Popular Post

Showing posts with label এমনি গল্প. Show all posts

অন্যরকম

By : Sayantari Ghosh
কলেজের পর সেই যে শহর ছেড়েছি, তারপর আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব মিলিয়ে অন্ততঃ খান তিরিশেক বিয়েবাড়ি মিস্‌ করেছি। তারজন্য অন্তরটিপুনিও খেয়েছি ঢের! খারাপও লেগেছে অনেকবার, ইচ্ছে থাকলেও আসতে পারিনি অনেকের বিয়েতে নানা কারণে। কিন্তু, চূর্ণির বিয়েতে কে জানে কি করে ছুটি’টা ম্যানেজ হয়ে গেল।
চূর্ণি আমার আজন্মকালের ক্লাসমেট। আমাদের ঠিক প্রিয়তম বান্ধবী বলা যায় না, তবে বয়সের হিসেবে আমাদের বন্ধুত্ব প্রায় আমাদেরই সমবয়সী। আমি চিরকালীন বইমুখো, মুখচোরা আর চূর্ণি দূর্ধর্ষ ডাকাবুকো, সুন্দরীও বটে। আর বিজ্ঞানে তো বলেই যে ‘বিপরীতে বন্ধুত্ব অবশ্যম্ভাবী...!’ আসলে সত্যি বলতে আমি ছিলাম চূর্ণির গুণপণায় মুগ্ধ। ওর বিশেষত্ব ছিল সব্বার থেকে আলাদা হয়ে থাকায়, মানে যাকে বলে অন্যরকম... ‘হট্‌কে!’
তখন আমরা স্কুলে। যে বয়েস’টা থেকে ছেলেদের সাইকেলগুলো ভিড় জমাতে শুরু করে গার্লস স্কুলের বাসস্টপে, সেই তেরো-চোদ্দ’র কাছাকাছি। ওইসময়টায় মেয়েদের আড্ডাতেও কিন্তু চুপিসারে ঢুকে পড়ে কিছু আপাত-সেন্সর্‌ড্‌ প্রশ্ন... “কেমন ছেলে ভালো লাগে?” “কেমন বর চাই?” “ফর্সা?” “টল, ডার্ক, হ্যান্ডসাম?”
পঁচিশ-ছাব্বিশ আসতে আসতে এইসব প্রশ্নের উত্তরে পালিশ পড়ে যায় প্রচুর, চোদ্দ’র সেই আনকোরা, ছিমছাম, টাটকা ভাব’টা থাকে না তখন আর। বছর এগারো বারো পেরিয়েও কারো উত্তর একতারার মত একসুরে বাজে চিরকাল, কারো উত্তর মাঝপথে আঘাত খেয়ে বিপ্রতীপ হয়ে দাঁড়ায় হঠাত্‌ কখনো, কারো উত্তরে আবার বয়েসের ছাপ পড়ে; ছেলেমানুষী কাটিয়ে ‘ম্যাচিউওর্‌ড্‌’ হয় সেগুলো। খুব হাতেগোনা কেউ কেউ এরকমও থাকে যাদের উত্তর’টা প্রথমদিন থেকেই পাকাপোক্ত, তাদের ম্যাচিউরিটির আর কিছু বাকি নেই! চূর্ণি ছিল এরকম একজন। প্রেমবিষয়ে তার এ’সব চোস্ত উত্তরের সৃষ্টিরহস্য কোনোকালেই আবিষ্কার করে উঠতে পারিনি বলেই বোধহয় ওর প্রতি মুগ্ধতা’টাও কাটিয়ে উঠতে পারিনি কখনও। স্কুল কিম্বা কলেজ, চিরকাল ওর “কেমন বর চাই” এর উত্তর ছিল ঝরঝরে, চাঁচাছোলা আর সাঙ্ঘাতিক ‘ম্যাচিউওর্‌ড্‌’, “ওসব লম্বা, ফর্সা, কোঁকড়ানো চুল নিয়ে কি চলবে সারাজীবন? চিরদিন থাকবে নাকি ওসব? আমি তো বলবো আমার বর কালো হোক, ভূঁড়িওয়ালা হোক, একমাথা টাক হোক... এমন হোক যাতে তোদের কারোর পছন্দ না হয়... কিছু পেটে কিছু বিদ্যে থাক, বুদ্ধি থাক কিছু ঘটে, একটা ঠিকঠাক চাকরি আর একটা ভালো মন... ব্যাস, আর কিচ্ছু চাই না!” ক্লাস এইটে ওর এইসব ধারালো জবাব শুনে শুধু আমি নই (আমি তো না হয় ক্লাসের চিরকালীন শ্রীমতি হাঁদাগঙ্গারাম) অনেক চোখা-বাক্যবাগীশও বেশ খানিকটা থমকে যেত বই কি!
সেভেন-এইটে ‘বর’ সংক্রান্ত আলোচনার বসবাস ছিল কানাঘুষোয় আর ফিস্‌ফিসানিতে; বছর তিনেক পেরোতে না পেরোতেই সে সব আড্ডা ‘রে রে’ করে ফ্রন্ট পেজে এসে পড়লো। টিউশনের খাতা দেওয়া-নেওয়ার গল্পগুলোই তখন হল মুখ্য সমাচার! অনেকেই সগৌরবে প্রেমে পড়ার খবর দিল, দু’একজন মনের আনন্দে চকোলেটও খাওয়ালো! আর আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম যে কোচিং সেন্টারের মোস্ট এলিজিবল ব্যাচেলার, যাকে দেখে ক্লাসের অনেকেই “কী ভীষওওওণ কিউউউট...!!” বলতে গিয়ে দম আটকে ফেলত, কে জানে কি করে, চূর্ণির সাইকেল জুড়ি বেঁধেছে সেই শাহনওয়াজ হুসেনের সাইকেলের সাথে। এক্কেরে অবাক হয়ে গেছিলাম। ভেবেছিলাম, শাহনওয়াজের বিদ্যেবুদ্ধির বহর, কই, নজরে তো পড়ে নি আমার সে ভাবে... ইলেভেনে একবার ফেল করে আমাদের সাথে পড়েছে যদ্দূর জানি... হ্যাঁ, সে লম্বা বটে, ফর্সাও বটে, খানিকটা ‘কিউট্‌’ও হয়তো... কিন্তু... চূর্ণির পছন্দ তো অন্যরকম!
একদিন আর থাকতে না পেরে প্রশ্নটা করেই ফেলেছিলাম চূর্ণি’কে। শুনে সে কাঁদো কাঁদো গলায় বলেছিল, “আর বলিস না, ভালোবাসি না বলতেই ব্লেড দিয়ে হাতের পাতায় কেটে কেটে আমার নাম লিখেছে...”
-“অ্যাঁ...! সে কি রে?” আমি বরাবরই ভীতু, দৃশ্য’টা কল্পনা করেই আঁতকে উঠেছিলাম!
-“তাহলে আর বলছি কি? ‘হ্যাঁ’ বলতেই হয়েছে বাধ্য হয়ে, বিশ্বাস কর...”
ওকে বিশ্বাস করি, তাই বিশ্বাস করেছিলাম।
বছর দুয়েকের মধ্যে স্কুলের ব্যাকড্রপ বদলে হল কলেজ। প্রেমের ছবিও বদলালো আরো। আমি যথারীতি দর্শকের ভূমিকায়। প্র্যাক্টিকালের রীডিং আর ক্লাসনোটের খাতা থেকে মুখ তোলার সুযোগ হলেই চলমান লাভস্টোরি’গুলোর খবর নিই। ব্যাপারটা অনেকটা মেগাসিরিয়াল দ্যাখার মত। সাধারণতঃ দিন সাতেকের এপিসোড মিস করে গেলেও বুঝতে খুব একটা সমস্যা হয় না।
চূর্ণি-শাহনওয়াজের কাহিনী খুব ‘প্রেডিক্টেবল টার্নিং’ নিল যখন চূর্ণি ফিলোসফি অনার্স নিয়ে আমার সাথেই কলেজে ঢুকলো আর শাহনওয়াজ দ্বিতীয়বার উচ্চমাধ্যমিক দেওয়ার তোড়জোড় শুরু করলো। আমি মনে মনে ভাবলাম, ‘এ তো হওয়ারই ছিল... চূর্ণির তো পছন্দ’টাই অন্যরকম!’
সুতরাং এমনটা যে হবে আমি খানিকটা আশা’ই করেছিলাম। তবে যেটা মোটেই আশা করিনি সেটা হল চূর্ণি এতজন প্রতিযোগিনীকে টেক্কা দিয়ে মিলন আগরওয়ালের ঝাঁ-চকচকে স্পোর্টস বাইকের পিছনের সিট’টা দখল করে ফেলবে! অনেক মেয়ে দুঃখ পেল, অনেকে চোখ টাটালো, সন্দেহ নেই। অনেকে অবাকও হল, কিন্তু আমি যে কারণে অবাক হলাম, সেটি ছিল সক্কলের চেয়ে আলাদা। আমার মনে মনে আশা ছিল, শাহনওয়াজের ফাঁড়া কাটানোর পর গোলগাল, চশমাপরা, ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট সিনিয়র রূপক সান্যালের সাথেই বোধহয় চূর্ণি পাকাপাকিভাবে সব বন্দোবস্ত করে ফেলবে। রূপকের সাথে চূর্ণির ভাব’ও খুব... বই নেওয়া, খাতা নেওয়া… তবে? মিলন কোত্থেকে ঢুকে পড়ে মাঝখান থেকে?
কৌতূহলের তাড়নায় একদিন চূর্ণিকে পাকড়াও করা গেল। সে খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো, “মাইরি! সব্বাই ভাবছে ভাবুক... তুইও?!”
ভ্যাবাচাকা খেয়ে বললাম, “ম্‌ম্‌... মানে?”
-“মধু, উই আর জাস্ট গুড ফ্রেন্ডস্‌... মি অ্যান্ড মিলন... দু’দিন আমাকে বাসস্টপে কি ড্রপ করেছে, সব্বাই ভাবছে যেন... ... এরকম কিচ্ছু নয়”, শেষ শব্দক’টায় বাড়তি জোর দিয়ে বলল চূর্ণি, “আর আমি এনগেজ হলে তোকে বলবো না মধু? আশ্চর্য্য, তুই তো জানিস আমার কেমন ছেলে পছন্দ...”
মনে মনে বলেছিলাম, “জানি হে জানি, রূপক সান্যাল”, মুখে কিছু বলিনি, হেসেছিলাম খালি।
কলেজের পর খাপছাড়া অরকুট-চিরকুট ছাড়া চূর্ণির সাথে যোগাযোগ তেমন ছিল না। তারপর একদিন হঠাত্‌ ই-মেলে ওর বিয়ের চিঠি পেলাম। মন’টা ভালো হয়ে গেল যখন শুনলাম ছেলে সেরা কলেজের ইঞ্জিনিয়ার, সেরা সরকারি সংস্থার উঁচুপদে ভালো চাকরি করে। রূপক সান্যালের নাম’টা মনে পড়ে হাসি পেল খানিকটা; যাক গে, সে না হোক, মনের মত ছেলে পেয়েছে শেষ অব্দি চূর্ণি।
বহুদিন বাদে শহরে ফেরা, তাও বন্ধুর বিয়েতে। স্কুল কলেজের বন্ধুদের সাথে দ্যাখা, রাতজাগা, ধুন্ধুমার আনন্দ- খুনসুটি-ছেলেমানুষি ঠাট্টায় আর আড্ডায় সন্ধ্যেটা চমত্‌কার কাটলো। চূর্ণিকে দারুণ দেখাচ্ছিল মেরুন বেনারসী’তে। একটা অদ্ভূত আলগা-বিষন্নতা, আলগা-কৌতূহলে, খানিক ক্লান্তি, খানিক টেনশনে আর কনের সাজে মিশ খেয়েছিল বেশ। মনে হচ্ছিল, সে রকম কোনো ফোটোগ্রাফার থাকলে চিরকালীন-বাঙালী-বধূ’র কনসেপ্টে কয়েকটা দূর্দান্ত ছবি তুলতে পারতো!
বিয়ের আসরও ভালো করেই মিটলো। তবে বন্ধুদের অনেকেই যে ঠোঁট টিপে হাসছিল, তা খেয়াল করলাম। খারাপ লাগলো। হ্যাঁ, মানছি, চূর্ণির বর তেমন রাজপুত্তুরটির মত দেখতে হয় নি। গায়ের রঙ হয়তঃ বা একটু বেশিই কালো, মাথার চুল না হয় একটু বেশিই পাতলা, চোখের চশমার কাঁচ না হয় একটু বেশিই পুরু... কিন্তু তাতে কি? চূর্ণির পছন্দ’টা তো অন্যরকম বরাবরই... সব্বাই জানে সেটা।
আজ ফিরছি আমার প্রাণের শহর ছেড়ে আমার কাজের শহরে। চূর্ণির ছোঁয়া লেগে থাকা স্মৃতিগুলো তাই একসাথে মনে আসছে কোলাজের মত। খুব ভালো লাগছিল ভেবে... ওই শাহনওয়াজ, ওই মিলন আগরওয়াল... কোনোভাবেই ওরা চূর্ণির মনোমত ছিল না। সুন্দরী মেয়ে মানেই কি তার ‘সুন্দর বর চাই’ হতে হবে না কি? ভালো লাগছিল, ওর ওই ক্লাস এইট থেকে চলে আসা ধারালো, স্মার্ট, হবু-বরের সংজ্ঞা’টার শেষ অব্দি মানরক্ষা হল বলে। মনে পড়ে গেল, বিয়ের চিঠি পেয়ে যেদিন ওকে ফোন করেছিলাম চূর্ণিকে, হাসতে হাসতে বলেছিল, “বিদ্যে-বুদ্ধি, চাকরি-বাকরির কথাটা যদি বাদ’ও দিই, মানুষটাও কিন্তু খুব ভালো, জানিস তো?”
আমিও হাসিমুখে বলেছিলাম, “কেমন এক্স্যাক্টলি মিলে গেছে... বল্‌?”
ভেবে ভালো লাগলো আবার; আর তখুনি একটা অদ্ভূত ব্যাপারও মনে পড়ে গেল। কথাক’টা শুনেই কে জানে কেন ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেছিল চূর্ণি... চুপ করাতে গেছিলাম, কিছুতেই চুপ করেই নি, কতবার জিগেস করেছিলাম, “কেন কাঁদছিস, চূর্ণি?" "কি হয়েছে?" "মন খারাপ করছে কিছু নিয়ে?”
কিচ্ছু বলে নি, কোনো কিচ্ছু বলে নি, শুধু অঝোরে কেঁদেছিল মিনিট তিনেক... তারপর হঠাত্‌ কান্না থামিয়ে ফেলেছিল নিজের থেকেই, থেমে থেমে বলেছিল, “সত্যি, এক্স্যাক্টলি মিলে গেল কেমন... বলা-কথা এভাবেও সত্যি হয়? ভাবতেই পারছি না জানিস... আনন্দে জল এসে গেছে চোখে, বিশ্বাস কর...”
ওকে বিশ্বাস করি, তাই বিশ্বাস করেছিলাম।

ভোর-রাত্রের স্বপ্ন

By : Sayantari Ghosh

ট্রেনের দরজার কাছে জমে থাকা ভিড়ের ফাঁক গলে কোনোক্রমে স্টেশনটায় নেমে পড়লো অর্ক; আর ট্রেনটাও ছেড়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে। অর্ক হাঁফাচ্ছিলো। হাত দশেক দূরে প্ল্যাটফর্ম ধরে সোজা হেঁটে চলে যাচ্ছে ঊর্মি। ও কি পাগল হয়ে গেছে? কি চাইছে ও? এখানে নেমে পড়লো কেন হঠাৎ? অর্ক ছুটতে শুরু করলো ঊর্মির পিছনে।

-“ঊর্মি-ই-ই... পাগল হলি কি? দাঁড়া...!”

ঘুরে দাঁড়ালো ঊর্মি। চোখদু’টো জ্বলছে যেন ওর, “তুই নেমেছিস কেন??” আঙুল তুলে জোর গলায় বললো ও, “তোকে কে আসতে বলেছে আমার পিছু পিছু? ক্যাচ আ ট্রেন আর গেট লস্ট...”

অর্ক ততক্ষণে পৌঁছে গেছে ঊর্মির কাছে, ওর হাত’টা ধরার চেষ্টা করে অর্ক বলতে গেল, “কি হয়েছে সোনা? কেন রাগ...”

 -“ডোন্ট ইউ ডেয়ার টু টাচ মি...!” গর্জে উঠলো ঊর্মি, হাত ছাড়িয়ে একটা ধাক্কা দিল অর্ক’কে, “বলছি না আমার তোকে দরকার নেই... কোনো সম্পর্ক নেই আর আমার তোর সাথে...”
-“ও’সব তোর রাগের কথা,” নরম গলায় অর্ক বলল, “এর আগেও এক’শ বার বলেছিস... কি হয়েছে রে? বল আমাকে... আমিই কিছু গোলমাল করেছি নির্ঘাত...” হাসার চেষ্টা করলো অর্ক।

-“শোন, বেকার এ’সব ঝুটামুটা এ্যাক্টিং বাদ দে তো”, ঊর্মি আরও গলা চড়ালো, “আমি তোকে নিয়ে বিরক্ত... ক্লান্ত... এমব্যারাস্‌ড্‌... আমি জানি না কেন, কি ভেবে, কি থেকে আমার মনে হয়েছিল যে তোর মত একটা মোস্ট অর্ডিনারি ক্যাবলা ছেলে আমার লাইফ পার্টনার হতে পারে... আয়াম সরি... মাই ফল্ট... এবার আমায় ছাড়ন দে,” শব্দ করে হাত জোড় করলো ঊর্মি, “গুড বাই...” বলে পিছন ফিরে জোরকদমে হাঁটা লাগালো সে।

-“আরেহ্‌...!!” অর্কও পা চালালো তাল মিলিয়ে। ঊর্মি কিছু একটা ব্যাপার নিয়ে সাংঘাতিক রেগে গেছে কে জানে কেন... ওর এইসব অদ্ভূত রাগের কোনো ব্যাখ্যা অর্ক খুঁজে পায় না কখনও… অভ্যস্ত হয়ে পড়তে পড়তে এখন আর খোঁজ করাটাও ছেড়ে দিয়েছে ও... রাগ হয়েছে, এটাই গুরুত্বপূর্ণ; ক্ষমা চাইতে হবে, এটাই জরুরী... কার্যকারণ ব্যাখ্যা খুঁজতে যাওয়া অর্থহীন। তাতে শক্তিক্ষয়। তাতে সময় নষ্ট।

হাঁটতে হাঁটতে ততক্ষণে ছোট্ট স্টেশনের ঘাসে-ঢাকা নামমাত্র প্ল্যাটফর্ম’টা থেকে বেরিয়ে এসেছে ততক্ষণে ওরা। কি আশ্চর্য পাগলামি করে মাঝপথে ট্রেন থেকে নেমে পড়লো আজ ঊর্মি...! হয়েছে রাগ, হয়েছে কথা কাটাকাটি, হয়তঃ দুটো কড়া কথাও বলে ফেলেছে অর্ক রাগের মাথায়, কিন্তু তা বলে কথা নেই, বার্তা নেই অজানা অচেনা স্টেশনে ট্রেন থেকে নেমে পড়বে? আশ্চর্য্য তো! কিন্তু এসব নিয়ে তর্ক করতে যাওয়াটা নিতান্ত বোকামী, তা জানে অর্ক খুব ভালো করে। ঘাড় ঘুরিয়ে স্টেশনের হলুদ-কালো বোর্ড’টার দিকে তাকিয়ে জায়গাটার নাম দেখে নিল সে একবার... ‘তালজোড়া’ লেখা আছে ইংরেজি, বাংলায়। যত গ্রাম্য নাম, তত অপ্রস্তুত দশা, মনে মনে এইরকম একটা হিসেব করেই যেন দীর্ঘশ্বাস পড়ল অর্ক’র...

-“ঊর্মি-ই-ই... লক্ষ্মী’টি... দাঁড়া, একটিবার...” আবার হাঁক দিল অর্ক।

ঊর্মি কিন্তু এবার তাকালোও না পিছন ফিরে। বাঁদিকের লাল রাস্তা’টা ধরে হাঁটতে লাগলো সোজা।  ঊর্মির বরাবরই অর্ক’র এইসব ন্যাকামোগুলো ভীষণ বোরিং লাগে। আজ মাথা গরমের চূড়ান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

স্টেশনের বাইরে নামমাত্র ক’টা দোকান... বিড়ি, সিগারেট, পানমশলা... চারটে আধবুড়ো লোক মেঠো কায়দায় হাঁটুর ওপর ধুতি গুটিয়ে বসে... তারা দাঁত বের করে হাসছে অর্ক’র দিকে তাকিয়ে... ‘শহুরে প্রেমের এমন নজারা টিভি সিনেমার বাইরে দ্যাখা তো এদের জোটে না, এনজয় করছে ব্যাটারা’... ভাবতে ভাবতে বাঁদিকের রাস্তাটা ধরলো অর্ক...

ঊর্মি অনেকটা এগিয়ে গেছিল। রাস্তা থেকে ধানক্ষেতের আলে নেমে পড়লো সে। ধানক্ষেত বলা’টা অবশ্য উচিত নয়... শীতকাল, মাঠ একেবারে ফাঁকা... যতদূর চোখ যায়, মনে হয় যেন একরাশ শূণ্যতার মধ্যে আল বরাবর সোজা সোজা দাগ টেনে কি একটা কঠিন জ্যামিতির আঁক কষা হয়েছে। ডানদিক-বাঁদিকে, সামনে-পিছনে, কোথাও কোনো তফাত নেই... কোনো এক সোনালি স্মৃতির দগদগে ধ্বংসস্তূপের মত অসমতল মাঠ জুড়ে ধানের গোড়াগুলো পড়ে আছে... শূণ্যতাই এখানে সব... মাথার ভেতরের ভারী ভাব’টা কেটে যাচ্ছিল যেন... কেমন উদাসীন হয়ে যেতে ইচ্ছে করছিল ঊর্মির...

-“ঊর্মি-ই-ই...!” অর্ক ডাকছে।

পিছন ফিরে চিৎকার করে উঠলো ঊর্মি, “কেন আসছিস এখনো? আমি বললাম তো আমি কোনো কথা বলতে চাই না...! আমার আর সহ্য হচ্ছে না তোকে...! আমায় একা থাকতে দে না একটু...! আমি একাই ভালো আছি... লিভ মি আলোন, প্লিজ...!”

অর্ক এগিয়ে আসতে গিয়েও থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো খানিক দূরে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল, তারপর থেমে থেমে বলল, “বেশ, একাই থাকিস... বাড়ি ফিরে যাই, তারপরে একা থাকিস? কেমন? জায়গাটা অচেনা, কোথায় কি বিপদ হয়, চল... প্লিজ...”

একটা আকুতির মত শোনালো অর্ক’র গলা’টা। আর শোনা মাত্রই একটা ছটফটে বিতৃষ্ণায় ভেতর’টা চিড়বিড়িয়ে উঠলো ঊর্মির। এই এক ভয়-পাওয়া কন্ঠস্বর, এই এক কাঁদো-কাঁদো চাইল্ডিশ ভাব... আগে মিষ্টি লাগতো ঊর্মির, এখন অসহ্য লাগে! কে বাধ্য করেছে ঊর্মি’কে এই ছেলেটাকে যাবতীয় অস্বস্তি সত্ত্বেও সহ্য করতে? কেউ না! তাহলে? ভাবামাত্র ইচ্ছে করলো অর্ক’কে সরিয়ে দিতে... নিজের সামনে থেকে, নিজের জীবন থেকে... ইচ্ছে করলো এমন ভাবে আঘাত করতে যাতে আর ও মুখ তুলে না চাইতে পারে... ইচ্ছে করলো এমন একটা ব্যবস্থা করতে যাতে “ঊর্মি” বলে যেন কক্ষনো ওকে পিছু না ডাকতে পারে অর্ক।

শান্ত ভাবে শব্দগুলোয় শান দিল ঊর্মি, “তুই থাকলেই আমার বিপদ, অর্ক... তুই আমার জীবন থেকে ভালো-থাকাটুকুকেই মুছে দিয়েছিস যেন... যেদিকে তাকাই খালি ফ্রাস্ট্রেশন, ভয়, প্যানিক... যেন জীবনটাই ফুরিয়ে গেছে আমার... তুই না থাকলে আমি খুশি... আমি নিশ্চিন্ত... আর আমার মনে হবে আমি বেঁচে আছি অন্ততঃ। সো স্টপ ফলোইং মি, ওকে? আমার ব্যাপার, আমি বুঝে নেবো... তোর ভাবার দরকার নেই... ইউ আর আ নো’বডি ফর মি...”

অর্ক স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল; মাঘ মাসের পড়ন্ত বিকেল... খুব ঠান্ডা একটা হাওয়া বইতে শুরু করেছে মাঠটায়... কয়েকটা মূহুর্ত কেটে গেল শীতল নিস্তব্ধতায়। অর্ক শেষ শক্তিটুকু একজোট করে বলল তারপর, “যাবি না... বাড়ি...?”

 -“তোর ভাবার দরকার নেই”, প্রতিটি শব্দে আলাদা করে জোর দিল ঊর্মি।
অর্ক আর দাঁড়ালো না। পিছন ফিরে হাঁটা লাগালো। ঊর্মি তাকিয়ে রইল। ওকে চলে যেতে দেখে ভালো লাগছিল। আর ওই ক্যাবলা, ভীতু, সাধারণস্য সাধারণ ছেলেটাকে বয়ে বেড়াতে হবে না ওকে। যার সাথে জীবনের প্রতিটি বিশেষ মূহুর্ত সাধারণ হয়ে যায়। যার সাথে প্রতিটি এ্যাডভেঞ্চার তেতো হয়ে যায় বিরক্তি আর লজ্জায়। ঊর্মি এখন স্বাধীন! বুক ভরে একবার শ্বাস নিল ঊর্মি। তারপর ব্যাগ থেকে ক্যামেরাটা বের করলো। একটু রিল্যাক্স করা দরকার। জায়গাটা অসাধারণ ফোটোজেনিক। কতগুলো দুরন্ত ছবি তোলা যাবে সূর্যাস্তের এফেক্ট’টাকে সাথে রেখে... ম্যাজিক লাইটে রঙিন হয়ে থাকা আজকের স্বাধীনতার দিন... পায়ে পায়ে এগোতে লাগলো ঊর্মি...

একটা ঝুড়িওয়ালা ঝুপসি বটগাছ... ক্লিক্‌...! ছবি উঠলো...!

আরেকটু এগিয়ে একটা আধপোড়ো মন্দির... ক্লিক্‌...! ক্লিক্‌...! আরো ছবি উঠলো...

এভাবে কতক্ষণ পেরোলো কে জানে! ঊর্মির খেয়াল হল তখন, যখন আলো কমে গেছে বলে আর ছবি উঠছে না ভালো... খেয়াল হল এমন করে যেন হঠাৎ নেশা কেটে গেছে এক ঝলক জলের ঝাপটায়... খেয়াল হল, ফিরতে হবে...

ফেরার পথ ধরলো ঊর্মি। কিন্তু খানিক বাদেই মনে হল, এ যেন ঠিক পথ নয়... কই, এ জায়গাটা তো পেরিয়ে আসে নি ও... আলরাস্তার প্রতিটি চৌমাথায় মনে হতে লাগলো কম্পাস যেন ঘুরছে বনবন করে... ডানদিক-বাঁদিকে, সামনে-পিছনে, কোথাও কোনো তফাত নেই... মনে হতে লাগলো এ সব ব্ল্যাক ম্যাজিক... গোটা পৃথিবীটাই যেন জ্যামিতির ছবি হয়ে গেছে... ক্ষতবিক্ষত, ক্ষুধার্ত, অসংখ্য নানামাপের চতুর্ভূজ ছাড়া আর সব মিথ্যে... সব মিথ্যে...

সন্ধ্যা গাঢ় হল... শীতের উত্তুরে হাওয়া নিষ্ঠুর হয়ে উঠতে লাগলো প্রতি মূহুর্তে... পুরোনো মন্দিরটা দু’বার পেরোলো, কিন্তু বটগাছ’টা কে জানে কেন কিছুতেই পাচ্ছে না খুঁজে... ব্যাগের ভেতর জল খুঁজলো ঊর্মি... গলা শুকিয়ে আসছে বারবার... মাথা ঘুরছে না কি? কেমন যেন মনে হচ্ছে, যেন একটা প্রতিধ্বনি দৌড়ে বেড়াচ্ছে আদিগন্ত শূণ্যতা জুড়ে, “আমি একাই ভালো আছি... লিভ মি আলোন, প্লিজ...!”

দম আটকে আসতে লাগলো। চিৎকার করতে গিয়ে একটা অদ্ভূত, বিকৃত স্বর বের হল গলা থেকে... তখনই, হঠাৎ, বিদ্যুৎচমকের মত মনে পড়লো মোবাইল’টার কথা! একটা ফোন, ব্যাস, তাহলেই তো আর কোনো চিন্তা করতে হবে না। কেউ না কেউ এসে পৌঁছাবেই ওকে নিতে!

কোনোক্রমে ব্যাগ হাতড়ে মোবাইল’টা বের করল ঊর্মি... আর বুকের ভেতর’টা যেন ফাঁকা হয়ে গেল তক্ষুনি... নেটওয়ার্কের ঘরে জ্বলজ্বল করছে শূণ্য... ঊর্মি ধপ করে বসে পড়লো মাটিতে... ...

আচ্ছা, অর্ক কি চলে গেছে? না কি... না কি স্টেশনে বসে এখনও অপেক্ষা করছে ওর জন্য? আধোঅন্ধকারে মরীচিকার মত একটা ছবি যেন দেখতে পেল ঊর্মি... যেন অর্ক একা বসে আছে ফাঁকা স্টেশনের একটা বেঞ্চে... বারবার ঘড়ি দেখছে... ঘুরে ঘুরে চাইছে লাল মাটির রাস্তাটার দিকে... ভাবছে, ‘কি করছে ঊর্মি’টা? এখনও ফিরল না?’

অন্ধকার হয়ে গেছে... এইবার কি ওকে খুঁজতে আসবে না অর্ক একবার?

অর্ক...? চলে গেছিস রে…?

তিন ফোঁটা বৃষ্টি

By : Sayantari Ghosh


এক/মেঘদূত

ন’তলা লাইব্রেরী বিল্ডিং টার দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে বললাম, “...আর এই হল জে.এন.ইউ. এর সেই বিখ্যাত লাইব্রেরী... হল দ্যাখা? তুই ফর্ম তুলতে এসেছিস না জে.এন.ইউ. ঘুরতে বল তো?”

ইন্দ্র অনেকক্ষন লাইব্রেরীটার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইল; তারপর বলল, “...আর এই পুরো ন’তলা খালি বইয়ে ঠাসা... ভাবতে কি ব্যাপক লাগে, তাই না?”

বই নিয়ে আদিখ্যেতা ব্যাপার'টা আমি কোনোদিনই বুঝি না, তাই তেমন ‘ব্যাপক’ কিছু অনুভব করতে পারলাম না বটে, কিন্তু নতুন আলাপী ছেলে, তদুপরি যদি সে এক ভালো বন্ধুর ভালো বন্ধু হয়, দুম করে তার কথায় বাধ সাধা যায় না... তাই আমার সেই ল্যান্ডমার্ক হাসিটা হেসে দিলাম যেটার কোনো মানে হয় না... তারপর বললাম, “বাঁদিকের রাস্তাটা ধরি...? তোকে বাসে তুলে দেব টি-পয়েন্ট থেকে... সোজা আই.আই.টির গেটে নামাবে তোকে...”

“ওকে! দ্যাটস গ্রেট...! একটা কথা বলি রিনি, তোর হাসিটা কিন্তু দারুন... আর... আই সোয়্যার, আমার মাথার যা অবস্থা, তুই এখানে আমায় ছেড়ে গেলে আমি বেমালুম হারিয়ে যাবো...”

কথাটার আদৌ কোন অন্তর্নিহিত অর্থ আছে কিনা ভাবতে যাবো, এ সময় আলতো করে যোগ করল ইন্দ্র, “সো কনফিউসিং... দীস জে.এন.ইউ. রোডস আর...”

দুজনে লাইব্রেরীর পিছনের আঁকাবাঁকা রাস্তাটা ধরলাম... এ সময়টায় গোটা ক্যাম্পাস জুড়ে হলুদ রঙের একটা ফুল ফোটে... বড় বড় গাছে থোকা থোকা ফুল... নাম জানিনা সেগুলোর... তবে ভারি ভাল লাগে... একটা আলাদা স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে যায় আমার জংলা ইউনিভার্সিটি জুড়ে...

“এ ফুলগুলো বেশ, তাই না?” ইন্দ্র বলল, “আমাদের ক্যাম্পাসে লাগায় না কেন.......”

ওর কথা শেষ হল না... একটা বাজ পড়ল... বোধহয় খুব কাছেই কোথাও... আকাশে ছায়া ছিল সকাল থেকেই আজ...

“সর্বনাশ! বৃষ্টি নামাবে নাকি?” একরাশ বিরক্তি নিয়ে আকাশের দিকে তাকাল ইন্দ্র...
“সর্বনাশের কি আছে রে? হোক, হোক... কতদিন ভিজিনি... বৃষ্টি হয় এ দেশে...? হচ্ছে, তো তাতে এত বিরক্তি কিসের শুনি?!” আমার তিনমাসের জমা অভিমান ওর ওপরেই গিয়ে পড়ল, তারপর সামলে নিয়ে বললাম, “ইয়ে... তুই ছাতা এনেছিস? না হলে আমারটা নে... আই.আই.টি গেট থেকে তোর হস্টেল তো অনেকটা...”

“না না, ঠিক আছে...” মাথা নেড়ে বলল ও।

“এনেছিস কি ছাতা?” জোরালো প্রশ্ন!

“নাহ্‌!” এবার স্বীকারোক্তি।

তেরছা জলের ফোঁটাগুলো একে একে ছুঁতে শুরু করেছে তখন... ব্যাগ থেকে ছাতাটা বের করে দিলাম ওকে,  “নে ধর!”

হাত বাড়িয়ে ছাতাটা নিয়ে বলল, “পরশু দেবু যাবেই তো আমার ওখানে... ওকে দিয়ে দেব... আর ইয়ে, থ্যাঙ্কস!”

পায়ে পায়ে টি পয়েন্ট বাসস্টপে এসে পড়লাম... একে উইক ডে, দুপুর দুটো, তায় বৃষ্টি আসছে... বাসস্টপ একেবারে খালি...

“তুই যাবি কি করে?” হাওয়া আর জল দুয়ের তেজ বাড়ছে দেখে ধীরে ধীরে জিগেস করল ইন্দ্র, “হস্টেল ঢোকার আগেই নেমে যাবে মনে হচ্ছে তো... ভিজে যাবি যে...!”

আমি একগাল হেসে বললাম, “ভিজবোই তো! আমি তোকে বাসে তুলে, চটি খুলে হাতে নিয়ে, চন্দ্রভাগা হয়ে ঘুরে ঘুরে হস্টেলে ফিরবো... আজ নামুক বৃষ্টি... খুব ভিজবো...!!”

“ওফ্‌! আবার সেই সব্বোনেশে হাসি!”
“ধুর!” হেসে বললাম আমি।
“ওই তো আবার!”
“এ্যাই! চুপ কর তো...! যা, হাসবো না আর...”

কড়কড় করে আরেকটা বাজ পড়ল।
“এই রিনি, তুই চলে যা... আমি বাস এলে চলে যাবো...” আকাশের দিকে তাকিয়ে ভীষণ ভুরু কুঁচকে বল ইন্দ্র।
“মানে? এরপর যদি তুই হারিয়ে যাস, বা একা পেয়ে কেউ তোকে কিডন্এযাপ করে ফ্যালে, তখন দেবু বাবাজি যে এসে আমাকে চেপে ধরবে, তার বেলা? "
"যা না বাবা... চলে যা..." 
একটু কড়া করেই বলল যেন। আচমকা এমন কথা শুনে একটু অবাকই হয়ে গেলাম, "এমন কি বললাম বাবা, যে তুই এত্ত রেগে গেলি... ওকে, চলে যাচ্ছি, টা টা...”
“রেগে? রাগতে যাবো কেন? রিকোয়েস্ট করছি... এমন কাজলা দিন, বৃষ্টি'টা জমিয়ে নেমেছে, রাস্তা'টা হলুদ ফুলের পাপড়ি মেখে একটা দারুণ রোম্যান্টিক ব্যাকগ্রাউন্ড রেডি করে বসে আছে... এর মাঝখান দিয়ে  তুই ভিজতে ভিজতে যা না...! আমি একটু দেখি...”
“ধ্যাত্‌!!”
........................................................................................

সেদিন সত্যিই চূড়ান্ত ভিজে ফিরেছিলাম হস্টেল... অতসী ঘরের দরজা খুলে রেগে গিয়ে চিত্কার করে উঠেছিল, “আবার সখ করে ভিজেছিস?! হাজার বার বলেছি না অসুখ করলে আমি তোকে দেখতে পারব না... কথা কানে...”

ওর কথা কানে না নিয়েই ওর গলা জড়িয়ে ধরেছিলাম... খুব খুব হেসেছিলাম ওকে জড়িয়ে ধরে... ও প্রাণপণে চেঁচাচ্ছিল, মনে আছে, “ছাড় ছাড়! দিলো রে, আমাকেও ভিজিয়ে দিলো...!!”

আমিও মনে মনে বলেছিলাম... আমাকেও ভিজিয়ে দিলো... আমাকেও ভিজিয়ে দিলো...



দুই/বৃষ্টিনেশা


রাত হলে শ্রীরাম সেন্টর থেকে ফেরা এত মুশকিল হতে পারে, ভাবিনি...!

ফোক ডান্স-এর শো ছিল একটা, আমার থিয়েটার পেপারের প্রজেক্টের পার্ট ছিল এটার রিভিউ সাবমিশন... শো শেষ হয়েছে পৌনে এগারোটায়; বারোটা বাজতে চলল, একটা ফিরতি অটো নেই কোত্থাও...!! আর তার কারণ বোধহয় এই ছিপছিপ বৃষ্টিটা...! ধুর! আজকেই নামতে হল...!? দিল্লি শহরে অগুনতি দিন অসংখ্য বার আকুল প্রার্থনা করেছি এক পশলা বৃষ্টির... তখন কোথায় কি? আর আজ... এই অক্টোবরে, রাতদুপুরে... নাহ্‌! জ্বালালে...!

“ছটফট করছিস কেন?” দোকানটার বন্ধ শাটারে হেলান দিয়ে বলল ইন্দ্র, “আর একটু ওয়েট কর... বৃষ্টিটা থামলেই পেয়ে যাবো কিছু একটা...”

“আরো ওয়েট??!” আমার বিচ্ছিরি লাগছিল, শীতও লাগছিল খুব, “বারোটা বাজল... হস্টেলে ইনটাইম নেই মানে কি যা খুশি তাই...? রাত বারোটা, ইন্দ্র...! ধ্যাত্‌ ! আমার ভাবতেই কেমন লাগছে... অতসী খুব বকা লাগাবে আমায়... দেবু'টা যখন আসতে পারল না আজ, তখন থেকেই কেমন একটা যেন লাগছে আমার...”

“আররে! দেবু আসতে পারে নি সেটা খচখচ করছে এখনও... আর আমি যে এলাম? তার বেলা?”

গলার স্বরে ও কি? অভিমান মনে হল? একটু হাসি এম্নিই চলে এল ঠোঁটে, “তুই যে আসবি, আমি জানতাম...”, বললাম থেমে থেমে।

“তাই? সত্যি? আগে বলিস নি তো?”

এর কোন উত্তর হয় কি? ভাবছি... এমন সময় অটো-গোছের একটা কিছুকে দেখে সব ভাবনা গুলিয়ে গেল... দরদামের পথে না গিয়ে উঠে পড়লাম দুজনে। বৃষ্টিও ততক্ষনে জোর এসেছে... অটোর দু’পাশ দিয়ে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে আসছে অতি উত্‌সাহী হিম-ছোঁয়ানো জল... মাঝখানের একটু শুকনোতে ঠাঁই নিলাম দুজনে...
দুজনেই ভিজে যাচ্ছি, বেশ বুঝছিলাম, কিন্তু বাঁচার বা বাঁচানোর উপায় জানা নেই যে...!

কোন কথা হল না! একটা কথাও না! শুধু বৃষ্টির মাতাল-মল্লার আর অটোওয়ালার এফ.এম-এ খুব নিচু স্বরে রাতজাগা মিঠে গান... একটার পর একটা...

অটো জে.এন.ইউ. এলো প্রথমে। তাপ্তী হস্টেলের গেটে আমার পিছু পিছু ইন্দ্রও নেমে এল। বৃষ্টি একটু ধরেছে ততক্ষনে...

“এই দ্যাখ! এসে গেলাম তো তাহলে... তখনই বলছিলাম ছটফট করিস না... ক’টা বাজে দেখি?” মোবাইলে সময় দেখে একটু হাসল ইন্দ্র, “শোন, অতসী কে বলিস যে আমি এসেছিলাম তোকে ছাড়তে... আর বলিস একটু কম চেঁচাতে... বুঝলি?”

হাসলাম আমি। বললাম, “বেশ! তাই বলে দেবো ওকে...”
“চলি তাহলে? ঘুমিয়ে পড় গে যা... গুড নাইট...”
“সাবধানে যাস... গুড নাইট!”

অটোটা তাপ্তীর সামনে থেকে শার্প টার্ন নিয়ে রিং রোড ধরা অব্দি সিঁড়িতেই দাঁড়ালাম আমি। তারপর পা বাড়ালাম রুমের দিকে... তখুনি মোবাইলে ছোট্ট কাঁপুনি... মেসেজ... হ্যাঁ... তারই বটে...
........................................................................................................
Not everything should be said clearly...
Not everything could be touched distinctly...
Many of them are better felt than told...
Like Faith.
Like Love.
Like God.
........................................................................................................
আচ্ছা, মাঝেমধ্যেই রাতবিরেতে এরকম বৃষ্টি হতে পারে তো...! দিব্বি হয় তাহলে...!


তিন/একদা নিদ্রাহীন রাতে 

ন’টা বেজে যাওয়ার পরও আমি রাতের খাবার খেতে গেলাম না দেখে অতসী উঠে এসে কপালে হাত ছোঁয়াল, “কই রে? জ্বর-টর নেই তো দেখছি... খাবি না? একটু কিছু এনে দিই মেস থেকে...? খেয়ে নে...?”

আমি শুয়ে শুয়ে চোখ না খুলেই মাথা নাড়ালাম। খাবো না।

“কেন?”, কারন খুঁজে বেড়ানোটা ফিজিক্সের লোকেদের বদ অভ্যাস, “কি হয়েছেটা কি?”
“কিছু না” এবার মুখ খুলতেই হল, “মাঝে মাঝে উপোস দেওয়া ভাল... তুইই তো বলছিলি সেদিন...”
“হ্যাঁ, তা ভাল... কিন্তু এরকম পাংশুটে মুখ করে, উপুড় হয়ে খাটে শুয়ে উপোস দিতে বলেছি বলে তো মনে পড়ছে না...”

ওহ্‌! অতসীটা না... খুব তাড়াতাড়ি রেগে যায়...! আসলে ভালবাসে খুব... তাই... ওকে শান্ত করতে গেলে আবার উলটে রেগে গেলে চলে না...

“আচ্ছা বেশ, তাহলে উঠে বসে গল্পের বই পড়ি... তাহলে চলবে তো?” হেসে জিগেস করলাম।
“যা খুশি কর গে যা... আমি পেরিয়ার চললাম, কাল অ্যাসাইনমেন্ট সাবমিট করতে হবে আমায়... খিদে পেলে ফোন করিস, কিছু কিনে নিয়ে ফিরব তাহলে...”

ওর সেই ধুমসো নীল ব্যাগটা ঘাড়ে ফেলে দরজা টেনে বেরিয়ে গেল অতসী। পরক্ষনেই আবার দরজা ঠেলে ঢুকলো, বলল, “বাব্বা! কি গুমোট করেছে রে... খুব মেঘ করেছে... ছাতা নিয়ে বেরোই, বুঝলি?”
“হুঁ...” কতকটা না শুনেই সায় দিলাম আমি।

অতসী বেরিয়ে গেল সব গুছিয়ে নিয়ে। আমি শুয়েই রইলাম খানিকক্ষণ। একবার মনে হল আলোটা নিভিয়ে দিই উঠে... আর তারপরই সন্ধ্যেবেলার ফোনটার টুকরো-টুকরো ক’টা লাইন ঘুরপাক খেতে লাগল গোটা ঘরটা জুড়ে... আলো নেভানোর কথাটা ভুলেই গেলাম নিমেষে...

এরকম কেন হল? কেন হল এরকম?

ইন্দ্র আগেই বলে দিতে পারত পিয়ালীর কথা। প্রথমেই বলে দিতে পারত... এতদিন বাদে... এভাবে বলার কি মানে হয়?

আমি নাকি ওর কাছে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ...
আমি নাকি ওর সবচে' কাছের  বন্ধু...
আমাকে নাকি ও ভরসা করে, অসুবিধায় পড়লে আমার কথাই নাকি মনে হয় ওর...
ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ আমি...!! ওর নভেলের ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ দ্বিতীয় অধ্যায়...!

নিজেকে ধুলোয় মিশিয়ে দিতে ইচ্ছে করল যেন... এত গুরুত্ব চাই না, ইন্দ্র... রেখে দে তোর বইয়ের তাকে সাজিয়ে, অন্য কাউকে দিস বরং, সে হয়তঃ মাথায় করে রাখবে... এ গুরুত্বের মানে বোঝার মতন অত বুদ্ধি আমি ধরি না রে... একটা তল-না-পাওয়া কুয়োর মধ্যে পড়ে যাচ্ছি মনে হল... দমবন্ধ করা অন্ধকার... শ্বাস নিতে চাইছি, আর কেউ যেন মুখ চেপে ধরছে প্রতিবার...

তখুনি জানলার পর্দাটা আলতো করে হাত বোলালো হাতে... একমুঠো স্বস্তির মতন একটা ঠান্ডা হাওয়া ছুট্টে বুকের ভিতর ঢুকে পড়ল ফাঁক পেয়ে... চন্দ্রভাগার ওপাশের জঙ্গল থেকে কি একটা নাম-নেই ফুল বেহিসেবী গন্ধ বিলিয়েছে আজ হাওয়াতে...

ঘড়ি দেখলাম। রাত সাড়ে এগারোটা... ঘর বন্ধ করে লনে চলে এলাম পায়ে পায়ে... দোতলার কার্ণিশে একটানা ‘কেয়া কেয়া’ বলে ডাকছে একটা ময়ুরী... অঝোরে বৃষ্টি নেমেছে... কারো ওপরে চরম অভিমানে মেঘের আদুরে মেয়ে রাত্রিবেলায় কাঁদতে বসেছে পা ছড়িয়ে... কি সুন্দর কাঁদতে পারে ও, তাই না? মনখারাপে, যন্ত্রণায় অবিশ্রান্ত কান্নায় সারা পৃথিবী ভাসাতে পারে ও...

আর আমি? আমি খালি হেসে উড়িয়ে দিতে পারি। আমার সব্বোনেশে হাসি ...!!
আমি খালি বলতে পারি, “ওভাবে বলিস না... নিজেকে কষ্ট দিস না...”
খালি বলতে পারি, “তোর কোনো ভুল হয় নি রে... দায় আমার... শুধু আমারই..”

ফাঁকা লনে একা দাঁড়িয়ে রইলাম... মনে হল হাতে-চোখে-বুকে যত কালি জমেছিল, সব ধুয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে... চোখের পাতায় আঙ্গুল ছুঁইয়ে, খোলা চুল ভিজিয়ে দিয়ে, ওড়না খসিয়ে দিয়ে আরো জোরে, ভীষণ জোরে বৃষ্টি নামল...

আমায় খেলা নে বৃষ্টি...! আজকে খেলা নে...! আজকে খেলা নে...!

মুখোমুখি

By : Sayantari Ghosh





দীপনের কথা

অফিস থেকে ফিরে নিয়মমত ব্রিফকেস’টা টেবিলে নামিয়ে সোফায় গা এলিয়ে দেয় দীপন। গত ছয়বছরে এটাই প্রতিদিন নিয়মিত দেখে আসছে তৃপ্তি। ও’ভাবে বসে পড়ার মানেই কাজের মেয়েটিকে ইশারা আসলে... আদা-দেওয়া বেশ কড়া একটা চায়ের না-বলা ফরমায়েস। চা শেষ করে একবার মিঠির ঘরে উঁকি দেবে দীপন... এটাও রোজ’ই। মিঠি তখন ঘুমায়; স্কুল থেকে ফিরে একটু ঘুমানোর অভ্যেস’টা তৃপ্তিই করিয়েছে ছোটো থেকে... তাহলে সন্ধ্যেটায় ফ্রেশ থাকে... হোমওয়ার্কগুলো করার সময় কম ঘ্যানঘ্যান করে। মিঠিকে ঘুমাতে দেখে স্নান সেরে এসে কম্পিউটারের সামনে বসে পড়বে দীপন... এই যে বসলো, সাড়ে ন’টায় তৃপ্তি খেতে ডাকার আগে সে উঠবে না... অফিসের কাজ, খানিক ফেসবুক, খানিক জি-টক... বন্ধুদের সাথে আড্ডা... কিছু পড়াশুনো, কিছু ফোটোব্লগ হাতড়ানো, কিছু নতুন বাজারে আসা ছবি-তোলার সরঞ্জাম নিয়ে জ্ঞানঅর্জন... শেষটায় স্রেফ গান শোনা... এই নিয়মের সাধারণভাবে কোন নড়চড় নেই।

দীপনের মাথায় এ সময়টায় হয়তঃ আরো কিছু ঘুরপাক খায় যে’সবের টের তৃপ্তি পায় না সেভাবে... অফিসের খিঁচড়ে যাওয়া মেজাজের টুকরোটাকরা বাড়ি বয়ে এসে মুখ দেখিয়ে যায় রোজই... তবুও... বিষয়গুলি গড়পরতা... অন্ততঃ দীপনের কাছে তাদের আদল খুব পরিচিত। অফ-টপিক কিছু বড় একটা ঘটে না, তাই রুটিনের অন্যথাও হয় না বড় একটা।

কিন্তু সেদিনটা অন্যরকম ছিল।

ঘরে ঢুকে ব্রিফকেসটা নামিয়েই বেসিনের সামনে গিয়ে মুখে জলের ঝাপটা দিল দীপন। তারপর তোয়ালে আর ইস্ত্রি করে রাখা ধবধবে পায়জামা পাঞ্জাবী নিয়ে সটান স্নানে ঢুকে গেল। কাজের মেয়েটির থেকেও অবাক চোখে সেদিকে তাকিয়ে রইলো আদা-দেওয়া চায়ের কাপখানা।

বাথরুমের দরজায় আলতো করে টোকা দিল তৃপ্তি, “শুনছো...? শরীর খারাপ লাগছে নাকি গো?”

দরজার ওপারে শাওয়ার চালিয়ে দেওয়ালে হেলান দিয়ে ঠায় ভিজছিল দীপন... তৃপ্তির কন্ঠস্বরের একটু সময় লাগলো চিন্তার জাল ছিঁড়ে ওর কাছ অব্দি পৌঁছতে, “কিছু হয় নি, ঠিক আছি,” উত্তর এল, “জাস্ট আ বিট টায়ার্ড...”

মোহরের মুখ’টা একটা ধোঁয়াটে সাইনবোর্ডের মত চোখের সামনে আটকে রয়েছে। সব দ্যাখা যাচ্ছে এ’পাশ থেকে ও’পাশ, কিন্তু সবের ভেতর সারমর্ম হয়ে বেরিয়ে আসছে ওই একটাই মুখ। কি ক্যাজুয়াল ছিল মোহর! কি আশ্চর্য্য! কলেজ স্ট্রিটের মোড়ে আজ ওকে দ্যাখা-মাত্র কেমন যেন বোকা হয়ে গেল দীপন... একটা মূহুর্তের জন্য লুকিয়ে পড়তে ইচ্ছে করলো ওর... ইচ্ছে হল এক্ষুণি ভিড়ের একটা যে কোন মুখ হয়ে যেতে... নিজেকে হারিয়ে ফেলে ভিড়ের ফাঁক থেকে উঁকি দিয়ে মোহরকে দেখতে ইচ্ছে হল... সত্যি, মোহর’ই...  শাড়ি, খোঁপা, চশমা, সিঁদূর... তবু, মোহর’ই।

তখুনি কি করে কে জানে মোহরের চোখ ঘুরলো এদিকে... আর এক সেকেন্ডের ভেতরে অজস্র ভয় এসে গলা টিপে ধরলো দীপনের... অগুনতি প্রশ্নের উত্তর হাতড়াতে লাগলো মাথার ভেতরে ও... “বম্বে পড়তে তুই একা যাস দীপ?”... “একটা চিঠি লিখতে ইচ্ছে হল না তোর?”... “আট’টা বছর... জাস্ট ভ্যানিশ হয়ে রইলি?” “আমি কি আদৌ ছিলামই না কখনো কোথাও?”... ... “কি করে পারলি রে?”...
চাপা পড়ে যাচ্ছিলো দীপন নিজের কল্পনাতেই... হাবুডুবু খাচ্ছিলো রীতিমত...

মোহর’টা অথচ...

কেমন পাগলিই রয়ে গেছে... চোখদুটোয় একটা অবাক-হাসি নিয়ে ছুটে এল... “দীপ...!! কেমন আছিস রে??” হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল কফি হাউসে, “আজ কোনো কথা শুনছি না... বউকে ফোন করে দে, বল আধ ঘন্টা দেরী হবে... আরে ধূর, জিগেসই করিনি... বিয়ে থা করেছিস তো?”

কত কথা বলল... জিগেস করলো আরো কত কি... কলেজের চাকরি, ছয় বছরের ছেলে, লেখালিখিতে ছেদ, নতুন করে রিসার্চের প্ল্যানিং... কত কত কথা।

শুধু বলল না কেন চিঠি লিখিস নি...

স্নান সেরে কম্পিউটারে বসলো দীপন... পনের মিনিট পরে উঠে পড়লো... শুলো খানিক... তাক থেকে একটা উপন্যাস নামিয়ে পড়তে নিয়ে দ্বিতীয় পাতায় আটকে গেল... একবার ভীষণ ইচ্ছে করলো একটা ফোন করতে; কিন্তু করা গেল না... তারপর ইচ্ছে করলো মিঠির ঘরে গিয়ে তৃপ্তিকে বলতে, যে আজ ওকে আর হোমওয়ার্ক করিও না, আজ ও একটু খেলুক আমার সাথে, আজ ওকে একটা গল্প শোনাই বরং... একটুবাদে সে ইচ্ছেটাও তেতো হয়ে গেল... তারপর আর কিছু ইচ্ছেই করল না।

বরের কথা জিজ্ঞাসাই করা হল না মেয়েটাকে... “হিংসে হল নাকি দীপন?” বুকের ভেতরের আয়নাটা বাঁকা হেসে বলল, “জেলাস! জেলাস! নাকি ইনসিকিউরিটি? না কি স্রেফ ভয়??”

জানি না জানি না... উফফফ...

কেন যে বলল না কেন চিঠি লিখিস নি...


মোহরের কথা


মোহর বাইরের গ্রিলের দরজাটা ঠেলতেই দোতলার জানলা থেকে বুয়ান উঁকি দিল, “এনেছো...? মা?”

একগাল হেসে হাতের আনন্দ পাবলিশার্সের প্যাকেটটা উঁচু করে দ্যাখালো মোহর। ঘরে ঢুকতেই ওই প্যাকেট আর তার ভেতরের টিনটিনের কমিকস খুলে মেঝেতেই বসে পড়লো বুয়ান; মোহর ওকে কোলের কাছে টেনে নিয়ে ওর পাশ’টাতেই বসলো শাড়িটা এলিয়ে, হাঁক পাড়লো ভেতর ঘরের দিকে, “কাজু...! আজ ফুলকপি কাটবি রাত্তিরের জন্য! বৃষ্টি হয়েছে এদিকে দুপুরে? জামাকাপড়গুলো তুলেছিস?

-“হ্যাঁ বৌদি,” ঘাড় হেলিয়ে সায় দেয় কাজু; হাঁক শোনামাত্র সে দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছিল, “কিন্তু বৌদি, মা-মনি আজ আমায় এমনি এম্নিই বকেছে... একটুখন কথা বলতে গেসলাম পাশের বাড়ির নমিতার সাথে, তাতে কি এমন মহাভারত’টা অসুদ্দ হয় বল ত?”

ছ’টা নাগাদ অনিন্দ্য ফিরল অফিস থেকে। তার আগের সময়টা কাজুর সাথে চেঁচামেচি করতে করতেই চলে গেল মোহরের। শাশুড়ি’মাকে বোঝালেও বুঝবেন না, তাই রোজদিন তাকে কাজুর সাথে চেঁচিয়েই গলা ফাটাতে হয় এ’সব সমস্যার সালিশি করতে এসে। অনিন্দ্য ঢুকেই হইচই শুরু করে দিল, “আজ বাইরে ডিনার!!!” কবে থেকে কি একটা এরিয়ার আটকে ছিল, সেটা নাকি আজ এসেছে।

-- “সাউথ সিটি যাই চলো...” মোহরের কোমর জড়িয়ে ধরে অনিন্দ্য বলল, “বুয়ান ওখানে বেশ এনজয় করে... আর ওদের ফুডকোর্ট’টা জাস্ট অস্যম!”
-- “চলো,” হাসিমুখে বলল মোহর, পরক্ষণেই চিন্তায় পড়ে গেল হঠাত, “এতগুলো আটা মাখালাম গো কাজুকে দিয়ে... আর গুচ্ছের ফুলকপি...”
-- “আরে দূর... ফ্রিজে রেখে দাও...”

সাউথসিটি থেকে ফিরতে রাত হল। ঘরে ঢুকেই আঁচল কোমরে গুঁজে বিছানা করতে লাগলো মোহর; বুয়ানটা তখন প্রায় ঘুমিয়েই গেছে।

পৌনে বারোটা বাজলো মোহরের বিছানায় আসতে। ছাড়া জামাকাপড়গুলো ভাঁজ করে, বুয়ানের স্কুলের ব্যাগ আর ইউনিফর্ম গুছিয়ে, কাল সকালের রান্নার সবজি, ভাতের চাল, চায়ের পাতা, চিনি-হলুদ-তেল-নুনের কৌটোর সরেজমিনে করে, জলের বোতলগুলো ভরে শুতে শুতে একটু তো দেরী হয়’ই। এ’সব সকালের জন্যে ফেলে রাখলে মুশকিল। সাড়ে ন’টার ট্রেন, বাড়ি থেকে বেরোনো সাড়ে আটটায়... তাতেই কলেজ ঢুকতে ঢুকতে পৌনে এগারোটা বেজে যায়... তার আগে রান্না, অনিন্দ্যর টিফিন, বুয়ানের স্কুলবাস...

-- “আহ্‌...” বিছানায় শুয়েই সারাদিনের ক্লান্তিতে শিরদাঁড়া’টা টনটন করে ওঠে মোহরের। পাশে অনিন্দ্য প্রায় ঘুমন্ত। একটু যেন ইতস্ততঃ করলো মোহর, তারপর হাত বাড়িয়ে অনিন্দ্যর হাত’টা ধরলো।

--“হুম...?” অনিন্দ্য ঘুমায়নি, “কি? কিছু বলবে?”
--“হু... আজ... আজ জানো... কলেজস্ট্রিট গেছিলাম বুয়ানের একটা বই কিনতে...” ক’টা মূহুর্ত থামলো মোহর, “হঠাৎ দীপনের সাথে দ্যাখা হয়ে গেল, জানো?”

একটু নড়ে ওঠে অনিন্দ্য, হাতে ধরা হাত একটু শক্ত হয়, তারপর আলতো হেসে বলে, “আরেব্বাবা... তা, কেমন আছে সে? বহুদিন পরে দেখা তো...”

--“... আট বছর... পুরো আট বছর... বম্বে থেকে ফিরেছে সেটাই জানতাম না...”
--“হুমম...” একটুখানি চুপ করে গেল অনিন্দ্য, তারপর গলা আরো নামিয়ে বলল “ঝগড়া করলে?”
--“নাহ্‌,” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল মোহর, “ইচ্ছেই করলো না... আর ও খুব আনকম্ফোর্টেবল ছিল...”

কিছুক্ষণ আবার নিস্তব্ধতা। বাইরের বারান্দায় ঘড়িটাই খালি একা-একা প্রলাপ বকছে টিক টিক করে। কম্পিউটারের স্ক্রিনসেভারে চাপা আলোয় ঘুরপাক খাচ্ছে একটা বেগুনি রঙের চতুর্ভূজ।

অনিন্দ্য মোহরের চুলগুলো আলতো হাতে সরিয়ে দেয় কপালের ওপর থেকে, “এই... মনখারাপ করে না, লক্ষ্মীটি...”

মোহর আস্তে আস্তে সেঁধিয়ে যায় অনিন্দ্যর বুকের ভেতরে, থেমে থেমে বলে, “না গো... মন খারাপ করলোই না একটুও... আশ্চর্য্য ব্যাপার...”

“আশ্চর্য্য কি আর?” বললো স্ক্রিনসেভারের বেগুনি আলোর ট্রাপিজিয়মটা... তার চারটে হাত নিজেদের দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে গড়ে তখনো চেষ্টা করে চলেছে আপ্রাণ... যদি ওপারের জন’কে একটু ছোঁয়া যায় কোনোভাবে...

- Copyright © পাঁচমিশেলি - - Powered by Blogger - Designed by সায়ংতরী -