Showing posts with label সত্যিকারের গল্প. Show all posts
দ্য আনসিঙ্কেবল / দুই
By : Sayantari Ghoshটাইটানিকের গল্পটা তো সক্কলের জানা। অনেকে হয়ত এটাও জানেন যে টাইটানিক'রা আসলে তিন বোন। অলিম্পিক,টাইটানিক আর ব্রিটানিক ছিল হোয়াইট ষ্টার লাইনের গর্বের তিন কন্যা;সিস্টার শিপ'স। সে সময়কার প্রযুক্তি, বিজ্ঞান আর শিল্পের সেরাটুকু দিয়ে জাহাজ তিনটিকে বানিয়েছিল হোয়াইট ষ্টার লাইন। ঘটনাচক্রে এমনি দাঁড়ায় যে দূর্ঘটনা প্রথম থেকে শেষ অব্দি পিছু ছাড়েনি এই তিন বোনের।
১৯১১'র জুন মাসে প্রথম জলে নামে অলিম্পিক। ৮০০ ফিটের চেয়েও বেশি দৈর্ঘ্যের প্রথম জাহাজ।সে বছরের'ই সেপ্টেম্বর মাসে সাউদাম্পটনে ধাক্কা খায় এইচ.এম.এস. হক জাহাজের সাথে। সাঙ্ঘাতিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দুটি জাহাজই,তবে প্রাণে বেঁচে যান দুই জাহাজের সকল যাত্রীই;খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ক্ষতবিক্ষত দেহে বন্দরে নোঙর করে বিশালবপু অলিম্পিক।
পাক্কা দু'মাস লেগেছিল অলিম্পিকের সেরে উঠে আবার জলে নামতে। সেই ধাক্কা সামলে নিতে টাইটানিকের প্রথম যাত্রা এক মাস পিছিয়ে দেয় হোয়াইট ষ্টার লাইন। মার্চ ২০'র বদলে টাইটানিক সাউদাম্পটন বন্দর ছাড়লো এপ্রিল ১০,১৯১২;কে বলতে পারে, এক মাস আগে হলে হয়তঃ নিউ ইয়র্কে নোঙর'ও করত টাইটানিক? পাঁচ দিন পর এপ্রিল ১৫'তে আইসবার্গের ধাক্কায় ১৫০০ টি প্রাণ সঙ্গে করে আতলান্তিকের তলিয়ে যায় টাইটানিক।
আসলে ব্রিটানিকের নাম হওয়ার কথা ছিল জাইগান্টিক। আকারে,আয়তনে সে ছিল বড় দুই বোনের বাড়া।কিন্তু টাইটানিকের মর্মান্তিক দূর্ঘটনায় হোয়াইট ষ্টার লাইন আর ওই দূর্ধর্ষ নামের দুঃসাহস দ্যাখাতে পারেনি। এম্নিতেও ততদিনে আকাশে উঁকি দিয়েছে বিশ্বযুদ্ধের মেঘ,অনেক স্লথ হয়ে গেছে জাইগান্টিকের জলে নামার প্রস্তুতি। সেপ্টেম্বর ১৯১৪'র বদলে ডিসেম্বর ১৯১৫ তে প্রথম যাত্রায় পাড়ি দিল সে,ততদিনে ব্রিটিশ জলবাহিনী অধিগ্রহন করে নিয়েছে তাকে,তার কাজ হয়েছে জলযুদ্ধে আহত সৈনিকদের সেবা,নাম বদলে হয়ে গেছে এইচ.এম.এইচ.এস. ব্রিটানিক, হিস ম্যাজেস্টিস হস্পিটাল শিপ ।
প্রায় ১৫০০০ আহত যোদ্ধা'কে ঘরে পৌঁছেছিল ব্রিটানিক মাত্র পাঁচটি সমুদ্রযাত্রায়। ষষ্ঠ বার আর ঘরে ফেরে নি সে। নভেম্বর ২১,১৯১৬'র সকালে একটি মাইন'এর সাথে হঠাৎ ধাক্কা খেয়ে মাত্র ৫৫ মিনিটের মধ্যে তলিয়ে যায় বিশাল ব্রিটানিক। সেদিন আরোহীদের মধ্যে কোন আহত বা অসুস্থ কেউ ছিলেন না। ১১০০ জনের ভেতর ৩০ জন প্রাণ হারান, আর সঙ্গে হারিয়ে যায় অলিম্পিক-পরিবারের শেষ সদস্য'টি।
এই গল্পের সাথে একজনের কথা না বললে অনুচিত কাজ করা হয়। ভায়োলেট জেসপ। ইনি হোয়াইট ষ্টার লাইনে কর্মরতা ছিলেন জাহাজের পরিচারিকা হিসেবে। কাকতালীয় হলেও সত্যি কথা যে অলিম্পিক, টাইটানিক আর ব্রিটানিকের দূর্ভাগ্যের দিনগুলিতে জেসপ জাহাজে ছিলেন। আজ্ঞে হ্যাঁ, তিনটি দূর্ঘটনার'ই তিনি প্রত্যক্ষ সাক্ষী! এবং প্রতিবার'ই চূড়ান্ত ক্ষয়ক্ষতি,অব্যবস্থা আর প্রাণহানির মধ্যেও তিনি দিব্বি বেঁচে ঘরে ফিরে আসেন! হয়তঃ সমুদ্রের লোনা জলে ফুসফুস ভরে ফেলে পৃথিবী ছেড়ে যাওয়া কপালে ছিল না জেসপের,দীর্ঘ সুস্থ জীবন লেখা হয়েছিল বিধাতার দপ্তরে তার জন্যে। কথায় বলে না, রাখে হরি মারে কে?
হরির রক্ষা করার প্রসঙ্গ উঠলো যখন,তখন আরেকটা অদ্ভূত গল্প বলে আজকের মত শেষ করি।
ওয়েলসের কাছে প্রায় ২৫ কিলোমিটার লম্বা একটি জোয়ার জলের নদীখাতের স্থানীয় নাম দ্য মেনাই স্ট্রেইট।ডিসেম্বর ৫, ১৬৬৪, মেনাই স্ট্রেইটে একটি জাহাজডুবি হয়। মারা যান একজন আরোহী বাদে বাকি ৮১ জন মানুষ। আবার একই তারিখ। ডিসেম্বর ৫, সাল ১৭৮৫; মেনাই স্ট্রেইটে ডুবে যায় আরো একটি যাত্রীবাহী জাহাজ।ষাটজন মারা যান, জীবিত উদ্ধার করা যায় আবারও মাত্র একজন'কে। ডিসেম্বর ৫, ১৮২০, একই জায়গায় আরো একটি জাহাজ দূর্ঘটনা। মৃতের সংখ্যা এবার ২৫, অদ্ভূত ভাবে এবারেও প্রাণে বেঁচে যান একজন মাত্র যাত্রী।
স্থান আর কালের তথ্যটুকু তো দিলাম,পাত্র বিষয়ক সেরা তথ্য'টা এবার বলি।
যারা বেঁচে যান,ঘটনাচক্রে তাঁদের প্রত্যেকের নাম ছিল হিউ উইলিয়মস!
অবাক কান্ড না? টাইটানিক'কে আনসিঙ্কেবল বলে দাবী করেছিল হোয়াইট ষ্টার লাইন; এই গল্প তবে কি দাবী করবে? হিউ উইলিয়মস... দ্য আনসিঙ্কেবল...?
Tag :
সত্যিকারের গল্প,
দ্য আনসিঙ্কেব্ল্ / এক
By : Sayantari Ghoshআজকে একটা অন্যরকম গপ্পো শোনাই তবে...
বিলিতি গপ্পো... তবে গল্প হলেও খাঁটি সত্যি... হাতেনাতে প্রমাণ আছে...
গল্প মানে আসলে এক সাহেবের কথা। আর একটা জাহাজের... খোলসা করেই বলি বরং...
সাহেবের নাম মরগ্যান রবার্টসন। আমেরিকার মানুষ।
সমুদ্র ভালোবাসতেন তখন থেকে যখন তাঁর বয়স আট কি দশ...! ক্যাবিনবয়ের চাকরি নিয়ে কোন ছোট্টবেলায় জাহাজে উঠে পরা আর দীর্ঘদিন ধরে ভেসে চলা...এই নিয়েই কাটিয়েছিলেন প্রায় সারাটা জীবন... দেখতে দেখতে ক্যাবিনবয় জাহাজের ক্যাপ্টেন হয়ে গেল অভিজ্ঞতার জোরে...শেষকালে, ১৮৭৭ সালে, সমুদ্র আলতো হাতে ক্লান্তি এঁকে দিল তাঁর চোখে... কূল টানলো... ফিরে এলেন দেশে...
পাঁচমেশালি কাজে আরো কিছুদিন কাটলো... কিন্তু চোখ বন্ধ করলেই দেখতেন মন জুড়ে আছে সমুদ্র, শ্বাসজুড়ে নোনা হাওয়া আর বুক ভর্তি হাজার একটা গল্প ওই নীল জলের রহস্য ছোঁয়ানো...
মরগ্যান সাহেব কলম ধরলেন। সাল'টা ১৮৯৮। গল্প লিখলেন... বেশ বড় গল্প...
একটা জাহাজের গল্প... নাম 'টাইটান'; সে তো জাহাজ নয়, ভাসমান শহর যেন...! লোকে বলত অত বড় জাহাজ ডুবতে পারে না...৮০০ ফুট লম্বা, পঁচাত্তর হাজার টন তার ওজন... সে সময়কার প্রযুক্তিবিদ্যার বিস্ময়কন্যা...!
সমুদ্রে ভাসল টাইটান... রুমাল উড়িয়ে বিদায় জানাল ৩০০০ যাত্রীর আত্মীয়-পরিজন...যাত্রীরাও যে সে লোক নয়...! রাজসিক ওই জাহাজে যাওয়ার খরচ-খরচা কম নাকি...? জাহাজে যারা ছিলেন সবাই ইউরোপ আর আমেরিকার অতি উচ্চবিত্ত...!
তখন এপ্রিল মাস। রাতের অন্ধকার বেশ গাঢ় হয়ে এসেছে তখন। আনন্দে উল্লাসে, হাসির লহরায় আতলান্তিকের জল আর আকাশ ধুইয়ে তরতর করে ছুটে চলেছে টাইটান... ক্যাপ্টেন দেখেনিলেন, আকাশে আলতো কুয়াশা, জাহাজের গতিবেগ ২৫ নট/ঘন্টা। যাত্রীরা অত হুঁশে নেই অবশ্য তখন... অনেকেই নেশায় একটু বেসামাল...
জায়গাটা টেরানোভার থেকে চারশো মাইল মত দূরে...
হঠাত্ খুব জোরে কেঁপে উঠল গোটা জাহাজ... আর সঙ্গে একটা প্রচন্ড শব্দ... অনেকেই ছুটে বেরিয়ে এলেন জাহাজের ডেকে...
একটা শব্দ মুখে মুখে প্রতিধ্বনির মত ঘুরে ঘুরে বেড়াল কিছুক্ষণ... আইসবার্গ...!!
তারপর কিছু টুকরো আর্তনাদ, বেপরোয়া চেষ্টা, আর যুদ্ধ... বাঁচার...!!!
টাইটান কূলে ভেড়েনি আর কখনও... ৩০০০ যাত্রীর জাহাজে লাইফবোট ছিল মাত্র ২৪টা... তাও বিপর্যয়ের সময় কাজে লাগানো যায় নি সেভাবে...
১৩জন বেঁচেছিল...
সমুদ্র গিলে খেয়েছিল বাকি সমস্তক'টা প্রাণ আর 'দ্য আনসিঙ্কেব্ল্' টাইটানকে...!!

................................................
মরগ্যান সাহেব লেখাটির নাম দেন 'দ্য রেক অফ দ্য টাইটান'...
পড়া হল তো...?গল্পটা কি কোনোভাবে চেনা চেনা লাগে...? নাম... জায়গা... পরিস্থিতি... সংখ্যা... সব...?
হ্যাঁ... আমাদের চেনা লাগা'টা স্বাভাবিক... 'টাইটানিক' আমাদের কাছে ইতিহাসের মত... বহুপঠিত...
আর সিনেমাটি তো চোখে এঁকে দিয়ে গেছে টাইটানিকের আটলান্টিকে তলিয়ে যাবার দৃশ্য...!
তাই এ গল্প'টা আমরা জানি... ঘটা করে এ গল্প লিখে ছাপাতে গেলে কোন প্রকাশকই রাজী হবেন না...
মরগ্যান সাহেবের গল্পটিও সেভাবে কেউ ছাপেনি...!
তবে কারণ'টা অন্য ছিল।
প্রকাশক'রা বলেছিলেন, এ'সব সমুদ্রনাবিকের কষ্টকল্পনা...! ও রকম জাহাজ তৈরী হতেই পারেনা; আর তৈরী হলেও ডুবে যেতে...?? কিছুতে কিছুতে পারেনা...!!
.................................................
মরগ্যান রবার্টসন এ গল্প লিখেছিলেন ১৮৯৮-এ...
১৯১২র চোদ্দ'ই এপ্রিল টাইটানিক আতলান্টিকে তলিয়ে যাবার চোদ্দ বছর আগে...!
Tag :
সত্যিকারের গল্প,
নীলচে সবুজ রহস্য
By : Sayantari Ghoshবারোই জুলাই, ২০১২ নীল-রঙা নেপচুন এক বছরের হল। অবিশ্যি আমরা তাকে চেনার পর থেকে হিসেব করা হলে... এমনি করে আমরা মানুষের বয়েস হিসেব করি না যদিও, তবে গ্রহ নক্ষত্রদের ক্ষেত্রে এটাই নিয়ম। আর সত্যি বলতে কি এছাড়া আর উপায়ও নেই! তাদের বয়েসের মাপকাঠি আমাদের থেকে অনেএএক বড়সড় কিনা? এই নেপচুনের কথাই ধর,পৃথিবী’তে প্রায় এক’শ পঁয়ষট্টি বছর পার হলে নেপচুনের বয়েস বাড়ে মাত্র এক বছর! ঠিকমত দিন হিসেব করলে তারিখ’টা দাঁড়ায় তেইশে সেপ্টেম্বর,১৮৪৬,যেদিন আমাদের কাছে নেপচুন জন্মালো। আর বললে বিশ্বাস করবে কি না জানি না,এক ঘন্টাও লাগেনি সেদিন নেপচুন’কে খুঁজে বার করতে! অথচ তার পঁয়ষট্টি বছর আগে, ১৭৮১ থেকে গোল বেঁধেছে, নেপচুন লুকোচুরি খেলছে সেই তবে থেকে, কিন্তু আশ্চর্য! কেউ খুঁজেই পায় নি! আসলে একেই বলে কলমের খোঁচা! আবার অঙ্কের ভেল্কিও বলতে পারো! (যারা অঙ্ক’কে দু’চক্ষে দেখতে পারো না,এই বলে দিচ্ছি,শুনে নাও... অঙ্ক না থাকলে একটা আস্ত গ্রহ থেকেও না-থাকা হয়ে থাকতো চিরকাল... হু হু,বাবা,নিন্দে-মন্দ করলেই হবে?)।
নাহ, বড্ড ছড়িয়ে যাচ্ছে! বরং পেতে বলি গল্প’টা...
১৭৮১ সালে এক বসন্তের সন্ধ্যেয় নিজের টেলিস্কোপ বাগিয়ে আকাশ দেখতে দেখতে উইলিয়ম হারশেল যবে থেকে ইউরেনাস’কে দেখেছেন, তার কিছুদিন পর থেকেই গল্পের শুরু। সৌরজগতের সপ্তম গ্রহটি আবিষ্কৃত হতেই দ্যাখা গেল আরো কিছু রহস্য যেন তার সাথেই দানা বেঁধে আছে। ইউরেনাসের যে পথে সূর্যের চারপাশে ঘোরার কথা, যত সময় লাগার কথা তার কোন অঙ্ক’ই সে পুরোপুরি মানে না! কোথাও ছোটে তাড়াতাড়ি, কোথাও বা ভীষণ ধীরে ধীরে। যেন কেউ তাকে ঠেলছে কখনও, কখনও বা টানছে পিছনদিকে... কে সে? অদেখা শক্তির উত্স খুঁজে চিরুনীতল্লাসী চলল, কিন্তু ওভাবে কি খোঁজ মেলে? অগনতি নক্ষত্রের আলো ঝিকিয়ে উঠলেই সব হিসেব গুলিয়ে যায় বারবার!
১৮২১ সালে একটা মস্ত বড় অঙ্ক কষা হল;কাগজে হিসেব করে লিখে ফ্যালা হল আগামী বছরগুলোতে কখন কোথায় থাকা ‘উচিত’ ইউরেনাসের। শুরু হল মিলিয়ে দ্যাখা, খুঁটিয়ে দেখতে চোখ পেতে বসে রইলেন বিজ্ঞানীরা; দ্যাখা গেল,হিসেবে কোনো ভুল নেই,কিন্তু ইউরেনাস মোটেই উচিত অনুচিতের হিসেবের ধার ধারছে না।
আবিষ্কারের গল্প হবে,আর সেই গল্পের একজন বুদ্ধিমান অঙ্ক-কষতে-ভালোবাসা নায়ক থাকবে না, তা কি হয়?
সে ছেলের নাম জন আডামস। ইংলন্ডের কর্ণোয়ালের কাছে একটা খুব ছোট গ্রাম লানেইস্টের এক চাষীর ছেলে সে। জমি আছে বাবার সামান্য, তাতে চাষ-বাস হয় অল্প করে, বাপ মা সাত ভাইবোনের সংসার তাতে টেনেটুনে চলে যায় একরকম। জন বাবাকে চাষের কাজে সাহায্য করত বটে, কিন্তু পাহাড়ের গায়ে ক্ষেতের পাশে বসে খাতা ভরিয়ে অঙ্ক করতেই যেন বেশী ভালো লাগে তার। যেদিন মেঘ থাকে না, সেদিন রাতের আকাশে তারার মেলায় হারিয়ে যেতে যেতে বিভোর হয়ে ভাবে লন্ডন... অক্সফোর্ড... কেমব্রিজ...
একদিন হঠাৎ করে সত্যি হয়ে গেল স্বপ্ন’টা। কোথা থেকে কে জানে টাকাকড়ি জোগাড় করে মা তার কেমব্রিজে আসার ব্যবস্থা করে দিলেন! ১৮৩৯ এ কেমব্রিজে এসেই একটা নতুন দরজা যেন খুলে গেল জনের সামনে। আর তখুনি কানাঘুষোয় একটা না-মেলা অঙ্কের খবর এসে পৌঁছালো তার কানে... ইউরেনাসের কক্ষপথে কে জানে কি গোলমাল... সে নাকি কোনো নিয়মের কথা শোনে না!
কলেজের পড়া শেষ করতে না করতেই কাজটায় হাত দিলেন তিনি। তাঁর বিশ্বাস ছিল যে ইউরেনাসের চলার মোড় ঘুরিয়ে দিচ্ছে তার খুব কাছেই থাকা আরেকজন কেউ। অঙ্কের কক্ষপথ থেকে ইউরেনাসের যেটুকু সরে যাওয়া,সে সেই অদৃশ্য উপস্থিতির জন্যেই। শুধু সেটুকু খবর আর নিউটনের সূত্রগুলি ছাড়া আর কিছুই লাগবে না সমস্যাটাকে মিটিয়ে ফেলতে। অঙ্ক কষে পরিষ্কার বলে দেওয়া যাবে,যে যার জন্যে এত গোলমাল,সে কে? সে কি কোন নক্ষত্র? না কি সৌরজগতের আরেক সদস্য? ধূমকেতু না কি নতুন কোন গ্রহ? কোথায় তার অবস্থান? এ’ধরনের অঙ্কের একটা নাম দেওয়া হয়েছে এখন... ইনভার্স প্রবলেম,মানে যাকে বলে ‘কার্য দেখিয়া কারণ অনুসন্ধান’!
১৮৪৪ এর সেপ্টেমরের মাঝামাঝি ‘সৌরজগতের অষ্টম গ্রহ’টির খবর নিয়ে কেমব্রিজ অবসারভেটরির ডিরেক্টর জেমস চ্যালিসের কাছে জন আডামসের চিঠি পৌঁছায়। সমস্ত অঙ্কের খাতা তো আর পাঠানো যায় নি চিঠির সঙ্গে; তাই চ্যালিসের মনে হয় এ নেহাত্’ই ছেলেমানুষের মাতামাতি! বাকি অঙ্ক দেখতে না চেয়েই তিনি উত্তর লিখে দেন,“খাটনি প্রচুর হবে নিশ্চিত,আর সাফল্য নিশ্চিত নয় একেবারেই...”
বছরখানেক পেরিয়ে যাওয়ার পর আবার সুযোগ আসে। কর্ণওয়াল থেকে ছুটি কাটিয়ে ফেরার পথে একদিন গ্রিনিচ অবসারভেটরির প্রধান জর্জ এয়ারির বাড়িতে উপস্থিত হন আডামস। আপয়েন্টমেন্ট নেওয়া ছিল না;জর্জ বাড়িতেও ছিলেন না। বাধ্য হয়ে পুরোনো চিঠিটির’ই একটা কপি জর্জের টেবিলে রেখে যান আডামস। সে চিঠির উত্তরে সমস্ত অঙ্কের হিসেব মিলিয়ে দেখার জন্যে চেয়ে পাঠান জর্জ এয়ারি।
ইতিমধ্যে সুদূর ফ্রান্সে একই সমস্যা নিয়ে মাথা খাটাচ্ছিলেন আরেকজন গণিতবিদ। তাঁর নাম লা ভেরিয়র। ১৮৪৫ এর নভেম্বরে আর পরের বছর জুনে পরপরদুটি পত্রিকায় তাঁর গণনা প্রকাশিত হয় আর সে গণনা অনুসরণ করে প্রথম ২৩শে সেপ্টেম্বর রাতে নেপচুন’কে দ্যাখা যায় বার্লিন থেকে। যেখানে থাকার কথা লা ভেরিয়র বলেছিলেন তার এক ডিগ্রির ভেতরেই!! অবসারভেটরির একজন উচ্ছ্বসিত বিজ্ঞানী এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন,“খড়ের গাদায় সূঁচ খোঁজার কাজটিকে পড়া-পড়া-খেলার মত সোজা করে দেয়,গণিত এমনি সুন্দর!”
২৩শে সেপ্টেম্বর ১৮৪৬। নাইট্রোজেন আর মিথেনের বরফে মোড়া সৌরজগতের দ্বিতীয় নীলগ্রহ’টি প্রথম ধরা পড়ে টেলিস্কোপের লেন্সে।
কিন্তু এই দীর্ঘ এক বছর সময় জন আডামস কেন এয়ারির চিঠির উত্তর পাঠাননি তা এখনও রহস্য। যে গণনা তিনি কতদিন আগে মিলিয়ে ফেলেছেন,দোরে দোরে ফিরেছেন তার স্বীকৃতির খোঁজে,কেন তা পাঠালেন না এয়ারি’কে? এ প্রশ্নের কোন সদুত্তর তিনি দিতে পারেন নি। হয়তঃ হতাশ হয়ে পড়েছিলেন,হয়তঃ বা নিজেই সন্দিহান হয়ে পড়েছিলেন...
ফ্রান্স আর ব্রিটেনের মধ্যে “নেপচুন কার” এ জাতীয় একটা ঠান্ডা লড়াই বেঁধেছিল সে সময়। শেষ অবদি ভেরিয়র’ই নেপচুনের আবিষ্কর্তা হিসাবে স্বীকৃত হয়ে যান। সৌরজগতের একমাত্র গ্রহ যার অবস্থান টেলিস্কোপের আগে অঙ্কের খাতা জেনেছিল... ভেরিয়র’ই হলেন তার প্রথম দ্রষ্টা। আর জন আডামসের নাম একটা রহস্যের মত খালি জড়িয়ে রয়ে গেল নীলচে সবুজ নেপচুনের গায়ে।
Tag :
সত্যিকারের গল্প,