Popular Post

Showing posts with label গা-ছমছম-গল্প. Show all posts

ওয়ে টু গ্রিন প্যারাডাইস/২

By : Sayantari Ghosh


[প্রথমার্ধের পর...]

-“কুছ পরেশানি হ্যায়?” লোকটা আবার বলল, শান্ত, নিরুত্তাপ গলা, “গাড়ি মে প্রবলেম? হম দেখে ক্যা?”

মাধবী এক মূহুর্ত সময় নিল নিজেকে সামলে নিতে, তারপর বলল, “নহি, গাড়ি নহি, হোটেল...”
- “হমকো গাড়ি মালুম, হোটেল মালুম...একই রকম শান্ত স্বর, “আইয়ে হামারে সাথ... হম লেকে চলেঙ্গে...”
- “পতা হ্যায় আপকো? হোটেল গ্রিন প্যারাডাইস?”
- “হাঁ জি... আইয়ে হামারে সাথ... হম লেকে চলেঙ্গে আপকো...

মূহুর্তের মধ্যে একজোট হয়ে গেল ওরা সকলে!

-“তাই নাকি! বড়িয়া হ্যায় ভইয়া!”
- “ভগবান নাকি ভাই তুমি! উফফ, কি বাঁচাটাই না বাঁচালে!”
-“নিসার, মিতালী জলদি আয়, থ্যাঙ্কু ভাই... অনেক অনেক থ্যাঙ্কু!”

পকেট থেকে একশ টাকার একটা নোট বের করে এগিয়ে দিল মানিক, “বহোত সুক্রিয়া...”... লোকটা কিন্তু টাকা নিল না, “হামকো পেরাডাইস হোটেল মালুম... চলিয়ে... পঁহুচকে প্যায়সা দেনা...”
-“গ্রিন প্যারাডাইস...”
-“হাঁ জি... গাড়ি স্টার্ট কিজিয়ে..”
-“আপ ফ্রন্ট সিট মে আ জাইয়ে” লোকটাকে ডাকলো মানিক।
-“নহি সাব, হম বাহার হ্যায় সাব, আপ চলিয়ে...” বলে লোকটা মাধবীর পাশের জানলাটা হাতে করে ধরে ফুটরেস্টের ওপর উঠে পড়লো। মানিক উঠে পড়ল ড্রাইভিং সিটে, গাড়ি ছেড়ে দিল। জানলার কাঁচ একটু খোলা, লোকটার মুখ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না আর, কিন্তু কথা পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে...

-“সিধা চলিয়ে... অব বাঁয়ে... চলিয়ে... সিধা... হাঁ জি... ডাঁয়ে মুড়িয়ে আগে সে...”

ডাইনে... বাঁয়ে... ডাইনে... বাঁয়ে...  গাড়ি চলেছে লোকটার নির্দেশমত... রাস্তা খুব একটা সরু নয় এদিকে, কিন্তু বেশ ভাঙাচোরা... হেডলাইটের আলোটা মাতালের মত টলতে টলতে চলেছে যেন। এদিকটায় ওরা আগেরবার আসেনি। লোকটা সত্যিই রাস্তা’টা চেনে, ওর কথায় কোনো জড়তা কোনো দ্বিধা নেই!

-“অভি সামনে চলিয়ে... হাঁ জি... ইয়ে আগে সে রাইট...”

বেশ তাড়াতাড়ি এগোচ্ছিল ওরা। জানলার কাঁচের ফাঁকটুকু দিয়ে তীরের ফলার মত শিরশিরে হাওয়া ঢুকছে। মাধবীর চোখ বুজে আসছিল ক্লান্তিতে... উফ... আর একটু... তারপরেই গরম ঘর... নরম বিছানা...

-“সামনে’সে অউর এক টার্ন বাবুজি... লেফট... উয়ো আ গয়া আপকা গিরিন প্যারাডাইস...” বলল লোকটা। 

আর তখুনি মাধবীর মনে হল জানলার বাইরে থেকে লোকটা যেন হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে! যেন উড়ে যাচ্ছে এক টুকরো কাগজের মত, যেন একটা ছবি হয়ে উড়ে চলে যাচ্ছে জানলার বাইরে দিয়ে, এক চিলতে নিষ্ঠুর হাসি লেগে আছে যেন সেই ছবিটার ঠোঁটের কোণে। ব্যাপারটা বুঝে উঠে মাধবীর কিছু বলার আগেই মানিক স্টিয়ারিং ঘোরালো বাঁদিকে... আর সঙ্গে সঙ্গে একটা প্রচন্ড শব্দ, তোলপাড় ঝাঁকুনি আর ঘষটে যাওয়া চাকার তীব্র আর্তনাদ! মনে হল পৃথিবী আর আকাশ একসাথে তালগোল পাকিয়ে গেল যেন। মাধবীর কপাল’টা খুব জোরে ঠুকে গেল কিছু’তে, ও শুধু বুঝতে পারল একটা ভীষণ অঘটন ঘটে গেছে, গাড়ি’টা খাদের ঢাল বরাবর পিছলে চলেছে নিচের দিকে, অভিকর্ষ ছাড়া আর কারো কথা শুনছে না! ভয়ে চোখ বন্ধ করে নিল ও!

*****

এক মিনিট বাদে যখন চোখ খুললো গাড়ি’টা একটা বড় গাছের গায়ে মুখ গুঁজে দাঁড়িয়ে। যে রাস্তা’টা দিয়ে ওরা যাচ্ছিল, সেটা দেখাই যাচ্ছে না কোথাও আর!

-“সবাই ঠিক আছিস?” সোহমের গলা। নিসার পিছনের সিট থেকে সাড়া দিল একটা হালকা গোঙানি’তে, মিতালী তখনও মাধবীর হাত’টা আঁকড়ে ধরে আছে। মানিকের কপাল থেকে দরদর করে রক্ত পড়ছে।

আস্তে আস্তে দরজা খুলে মাধবী নেমে এল গাড়ি থেকে। রাস্তা’টা এবার দেখা যাচ্ছে, বোঝা যাচ্ছে যে প্রায় পনের-কুড়ি ফুট উপর থেকে সটানে নিচে পড়েছে গাড়ি’টা। দেওদার গাছ’টার গায়ে হেলান দিয়ে তিরিশ ডিগ্রি কোণে ঝুলে আছে খাদের দিকে মুখ করে। পাশেই পড়ে আছে “রোড এন্ড্‌স হিয়ার” লেখা একটা তুবড়ে যাওয়া সাইনবোর্ড, বোঝা যাচ্ছে গাড়ির ধাক্কা’তে সেটিও ওদের সাথেই রাস্তা ছেড়ে এখানে এসে পড়েছে। সামনে এক ফুটের পরেই ঝুপ করে নেমে গেছে অন্ধকার অতল পাইনের সারি। ওরা যে ওই খাদে তলিয়ে যায় নি, এখনও বেঁচে আছে সেটাই আশ্চর্যের!

-“সবাই ঠিক আছিস তো?” সোহম আবার প্রশ্ন’টা করলো। এক এক করে সকলেই নেমে আসছে তখন গাড়িটার থেকে।

-“গাইড’টা কোথায় গেল? গাইড’টা?”

মাধবী কিছু বলতে পারল না। লোকটা ওর চোখের সামনে সত্যিই কি মিলিয়ে গেল হাওয়ায়?? ঠিক দেখেছিল কি ও? না কি চোখের ভুল? কে জানে...

****

একে অপরের হাত ধরে যেন একটা ঘোরের মধ্যে ওরা সেই গভীর রাতে পাহাড় ভেঙে উপরে উঠে এল। ভাঙাচোরা রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সদ্য হয়ে যাওয়া অ্যাক্সিডেন্টের ছাপ...  উপড়ে যাওয়া সাইনবোর্ড’টার লোহা, গাড়িটার ছোটখাটো এক-দুটো খুলে পড়া পার্টস... হোঁচট খেতে খেতে ওরা হাঁটা দিল ফিরতি পথে, মোবাইলের নিবু নিবু আলো’তে সদ্য আসা গাড়ির টায়ারের দাগ দেখে হাঁটতে থাকলে ভোররাতের আগে পৌঁছে’ই যাবে নিশ্চয়ই বাজার এলাকাটায়।

ওরা হাঁটছিল, কিন্তু কারো মুখে কোনও কথা ছিল না। সকলেই বোধহয় ব্যস্ত নিজের মত করে ধাঁধাটার উত্তর খুঁজতে। মনের ভেতর হাজারটা প্রশ্ন উত্তাল হয়ে উঠছে প্রতি মূহুর্তে... কে ছিল লোক’টা? কোথায় উবে গেল হঠাত্‌? চোর-ডাকাত হলেও হয়তঃ এর থেকে সহজ হত ব্যাপার’টা বোঝা। কেন কয়েকজন ট্যুরিস্ট’কে বাজারের মাঝখান থেকে এই শেষ হয়ে যাওয়া রাস্তায় টেনে এনে খাদে ফেলে দিতে চাইল? পাগল কি? না কি ফ্রাস্ট্রেটেড নেশাখোর মাতাল কোনো? উন্মাদ কোনো খুনি? না কি আরো অবিশ্বাস্য অভাবনীয় কিছু?

ওরা হাঁটছিল। মাঝেমাঝে চোটের ব্যথা জানান দিয়ে যাচ্ছিল, মাঝেমাঝে নাড়া দিয়ে যাচ্ছিল গা ছমছমে ভয়। মাঝরাত পেরিয়ে গেছে। আকাশে এক ফোঁটা মেঘ নেই। চাঁদ উঠছে আস্তে আস্তে। খাদের মধ্যেকার অতলান্ত সবুজ পাইনের জঙ্গল থেকে হু হু করে উল্মাদ হাওয়া ছুটে চলেছে। যেন একসাথে মাথা দুলিয়ে অট্টহাসি হাসছে শয়তানের শাগরেদের দল, “হম লেকে চলেঙ্গে আপকো... উয়ো আ গয়া আপকা গিরিন প্যারাডাইস...”

[শেষ]

ওয়ে টু গ্রিন প্যারাডাইস/১

By : Sayantari Ghosh

-“আর কতক্ষণ?”

গাড়ির জানলা দিয়ে মাথা বের করে অধৈর্য্য গলায় মাধবী বলল। সঙ্গে সঙ্গে ওর মুখে পিন বিঁধিয়ে দিয়ে গেল এক ঝলক ভীষণ ঠান্ডা হাওয়া! ডিসেম্বরের উত্তুরে বাতাস আস্তে আস্তে কৌসানি শহরের দখল নিচ্ছে। রাত বাড়ছে।

ওর দিয়ে তাকিয়ে ঠোঁট ওল্টালো সোহম। কত আর মিথ্যে বলা যায়, ও তো সত্যিই বুঝতে পারছে না যে আর কত দেরি হবে!

মাধবীর ক্লান্ত, বিরক্ত হয়ে ওঠা মুখটায় এবার আস্তে আস্তে দুশ্চিন্তার ছায়া পড়ছে। সোহম এসে জানলার কাছে দাঁড়ালো, “জানলার কাঁচ তুলে বস রে, বাইরে প্রবল ঠান্ডা”, বলল সোহম, “এই গুগল ম্যাপের যুগে রাস্তা চিনতে গিয়ে এরকম নাকানি-চোবানি খাচ্ছি... বল দেখি? এরকম জানলে একটা ভাড়া গাড়ি করে নিতাম, অনেক বেটার হত। লোকাল ড্রাইভার হলে ঠিক রাস্তা চিনতো।“

তাই বা হত কি করে? নতুন গাড়ি কিনে কিছুটা সেলেব্রেসনের আনন্দেই তো এবার ট্যুর’টা প্ল্যান করেছিল মানিক। পাঁচবন্ধু মিলে লং ড্রাইভ! আর দিল্লী থেকে কি ভালো এসেওছে গাড়ি’টা! হাত বদলিয়ে সকলেই স্টিয়ারিং ধরেছে অদল-বদল করে। নৈনিতালে দু’দিন, তারপর আলমোরা, সেখান থেকে রানিখেত হয়ে আজ কৌসানি পৌঁছানোর কথা। কৌসানি’টাই এবারের ট্রিপের বেস্ট স্পট। কৌসানি বাজারের ভিড় ছাড়িয়ে একটু এগিয়ে পাহাড়ের গায়ে দেওদারে ঘেরা একটা বাংলো বুক করেছে মিতালী। হোটেলের নাম গ্রিন প্যারাডাইস! ইন্টারনেটে দেখেছিল কটেজের ত্রিসীমানায় আর কোনো জনবসতি নেই বহুদূর অবদি, শুধু সবুজ আর সবুজ। বন্ধু’রা মিলে এলে এরকম একটা জায়গাই তো চাই, দু’টো দিন জাস্ট রিল্যাক্স করে কাটাতেই তো আসা!

রানীখেত থেকে বেরোনোর পর সময় হাতে যথেষ্টই ছিল। দাঁড়াতে দাঁড়াতে, ছবি তুলতে তুলতে, এগোচ্ছিল ওরা। সোমেশ্বর বলে একটা জায়গা পেরোলো সাড়ে পাঁচটায়, কৌসানির আগে এটাই শেষ জনপদ। সোমেশ্বরের বাজারে দাঁড়িয়ে চা আর তেলেভাজা খাওয়া হল যখন, তখনও তাড়াহুড়োর কথা কারো মাথায় আসেনি। ওখান থেকে আধঘণ্টার বেশি লাগার কথাই নয়। কিন্তু কপালে দূর্ভোগ লেখা থাকলে আর কি করা যাবে! এক চিলতে শহরটা পেরিয়ে যেই না পাইনবনের রাস্তা’টা এসে পড়ল, অম্নি তিন বার ঝাঁকুনি দিয়ে দাঁড়িয়ে গেল গাড়িটা। সন্ধ্যে’টাও ঝুপ করে নেমে এল তক্ষুনি।

-“কার্বুরেটরে কচ্‌রা..” বলল সোহম; মানিক আর নিসার’ও তখুনি নামল গাড়ি থেকে। বনেট খুলে নানারকম যুদ্ধ চলল ক্রমাগত। আনাড়ি হাতের অত্যাচারে মাঝেমাঝে ভয়ানক গর্জন করে উঠছিল গাড়ি’টা, কিন্তু তবুও নড়বে না শপথ করে সে দাঁড়িয়ে রইল পুরো পৌনে ঘন্টা। অগুনতি বার সেলফ মারতে মারতে শেষে ঘশঘশ করে একটা হোঁচট খেয়ে যখন স্টার্ট নিল গাড়ি’টা, ঘড়ির কাঁটা তখন সাত’টা ছুঁইছুঁই। আর কৌসানি তখনও বারো কিলোমিটার।

খুব সাবধানে চালাচ্ছিল মানিক, ফলে গাড়ি কৌসানি বাজার পৌঁছালো পৌনে আটটা নাগাদ। ম্যাপ দেখে বড় রাস্তা ছেড়ে জংলা রাস্তা ধরার দশ মিনিটের মধ্যেই বোঝা গেল পথ ভুল হয়ে গেছে। এ দিকে শুধুই পাইনের জঙ্গল, কোনো হোটেল রিসর্টের চিহ্নমাত্র নেই। তখুনি গাড়ি ঘুরিয়ে আবার খানিক রাস্তা হাতড়িয়ে বাজার ফিরে আসা ছাড়া আর কোনো উপায়ই দেখা গেল না।

বাজার এলাকার এক পাশ করে গাড়িটা লাগিয়েছে নিসার। গত কুড়ি মিনিট এখানেই দাঁড়িয়ে আছে ওরা। আশ্চর্যের ব্যাপার হল, এই এতক্ষণে অন্য একটা গাড়িও পেরোয় নি এখান দিয়ে! শীতকাল, অফ সিজন বলেই বোধহয় ট্যুরিস্ট’দের ভিড় কম! কে জানে!  একটু আগে মিতালীও নেমে গেছে গাড়ি থেকে, মাধবী একাই বসেছিল। ভীষণ টায়ার্ড লাগছে, ঘরে ঢুকতে ঢুকতে কত রাত হবে কে জানে! ব্যাগ ঘাড়ে করে পায়ে হেঁটে চলে যেতে ইচ্ছে করছে এবার! লোকজনের ঘরের দরজায় টোকা মেরে জিগেস করতে ইচ্ছে করছে, “আজ রাত্তির’টা একটু থাকতে দেবেন প্লিজ...”... ইস! যদি আরেকটু সকাল সকাল বেরোতো!

- “ধূর! আজকের দিনটাই খারাপ! মনে মনে গজগজ করে উঠলো মাধবী।

সন্ধ্যে সাড়ে আট’টার কৌসানি বাজার মধ্যরাতের কলকাতার মত শুনশান। ডিসেম্বরের শীতে শহরটা যেন অন্ধকারের সাথে লেপ্টে শুয়ে আছে একটু উত্তাপ খুঁজে। দোকানগুলোয় ঝাঁপ পড়ে গেছে, রাস্তার পাশে ঠেলাগাড়িগুলো অথর্ব হুইলচেয়ারের মত পড়ে আছে। আলো বলতে একখানা স্ট্রিটলাইটের দপদপানি খালি। আগেরবার বাজার পেরোনোর সময় দেখেছিল, দূরে একটা গলির মুখে চার-পাঁচটা লোক কম্বল মুড়ি দিয়ে সন্ধ্যের মৌতাতে বসে আগুন জ্বালিয়ে শরীর সেঁকে নিচ্ছে, এখন তারাও নেই, মরা আগুন’টা থেকে আলগা একটু ধোঁয়া উঠছে খালি। কি ভীষন নিঝঝুম চারদিক। শব্দ বলতে মাঝেমাঝে কোনো একটা অজানা পাখির আর্তনাদ, ব্যাস!

রাস্তার ওপাশে একটা পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরিয়েছে নিসার আর মানিক। সোহম আর মিতালী এখনো লড়ে চলেছে ফোন নিয়ে। টাওয়ার প্রায় অদৃশ্য। বাংলোর কেয়ারটেকার’কে তবু যদি পাওয়া যায়! গাড়ির হেডলাইট’টায় আলো হয়ে আছে জংলা পথের বাঁক’টা, মাধবী সেদিকেই তাকিয়ে ছিল। আস্তে আস্তে উল্টোদিকের জানলার কাঁচ’টা নামালো ও। গাড়ির বাইরে সত্যিই ভীষণ ঠান্ডা! দূরে অন্ধকার পাহাড়ের গায়ে ফোঁটা ফোঁটা আলো, মনে হচ্ছে কোল ভরে আলো জ্বালিয়ে পাহাড়টা যেন আকাশের তারাদের চ্যালেঞ্জ করছে বিউটি কনটেস্টে! ... ওটা কি জায়গা? ওরা কি পেরিয়ে এসেছে ওদিক’টা, না পৌঁছায়নি ওখানে এখনও?  ওই আলোগুলোর দিকে একটুক্ষন তাকিয়ে থাকলে বোঝা যায় যে কি ভীষন অন্ধকার ওই জঙ্গলের দিক’টা! ঘড়ির কাঁটা যত রাত্তিরের দিকে এগোচ্ছে, পাইনাসের দল যেন সারি বেঁধে আস্তে আস্তে রাস্তায় নেমে আসছে। গাড়ির হেডলাইট’টা যেন তরোয়ালের ফলার মত সেই আলখাল্লা পরা ভিড় সরাচ্ছে আর এই পাঁচটা মানুষের অস্তিত্বের জন্য আপ্রাণ লড়াই করছে।
সোহম’রা ফিরছে গাড়ির দিকে; নিসার’রাও। যা বোঝা যাচ্ছে আজ গাড়িতেই রাত্রিযাপন। বাইরে রাতের হাওয়া তান্ডব শুরু করছে এবারে। ইস! আজকের সব আড্ডার প্ল্যান একেবারে ভেস্তে গেল!

-“কুছ পরেশানি হ্যায় ক্যা মেডাম জি?”

ঘাড়ের কাছে হঠাত্‌ গলা’টা শুনে আঁতকে উঠল মাধবী! বুকের ভেতর’টা ধড়াস করে উঠলো যেন। এই শুনশান পাহাড়ী রাস্তার অন্ধকার বাঁকে রাতপাখির চিত্‌কারের মাঝে বসে থাকতে থাকতে বোধহয় পৃথিবীতে আর কোনো মানুষ থাকতে পারে এই ধারণাটাই লোপ পেতে বসেছিল।

একটা লোক। আপাদমস্তক গরম কাপড়ে মোড়া। মুখের মধ্যে খালি দেখা যাচ্ছে চোখদুটো, বাকিটা মাফলারে ঢাকা। উঁকি দিচ্ছে খোলা জানলার কাঁচের ফাঁক দিয়ে।

[পরের কিস্তি'তে শেষ]

হাওয়াঘন্টি / ২

By : Sayantari Ghosh




[শেষটুকু...]

ভয় করল ভীষণ! গলা শুকিয়ে গেল মূহুর্তে... এই ভরদুপুরে, দিনের আলোয় এ কিরকম পাগলামিতে পেয়ে বসল আমাকে...?

কি রে?” চমকে পিছনে ফিরলাম রিদ্‌মের ডাকে, “রেস্ট নিতে বললাম তোকে... আর তুই...... এইইই, এরকমভাবে ঘেমেছিস কেন রে...? কি হল'টা কি তোর...? শরীর খারাপ করছে না কি?”

না না, আয়াম ফাইন... আমি... আমি ঠিক আছি... জাস্ট টায়ার্ড...বললাম, কিন্তু নিজের গলাটাই চিনতে পারলাম না নিজের বলে... গলার কাছে কি যেন দলা পাকিয়ে আটকে গেছে...!!

সারা দুপুর চুপটি করে বসে রইলাম... জেনের জার্মান স্পিত্‌জ্‌ চেরি আমার কোলে উঠে বসেছিল... আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলাম ওর মাথায়... ঠুন্‌ন্‌-ঠুন্‌ন্‌‌ করে উইন্ডচিমার বাজছে বারান্দায়... ফালি ফালি পড়ন্ত রোদ ঢুকে পড়ছে বাগানের ওক গাছটার ফাঁক দিয়ে... ঘরের হাওয়াটা কেমন যেন ভারি ঠেকছে আমার... যেন পলিথিনের প্যাকেটে মোড়ানো হয়েছে হাওয়াটাকে... একটা ছায়া যেন ঘিরে ধরে আছে...

রিদ্‌ম বলল বিকেলে সেন্ট এডওয়ার্ড স্কুলের পাশের চার্চে যাবে। ওর লাগোয়া গোরস্থানটাও বেশ পুরোনো... এখন আর লোকজনের সেরকম যাতায়াতও নেই সেখানে...

তুই যাবি...? না কি...... আই থিঙ্ক ইউ শুড টেক রেস্ট... ঘোরাঘুরি করতে হবে না আর...বলল ও...
বুঝতে পারছিলাম না! বেরোতে ইচ্ছে করছে না, কিন্তু একা থাকার কথা ভাবতেই কেমন একটা বোকাবোকা ভয় চেপে ধরছে যেন। বললাম, “জেন কখন ফিরবে রে...?”

আজ তাড়াতাড়ি ট্রাই করবে... মে বি ফাইভ থার্টি অর সিক্স... কেন...?”

টেবিলের ওপর থেকে হাতঘড়িটা তুলে দেখলাম। চারটে। বললাম, “তাহলে... তাহলে আমি আর বেরোবো না...
ওকে দেন... আমি বেরোই, কেমন...? কিছু নিয়ে আসব? কিছু চাই...?”

বলতে ইচ্ছে করল, “রিদ্‌ম্‌... আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে... আমি চন্ডীগড় ফিরতে চাই...

বলা গেল না।

........................................................................................................

রিদ্‌ম্‌ বেরিয়ে যাবার পর সোফায় বসে বসে চেরিটাকে জড়িয়ে ধরে কখন জানি চোখ লেগে গেছিল। চোখ খুললাম যখন, আলো কমে এসেছে ঘরটায়। এত তাড়াতাড়ি সন্ধ্যে হয়ে গেল বুঝি? 'টা বাজছে...? চোখ রগড়ে টেবিলের উপরটা হাতড়ালাম অন্ধকারেই...

খুব ঠান্ডা কি একটা হাতে ঠেকলো... চমকে উঠে বসলাম... একটা জলের বোতল...! কেউ এক্ষুণি ফ্রিজ থেকে বের করে রেখেছে... এতটুকু জল গড়ায় নি সেটা থেকে এখনও... আর গোটা টেবিলে কোথাও রিস্টওয়াচ'টা নেই...!

ঝট করে উঠে দাঁড়াতেই মাথাটা ঝিমঝিম করতে লাগল... পা টলছে... চেরি কোথায় গেল...?
চেরি...!ডাকলাম...

সাড়া নেই...

সোফার নিচেটা দেখলাম উঁকি দিয়ে... ঘর'টা বেশ অগোছালো, টের পাচ্ছি রীতিমতো... ডায়নিং টেবিলের ওপর আমার শেষ-করা কফির কাপ'টা ধুয়ে উলটে রাখা, ওয়াশ বেসিনের পাশে জল ছড়িয়ে আছে, একটা চেয়ার টেনে একটু বেঁকিয়ে রাখা... যেন কেউ বসেছিল সোফাটার দিকে তাকিয়ে...

চেরি নেই কোত্থাও!

চেরি...?” ডাকলাম আরেকবার... পাত্তা নেই কারো...

আস্তে আস্তে বারান্দায় বেরিয়ে এলাম.....উইন্ডচিমারটা সেরকমই বাজছে এখনও... ওকগাছটাকে কেমন ডাইনিবুড়ির মতন দেখতে লাগল একবার তাকিয়ে...

ঘরে ফিরে এলাম; এক গ্লাস জল খাবো... টেবিলে রাখা বোতল'টা নিতে গেলাম আর রক্ত হিম হয়ে গেল মূহুর্তে...

সোফাটার কোল জুড়ে অন্ধকার বেশ গাঢ় হয়েছে ততক্ষনে... দেখলাম, চেরি সোফার কুশনে গা ঘষছে আনমনে... যেন খুব করে আদর খাচ্ছে কারো কাছে...

কে...???? কে ওখানে...?” চেঁচিয়ে উঠলাম খুব জোরে...

একঝাঁক হাওয়া ঢুকলো খালি জানলার পর্দাটা উড়িয়ে দিয়ে...

কে...??? কেন ভয় দ্যাখাচ্ছো...? জেন...? জেন ফিরে এসেছো বুঝি...? না কি... না কি তুই রিদ্‌ম্‌...? প্লিজ আমায় আর ভয় দেখাস না তোরা, ভাল্লাগছেনা আমার, প্লিজ...

গলা ভেঙে গেল আমার কথা'কটা বলতে গিয়ে... বুকের ভেতর কেউ যেন ভয়ে চোখ বন্ধ করে বলছিল যে ঘরে কেউ আছে... নিশ্চিত আছে... কিন্তু সে রিদ্‌ম্‌ নয়... জেনও নয়... তাকে আমি চিনি না...!!
আরেকবার পর্দাটা উড়ল... এবার খুব জোর হাওয়া... টেবিলের নিচের তাক থেকে খবরের কাগজগুলো উড়ে ঘরময় হয়ে গেল একেবারে... চেরি এবার আমার দিকে তাকাল অবাক হয়ে...

কেন...? কেন...? কি চাও...? কি.........বলতে বলতে চোখ জল এসে গেল আমার... নড়তে পারছি না এতটুকু... গলার স্বর তলিয়ে যাচ্ছে যেন চিরকালের জন্যে...

..........আরেকজনও কিছু বলতে চায়... ভীষণ ভাবে বলতে চায়... ঘরজোড়া টানটান অন্ধকার সেটা জানান দিইয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত...

আরেকবার হাওয়া দিল... আর পাক খেয়ে খবরের কাগজের একটা পাতা আমার পায়ে জড়িয়ে গেল...
আর সাথে সাথে হাওয়া থেমে গেল একেবারে...

সব চুপ... সব শান্ত... যেন ত্রিভুবনে শব্দ বলে কিছু হয়'ই না এ'রকম নীরবতা... উত্‌কন্ঠায় উপচে যাওয়া নীরবতা... সব্বাই যেন অপেক্ষা করছে আকুল হয়ে...

আঙুল হিম... হাত কাঁপছে... কোনোরকমে কাগজটা কুড়িয়ে নিলাম...

গত চোদ্দ'ই ফেব্রুয়ারির খবরের কাগজ...

পাতাজোড়া গোলাপি রঙের বিজ্ঞাপন কোনো এক গ্রিটিংস্‌ কার্ড কোম্পানির... বড় বড় অক্ষরে লেখা...

Some day, when I'm awfully low
When the world is cold
I will feel a glow just thinking of you
And the way you look tonight

পড়া শেষ... আস্তে আস্তে মাথা তুললাম... হাঁটুর আশেপাশে জোরালো কাঁপুনি... শিরদাঁড়ায় ঠান্ডা ঝিমুনি... ঘরের আলোআঁধারের মধ্যে কাউকে খুঁজে চলেছে আমার দু’চোখের মণি... স্ট্যাচু হয়ে তাকিয়ে রইলাম সামনের দিকে...

চেরি আবদারি জুলুজুলু চোখে তাকালো আমার দিকে...

নরম আকুতির মতন খুব আলতো একটা হাওয়া দিল ঘরটায়...

[শেষ]


হাওয়াঘন্টি

By : Sayantari Ghosh


মেজর চার্লস ক্রস্‌বি...? তাই তো...?” আরেকবার জিগেস করলাম আমি।

ইয়াপ্‌, তাই...বলে কবরগুলো থেকে চোখ তুলে আমার দিকে তাকালো রিদ্‌ম্‌, “ফিলিং টায়ার্ড, না?”

আসলে তাই! সকাল সাতটায় ঢুকেছি সঞ্জৌলি গোরস্থানে;  এখন মাথায় ওপর চনচন করছে রোদ... ঘড়ির কাঁটা বারোটা পেরিয়ে গেছে...

কাল এসেছি সিমলায়। চন্ডীগড়-সিমলা যাতায়াত'টা আমি আর রিদ্‌ম্‌ ইচ্ছে হলেই করে থাকি... উইকএন্ড, অফিসে ছুটি, সেলিব্রেশন বা মনখারাপ... গাড়ি বের করে সোজা সিমলা! তবে হুজুগটা বেড়েছে রিসেন্টলি... যবে থেকে এই জিনিওলজির ভূত'টি এসে রিদ্‌মের মাথায় চেপেছে! বোধহয় একটা পুরোনো ডায়েরি থেকে শুরু হয়েছিল ব্যাপারটা... তারপর এখন নিজের পরিবারের ইতিহাস ঘেঁটে দ্যাখাটা শখ হয়ে গেছে রিদ্‌মের; আর পুরোনো জায়গায় ঘুরঘুর করতে চাইলে আমার ঝুলে পড়তে আপত্তি থাকেনা কখনই.....

তিনদিন আগে থেকে এই চার্লস ক্রস্‌বির নামটি মাথায় ঢুকেছে ওর। বুধবার রিসেস আওয়ারে দুম করে আমার ক্যাবিনে ঢুকে এক গাল হেসে বলল, “তোর বর পাওয়া গেছে রে...!” সত্যি বলতে কি, শোনামাত্র আমার বুকের ভেতর ধুকপুকুনি বেড়ে গেছিল! বলে কি ছেলেটা? প্রপোস'টা এভাবে করবে বুঝি? মাথা'টা কি খারাপ হয়ে গেল একেবারেই ওর? এক মিনিট পরে থতমত ভাবটা কাটিয়ে উঠলাম যখন রিদ্‌ম্‌ খোলসা করে বলল গল্প'টা। পুরো'টা শুনে মজা পেলাম ঠিক'ই, কিন্তু ভেতর ভেতর নিজেকে বড্ড বোকা মনে হচ্ছিল। হপ্তাখানেক আগে ভ্যালেন্টাইনস ডে'র দিনও এই একই রকম পাগলামি করছিল মন'টা! নিজেকে একটা আস্ত হাঁদাগঙ্গারাম মনে হল।  প্রপোস-টোপোস কত কি ভেবে ফেলেছিলাম, ধূর! 

রিদমের গল্পের মুখ্য ভূমিকায় আছেন এই চার্লস ক্রস্‌বি বলে ভদ্রলোক'টি। সম্পর্কে ওর ঠাকুর্দার মাসতুতো ভাই... প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় সিমলায় পোস্টিং ছিল তাঁর... সারা সিমলায় ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীর হত্তাকত্তাদের মধ্যে মেজর ক্রস্‌বির নামযশ ছিল নাকি খুব... বাড়ির বাতিল কাগজের স্তূপের কোত্থেকে জানি রিদ্‌ম্‌ একখানা ঘষে যাওয়া হলদেটে ছবি পেয়েছে... চাড়া-দেওয়া গোঁফের ক্রস্‌বি সাহেব আর তাঁর সদ্যবিবাহিতা স্ত্রী'র... রিদ্‌মের চাপাচাপি’তে মানতে বাধ্য হলাম মেজর সাহেব যতই জাঁদরেল চেহারার হোন না কেন, ভদ্রমহিলাকে সত্যি সত্যি অনেকটাই আমার মতন দেখতে... ব্যাস, ছেলে খেপে উঠলো একেবারে, “চল না এই উইকএন্ডে ঘুরে আসি একবার, জাস্ট দ্য সেমেটারিস্‌... উই উইল লুক ফর এ হোয়াইল অ্যান্ড কাম ব্যাক...

ঘ্যানঘ্যান করলে ওকে 'না' বলতে পারিনা কখনও... কে জানে কেন... মোক্ষম ব্যাপারটা হল, রিদ্‌ম্‌ ডাকলে আপত্তি করার ক্ষমতাই থাকেনা আমার... মনে হয় সারাটা জীবন যদি এভাবে হুঠহাঠ ওর সাথে বেরিয়ে পড়া যেত...... ধুর! সেসব কথা ওকে বলাই হয়না আমার... ডিয়ারেস্ট কলিগ, বেস্ট ফ্রেন্ড এই বেশ ভালো আছি... কি দরকার ঝামেলা বাড়িয়ে...

যাগগে সেসব কথা... উইকএন্ড এসে পড়তেই তাই কাল বেরিয়ে পড়েছিলাম... আর আজ অভিযান সঞ্জৌলি...

লেট্‌স্‌ গো ব্যাক দেন ফর নাও,” আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রিদ্‌ম্‌ বলল, “তোকে খুব ক্লান্ত দ্যাখাচ্ছে...
ওক্কে...আমি হেসে বললাম, “একটু বসে নিই? এক্কেবারে হাঁফিয়ে গেছি...

একটা বিশাল রডোডেন্ড্রনের নিচে বসলাম পা ছড়িয়ে। জায়গাটা এম্নিতে বেশ চুপচাপ, তারসাথে গলাজড়াজড়ি করে রয়েছে একটা পুরোনো গন্ধ... সারসার পুরোনো পাথর আর আদ্যিকালের পাহাড়ি গাছেদের ভিড়... মানুষগুলো ঘুমোচ্ছে কে জানে কবে থেকে... ডরোথি ড্যালি, ১৯২৯... ব্যারনাবি মারফি, ১৯৩৪... উইলিয়ম ক্যাহিল, ১৯৩৮... সবাই অঘোর ঘুমে... আগে হয়তঃ প্রতি সপ্তাহে কেউ দেখা করতে আসত... একটা গোলাপ ফুল রেখে যেত ঘুমিয়ে পড়া বুকের ওপর... ছুঁয়ে বসে থাকত... কেঁদে যেত অঝোরে... তারপর কতযুগ, কতযুগ পেরিয়ে গেছে... আর কেউ আসেনা... কেউ আসে না...

ঝুপ করে আচমকা একটা শব্দ হল আমার ঠিক পিছনে! খেয়ালে এমন ডুবেছিলাম যে ভেতর অব্দি কেঁপে গেল আওয়াজ'টায়... উঠে দাঁড়িয়ে পড়লাম হুট করে...

হেই... হোয়াট হ্যাপেন্‌ড্‌?” রিদ্‌ম অবাক হয়ে বলল, “এনিথিং রং?”

জানিনা...! পিছনের ঝোপটার দিকে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ... অন্ধকার করে রয়েছে সাদা ফুল ফোটানো একটা বুনো লতা... আর... আর যেন তার ওপাশ থেকে কেউ দেখছে আমাকে... মনে হল ঝুপসি হয়ে নেমে আসা পাতাগুলো সরানোর অপেক্ষা... কেউ আছে ওখানে...

মিলি...? কি হয়েছে...? বলবি তো...?”
নাথিং!একটা ঢোঁক গিলে বললাম, “বেরিয়ে পড়ি, চ... দেরি হচ্ছে...

সিমলা এলে আমাদের ঠিকানা হয় জেনের বাড়ি। তার দুটি পরিচয়... রিদ্‌মের খুড়তুতো দিদি; আর সোনায় বাঁধানো মনের একজন মানুষ। সারাটাদিন মনিপাল ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসে পড়ে থাকে; আর সন্ধ্যেয় ফিরে দারুণ দারুণ সব গল্প আর তারচেয়েও ভাল ভাল রান্না দিয়ে আড্ডা জমিয়ে দিতে পারে...
বাড়ির সামনে পৌঁছাতেই পাশের দোকানের মেয়েটা দৌড়ে এসে চাবি ধরিয়ে দিল রিদ্‌মের হাতে; সঙ্গে একটা ছোট্ট চিঠি...
খিদে-টিদে পেয়ে গেছে নিশ্চয়ই... রান্নাঘর এবং ফ্রিজ তোমাদেরই... আগুন-টাগুন ধরিয়ে দমকল ডাকা ছাড়া যা খুশি করতে পারো... :)

এই হল জেন... মন'টা ভালো হয়ে গেল এক মিনিটেই...

ঘরে ঢুকে সোফায় এলিয়ে বোস...তালা-চাবি আমার হাতে ধরিয়ে রিদ্‌ম বলল, “আমি একটা দারুণ করে কফি করছি...

সদর দরজায় ছিটকিনি দিয়ে বাগান পেরিয়ে ঘরে ঢুকলাম; বাগান’টা মরসুমি ফুলের ভিড়ে রংরঙিন। বিশাল ওকে গাছটায় ঝিকিয়ে উঠেছে রোদ। বারান্দায় সেই চেনা উইন্ডচিমার'টা হাওয়ায় দুলছে। মন'টা জুড়িয়ে আসছিল। বসার ঘরের সোফায় এলিয়ে থাকবো এখন খানিক, তাহলেই ফ্রেশ হয়ে যাবো। হয়তঃ সত্যিই খুব ধকল হয়ে গেছে, তাই অস্বস্তি হচ্ছিল তখন। 

টেবিলে তালাটা রাখতে গিয়েই জানলার বাইরে চোখ চলে গেল...

একি! সদর'টা হাট করে খোলা...! সঞ্জৌলির ধুকপুকুনিটা হুড়মুড়িয়ে ফিরে এল বুকের মধ্যে... আমি যে... আমি যে এখুনি লাগিয়ে এলাম দরজাটা...!! কে খুলে দিল তাহলে?


হুশ করে জানলার পর্দাটা উড়ে চোখ ঢেকে দিল আমার... আর সঙ্গে সঙ্গে কিরকম একটা অস্বস্তি পাক দিয়ে উঠল সারা শরীরে... মনে হল যেন ঠিক আমার পিছনে দাঁড়িয়ে কেউ দেখছে আমায়...!!

[পরের কিস্তি'তে শেষ]

- Copyright © পাঁচমিশেলি - - Powered by Blogger - Designed by সায়ংতরী -