবারই সাড়ে তিনটে নাগাদ তার আগমন ঘটবে, তখন এত আনন্দ রাখব কোথায়, এই নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেলাম!
এরপর থেকে শুরু হল এক অদ্ভুত রুটিন! বাড়ির সবাইকে দিবানিদ্রার সুযোগ দিয়ে স্বার্থত্যাগী (?) আমি শনিবারের ভর দুপুরগুলো অঙ্ক খাতা নিয়ে দিন-জাগা শুরু করলাম! মা তো মহাখুশি! মাধ্যমিকের বছর মেয়ে দুপুরে টানটান পাঁচঘন্টা না ঘুমিয়ে অঙ্ক খাতা নিয়ে বসলে মায়ের খুশি হওয়াটাই স্বাভাবিক। আর আমি? সেই “পাপা কেহতে হ্যায়...” গানের স্টাইলে সারা দুপুর “চমকিত মন, চকিত শ্রবণ, তৃষিত আকুল আঁখি” নিয়ে দুরুদুরু বক্ষে বসে থাকতাম— অপেক্ষা— কখন সে আসবে আর আমি দরজাটা খুলে দেব! সে রোমাঞ্চ ভাষায় বলার মতন অত বাংলা আমি শিখিনি এখনও...!
এতদূর শুনে যদি আপনি একটা দারুন প্রেমের গল্পের গন্ধ পাচ্ছেন, তাহলে মহাভুল করছেন মশাই! গল্পের মুখ্য পাত্রীটি যে আমি সেটা বুঝি নির্ঘাত ভুলে মেরে দিয়েছেন? মাসছয়েক ধরে আমি ওই দরজা খোলার কাজটি বড় দায়িত্ব নিয়ে, ভীষণ নিপুণতার সাথে করে গেলাম আর তারপর...? 
তারপর আর কি? জয়েন্ট পেয়ে গিয়ে সে যথারীতি বিদায় নিল!
সেই দুঃখে মাসখানেক মুহ্যমান হয়ে ছিলাম। আমার বন্ধুরা বলে সেসময় নাকি আমার মধ্যে বেশ একটা বৈরাগ্য-গোছের ভাব এসছিল; ওদের নাকি ভয় হয়েছিল যে তার নামের মালা জপ করেই বোধহয় আমার বাকি জীবনটা কেটে যাবে... যাই হোক, ঘাড়ের ওপর হুড়মুড়িয়ে মাধ্যমিক পরীক্ষাটা এসে গিয়ে আমার বৈরাগ্য-টৈরাগ্যের সব্বোনাশ করে দিলে... নইলে আমায় নিয়েও কত্তো কবিতা-উপন্যাস লেখা হত, দেখতেন!
শেষমেশ আর একটা কথা বলি। মাধ্যমিকে অঙ্কে সঅঅব ঠিক করে এসছিলাম; তবু একশ হয়নি। প্রথমে দুঃখ পেলেও পরে বুঝেছিলাম এ আমারই পাপের ফল বই আর কিছু নয়। শনিবারের ওই দুপুরগুলো অঙ্ক করার ব্যাপারটা যে শুধুই গল্প, সে ত আর মা-বাপি কোনোদিন জানতে পারেনি! রীতিমত ভয় করত মাঝেমাঝে, যে কোনদিন মা এসে ক্যাঁক করে চেপে ধরবে, “প্রতি শনিবার অত্তো অত্তো অঙ্ক করলে তো দশ-বিশ কিলো খাতা জমে যাবার কথা! কোথায় সে সব? দেখি...” ইত্যাদি! যা হোক, সে দুর্দিন আমার আসেনি কখনও।
তা এই হল গিয়ে আমার আজকের স্বীকারোক্তি! আপনার কিন্তু অসাধারণ ‘ইয়ে’.... এখনো পড়ে যাচ্ছেন!! তো এতটা যখন পড়লেনই, আর একটা কাজও করে ফেলুন না! আজ দিনটা সত্যিই খুব ভালো। আপনিও একটা এই জাতের স্বীকারোক্তি করেই ফেলুন না বুকের সমস্ত সাহস একজোট করে...! বলছি শুনুন, কিউপিডের নেকনজরে থাকবেন! বিশ্বাস করুন...

ফ্রুটকেক

By : Sayantari Ghosh


খচখচানি’টার শুরু সেই পরশু দিন... অর্থাত তেইশ তারিখ।


তেইশ তারিখ সন্ধ্যেবেলা যখন অফিস থেকে বেরোলাম পার্কস্ট্রিট যাবো বলে তখনও কেক কেনার ব্যাপার’টা “আজ সন্ধ্যের কাজ”এর লিস্টে জ্বলজ্বল করছে মাথার ভেতরে। অথচঃ ঘন্টাদুয়েক মিতের সাথে বকবক করে তিনবার পার্কস্ট্রিট চক্কর দেওয়ার পর হিজিবিজি ভাবতে ভাবতে যখন মেট্রোয় উঠে পড়লাম, তখন ফ্রুটকেক চাপা পড়ে গেছে দেশ ও জাতির উন্নতি ও পিছিয়ে পড়া বিষয়ক সুদীর্ঘ আলোচনার নিচে!


পরদিন বাড়ি ফেরা! ভাবলুম পার্কস্ট্রিট হল না, কিছু একটা অফিসের পাশ থেকেই কিনে নেবো, ট্রেন ধরার তাড়াহুড়োয় সেটায় ভুলে গেলাম বেমালুম। সন্ধ্যে রাত্তিরে যখন বাড়ি ঢুকছি, মন খারাপ হয়ে গেল এক্কেবারে! এত করে ভেবে রেখেও বড়দিনের আগে একটা কেক আনতে পারলাম না!? মার্কামারা স্মৃতিশক্তি বটে!!


যা হোক গে, আমি ভুললেও মা ভুলে যায় নি মোটেই! এখন আমি আর বোন দু’জনেই হপ্তাবাবু হয়ে গেছি, মাসে বা সেমেস্টারে বাড়ি ফেরে যারা হপ্তাবাবু’দের দর তাদের থেকে কম যদিও, তবু মা উইকএন্ড উত্‌সবগুলো’কে চট করে মিস করেন না। দেখলাম, চার-পাঁচ রকমের বিভিন্ন স্বাদের কেক জড়ো করা হয়েছে বাজার ঘুরে। নানারকম রঙিন বাক্স, জড়ির ফিতে... বাড়ি ঢুকেই ঝাঁপিয়ে পড়লাম একরকম!গপাগপ মুখে পুরে ফেললাম অনেকখানি। কিন্তু কেমন যেন একটা খচখচানি... কে জানে কেন, মনে হল, “কি যেন নেই-নেই... কেমন ”... সে’কথা আর মা’কে বললাম না!


পরদিন বোনের সাথে বাজার বেরিয়েছি। আরো কতগুলো “দ্য রিয়েল ফ্রুটকেক” ইত্যাদি লেখা, নামী কোম্পানীর সিল-মারা বাক্স কিনে বাড়ি ফিরলাম! মা চোখ পাকালেন, আমি অপরাধীর মত মুখ করে নতুন আনা বাক্সগুলো থেকে কোণা ভেঙ্গে মুখে দিলাম...
দুত্তেরি!! এ কি রে বাবা? রিয়েল ফ্রুটকেক?! রাশি রাশি টাকা নিলে এরজন্যে?! মাথা গরম হয়ে গেল!


বোন সেই কেক দু'খানা ঝপাঝপ সাবাড় করে ঘোষনা করল যে আমার কেকটেস্টিং’এর কাজ ছেড়ে ইমিডিয়েটলি তেলেভাজায় শিফট করা উচিত, আমার কিছু একটা সিভিয়ার প্রবলেম হয়েছে!


মন খারাপ করে বেরিয়ে পড়লাম। তখন সন্ধ্যে হয়ে গেছে, আমাদের পাড়ার মোড় থেকে মিশনারি গার্লস স্কুলের চার্চ’টা দ্যাখা যায়, ইচ্ছে করলো ও’দিক থেকে ঘুরে আসি। গলি’র মুখের স্ট্রিটলাইট’টা ক’দিন থেকে খালি দপদপ করছে... আলোছায়া, ছায়া আলো... আমি কিছু একটা ভাবছিলাম, তবে খুব নিটোল কিছু নয়, অন্যমনস্ক’ই ছিলাম হয়তঃ... হঠাত একটা আচমকা ‘ভোঁওওপুউ! ভোঁওওপুউ!’ শব্দ শুনে বিচ্ছিরি রকম চমকে গেলাম! তাকিয়ে দেখি, আমাদের নয়ন পাউরুটিওয়ালা।

নয়ন পাউরুটিওয়ালার খালি নাম বললে পুরো’টা বলা হয় না। ওর সাথে আমার আলাপ তখন, যখন আমি ক্লাস ওয়ান। তখন এই পাড়া’টা নতুন, আমাদের বাড়ি’টা নতুন; পাউরুটিওয়ালার ঠেলাগাড়িটাও নতুন ছিল তখন। আমি আর বোন তখন একই রকম ফ্রক পরতাম দু’সাইজ ছোট-বড়। স্কুল থেকে ফিরে বাড়ির সামনের খোলা চত্ত্বর’টায় ছোঁয়াছুয়ি... কুমীরডাঙা... তখন পাউরুটিওয়ালা আসতো। আমাদের প্রতিদিনের টিফিনের বরাদ্দ পাউরুটি নেওয়া হত তার কাছ থেকে। বাপি স্কুল থেকে ফিরে তিন টাকা রেখে দিত টি.ভি.’র টেবিলে। পাউরুটিওয়ালা ডোরবেল বাজালেই আমি আর বোন ছুট ছুট! কে আগে টাকা নিতে পারে, কে আগে দাম দিতে পারে, কারণ আড়াই টাকার পাউরুটি’র পর বাকি আট আনার প্রজাপতি বিস্কুট বা কাপ কেক প্রাথমিকভাবে তার পাওনা হত। সে দয়া করে অন্যজন’কে দিতে পারে (দয়া অবশ্য রোজ’ই করা হত, পরেরদিন যে কেউ জিততে পারে সেইটে মাথায় রেখে)! নয়ন পাউরুটিওয়ালা হাসতো আমাদের দেখে। ছোটখাটো চেহারা লোকটা’র, ভেবে অবাক লাগতো কি ভাবে ওই একটা গাড়ি ঠেলে ঠেলে গোটা শহর চক্কর মারে সে! জিগেস করতাম মাঝে মাঝে,
“তোমার খিদে পায় না? এত যে হাঁটো?”
“পাবে না কেন? তখন খেয়ে নি!”
“কি খাও? পাউরুটি? কেক?”
“না না!!” হো হো করে হাসতো নয়ন পাউরুটিওয়ালা, “ভাত খাই, দোকানে গিয়ে...”
“এত কেক থাকতেও ভাত খাও?”
“ওটা তো বেচার কেক, খেলে হবে?”
….
“আচ্ছা, তুমি চান করলে কোথায়?”
“পুকুরে!”
“জামা কই? গামছা কই?”
“গাড়ির ভেতর বাক্স আছে, তাতে জামা আছে, গামছা আছে, তেল সাবান সব আছে...”
“কোন পুকুরটার চান করো? সরকার কাকুদের পুকুরে?”
“ওখানে আমায় ঢুকতেই দিবে না...”
“ও... তাহলে?”
“কত পুকুর আছে...”


পাউরুটির দাম আড়াই থেকে তিন, সাড়ে তিন, চার, সাড়ে চার, পাঁচ, ছয়, সাত হয়ে গেল। আমিও পাউরুটিওয়ালার থেকে অনেক ছোট থেকে তার সমান হয়ে তার চেয়েও লম্বা হয়ে গেলাম! প্রথমে যখন পাউরুটিওয়ালা আসত আমরা কুমীরডাঙা খেলতাম... তারপর খেলতাম ব্যাডমিন্টন... তারপর কলেজ থেকে ফেরার পথে শুনতাম ‘ভোঁওওপুউ! ভোঁওওপুউ!’ অন্য পাড়ায় পাউরুটিওয়ালার গাড়ি ঘুরছে।  আমি তখন ক্যান্টিনে লাঞ্চ করি, বোন কলকাতায় চলে এসেছে, টিফিনে আর আমাদের বাড়িতে পাউরুটি খায় না কেউ।

লোকটার সাথে আমার পরিচয় বছর পনেরো’র। অবাক লাগতো ভেবে যে ওর নামটাও জানতাম না! নয়ন পাউরুটিওয়ালার নাম’টা হল বেকারির নাম... নয়ন বেকারি... পাউরুটিওয়ালার নাম’টা মো্টেই জানতাম না। ওর ব্যাপারে ব্যাক্তিগত খবর জানতাম দু’টো। এক, লোকটা মুসলমান, ঈদ আর মুহাররমে আসতো না, ঈদের আগের দিন “আমি তো কাল আসবো না” বলে দুটো পাউরুটি দিয়ে যেত... আর দুই, লোকটার একটা মেয়ে ছিল, আমাদের চেয়ে অনেক ছোট, তার জন্যে আমাদের পুরোনো বই, পুরোনো সোয়েটার মা দিত ওকে মাঝে মাঝে, দেখেছি। আর কিছু জানতাম না ওর ব্যাপারে, আর কে জানে কেন, জানার তাগিদও অনুভব করিনি কখনও...


আলোআঁধারির ভেতর হঠাত সেই খুব চেনা ‘ভোঁওওপুউ! ভোঁওওপুউ!’ শুনে নস্টালজিয়ায় ভেসে গেছিলাম ক’টা মুহুর্ত, নয়ন পাউরুটিওয়ালা একগাল হেসে বলল, “ভালো আছো? তোমাকে তো দেখিইনা আজকাল... অনেক দিন দেখি না...”


আমিও হাসলাম, “হ্যাঁ, এখন কলকাতা চলে গেছি গো... বছরতিনেক হল... চাকরি... তুমি ভালো আছো?”


হেসে ঘাড় হেলালো নয়ন পাউরুটিওয়ালা, ভালো আছে। আলো দপদপ করছে যদিও, তবু মনে হল যেন অনেকটা বুড়ো হয়ে গেছে এক ঝটকায়, হয়তঃ অনেকদিন দেখিনি, তাই এরকম লাগছে... হতে পারে...


“কেক নেবে? বড়দিনের ভালো ফ্রুটকেক আছে...” জিগেস করল ও।
“দাও”, কতকটা ভদ্রতা রাখতেই বললাম... তেইশ তারিখ থেকে পাগলামি করে চলা খচখচানি’টা আবার হাত গোটাল যেন... কেক নিয়ে যা কান্ড চলছে কাল থেকে... নেব আবার?!

“ছোট একটা দাও...” যোগ করে দিলাম আমি।
“ছোট নেবে? বোন, মা... সবার হবে ছোট’তে?... এইটা নাও...” আমার হয়ে নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় সে, “এটা ভালো হবে...”


দাম দিতে দিতে বললাম, “তোমার মেয়ে কেমন আছে?” এখন তো আর ছোটবেলার সেই অর্থহীন প্রশ্নগুলো করতে পারি না, তাই সামান্য যে ব্যাক্তিগত অংশটুকু তার জানি, তার থেকেই আদ্ধেকটা সম্বল করে জিগেস করলাম, “ভালো?”


একগাল হাসল নয়ন পাউরুটিওয়ালা, “ভালো আছে... ওকে বারাসতের কাছে একটা ইস্কুলে দিলাম, মাসে ন’শো টাকা লাগে, থাকা, খাওয়া, পড়া, টিউশনি... ইলেবেনে উঠলো তো... ভালো পাশ করেছে আগের বার...”


“বাহ্‌!!” আমিও হাসলাম, “ভালো হবে, দেখো...”


ঘাড় হেলিয়ে আরেকবার হেসে হাঁটা লাগালো লোকটা। মোড় ঘুরে গেল গাড়ি। খানিকবাদে শোনা গেল একবার, ‘ভোঁওওপুউ! ভোঁওওপুউ!’


গার্লস স্কুলের দিকে আর গেলাম না। উলটো পথ ধরলাম বাড়ি ফেরার। নানারকম সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে ডোরবেল বাজালাম। দরজা খুলেই আঁতকে উঠল বোন, “আবাআআআর...!?!”

বুঝলাম, হাতে কেকের বাক্স, ও নিঃসন্দেহে আমায় পাগল ভাবছে। কি আর বলবো! বিড়বিড় করে বললাম, “নয়ন পাউরুটিওয়ালা ধরিয়ে দিল...”
বোন গজগজ করে বলল, “কিনছো কেনো, তু্মি খাবে সব...!”
তুই থেকে তুমি... মানে বোন সিরিয়াস!


আর কথা বাড়ালাম না। পড়ার টেবিলে বসলাম বই খুলে। ঝামেলার সময় এটাই আমার বাড়ির যাকে বলে 'সেফেস্ট কর্ণার', আমার একুশ বছরের অভিজ্ঞতা তাই বলে!


খানিক বাদে মা “জলখাবার!” বলে ঠকাস করে এক ডিশ ভর্তি আমার সদ্য কেনা কেকের টুকরো  রেখে গেল। আমতা আমতা করে কিছু একটা বলতে বলতে একটুকরো কেক মুখে ঢুকিয়েছি আর...

আর... কিছু বলতেই ইচ্ছে করল না! আমেজে চোখ বুজে এল যেন! আরেকখানা টুকরো মুখে ঢোকালাম তক্ষুনি... আহা...


মুখে যা ঢুকিয়েছি সেটা হল একটা টিপিক্যাল ফ্রুটকেক... সেটা প্রাথমিকভাবে একটা হলদেটে প্যাকেটে মোড়ানো ছিল, ‘নয়ন বেকারি’ লেখা একটা কাগজ প্যাকেটের গায়ে সাঁটা ছিল... কেকের ওপরটা শক্ত শক্ত, ভেতরে কালো কালো কিসমিস, বড় বড় মোরব্বা, একখানা কাজু আর খুব কপাল ভালো থাকলে নিচের কোণার দিকে আধখানা চেরি পাওয়া গেলেও যেতে পারে। কিন্তু সেই মূহুর্তে সেটা আমার কাছে অমৃতের বাড়া মনে হল আর প্যারালেলি মনে হল, এতক্ষণে ক্রিসমাস’টা বেশ ‘মেরি’ ক্রিসমাস হল!

- Copyright © পাঁচমিশেলি - - Powered by Blogger - Designed by সায়ংতরী -