Popular Post

Showing posts with label উইকএন্ডের গল্প. Show all posts

উইকএন্ডে চলুন, তিঞ্চুলে

By : Sayantari Ghosh

 

কাল রাতে একটা জম্পেশ স্বপ্ন দেখলাম।

দেখলাম, আমি ট্রেনে করে যাচ্ছি, সাইড লোয়ার বার্থে ঘুমাচ্ছিলাম, হঠাত ঘুম ভেঙে গেল। দেখি, একটা সবুজ পাইনে ঘেরা দিগন্তজোড়া চা-বাগানের পাশে ট্রেন দাঁড়িয়ে গেছে... রেললাইনটাকে প্রায় জড়িয়ে ধরে ফুটে আছে ঝাঁক ঝাঁক গোলাপী আর হলুদ ঘাসফুল। খানিকটা দূরে বেঁকে চলে গেছে একটা হাতছানি দেওয়া সর্পিল রাস্তা, রাস্তার ধার বরাবর পতপত করে উড়ছে তিব্বতী ভূততাড়ানি পতাকার সারি... ডানদিকে অনেকটা দূরে একটা সবুজ পাহাড়, পাহাড়ের কোল আলো করে কমলালেবুর বাগানে ঘেরা একটা ছোট্ট রংচঙে মনাস্ট্রি। আর সবার পিছনে টারকুইজ নীল ব্যাকগ্রাউন্ডে ঝলমল করছে কাঞ্চনজঙ্ঘা!

স্বপ্নটা আজ সকালে উঠেও আলো করে ছিল মনটা। দাঁত মাজতে মাজতে ভাবছিলাম, কোথায় যেন দেখা ছবিগুলো... ফুলের দল, চা-বাগান, মনাস্ট্রি, গাছ উপচানো কমলালেবু, পাইনের সারি, টিবেটান প্রেয়ার ফ্ল্যাগ, কাঞ্চনজঙ্ঘা... টুকরো টুকরো ছবির একখানা কোলাজ যেন দেখলাম!

চায়ের জল’টা যেই সোনালী হয়ে ফুটে উঠলো, অম্নি মনে পড়ে গেল... তিঞ্চুলে...!

বছর তিনেক হয়ে গেল তিঞ্চুলে ঘুরে এসেছি, জানেন, কিন্তু যখনই ট্যুর’টা মনে পড়ে কি যে ভালো লাগে কি বলব! আজ ছবিগুলো উল্টেপাল্টে দেখতে দেখতে ভাবলাম যেটুকু যা মনে আছে এখানে তুলে রাখি। আপনি হয়তঃ কাজের চাপে দম ফেলতে পারছেন না, বা কোনো কিছু নিয়ে খুব টেনশনে আছেনহয়তঃ আপনার খুব মনখারাপ যাচ্ছে, কিম্বা প্রাণ’টা ছটফট করছে ব্যস্ত শহরের হুড়োহুড়ি’তে। সেক্ষেত্রে এ লেখা’টা আপনার কাজে লেগেও যেতে পারে। উইকএন্ডের আশেপাশে আর একটা কি দুটো দিন ছুটি ম্যানেজ করতে পারবেন? তাহলে তিঞ্চুলে’টা ঘুরে আসুন। নিজের সাথে সময় কাটাতে হলে এ জায়গার কোনো জুড়ি নেই। এখানে পাইনবনের আলোছায়ার ঘুরতে ঘুরতে আপনার নিজের সাথে নতুন করে দেখা হয়ে যাবে, কথা দিতে পারি।

এবার আপনি বলবেন, “তিঞ্চুলে... হেঃ হেঃ, অদ্ভূত নাম... কোথায় জায়গাটা?”

আমিঃ “কাছেই... উত্তর বাংলা... নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে নেমে ঠিক পঁচাত্তর কিলোমিটার... শুক্কুরবার রাত্তিরে অফিস করে ট্রেন ধরে নিন... সকাল সকাল নামবেন... তারপর গাড়ি... দুপুরের লাঞ্চ তিঞ্চুলে’তে... আবার সোমবার’টা ছুটি নিলে মঙ্গলবার ভোরে আপনি আবার আপনার ব্যস্ত শহরের রাস্তায়... উইকএন্ডে ঘুরে আসার মত এরকম রোম্যান্টিক জায়গা খুব কম হয়, বুঝলেন...! নিচু হয়ে থাকা পাইনবনের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা রাস্তা... গেলে মনে হবে গ্রাম’টা যেন চা’য়ের বাগানে গা এলিয়ে আলসেমি করছে... বেড়ানোর প্ন্যানও একেবারে তৈরী... কোথায় যাবেন কি বেড়াবেন সে নিয়ে বেশী ভাবনারও দরকার নেই... তিঞ্চুলের গুরুং গেস্ট হাউস বুক করে রাখলে সব ব্যবস্থা ওরাই করে দেবে...”

  



আপনি(খানিক ডিপ্রেসড মুখ করে), “অ... গেস্ট হাউস... ভালো হোটেল কিছু নেই? রিসর্টগোছের আর কি...”

আমি (রে রে করে উঠে), “আরে বলেন কি? ভুলেও এ’কথা আর মুখে আনবেন না... অনেকরকম হোটেল রিসর্টের থেকেছি মশাই, কিন্তু গুরুং গেস্ট হাউসের মত ভালো ব্যবস্থা আর আদরযত্ন খুব কম জায়গায় পেয়েছি... যে’কদিন থাকবেন, মনে হবে আপনাকে পেয়ে বোধহয় ওদের আনন্দ আর ধরছে না... ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠিয়ে অসাধারণ চা খাইয়ে আপনাকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখাতে নিয়ে যাবে, বাড়ির ছেলেরা সঙ্গে করে ট্রেকিং’এ নিয়ে যাবে... আর খেতে বসে আপনি বলবেন যে ‘আর পারবো না’, তবু আপনার পাতে জোর করে দু’টো লুচি গুঁজে দেওয়া হবে... একেবারে জামাই-আদর যাকে বলে...”

আপনি, “তাই নাকি? বাব্বাহ্‌, দারুন ব্যাপার তো হে... তা প্ন্যানটা একটু গুছিয়ে বল দিকিনি...”

আমি, “ওই তো... ধরে নিচ্ছি আপনি সোমবার’টা ছুটি ম্যানেজ করেছেন... তাহলে শুক্রবার রাতে ট্রেন, শনিবার সকালে নিউ জলপাইগুড়ি, দুপুরে তিঞ্চুলে... বিকেল’টা জাস্ট পাইনবনে ঘুরে, পাখির ডাক শুনে, ঝোলা বারান্দায় বসে দার্জিলিং টি খেয়ে রিল্যাস্ক করুন... রোববার ভোরবেলা উঠে পড়ে গেস্ট হাউসের টাওয়ার থেকে দেখে নিন সানরাইস... যারা আগে দেখেছেন তাদের আর নতুন করে বলার কিছু নেই যে কি অভাবনীয় রকমের সুন্দর কাঞ্চনজঙ্ঘায় সূর্যোদয়... আমার দেখা সেরা কাঞ্চনজঙ্ঘা কিন্তু আমি তিঞ্চুলে থেকেই দেখেছি, নভেম্বর মাসের ধারালো ঠান্ডায় ভোর পৌনে পাঁচটায়। আমার নিজের কথা বলতে পারি, স্পেলবাউন্ড বলতে যা বোঝায় আমার সেই দশা হয়েছিল! যখন কমলালেবুর মত সূর্য’টা আস্তে আস্তে উঁকি দেবে আর গলানো সোনা ঢেলে বাঁধিয়ে দেবে কাঞ্চনজঙ্ঘা’কে, তখন আপনি পৃথিবীর আর সব কিছু পুরোপুরি ভুলে যাবেন কয়েকমিনিটের জন্য! মনে হবে সময় থমকে গেছে আর আপনি দাঁড়িয়ে আছেন স্বর্গের দরজায়। চোখ ফেরানো যায় না এত সুন্দর, অথচ সে সৌন্দর্য জমকালো না কি স্নিগ্ধ সেটা আমি এখনও ঠিক করে উঠতে পারিনি... অসাধারণ অভিজ্ঞতা... ভাষায় বোঝাতে পারবো না আর কি...”



আপনি, “আহা... মন ভরে যাচ্ছে গো... সত্যি এত সুন্দর?”

আমি, “সে তো হবেই, কাঞ্চনজঙ্ঘা বলে কথা, এ বাংলায় ও’রকম ডাকসাইটে সুন্দরী আর ক'জন আছে বলুন! হেঃ হেঃ হেঃ... সানরাইস হয়ে গেল তাহলে... সূর্য ওঠার পর কাঞ্চনজঙ্ঘা যখন আপনার মন ভরিয়ে দিয়েছে, তখন বাগানে চেয়ার পেতে বসে ব্রেকফাস্ট সেরে নিন... এরপর কিন্তু সারাদিন বেড়ানো... শুরু করুন হাতের কাছের গ্রাম লামাহাট্টা দিয়ে (এখানেও অনেক নতুন হোটেল হয়েছে, অনেকে তিঞ্চুলে’তে না থেকে এখানেও থাকেন)... এখানে আছে পাহাড়ের ধাপ বেয়ে মরসুমী ফুলের বাগান, আর পাখির ডাকে কুয়াশার ওড়নায় ঢাকা একটা ছোট্ট লেক... ঘন্টাখানেক এখানে কাটান আর অফিসের যাবতীয় দুশ্চিন্তাকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দিন... তারপর চলে আসুন তিঞ্চুলে মনাস্ট্রি... পাহাড়ের চূড়োয় ছোট্ট এই মনাস্ট্রি’টিও শান্তি-দিয়ে-মোড়া... এরপর দুপুরের খাওয়া সেরে বড়া-মাঙ্গওয়া গ্রামের কমলালেবুর বাগান... যাওয়ার রাস্তা একটু ভাঙাচোরা, কিন্তু বাগান’টি দেখে মন ভরে যাবে... আর সব শেষে তিস্তা-রঙ্গিতের সঙ্গম, ত্রিবেণী’ও বলে জায়গাটা’কে অনেকে... দেখবেন চঞ্চল, উদ্ধত, সবুজ রঙ্গিত নদী হঠাত এক পাহাড়ের বাঁকে এসে শান্ত তিস্তার ধূসর রহস্যের মধ্যে হারিয়ে ফেলেছে নিজেকে... প্রতি’টা জায়গা চোখজুড়ানো, মনভরানো... ঘন্টার পর ঘন্টা শুধু নিস্তব্ধতা’টাকে উপভোগ করে কাটিয়ে দিতে পারবেন... মনে হবে, এ’সব জায়গায় কথা বলার প্রয়োজনই নেই কোনো... সব কথা এম্নিই বলা হয়ে যায়... সব চিন্তা আপনিই দূর হয়ে যায়... যখন সন্ধ্যেবেলা গেস্ট হাউস ফিরবেন, ততক্ষনে রবিবার দিনটা শেষ হয়ে গেছে... আর আপনার ছুটিও প্রায় শেষ...”
  



আপনি, “ইস...”

আমি, (বলেই চলেছি), “পরেরদিন সকাল’টা তাই নিজের মতন করে কাটান... গেস্ট হাউসের একজন কাউকে সাথে নিয়ে বেড়িয়ে পড়ুন ট্রেকিং’এ... অথবা পায়ে হেঁটে উঁচুনিচু পথে নিটোল ছোট্ট এই গ্রাম’টা ঘুরে নিন... পাইনে ঘেরা এক চিলতে মাঠে ক্রিকেট খেলে নিন গ্রামের ছোটদের সাথে... কিম্বা প্রিয়জনের হাত ধরে এক্সপ্লোর করে আসুন পাইনবনের আলোআঁধারির ভেতর দিয়ে হারিয়ে যাওয়া কোনো একটি আঁকাবাঁকা শুঁড়িপথ... দশ’টা নাগাদ ফিরে এসে দেখবেন গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে... ব্রেকফাস্ট রেডি... মনে হবে শুধু আপনিই তৈরী নন তিঞ্চুলে’কে ছেড়ে আসতে... বিকেলে যখন এন.জে.পি. থেকে ট্রেনে উঠবেন দেখবেন তখনও আপনার মন মনাস্ট্রির প্রেয়ার ফ্ল্যাগের পাশে, চা’বাগানের কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলে কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকে তাকিয়ে আছে...”














আপনি, “উফফ, যা বলেছ... খরচ-খরচার একটা এস্টিমেট দাও দেখি এখুনি... এত কিছু শুনে যে যাওয়ার ইচ্ছে প্রবল হয়ে উঠছে ভাই...”

আমি, “যান না, আমিও তো যেতেই বলছি... গুরুং গেস্ট হাউসের ওয়েবসাইট দিয়ে দিচ্ছি... যোগাযোগ করুন... ইচ্ছে হলে লামাহাট্টা বা বড়ামাঙ্গওয়া’তেও থাকতে পারেন... থাকার খরচা সব জায়গায় কম-বেশি একই... ১২০০-১৭০০ ঘরভাড়া, সঙ্গে সারাদিনে চারবেলার খাওয়া-দাওয়া ৫০০-৬০০ মত। বাড়তি খরচা হল গাড়ি... মনে রাখবেন জলপাইগুড়ি থেকে পিক আপ আর ড্রপের গাড়ি বুকিং’এর কথাটা হোটেল’কে বলতে ভুলবেন না... তিঞ্চুলে’তে কিন্তু ট্যুরিস্ট’এর ভিড় নেই, ফলে শেয়ারে গাড়িও নেই... স্টেশনে নেমে গাড়ি করতে গেলে ড্রাইভার’রা যা খুশি দর হাঁকতে পারে... হোটেল থেকেই গাড়ি’টার ব্যবস্থা হলে ভালো... সে খরচা’টা আমাদের পড়েছিল ১৮০০টাকা... আমি কিন্তু তিন বছর আগের কথা বলছি...

আপনি, “ওক্কে, বুঝলাম, সব মিলে মন্দ নয়, বুঝলে... দেখি কবে যাওয়া যায়... আর দরকারী কিছু বাদ পড়ছে? ভেবে বল দেখি...”

আমি, “ও হ্যাঁ, ভুলেই গেছিলাম বলতে... আপনাদের বেড়ানোর দল যদি অ্যাডভেঞ্চারাস হয়, তাহলে রাফটিং করতে পারেন তিস্তায়... ত্রিবেনী’তেই রাফটিং হয়, ভীষণ এনজয় করবেন... আর হ্যাঁ, এন.জে.পি.’র ট্রেনের টিকিট কিন্তু সময় থাকতে কেটে ফেলুন, টিকিট পাওয়া যায় না দেরী হয়ে গেল আর... ঘুরে আসুন, ভালো লাগবে... দুটো দিনের জন্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলুন না তিঞ্চুলের পাইনবনে... দেখবেন, নিজেকে খুঁজে পাবেন নতুন করে... ফিরে এসে আমাকে জানাবেন কিন্তু কেমন ঘুরলেন...


উইকএন্ডে চলুন, বড়ন্তি

By : Sayantari Ghosh


মাঝেমাঝে উইকএন্ড’গুলো ঘরে বসে থাকতে হবে ভেবে আপনার গায়ে জ্বর আসে না? আমার তো প্রায়শঃই আসে! বিশেষতঃ যদি তার সাথে একটা সোমবার পনেরই অগাস্ট পড়ে যায়, বা শুক্কুরবার’টা হয় গুড ফ্রাইডে। আমার তো ভাই তেমন হলে মাথা দপদপ, কান কটকট, হাত নিশপিশ সব একসাথে হতে থাকে। পড়াশোনা করতে বসলেই ব্যাগ গোছাতে ইচ্ছে করে, পুরোনো বেড়াতে যাওয়ার ছবিগুলো দেখলেই কান্না পায়, ইন্টারনেট খুললেই হাত চলে যায় ইন্ডিয়ান রেলওয়েজের ওয়েবসাইটের দিকে। বুকের ভেতর নানারকম প্রশ্ন খচরমচর করে, “কোথায় টিকিট আছে দেখি? কবে যাওয়া যায়? কবে ফেরা যায়? থাকবো কোথায়?” আরো কত কি!

আমি তাই যখন-তখন বেরিয়ে পড়ি পিঠে ব্যাগ নিয়ে, সঙ্গে বন্ধুবান্ধব বা বাড়ির কাউকে জুটিয়ে নিই। তো এরকমই একটা উইকএন্ডে আমরা ঘুরে এলাম বড়ন্তি। নেক্সট ছুটি’তে যদি আপনার ইচ্ছে হয়, তাই ডিটেইলগুলো ব্লগে তুলে রাখছি। যদি আপনাদের কারো কাজে লেগে যায়...

এবার আপনি বলবেন, “কেন যাবো বড়ন্তি? সেখানে আছে’টা কি?”

আমি বলব, “আপনার গ্রাম ভালো লাগে? মেঠো আলপথ, লালমাটির ধূলোওড়া রাস্তা, পরিষ্কার আকাশ, খোলা হাওয়া, অন্ধকার রাতের আকাশে একটা-দুটো করে উল্কা? তার সাথে জুড়ে নিন ছড়ানো-ছেটানো পাহাড়, টিলা, শিমুল-পলাশের জঙ্গল আর একখানা বি-শা-ল লেক। নির্জন, ছিমছাম, নির্ঝঞ্ঝাট। কলকাতার হট্টগোল থেকে দুটো দিন নিজেকে ছুটি দিতে ইচ্ছে করলে আপনার এ জায়গা ভালো লাগবে আমার মনে হয়...”

এবার আপনি, “জায়গাটা কোথায় বল তো?”

আমি, “মুরাডি চেনেন? যেখানে খুব বড় একটা চোখের হাসপাতাল আছে? চেনেন না? আমি বলে দিচ্ছি। আসানসোল চেনেন তো? বড়ন্তি আসানসোল থেকে ৪০ কিলোমিটার মোটামুটি। একটা উইকএন্ড কাটিয়ে আসার পক্ষে কলকাতা থেকে বড়ন্তির দূরত্ব’টা কিন্তু এক্কেবারে আইডিয়াল।
ধরুন, যদি কলকাতা থেকে যান তাহলে দু’ভাবে যেতে পারেন। এক, আপনি চাপতে পারেন আসানসোল যাওয়ার যে কোন ট্রেনে। আসানসোলে নেমে চেপে পড়ুন আদ্রা লাইনের যে কোনো লোকালে, চতুর্থ স্টেশন মুরাডি, আধ-ঘন্টার রাস্তা। আবার অন্য আরেকটা উপায় হল শুক্কুরবার অফিস সেরে এসে আপনি রাত্তিরে ধরে নিতে পারেন হাওড়া-চক্রধরপুর প্যাসেঞ্জার। ভোর পাঁচটায় নামবেন আদ্রা। এক কাপ চা খেয়ে আসানসোল লাইনের লোকাল ট্রেন ধরুন, এদিন থেকেও চার নম্বর স্টেশন মুরাডি। আমার মতে দ্বিতীয়’টা আপনার পক্ষে বেটার অপশন। তাতে সময় বাঁচবে। তবে যদি আসানসোল বা আদ্রা থেকে দু’দিনের জন্য একটা গাড়ি ভাড়া করে বেরিয়ে পড়তে চান, তা হলে আপনার আসানসোল হয়ে যাওয়াই ভালো, আদ্রায় অত গাড়ি পাবেন না।

আপনি, “মুরাডি, আদ্রা, জায়গাগুলোর নাম শুনিইনি আগে কখনও...”

আমি, “হেঃ হেঃ হেঃ... জয়চন্ডী পাহাড়ের নাম নিশ্চয়ই শুনেছেন? হীরক রাজার দেশের অনেকখানি শুটিং হয়েছে কিন্তু এই এলাকায়, সেই পাহাড়ে মাস্টারমশাইএর লুকিয়ে থাকার জায়গাটা মনে আছে তো? দেখবেন, দেখলেই চিনে ফেলবেন। আদ্রার দিক থেকে এলে জয়চন্ডী পাহাড় স্টেশনটাও পেরোবে, অনেকে ট্রেকিং করতে আসে এই পাহাড়ে... ট্রেন থেকেই দেখতে পাবেন...

ট্রেন থেকে নেমে দেখবেন, মুরাডি স্টেশন’টা চুপটি করে ঘুমিয়ে আছে যেন। কোন ব্যস্ততা নেই কোথাও। নেমে পড়ে একটা রিক্সা করে নিন, ধিমে তালে রিক্সা চলবে গাংপুর গ্রামের অলিগলি ধরে। গ্রাম ছাড়িয়ে মেঠো পথ ধরে আরেকটু এগোতেই দেখতে পাবেন এলোমেলো পাহাড়ি দিগন্ত রেখার গায়ে রূপোলি একটা দাগ, স্টেশন থেকে আট কিলোমিটার রাস্তা পেরিয়ে এসে যখন রিসর্টের সামনে নামবেন, দেখবেন সেই দাগটাই পাহাড়ে ঘেরা এক বিশাল লেক হয়ে গেছে। কলকাতা থেকে রাত সাড়ে দশটায় শুরু করে সকাল সাত’টা সাড়ে সাত’টার ভেতর আপনি বড়ন্তি’তে। আর একেবারে হাওড়া থেকে এই রিসর্ট অবদি যাতায়াতে সাকুল্যে আপনার ২৫০ টাকাও খরচ হবে কিনা সন্দেহ...”

আপনিঃ “ওকে, ওকে, গুড... পৌঁছে গেলাম ধরো, এবার? কদিনে প্ল্যান, কি কি ঘোরার জায়গা?”

আমিঃ “দেখুন, এ জায়গাটার মেইন অ্যাট্রাকশন কিন্তু শান্তি আর নির্জনতা। নিজের সাথে, নিজের কাছের মানুষদের সাথে দু’দন্ড রিল্যাক্স করা। দেখার জায়গা যে কিছু নেই তা না, অজস্র আছে, বড়ন্তির একদিকে বিহারিনাথ পাহাড়, একদিকে পাঞ্চেত ড্যাম, আর খুব কাছেই গড়পঞ্চকোট। তারপর ধরুন, আসানসোলের পথে একটু এগোলেই মাইথন ড্যাম, কল্যানেশ্বরী মন্দির। গাড়ি নিয়ে আসেন যদি তাহলে এ’সব বেড়াতে বেড়াতে দিব্বি দু’টো দিন কেটে যাবে। কিন্তু এ’সবের আগে বিকেলে যখন লেকের জলে হাজার শেডের হলুদ, কমলা আর লাল গুলে দিয়ে সূর্যাস্ত হবে তখন জলে পা ডুবিয়ে বসে থাকুন খানিকখন... ভোরবেলা উঠে ছোট্ট একটা ট্রেক করে আসুন সামনের দন্ডাহিত পাহাড় থেকে একজন লোকাল গাইড নিয়ে... রাত হয়ে গেলে দু’চোখ ভরে দেখে নিন আদিবাসী গ্রামের রাত্তির কি অদ্ভূত অন্ধকারে মোড়া, কি অপূর্ব সব শব্দ দিয়ে সাজানো... রিসর্টের বাগানে বা ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দেখবেন আকাশের গায়ে আঁচড় কেটে উল্কা চলে গেল... ক্যাম্পফায়ারের আগুনের ধারে বসে জমজমাট ভূতের গল্প করবেন... এ’সব কলকাতায় কোথায় হয় বলুন তো মশাই?”

আপনিঃ “হুম, বুঝলাম... মন্দ লাগছে না শুনে, বুঝলে... তা রিসর্ট বলছো... কেমন রিসর্ট? কি নাম?”

আমিঃ “আমরা ছিলাম যেটায় সেটা সবচে’ পুরোনো আর লেকের সবচে’ কাছে। নাম আকাশমণি। মোটামুটি সব মিলিয়ে ভালোর দিকেই বলবো (লোকেশন, ৫/৫, রাঁধুনির রান্নার হাত, ৫/৫, ঘরের অবস্থা, ৪/৫, বাথরুমের অবস্থা, ৩/৫, বাগানের অবস্থা, ৩/৫, এসি ঘর, বোধহয় নেই, পার্কিং’এর জায়গা, যথেষ্ট আছে, ঘরভাড়া, ৮০০-১২০০ টাকার মধ্যে, সাথে সারাদিনের খাওয়াদাওয়ার জন্য একজনের ২৫০/৩০০ টাকা)। আমার এখানে থেকে ভালোই লেগেছে, তবে ৮০০টাকার ঘরগুলোর আরেকটু মেইন্টেনেন্সের দরকার বলে মনে হয়েছে। আকাশমনি’তে থাকতে হলে ফোন করুন এই নম্বরে +918017215958, বাকি ব্যবস্থা ফোনেই হয়ে যাবে, দেখবেন। ইন ফ্যাক্ট, চারবেলায় কি কি খাবেন সে’সব ফরমায়েসি মেনু’ও আপনার কাছে ফোন করে জেনে নেবেন কেয়ারটেকার নিজে।

তবে এই হোটেল’টি ছাড়াও আরো অনেক হোটেল রিসর্ট আছে। কয়েকটা নাম বলছি, আপনি গুগল করে দেখতে পারেন, পলাশবাড়ি, লেক হিল রিসর্ট, বড়ন্তি ভিলেজ রিসর্ট... এগুলো সবই বেশ ভালো জায়গায় আর ব্যবস্থাও সুন্দর... আপনি শুধু যাওয়া ঠিক করুন আর ফোন করুন, দেখবেন থাকার জায়গা নিয়ে আপনাকে সমস্যায় পড়তে হবে না... এ’সব জায়গায় তো আর ট্যুরিস্টের ভিড় নেই...”

আপনি, “বাঃ, বেশ বেশ... আর কিছু... ফাইনাল টিপস...”

আমি, “উমমম... ওখানে গেলে লেকের মাছ অবশ্যই খাবেন, শীতে গেলে ভোরবেলা তখুনি গাছ থেকে নামানো খেজুর রস খাবেন, মাছ ধরা দেখবেন, সূর্যাস্ত কোনো মূল্যে মিস করবেন না, লোকাল ক্র্যাফট (যেমন, ছৌ নাচের মুখোশ) কিনবেন। শুধু ভালো ভালো বলছি, নেগেটিভ দিকগুলোও বলে দি... রাস্তা কিছু জায়গায় কিন্তু বেশ খারাপ থাকতে পারে... আর আমি গিয়েছিলাম জানুয়ারি’তে... অন্যান্য সিজনে যেতে হলে কেয়ারটেকারের সাথে কথা বলে নেবেন... আফটার অল, পুরুলিয়া জেলা, গরমে কিন্তু কষ্ট হতে পারে, সেটা মাথায় রাখবেন... আর কি? এবার একটা প্ল্যান করুন দেখি... দু’দিন একটু ঘুরে আসুন... যখন ফিরে আসবেন, দেখবেন বুক ভরে গেছে তাজা অক্সিজেনে আর ছুটি কাটানোর আনন্দে... সেই রসদ দিয়ে আবার দু’টো মাস অফিসের ঘানি টানা যাবে... তারপর আবার অন্য কোথাও, অন্য কোনোখানে...


ঘুরে এসে আমায় জানাবেন কিন্তু যে কেমন লাগল...”

নষ্টনীড়

By : Sayantari Ghosh


রবীন্দ্রনাথ ‘নষ্টনীড়’ লিখেছিলেন ১৯০১ সালে। সত্যজিত রায়ের ‘চারুলতা’ রিলিজ করে ১৯৬৪’র এপ্রিলে। ‘চারুলতা ২০১১’ এল ২০১১’তে,‘আমি চারুলতা’ আসতে চলেছে ২০১৩ তে। অর্থাৎ হিসেব অনুযায়ী দেখতে গেলে আমরা এক শতাব্দীকাল ধরে বার বার চারুলতার কাছে ফিরেছি। বার বার নানাভাবে আমরা চিনতে চেয়েছি সেই চারু কে ‘কাগজের আবরণ ভেদ করিয়া স্বামীকে অধিকার করা’ যার পক্ষে ‘দুরূহ’ হয়েছিল। ভূপতি,অমল আর চারু,এই তিনটি চরিত্রের হাত ধরে মনের আলো-অন্ধকার হাতড়ে হাতড়ে বেড়ানোটাকে বোধহয় ভালোবেসে ফেলেছি আমরা সকলেই। আরেকবার সেই একই অভিজ্ঞতা’কে অন্যভাবে অনুভব করতে গিয়েছিলাম স্টার থিয়েটার;‘যোজক’ সপ্তাহশেষের এক জমজমাট আসর বসিয়েছিল রবীন্দ্রনাথের জন্মসার্ধশতবর্ষ উদ্‌যাপনে। আর সেই আসরের শেষ নাটক ছিল ‘নষ্টনীড়’। অবশ্য নাটক না বলে ‘যোজক’ তাদের পরিবেশনার নাম দিয়েছিল সিনে-প্লে,সিনেম্যাটিক থিয়েটার।



গৌতম হালদার নিজে সিনেমা ও নাট্যজগতের একজন সফল পরিচালক। এবং উনি ভীষণ ভার্সেটাইল। ওনার আরেকটি সাঙ্ঘাতিক গুণ হল,প্রিয় লেখকদের প্রিয়তম কাহিনীগুলি নিয়ে নাটকের ফাটাফাটি এক্সিকিউশনে উনি অনবদ্য। নান্দীকারের সফল নাটক ‘বড়দা’(মুন্সি প্রেমচন্দ),‘চোখ-গেল’ (তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়),‘বাপ্পাদিত্য’ (অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর),‘দুলিয়া’ (লীলা মজুমদার),‘সজন বাদিয়ার ঘাট’ (জসীমুদ্দিন) এবং আরো অনেক নাটক তাঁর এই দক্ষতার জলজ্যান্ত প্রমাণ। এবার ‘যোজক’এর সাথে উনি হাত দিয়েছেন শহর কোলকাতার প্রথম সিনে-প্লে নির্মানে;প্রথম পছন্দের কাহিনীকার অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ আর কাহিনী ‘নষ্টনীড়’। খবরটা কানে যেতেই প্রাথমিক প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছিলুম। অপেক্ষা ছিল সপ্তাহান্তের,প্রস্তুত ছিলাম চমকে যাওয়ার জন্য। একটা ভিন্ন জাতের আনন্দের জন্য যেটা মেলে পুরোনো চিঠির ভেতর বছর কুড়ি পরে নতুন কোন সংকেত আবিষ্কারে।

কিন্তু নাটকের দিন সকাল থেকে সব কেমন গোলমাল হয়ে গেল। কাজ মিলল না,তার ওপরে তুমুল বর্ষণ। বৃষ্টি মাথায় করে,কাদায় সালোয়ার লেপ্টে ফেলে,আধঘন্টা স্টার থিয়েটারের দরজার লাইন দিয়ে ঢুকতে পেলুম। চেনাশোনা নামের আনাগোনা চারদিকে,গৌতম হালদার,দুলাল লাহিরী,রীতাভরী,শুভ্রজিত... তবু কেন জানি না,কাজের চাপেই হয়তঃ,মনে মনে বেশ ভারাক্রান্ত লাগছিল। মনে হচ্ছিল,সারাদিনের মত নাটকটাও ঝুলিয়ে দেবে নিশ্চয়ই। মুঠোফোনগুলি’কে নীরবতায় স্থান দেওয়ার হাল্কা কিছু পরিচিত অনুরোধ যখন চলছে,তখনও আমি নিজের আসনে একটু যেন অস্বস্তিতে। কিন্তু তারপর... তারপর যেন ডুবে গেলাম একটা যাদুমন্তরের ভেতরে। হুঁশ ফিরলো সমবেত হাততালির শব্দে। দু’ঘন্টা কোথা দিয়ে যেন পেরিয়ে গেছে। মনের ভেতর তখন শুধুই উথাল-পাথাল করছে হাজার’টা সংলাপ,হাজার’টা অনুভব।

‘নষ্টনীড়’এর কাহিনী নিয়ে তো আর নতুন করে কিছু বলার নেই। কাহিনী আমাদের চারু’র,যার অযথা-কাজে-আটকে-থাকা স্বামীর সময় হয় না তার দিকে তাকানোর। কেউ সে কথা মনে করিয়ে দিলেও তিনি চারুর সঙ্গী হিসেবে এনে দেন ‘শ্যালকজায়া মন্দাকিনীকে’। এ এক এমন গৃহস্থালীর গল্প যেখানে বিবাহিত জীবনের প্রাথমিক উচ্ছ্বলতাটাই নেই,যেখানে চারুলতা আর ভূপতি ‘নূতনত্বের স্বাদ না পাইয়াই উভয়ে উভয়ের কাছে পুরাতন পরিচিত অভ্যস্ত হইয়া গেল’। নিতান্ত একাকীত্বে,ঔদাসীন্যে স্থির হয়ে থাকা চারুর জীবনে একমাত্র নতুনত্ব যদি কিছু থেকে থাকে,তবে তা হল  ভূপতির পিসতুতো ভাই অমলের দৌরাত্ম,তার আবদার,তার নিত্যনতুন চাই-চাই। চারু’র সমস্যা ছিল এই যে ‘তাহার কাছে কেহ কিছু চায় না,অমল চায়-- সংসারে সেই একমাত্র প্রার্থীর রক্ষা না করিয়া সে থাকিতে পারে না।... প্রত্যেক বারেই চারুলতা আপত্তি প্রকাশ করিয়া কলহ করে এবং প্রত্যেক বারেই বহু যত্নে ও স্নেহে শৌখিন অমলের শখ মিটাইয়া দেয়...’ শুধু তাই নয়,চারুর পড়াশোনার সখ,তার বাগান করার গল্প,অমলের কাব্য নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা,তার পান থেকে শুরু করে কার্পেটের জুতোর আবদার... সব মিলিয়ে এই সম্পর্কে লাগে এক খুব কাছের,বড় নিজের বন্ধুতার রঙ। কিন্তু অমল তো চারুর জীবনের চিরস্থায়ী সত্য নয়,সেই সত্যের নাম ভূপতি। সম্পর্কের এই দোলাচলের নাম’ই ‘নষ্টনীড়’।

কিন্তু এখানেই কি শেষ?তা নয়। সত্যজিত রায়ের চারুলতা আর রবীন্দ্রনাথের নষ্টনীড়ের একটা বড় তফাত শেষ দৃশ্যে। অমলের চলে যাওয়ায় চারুলতার ভেঙে পড়াতেই কিন্তু রবীন্দ্রনাথ গল্পটাকে শেষ করে দেন নি। শেষ পর্যায়ে ভূপতির স্বগতোক্তি’তে বুঝতে পারি,এ কাহিনীর সারমর্ম শুধু ত্রিকোণ-প্রেম আর একাকীত্বেই শেষ হয়ে যায় না। দেখতে পাই,চারু অমল কে ভালোবাসে বুঝতে পেরে ভূপতি খুব সহজে ভাবতে পারে,‘আমার কথা সে একবার ভাবিয়া দেখিল না?... নির্জন বন্ধুহীন প্রবাসে প্রত্যহ তাহাকে সঙ্গদান করিতে হইবে?সমস্ত দিন পরিশ্রম করিয়া সন্ধ্যায় যখন ঘরে ফিরিব তখন নিস্তব্ধ শোকপরায়ণা নারীকে লইয়া সেই সন্ধ্যা কী ভয়ানক হইয়া উঠিবে। ... যে আশ্রয় চূর্ণ হইয়া ভাঙিয়া গেছে তাহার ভাঙা ইঁটকাঠগুলা ফেলিয়া যাইতে পারিব না,কাঁধে করিয়া বহিয়া বেড়াইতে হইবে?’ চারু অমল কে ভালোবাসে বলে ভূপতি খুব সহজে বলতে পারে,তোমাকে সঙ্গে নিয়ে চলা?‘না,সে আমি পারিব না...’
এ তো খুব সহজ স্বাভাবিক বক্তব্য স্বামীর ক্ষেত্রে,তাই না?বিবাহিতা স্ত্রী পরপুরুষে সমর্পিত-প্রাণ বোঝার পরে এই মনোভাবই তো হওয়া উচিত পতিদেবের...! আজকের দিনেও অজস্র মানুষ ভূপতির সঙ্গে একমত হয়ে যাবেন। এর প্রতিবাদ করতে গেলে ফেমিনিস্ট আখ্যা জুটতে বাধ্য। কিন্তু একশ বছরেরও বেশি আগে রবীন্দ্রনাথের চারুলতা ভূপতির দয়াপরবশতা কে প্রত্যাখ্যান করেছে,দৃঢ়কন্ঠে বলেছে,‘না থাক্...!’ এই একবিংশ শতকেও ক’জন সহধর্মিনী চারুলতার মত বলতে পারে,‘না থাক্’...?

রবীন্দ্রনাথের চারুলতার এই কাহিনীকে জীবন্ত হতে দেখলাম সেদিন স্টারে। গৌতমবাবু গল্পের আধুনিকীকরনের বিন্দুমাত্র চেষ্টা করেন নি। নাটকের সময় তাই ১৮৭০-৮০ তেই বাঁধা। কিন্তু শতাব্দীপ্রাচীন গল্পে এই শতকের রঙ লাগিয়েছে টেকনোলজি। আগে শুটিং হয়ে যাওয়া প্রি-এডিটেড কিছু দৃশ্য অসাধারণ আলো-শব্দের কারসাজিতে একাত্ম হয়ে গেছে স্টেজের লাইভ পারফর্মান্সের সাথে। চারুর জানলার বাইরে উন্মত্ত ঝড়,ছাদ থেকে চারুর ছুটতে ছুটতে ঘরে ফিরে আসা,জানলা দিয়ে দ্যাখা বাগানের দৃশ্য আর আয়নায় টিপ পরতে পরতে ‘বৌঠান’ ডাকের সাড়া দেওয়ার দৃশ্যগুলি রোমাঞ্চকর লাগে রীতিমত। Computer-Generated Imagery,যেটা মূলতঃ ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির ব্যবহার্য,তার তুলনাহীন ব্যবহারে তাক লেগে যায়। একাঙ্ক থিয়েটারের সীমা’কে ছাড়িয়ে স্ক্রিন আর সিনক্রোনাইজেশনের দূর্দান্ত নমুনা রেখে ‘যোজক’এর শিল্পীরা কার্যতঃ অবাক করে দেন দর্শককে। আর উপরি-পাওনা হিসেবে জুটে যায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কন্ঠের ভাষ্যপাঠ!
আগেই বলছিলাম,আমি যখন স্টার থেকে বেরোলাম সে দিন,মনের ভেতর সংলাপের ভিড়,অনুভবের আনাগোনা। একশ রকম যেন একসাথে খেলা করছে বুকের ভেতরে,কিন্তু তবু তার মধ্যে হলে ঢোকার আগের সেই মন-ভার’টা যেন কোথায় হারিয়ে গেছে দেখলাম। তখন স্বপ্নের মত কতকিছু মনে হতে লাগল,মনে হল বাসা বাঁধতে গেলে যে খড়কুটোগুলো লাগে সেগুলোর নাম ভালোবাসা-ভালোবাসা... সেগুলোর রঙ নীল,সবুজ,গোলাপী,আকাশি,কমলা... এই যে ছুটছি,রোজ হাঁপাতে হাঁপাতে ডেলিরুটিনের কাজগুলো সামলে ফেলছি রোজ,যদি এক মূহুর্ত সময় দি নিজেকে ভাবার এ সবের মাঝে,‘আমি সেই রঙগুলো হারিয়ে ফেলিনি তো...?’ যদি ওটুকু সময় নষ্টই করি,খুব কি ক্ষতি হয়ে যাবে?

দেরি হয়ে গেছিল একটু। সাড়ে ন’টার সময় যখন হাতিবাগানের মোড়ে হাত দেখিয়ে বাস’টাকে দাঁড় করিয়ে উঠে পড়লাম,তখন একটা কথাই মনে হয়ে গায়ে কাঁটা দিল হঠাৎ,‘ভদ্রলোক আজও কি সাঙ্ঘাতিক ভাবে রেলেভেন্ট... উফফ...’

ফান টু সি

By : Sayantari Ghosh



আজ আতস কাচটাকে তাক থেকে পাড়ার আগে আসুন ভাবা যাক কয়েকজনের কথা;তাদের আমরা দৈনন্দিনে দেখি বটে, কিন্তু খুব যে একটা খেয়াল করি, খুব যে একটা ভাবতে বসি তাদের কথা, খুব যে কিছু করতে চাই তাদের জন্যে, তা নয়।ঘটনাচক্রে, আজ যাদের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছি, তারা সকলেই নারী, প্রত্যেকেই বিবাহিতা, তবে না, আপনি যা ভাবছেন তা নয়, তারা শ্বশুরবাড়িতে লাঞ্ছিতা নন, কেউ তাদের গায়ে হাত তোলে নি, কেউ তাদের খাদ্য-বস্ত্রের সংস্থান নিয়ে অভিযোগ করার সুযোগ দেন নি, মা-বাবা পণ দিতে পারেনি বলে কেউ তাদের গায়ে আগুন দিতে আসে নি বা পরপর তিনবার কন্যাসন্তানের জন্ম দেওয়ার অপরাধে তারা অপরাধীও নন।অর্থাৎ সেদিক দিয়ে ভাবতে গেলে তারা নিগৃহিতা বা অত্যাচারিতা নন, এমন একটা ধারণাই আপনি-আমি পোষণ করে থাকি।আসুন, একবার দেখি তারা কেমন আছেন?

১   প্রথমে কল্পনা করুন এমন একটা ছবি, যেখানে রয়েছেন এক পঞ্চাশোর্ধ দম্পতি।স্ত্রী তার স্বামীর হাতে তুলে দিচ্ছেন নিজের সাধের গয়নার বাক্সখানা আর স্বামীও গদগদ আপ্লুত মুখে বলছেন, “দাও, দাও, এ’সব আর তোমায় তেমন মানায়ও না...” মজার ব্যাপার হল, যে আপনার সাধারণ ভাবে মনে হবে,গয়নার বাক্স স্বামীর কোনো জরুরী দরকারে কোথাও বন্ধক রাখার কাজে দিচ্ছেন হয়তঃ ভদ্রমহিলা, কিন্তু সে রকম কিছু মোটেও না, উনি ওগুলো দিচ্ছেন স্বামীর বছর পঁচিশেকের নতুন প্রেমিকার জন্যে...!......কেন বলুন তো?......শুধু এই আশায় যে যদি এই সুযোগে, তাঁর এতবড় স্বার্থত্যাগের নজির দেখে স্বামী তাকে একটুখানি ভালো আবার করে বেসে ফেলেন কোনো ফাঁকে......কোনোভাবে যদি...

২  এবার, ভাবুন এ’রকম একটা দৃশ্য, যেখানে স্বামী যখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান কাজে, তখন সারাদিনের জন্য একটা হিংস্র, মানুষখেকো পাখি’কে রেখে যান সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী এর পাহারায়...!‘ভালোবাসি, তাই সুরক্ষা দিতে চাই’ এই হয় এই দৈনন্দিন পাহারার অজুহাত।পাখিটা মাথার ওপর গন্ডি কাটে, হাড়-হিম-করা চিতকার করে ডাকে আর গন্ডির বাইরে পা বাড়ালেই মাংস খুবলে খেতে চায়......স্বামী কিন্তু তখনও বলেন, ‘ভালোবাসি, তাই সুরক্ষা দিতে চাই’...

৩  তৃতীয় দৃশ্যে চলে আসি, আসুন।ছবিটায় আছেন এক আধুনিকা অর্ধাঙ্গিনী।সে স্বাধীনচেতা, শিক্ষিতা, বুদ্ধিমতী, স্বাবলম্বী।যেহেতু সে কথায় কথায় স্বামীর পায়ে লুটিয়ে পড়তে পারে না, যেহেতু সে পায়ের কাছে কাদা হয়ে পড়ে থাকতে শেখে নি, তাই বিয়ের কিছুদিনের মধ্যেই তার এই কোমলতাহীন সৌন্দর্য্য স্বামীকে টানে না আর।যুদ্ধে তছনছ হয়ে যাওয়া দেশ ছেড়ে আত্মরক্ষার আশ্রয় খুঁজে নিয়ে বেরিয়ে পড়ার সময় স্বামীর মনেই থাকে না মেয়েটির কথা!তিনি ভুলেই গেছেন তখন সাগ্নিক সপ্তপদীর শপথগুলো।মেয়েটি বেপরোয়া হয়ে পড়ে।কখনও অস্ত্র হাতে তুলে দুনিয়ার কাছে প্রমাণ করতে চায় নিজের যোগ্যতা, কখনো বা অযোগ্য কারো সাথে প্রেমের ভনিতায় প্রমাণ করতে চায় স্বামীর কাছে যে তার প্রেমে এখনও কেউ পড়তে পারে...এ কি খালি স্বামীর কাছে প্রমাণ করার চেষ্টা?জগত সংসারের কাছে প্রমাণ করার বাসনা?না কি নিজের কাছেও......

৪  শেষ দৃশ্য।ভয়ানক দৃশ্য।ভাবুন, জাস্ট ভাবার চেষ্টা করুন একটি এমন মেয়ের কথা, যার স্বামী ঘুমিয়ে আছে...!জীবিত, শ্বাস প্রশ্বাস চলছে, জেগে ওঠে এক বছরে একবার...উঠে স্বামীসুলভ সব অধিকার সব জোরজুলুম একবার ফলিয়ে নেয় স্ত্রী’র ওপরে।একদিন জেগে থাকে।একটা দিন।তারপর আবার কালঘুম...এক বছর আবার সব চুপচাপ.........

চরিত্রগুলোকে চিনতে পারলেন?চেনা-চেনা লাগলো, ভালোবাসার নামে, ‘বিবাহ’ নামক প্রহসনের নামে, ‘পতি পরম গুরু’ স্লোগানের আস্ফালনে অন্ধকুঠুরিতে বন্দিনী এই মেয়েগুলোকে?কি বললেন?আমাদের আশেপাশেই দেখেছেন মনে হল?ঠিক বলেছেন!তবে কি জানেন, আমার সাথে এদের দ্যাখা হল অন্যভাবে।

দেখতে গেছিলাম ‘সুন্দরম’এর নাটক ‘আশ্চৌর্য ফান্টুসি’।আর ওই দু’ঘন্টায় খুচরো হাসির ফাঁকতালে ভীষণ ভাবে খেয়াল করতে বাধ্য হলাম যে, মহাকাব্যের আড়ালে, যাকে বলে টাইম ইম্মেমোরিয়াল, সেই তবে থেকে ওরা ছিল আমাদের পাশেই।আমরাই কে জানে কি করে এতদিন খেয়াল করি নি।রাবণের স্ত্রী মন্দোদরী, মহাকাব্যের নায়িকা সীতা, বিভীষণের স্ত্রী সরমা আর কুম্ভকর্ণের স্ত্রী বজ্রমালা।ওরা ছিল।আমরা দেখি নি।আর তাইই হয়তঃ ওরা আজো রয়ে গেছে।

তবে এখানেই থামেন নি নাট্যকার।ওদের এই ভালো-থাকার সমস্যার একটা বিহীত করতে টেনে এনেছেন হনুমতী’কে!আজ্ঞে না, একে পাবেন না মহাকাব্যে।কিন্তু সেদিনের নাটকের বক্তদ্যটাই ছিল এ’রকম।যদি ধরুন, হনুমানের বদলে কোনো এক হনুমতী যেত সীতার কাছে রামের অঙ্গুরীয় নিয়ে?তা’হলে?তা’হলে কি রামায়ন লেখা হত একই ভাবে?

এই বদলটুকুর কারণে নাটকের নাম, ‘আশ্চৌর্য ফান্টুসি’।ভেঙে ভাবতে গেলে দাঁড়ায় আশ্চর্য চৌর্য আর ফান্টুসির সন্ধি-বিচ্ছেদে ফান-টু-সি।অর্থাৎ কি না যে অবাক করা চৌর্যবৃত্তি দেখতে ভারী মজা।বাল্মীকি রামায়নের গল্পের এমন সার্থক চৌর্যবৃত্তিকে স্বাগত!দু-ঘন্টার জমজমাট গানে গানে ভরা চিত্রনাট্য।‘ও আকাশ’, ‘আমি কবে হবো আমার’ এই গানগুলো নাটক শেষ হওয়ার অনেক পর পর্যন্ত কানে লেগে থাকে।নাটকটির চিত্রায়ণ গ্রামবাংলার পালাগানের সাথে মিল রেখে।এই বাঙালিয়ানা আর folk-মেজাজ আপাদমস্তক দূর্ধর্ষ।জয় সেনের পাপেট আর আলোর কাজ অনবদ্য।গানের সুর করেছেন ভূমি’র সৌমিত্র রায়।আর গানের কথা স্বয়ং নাট্যকার-কাম-নির্দেশকের।

সেদিন আকাদেমি থেকে মন ভর্তি করে রঙীন বুদবুদ সামলে আনতে আনতে তুলট কাগজের ধূলোটে মহাকাব্যটিকে নতুন করে চিনলাম যেন।সত্যি করে ভাবতে গেলে, হনুমানের পক্ষে খেয়াল করা সত্যিই মুশকিল যে আপাতসুখী সোনার লঙ্কা জুড়ে এতগুলো মেয়ে মোটেই ভালো নেই।খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থানের অভাব না থাকলেও তাদের জীবনে কতগুলো অতি প্রয়োজনীয় জিনিসের হাহাকার চলছে।যেমন, যথাযোগ্য সম্মান, খানিকটা মর্যাদা, একটুখানি ভালোবাসা।এই সত্য আবিষ্কারের জন্য একটি হনুমতীরই প্রয়োজন।যে কোনো বাধা মানে না।পাহাড়ী ঝর্ণার মত যে মুক্ত।যে কারো দাসী হতে শেখে নি।যা ঠিক বলে বোঝে, তাই করে।এমন একটি লক্ষ্মীছাড়া, বিশ্ববখাটে, অবাধ্য মেয়েই পারে ওদের’কে নিয়ে নতুন দেশের দিকে নাও ভাসাতে।

মনোজ মিত্র যে কেন বাংলা নাটকের লেজেন্ড, তা এতদিনে হাড়ে হাড়ে টের পেলাম।


- Copyright © পাঁচমিশেলি - - Powered by Blogger - Designed by সায়ংতরী -